দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা
নাটকের জমিতে এমন এক মহান মানুষ এসেছিলেন, যাঁর হৃদয়বৃত্তিতে খেলা করত, একজন সুকুমার বালক। হাজার সঙ্কটেও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই খেলা অনির্বাণ জ্যোতিতে জ্বলেছে তাঁর হৃদয়ের গভীরে। খুব ছোট বেলায় দিল্লিতে নাটক দেখতে বসে যিনি আলোর ভাষা কী, তাই বুঝতেই উন্মাদ হয়েছিলেন। আর তাই সন্ন্যাসীর মতন মনে প্রাণে আউল বাউল ছিলেন। ঘরের ঘেরাটোপে থেকেও তিনি ছিলেন একলা এবং একা। আর পাঁচটা মানুষের মতন তিনি সুখের জীবনে আটকে থাকতে পারেন নি। বলা উচিত, থাকা হয়ে ওঠেনি। তাই মা বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই, প্রথাগত চাকরির লোভে আক্রান্ত না হয়ে, সব ছেড়ে যিনি, জীবনের মাত্র ১৫ বছর বয়সেই আলোর কারিগর বনতে উদভ্রান্ত হয়েছিলেন। অন্তরে অন্তর্ভুক্ত সংবাদে অন্তর্গত তারুণ্যের হাত ছানিতে মাতোয়ারা হয়েছিলেন। কেননা আলো সংক্রান্ত এক পাগলামি নেশা তাঁকে খ্যাতি প্রশান্তির বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে সারাটা জীবন তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে ফিরেছে। তিনি প্রকৃতপক্ষে খ্যাতি চান নি। চেয়েছিলেন কাজ। আবিস্কারের ঝোঁকে মগ্ন হতে। তাই তিনি ভেতর থেকেই চেয়েছিলেন তাপে জর্জরিত উত্তাপিত জীবনের উত্তপ্ত চলমান আবহাওয়া। মন থেকেই চেয়েছিলেন আলোক প্রকৃয়ার নতুন নতুন উদ্ভাবন। তাই এক অলীক মায়ায় শুধু আলো ঘাটাঘাটি করতে করতেই বনে গেছিলেন আলোর যাদুকর।
কেননা এই সুকুমারের অন্তরে ছিল সুকোমল বৃত্তির এক হ্রদ। সেই হ্রদের জলে সাঁতার কেটেই তিনি দেখতে পেতেন আলোর ছন্দ তরঙ্গ। আর জাগতিক জগতে প্রতিটি জীবনে যে নাট্য তরঙ্গ আছে, মানুষের জীবনের যাবতীয় অভিব্যক্তি গুলিকে সেই আলোতে জাজ্বল্যমান করতেই, একটা গোটা জীবন অনুসন্ধানে মেতেছিলেন। তাই চলতে ফিরতেই কখন যে নিজেই ডুবে যেতেন ভাবের জগতের আলোর মায়ায়। নিজেও সব ঠাহর করতে পারতেন না। অতএব, জ্ঞানতাপস হতেই তিনি প্রজ্ঞা পারমিতায় নির্ভরশীল হয়েছিলেন। অল্প বয়সের সব খেয়ালের শেকড় যে গভীরে প্রোথিত হয়ে চলেছে, জীবন ধারণ প্রকৃয়ায়, সে সময় সব কিছু অনুধাবন নিজেও করতে পারেন নি। মজা-ময় এক কল্পিত আলোক সুন্দরী তাঁর চারপাশে নেচে বেড়াত। সে এসে ভোগ তারিত জীবন থেকে টেনে নিয়ে যেত আলোর শিল্প মায়ার ভিতরে। তিনি উপেক্ষা করতে পারেন নি, সেই আলোক মরিচিকার টান। তাই এক অজানা মায়ার মোহে তিনি অন্ধকার থেকে অনায়াসে আলোর পথ যাত্রী হবার আত্ম বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই প্রত্যয় ছিল ঘোরের ভরে গম্ভীর আত্মানুসন্ধান। সেই খোঁজ থেকেই তিনি আলোর ঈশারায় তুলে আনতেন নদীর জলে আলো ছায়ায় ভেসে চলা ঢেউয়ের বিবিধ গল্প উপন্যাসের বিচিত্রিতা। বিভিধ সাহিত্য মনন। সেই ভর কেন্দ্রে প্রকাশিতব্য ভূমিকায় আসা চরিত্রের ভেতর দ্যোতনাকে মুক্তি দিতে এসেছিল আলোর ভূমিকা।
