নারায়ণ দেব
ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের উদ্যোগে ২০ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর আগরতলার রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনের ২ নং হলে দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রাজ্য ভিত্তিক নাট্যোৎসব,২০২৩।
উৎসবের দ্বিতীয় সন্ধ্যার দ্বিতীয় নাটক ছিল ‘সরল বার্তা’। মূল গল্প- হরিশঙ্কর পরসাই। নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় পার্থপ্রতিম আচার্য। ডিজাইন ও কার্যকরী পরিচালনা চিন্ময় রুদ্রপাল। পরিবেশনায় নাট্যভূমি গ্রুপ থিয়েটার, আগরতলা।
পার্থ প্রতিম আচার্যের নাট্যরচনার বিশেষতা হল, তাঁর নাট্য রচনায় সধারণত একটা শাণিত বক্তব্য থাকে। এই রচনাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। হত- দরিদ্র, সরল ও প্রতিবাদহীন ‘সরল মুন্ডাকে’ নিয়ে আবর্তিত হয় নাটকের কাহিনী। জোতদার একে একে সরলের জমি জিরেত ছিনিয়ে নেয়, এমনকি শেষপর্যন্ত শৌচালয় নির্মাণের জন্য তার বসত ভিটেটি পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়। তবু ‘সরল’ থাকে প্রতিবাদহীন। জোতদারের অত্যাচার সইতে না পেরে তার স্ত্রী আত্মহত্যা করে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তার সঙ্গী প্রিয় কুকুর ছোটকা। মৃত্যুর পর জীবিত অবস্থায় কোনও পাপ না করেও সরলের স্থান হয় নরকে। আর জোতদারের বাড়ির মাংস চুরি করে খেয়েও মৃত্যুর পর ছোটকার স্থান হয় স্বর্গে। ‘সরল’ ঘটনার প্রতিবাদ করে। এতে যম খুশি হয়ে তাকে স্বর্গে থাকার অনুমতি দেয়। যম রাজার আদেশে স্বর্গে সরলের জীবনী নিয়ে নাটক প্রদর্শিত হয়। সরল ছিল নাটকের বিচারক। তার জীবন বৃত্তান্তের অভিনয় দেখার পর সরল স্বীকার করতে বাধ্য হয় প্রতিবাদ না করাটাই আত্মহত্যা। এই কথাটাই নাটকের মূল বার্তা।
পার্থ প্রতিমের নাটক রচনায় রয়েছে ঝকঝকে স্মার্টনেস। জোরালো সংলাপ। সংলাপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে নাটকটিকে ডিজাইন করেছেন চিন্ময় রুদ্রপাল। প্রতিটি চরিত্র উপস্থাপন করার সময় আঙ্গিক অভিনয়কে কিছুটা উঁচু ম্যানারিস্টিক সুরে বাঁধেন তিনি এবং যতটা সম্ভব অকৃত্রিম রাখেন সংলাপ উচ্চারন ও প্রক্ষেপণকে। ফলে একটা ব্যালান্স বজায় রেখে তিনি তাঁর চরিত্র গুলিকে দর্শকের সামনে অতি সামান্য হলেও কিছুটা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেন। অথচ তাতে সামান্যতম অতি- অভিনয় থাকে না। এ ধরনের নাট্যক্রিয়া নাট্য চলনকে যে কতটা গতি এনে দেয় এবং সমগ্র প্রযোজনাটিকে যে কতটা সচল রাখে তা বর্তমানের এই কাজটিতে দর্শক আর- একবার উপলব্ধি করলেন।
নাটকে চিত্রগুপ্ত চরিত্রে একজন মহিলাকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে পরিচালক এক অচলায়তন ভেঙেছেন। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। অভিনয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ চরিত্রকে যথাযথ ভাবে প্রকাশ করেছেন তাঁদের বাচিক এবং শারীরিক অভিনয়ের মাধ্যমে। এর মধ্যেও বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয় চিত্রগুপ্ত ও লক্ষ্মী চরিত্রে মধুমিতা নাথের কথা। তাঁর সংলাপ প্রক্ষেপন, উচ্চারন, স্বরের ওঠানামা বা অভিব্যক্তি প্রকাশে তিনি দর্শকের নজর কাড়েন। দন্ডবত ও যমরাজের চরিত্রে সুরজিৎ দাস ছিলেন যথেষ্ট সাবলীল। এ ছাড়াও ভালো লাগে জোতদার ও ড্যান্সার চরিত্রে রমন নট্ট, সরল চরিত্রে শুভ্রজিৎ পাল, ছোটকা চরিত্রে সরজিৎ দেব কিংবা চস্পা চরিত্রে সুস্মিতা ধর পাল অথবা সরল- ২ চরিত্রে চিন্ময় রুদ্রপালকে। চানকা চরিত্রের ছোট্ট পরিশরে বিদ্যুৎজিত চক্রবর্তী নিজের জাত চিনিয়েছেন। অন্যান্য চরিত্রগুলিতে রূপ দান করেন আপ্রোদিতি আচারিয়া, তৃষাণ দেব, বুদ্ধদেব সাহা, অনুরাগ সাহা, রাজেশ দত্ত, সমীক রায় এবং বিক্রম রায় চৌধুরী। সৌমেন্দ্র নন্দীর আবহ, পীযূষ কান্তি রায়ের রূপটান এবং প্রদীপ দাসের আলোর যুগলবন্দী নাটকটির চলনকে মসৃণ করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রযোজনার প্রতিটি বিভাগই নিঁখুত ভাবে সম্পাদিত হওয়ায়, সমগ্র নাট্যটির উপস্থাপনায় পেয়েছে এক নিটোল চেহারা।