যে কারণে তাঁকে আমরা চিনি আলোর যাদুকর বলেই। সএই যাদুকরের পুরো নাম তাপস কুমার সেনগুপ্ত। পরে নিজেই এক দুঃসাহসে নিজেই নিজের নামকে বড্ড ভার বলে অনুমান করে, অহং থেকে ছেটে খাটো করে নিয়েছিলেন। নিজের নাম থেকে “কুমার” আর ‘গুপ্ত” বাদ দিয়ে হাল্কা পলকা সাধারণ পরিচয়ে হয়ে ছিলেন তাপস সেন। এই বৈরাগ্য কী ভাবা যায়? হয়তো এই মনেই ছিল নিজেকে অস্বীকার করে, নিজেকে অলক্ষ্যে রেখে কাজ করে যাবার অনন্ত পারম্পর্য। তাই এসে গেছিল আলোর ভূবণে বিচরণ স্বীকৃতি খুঁজে নেবার এক অনির্বচনীয় জীবন বোধ। যেখানে বাসা বেঁধে ছিল চির সুকুমার বৃত্তিতে অন্যন্য অরূপরতনকে সৃষ্টিতে আনার অন্তর মন। তাঁর সেই মন আর অন্তর দিয়েই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের অজস্র মঞ্চে আলোর মায়াকে সৃষ্টির ছায়ায় এনে আমাদের চেতনাকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। নব নাট্যের শুরু থেকেই তিনি শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্তের সাথে ছিলেন বলেই আজ বাংলা নাটক, এ-ই উন্নত সময়কে দেখতে পেয়েছে। কারণ উদ্দেশ্যে বিধেয়তে সেদিনের নাটকের দাবি অনেক বেশি ছিল। শিল্প্যার শিল্পের জন্য। বস্তুত আজকের আলোক-শিল্প-কলার যে প্রয়োগ প্রকৃয়া বর্তমান আছে, তার সবটুকুই তাপস সেন কৃত পরম্পরার অনুসরণ। যথার্থই তাঁকে অনুধাবন করে, তাঁর নাট্য ধারণাকে এবং এমন মহৎপ্রাণ অন্তর নিঃসারিত কিছু বোধকে আত্মস্থ করেই আমরা পেয়েছি, মঞ্চের উপরের আলোক ভূমিকার সব চলাচল। এক সময়ে চারিদিকের অর্থনৈতিক সঙ্কটে তিনি, আলোক শিল্পে অমিতব্যয়ী চিন্তায় কাজ করেছেন। কম আলোক সোর্সে, নানান কাটুম কুটুম বিদ্যায়, গুটি কয়েক পুরানো দিনের ভারী ডিমার দিয়েই যাবতীয় উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়ে গেছিলেন অনায়াসে।
সরস্বতীর বরদানে, সেই সময়ের সাহিত্য ধর্মী মন মানসিকতায় টেক্সটের খানাখন্দ খুঁজে বাস্তব সত্য প্রকাশের উপায় খুঁজে বের করেছেন। তাই ফলো স্পটে কালারড সেলোফিন পেপারে মাঝখানে গোল ছ্যাঁদা করে, আলো প্রক্ষেপন করে পরিবেশকে রাত্রির নীল মায়ায় ভাসিয়েও পাশাপাশি চরিত্রের মুখকে উজ্জ্বল সাদা আলোয় উদ্ভাসিত করতেন। মিরর লাইটও তাপস সেনের আবিস্কার। সারা মঞ্চ অন্ধকার, শুধু চরিত্রের মুখ আর অভিব্যক্তিকে প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছদে ধরতেই তিনি মঞ্চে জীবন্ত মূর্তিকে প্রতিপন্ন করেছিলেন। তাই তাঁর হাত ধরেই পথ চলতে চলতে আজকের বাংলা নাটকের বা ভারতীয় থিয়েটারের আলোক চিন্তন যা কিছু নতুন পন্থানুসরণ করতে পেরেছে। তার প্রথম প্রয়োগ তাঁর হাতেই হয়েছিল। অতএব পরিস্কার ভাবে বলতে চাই, তাপস সেনকে অতিক্রম,– বাংলা নাটকের আলোক চর্চা আজো করে উঠতে পারে নি। চলেছে তাপস অনুসরণ। এবং এখন তাকে ভিত্তি করেই যা কিছু অন্য সকলে করতে পারছে। নতুন কিছুই তাপস সেন পরবর্তীতে অনিবার্য শিল্প কান্না বা যন্ত্রণা কষ্টের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে নি। আসতে পারছে না। কারণ কমার্শিয়াল ভাবনা আর অর্থ উপার্জন করে টিকে থাকা, সাথে একটু কিছু করতে না করতেই আত্ম প্রসাদে বিভোর হওয়া শিল্পীদের আত্মার তৃতীয় নয়ন খুলছে না। তার মধ্যেই এসেছে উন্নত প্রযুক্তি। এসে গেছে বিজ্ঞান, টেকনোলজি টেকনিকের অজস্র উপাদান। তাই যদি কিছুই নতুন বলে অনুভুত হয়েছে, বুঝতে হবে সবই সম্ভব হয়েছে বাজারে আসা ব্যয়বহুল নানা যান্ত্রিক উপাদানের আনুকুল্যে। হয়তো বিতর্ক বার্তার সূচনা করলাম। তাই ভারতীয় সিনেমা এবং থিয়েটারে তাপস অতিক্রম কতটা হয়েছে, সেটা নিয়ে সেমিনারে আলোচনা করে সবাই মিলে বসে, ভাবা যেতেই পারে। যদিও তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানে তাপস মহিমান্বিত ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটনই শুধু চলুক।
যে পথে সত্যেন্দ্রনাথ সেন বিদেশ ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন, প্রায় একই পথে নিয়ম মাফিক ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পলেটিকনিক থেকে পড়াশোনা করেও, তিনি প্রথাগত ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে, চাকরির বৃত্তিমূলক আরামদায়ক এক সংসারী মানুষ না হয়ে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতনই ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে বেরিয়ে এসে আলোর গান গাইবেন বলে দিল্লি বোম্বাই ঘুরে এই বাংলাতেই ফিরে এসে তিনি থিতু হয়েছিলেন। ভাবতে ভাবতে, কাজের কাজ করতে করতেই, পরবর্তীতে সর্ব ভারতীয় থিয়েটারের বিশিষ্ট আলোক শিল্পীও হয়ে উঠেছিলেন।
আমি জানি, অনেকেই বিদিত আছেন তাপস সেনের কীর্তি কথাগুলি। নাট্যজনদের প্রায় সবাই-ই, সে সব জানেন। তাছাড়া তাঁর জন্ম শত বর্ষে, তাপস সেনের ঋষিবৎ হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে, অনেক কথাই অনেকে বলবেন। তাহলে পুনরায় নতুন কী বলবো আমি। কি লিখি তা-ই ভাবছি। উপায় না দেখে তাই, শুধু কিছু তথ্যসূত্র উল্লেখ করেই আমি ওনাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। এমন হতেই পারে, অন্য অনেকের লেখায় এই তথ্যপঞ্জি এবং ব্যাখ্যা এভাবে নাও আসতে পারে। কিছু ভাবনা এখানে দৃষ্টিভঙ্গীতে আলাদা। প্রাণে প্রাণ মিশিয়ে দেবার জন্যে, অনুল্লেখিত থেকে যেতে পারে হৃদয় কথা। তাহলে আসুন, জানি তথ্য গুলি কী?
তাপস সেনের শিল্পী হবার জীবন কাল
থিয়েটারের জগতের কিম্বদন্তী মানুষ তাপস সেন, আসামের ধুবড়িতে ২৯২৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জন্মে ছিলেন। আর তাঁর প্রয়াণ ঘটেছিল ২৮ জুন ২০০৬ সালে। তাহলে তাপস সেনের জীবন কাল ছিল মাত্র ৮১ বছর ৯ মাস ১৭ দিন। এবার যদি ওনার কীর্তির দিকে যদি নজর দেওয়া যায়, তবে পাওয়া যাবে বিপুল ব্যস্ততা আর চরম অনুসন্ধিৎসার খোঁজ। প্রায় ষাট বছরেরও বেশি এই আলোক উদ্ভাবনে তিনি নিয়োজিত। জীবনের বেশিটাই নাটক আর নাটকের মানুষের সাথে তিনি থেকেছেন। ব্যক্তি জীবনের নানা সঙ্কট উপেক্ষা করেও, নিজের শরীরকে নিজে নির্যাতন করেই তিনি নাট্য, নৃত্য নাট্য, চলচ্চিত্র, লাইট আ্যন্ড সাউন্ড, এগজিবিশন লাইন, হাওড়া ব্রিজের আলোক পরিকল্পনা ইত্যাদিতে জড়িয়ে থেকে আলোর গতি প্রকৃতি নিয়ে দ্বান্দ্বিকতায় পরীক্ষা নীরিক্ষা করে, নিজের মগ্ন ধ্যানেই পথ খুঁজে গেছিলেন, সারাটা জীবন। ষাট বছর তিনি পেশাদার আলোক শিল্পী ছিলেন। কাজে নিমগ্ন থেকে তিনি পথ খুঁজে গেছেন উপায় থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্ত উত্তরণের দিকে। নিজেকে অসন্তোষে রেখেও শিল্পের সন্তোষ জনক সন্তানের ভূমিষ্ট হওয়াকেই কেবল প্রাধান্য দিয়েছিলেন।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি এবং বাংলা নাটকের আরো বেশ কিছু এই সময়ের নাট্যবন্ধু ও নাট্যজনেরা ১৯৮৮ সালে পশ্চিম্বঙ্গ নাট্য আকাদেমি পরিচালিত, বহরমপুরে নাট্য প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষার্থী হয়ে ওনার সান্নিধ্যে এসেছিলাম। নাটকের জন্যে আলোর ক্লাসে প্রাথমিক ধারণা কথা কিছু জেনেছলাম। কেন আলো, কিভাবে আলো ব্যবহৃত হবে তাও শিখেছিলাম। এই শিখতে বসেই ঘটেছিল অন্তর দিয়ে দেখা আর হয়েছিল আন্তরিক মুলাকাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩/৬৪ বছর। আমরা সবাই সে সময় চাক্ষুষ করেছিলাম আলো নিয়ে তাঁর অন্তরের ধ্যান মগ্ন চেহারাটাকে। তখন তাঁর পরনে থাকত মিস্ত্রীদের মতো পোশাক আসাক। কোন বিখ্যাত নাট্যজনদের মতো সেজেগুজে সবার সামনে আসার মতো মানুষ তিনি ছিলেন না। কখন কোন সময়ে হাতের কাছে কি পেলেন, সেই পাওয়া জীর্ণ বেশ ভূষাও কখনো তাঁর পরনে দেখেছি। মোট কথা নিজেকে প্রশংসার প্রশান্তিতে প্রশস্ত কেউকেটা করার বিন্দুমাত্র প্রবণতা তাঁর ছিল না। সব সময় কি যেন ভাবতেন। থাকতো চিন্তা। ছিল চুক্তি মোতাবেক অনেক নাট্যদলের বহু নাটকের আলোক পরিকল্পক হবার দায় দায়িত্ব। তাই ব্যক্তিগত রুচি হারিয়ে যেত। হয়ে যেত অনিয়মিত খাওয়া দাওয়া। সময়ের অভাবে ঘুমও ছিল যথেষ্ট কম। মুখে বকবকানি হীন নীরব তাপস হৃদয় ছিল বুদ্ধের মতন। তাই তিনি যখন কথা বলতেন মনে হতো উনি যেন ঘুমের ঘোর থেকে উঠে এসেছেন। মুখে একটা বিশেষ শব্দ করতেন। তখন প্রায় একইভাবে ওনার সাথে শিক্ষক হয়েছিলেন বিখ্যাত সুরকার দেবাশীষ দাসগুপ্ত, বাদ্যকার মঞ্চশিল্পী খালেদ চৌধুরী এবং তৎকালীন সময়ের সব প্রতিভাধর নাট্য নির্দেশকেরা। যাঁরা সবাই তাঁকে দেবতার মতো পুজো করতেন। কিন্তু তিনি অতটা খেয়ালে রাখতেন না। সম্মান অসম্মান নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কিছু সমীহ এসে গেলেও, তিনি সে সব ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে এড়িয়ে যেতেন। খাবার টেবিলে আমাদের সাথেই তিনি সামান্য খেতেন। কিন্তু মন পড়ে থাকত, অজস্র নির্মিতব্য নাটকের আলোক সৃজন চিন্তায়। নতুন কি বাকি? পথ কোথায় তা অর্জনের? তাছাড়া মানুষটার মনের দৈর্ঘ্য তো কম নয়। দেখতে রোগা পাতলা, কিন্তু মনের বুক মস্ত চওড়া ছিল।
তা বোঝা যায় ওনার নিজের কথায়। ২০০০ সালে প্রকাশিত, আশিস গোস্বামী লিখিত তাপস সেন কীর্তি প্রসঙ্গের,”দ্বিতীয় অঙ্ক : প্রথম দৃশ্যের আলো” শীর্ষক বইয়ের ভূমিকায় তিনি নিজে লিখেছিলেন,– ” প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলো, প্রথম অঙ্কের শেষ দৃশ্যের যবনিকা পড়েছে। সেই কবে বিদেশে ইঞ্জিনিয়ার হতে গিয়ে এক তরুণ নিয়ম মাফিক ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে, পথ বদল করে বেছে নিলেন মহাপ্রয়োগের বিশেষ বিষয়কে। সেদিনের সেই সত্যেন্দ্রনাথ সেন দেশে ফিরে এলেন। হলেন সতু সেন। এই প্রথম অঙ্কের শুরুর আরো অনেক আগে, বাগবাজারের নাট্যপ্রেমী একদল যুবক সূচনা করেন সাধারণ রঙ্গালয়ের কাজ। সেই মঞ্চে তখন বিজলি বাতি আসেনি। শুরুর সন্ধ্যাগুলিতে প্রথমে তেলের, পরে গ্যাসের আলোয় মঞ্চস্থ হত নাটক। তাই বাংলা মঞ্চের স্থাপত্য ও আলোর বিচরণের ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সতু সেন। সেদিনের অনগ্রসর কলকাতার মঞ্চে সতু সেন একেবারে দেশি মালমশলায়, তাঁর বিদেশলব্ধ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছিলেন, এখানকার কারিগরদের সাহায্যে। ….সাল ১৯৩৩। এই প্রথম কলকাতা তথা ভারতবর্ষে রিভলভিং স্টেজ। নাটক মহানিশা। ওই সময় থেকেই কলকাতার ঘূর্ণায়মান মঞ্চ ও আলোর প্রথম অঙ্কের বিকাশ। যে অঙ্কের শুরু হয়েছিল গিরিশ ঘোষ, অমরেন্দ্র দত্ত, অপরেশচন্দ্রের মতো মানুষের হাত ধরে।…. এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, উত্তর কলকাতার এক স্কুলের ড্রইং টিচার, যাঁর নাম ধর্মদাস সুর। মঞ্চ-ভাবনার বিকাশে তিনিই প্রথম পুরুষ। তারপর মনে পড়ে নানুবাবু, পটলবাবুর নাম। কাকতালীয় ভাবে আমার জীবনেও এসেছেন একজন ড্রইং টিচার। যাঁর অনুপ্রেরণায় আমার থিয়েটারে হাতেখড়ি। তিনি শ্রদ্ধেয় প্রতাপ সেন, তিনি একজন অচেনা ছাত্রের মধ্যে আলোছায়া ও নাটকের আকর্ষণ দেখে প্রেরণা দিয়েছিলেন। সেই ছাত্র, এই আমি। আজকের তাপস সেন। বাংলা নাট্যজগতের দ্বিতীয় অঙ্কে, আজ থেকে ষাট (২০০০ সালে লিখিত কাল) বছর আগে ১৯৩৯ সালে যাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল…পাবলিক থিয়েটার ও গ্রুপ থিয়েটার, দুই ধারাতেই কাজ করেছি। আমার কাছে দুই ধারাই গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চাশের দশকে একদিকে সেতু, অন্যদিকে অঙ্গার। একদিকে পাবলিক থিয়েটারের ঐতিহ্য, অন্যদিকে চূড়ান্ত রাজনৈতিক ভাবাদর্শের নাটক —-দুটিতেই আমার কাজের সাফল্য ও বিতর্ক জড়িয়েছিল।”
এগুলি ওনার নিজের কথা। তাপস সেনের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং আলোচিত কাজ হয়ে উঠেছিল, সেতু নাটকের আলোকসম্পাত। রক্তকরবী, অঙ্গার, কল্লোল বিস্মিত ও স্তম্ভিত করেছিল ঠিক, কিন্তু সেতু তাঁকে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে আসে। সেতু নাটকের ট্রেনের সিন ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সময়কার দর্শক-সমালোচকদের। ড: চার্লস এলসন সেতুর অনবদ্য কাজ দেখে মন্তব্য করেছিলেন,” হলিউড আ্যন্ড ব্রডওয়ে উইথ অল ইটস রিসোর্সেস আ্যন্ড মানি কুড নট হ্যাভ এভার ড্রেমপট, অফ সাচ এ সলিউশন “। এই দৃশ্যটি গড়েছিলেন আলো আর শব্দ দিয়ে। সত্যিকারের কোন রেল ইঞ্জিন ছিল না। তাপস সেন লিখেছিলেন, ” রেল লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখি। প্রতি মুহুর্তে যে অনুভুতিটা হয়, তাকে ধরবার চেষ্টা করি। দেখলুম দূর থেকে ছোট আলোটা যখন বড় হয়ে কাছে আসে, তখন আবার মনকে বিভ্রান্ত করে দেয়। সোজা মোটরের হেড লাইটটা চোখে পড়ে তখন আর কিছু দেখা যায় না। এই সলিউশনটা খুব জরুরি ছিল আমার কাছে। এই যে অন্য কিছু দেখা যায় না, বুঝলাম সেটা দেখাবার জন্যে বিশ্বরূপার দেওয়ালকে কালো রঙের পেন্ট করালাম। এবং ইঞ্জিনের শব্দটা বড় করে বাজতে থাকে যখন, তখন দর্শকও অন্য কিছু দেখতে পেত না। পায়ওনি কোনোদিন। “
এমন তো হবারই কথা। কারণ নাটক দেখার অভ্যাস ছিল। দেখা আর ভাবা ছাড়া সৃষ্টিশীল কাজে পারঙ্গম হওয়ার আর তো কোনো উপায় নেই। অতীত থেকেই প্রায় নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহ মঞ্চে আসতেন। নাটক দেখতেন। কে কি করছেন, তার খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি শ্রীরঙ্গমে সীতা, মাইকেল দেখেছিলেন। শিশির কুমার ভাদুড়ীর অস্তমিত প্রতিভার স্ফুরণ দেখে বিস্মিত এবং দুঃখ পেয়েছিলেন। সতু সেনের কাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। শচীন সেনগুপ্তের রাষ্ট্র বিপ্লব দেখেছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন, যা শুনে শচীন সেনগুপ্ত খুশি হয়েছিলেন। দেখেছিলেন দেব নারায়ণ গুপ্তের রামের সুমতি। এসবের সুফল তিনি নিজের কাজেই পেয়েছিলেন। তবেই না আলোর যাদুকর হতে পেরেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে বলা দরকার, তিনি তাই বলে শুধু থিয়েটারের কাজেই নিবদ্ধ ছিলেন না। আলো নিয়ে শিল্পের বিচিত্র শাখা প্রশাখায় তিনি পাখির মতো উড়ে বেড়াতেন। এভাবে না উড়ে চললে তিনি আর তাঁর মস্তিষ্ক এই বিপুল পরিমাণ নিরীক্ষায় নিবিষ্ট হতে পারত না। তাই নিজের আত্ম স্ফুরণ বা চিন্তার বিকাশ ঘটাবার ক্ষেত্র তিনি খুঁজে বেড়াতেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, যে তিনি বহুদলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানে, ভালবাসায় যুক্ত ছিলেন। এখানেই জানিয়ে দেই, তাপস সেন সাংগঠনিক ভাবে যুক্ত ছিলেন একমাত্র লিটিল থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে। তাই কল্লোল চলাকালে উৎপল দত্ত যখন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তখন তাপস সেন দলের হাল ধরেছিলেন। খবরের কাগজ যখন আসু শোয়ে’র বিজ্ঞাপন ছাপতে অস্বীকার করেছিল। তখন পুরানো খবরের কাগজের পাতায় বড় বড় করে লিখেছিলেন “কল্লোল চলছে, চলবে”। সেই পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল কলকাতা শহর। এটাই চরম বিজ্ঞাপন হয়ে সংবাদ পত্রের লজ্জার কারণ হয়েছিল সেদিন। কারণ কল্লোলের ভীড় বিপ্লবের চেহারা নিয়ে এক অভূতপূর্ব নাট্য আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ক্রমে বামপন্থীদের রাজনৈতিক স্লোগান হয়ে উঠেছিল ” চলছে চলবে” এই কথাকটি। এল টি জি’র সভাপতি হয়ে এভাবেই কাজ করেছেন। তথাপি একদিন সেখান থেকে বাদ হয়ে শুন্যের মধ্যে ফিরে এসেছিলেন। উৎপল দত্তের সাথে বিতর্কিত বিষয় হয়ে ছিল সাংগঠনিক শৃঙ্খলার চেয়ে ব্যক্তি আবেগকে প্রাধান্য দেওয়াতে। তাতে অবশ্যই উৎপল তাপস সম্পর্কে কোন ফাটল ধরে নি কোনদিনই। তবে বন্ধুত্ব থাকলেও আর কখনও সাংগঠনিক ভাবে যুক্ত হন নি, ওই পি এল টি’র সাথে। এমন বহু ঘটনাই ছড়িয়ে ছিল কাজের ক্ষেত্রে মতভেদের কারণে। যেমন ১৯৬৫ তে স্টার থিয়েটারে একক-দশক-শতক নাটকে গান্ধী টুপি ব্যবহার নিয়ে বিতর্কে, ১৯৮০ সালে কলকাতা নাট্যকেন্দ্র আয়োজিত গ্যালিলিওর জীবন নাটকের বিতর্কে, সব জায়গায় কিন্ত তিনি ছিলেন বেপরোয়া এবং স্পষ্টবাদী। তিনি জীবনে রাজনীতির সাথে জড়িয়েছেন, কিন্তু নাটকই ছিল প্রধান কেন্দ্রীয় কাজের ক্ষেত্র। তিনি এস. ইউ. সি. আই. দলের হয়ে যেমন জেল খেটেছেন, তেমনই আবার তীর নাটকের গড়ে ওঠার সময়ে, উৎপল দত্তের সাথে চারু মজুমদারের কাছেও গেছেন। চিরদিন তিনি নাটক আর নাটকের মানুষের পাশে থেকেছেন। যখন যে নাট্যদল সঙ্কটে থেকেছে, তাপস সেন ছিলেন তাদের সাথে। ব্যক্তি জীবনের নানা সঙ্কটে জর্জরিত হয়েও, সব উপেক্ষা করেও, বারবার নাট্যদলের জন্যে ছুটে গেছেন। শোনা কথা, নিজের মৃত্যু কালেও তিনি তাঁর শেষ কথায় বলে গেছিলেন, “আমি চললাম, সবাই ভাল থাকুক”। আজীবন কীভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, কীভাবে শিল্পীর যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে হয়, তার প্রমাণ তিনি নিজেই। এমন শিল্পী ক’জন হতে পারেন বা পেরেছেন?
রাজনীতি-প্রতিবাদে সোচ্চার তাপস সেন
কলকাতায় এসে, নাটকের কাজের ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশের সাথেই তাপস সেন জড়িয়ে পড়েছিলেন এস. ইউ. সি. আই রাজনৈতিক দলের সাথে। মানুষের কল্যাণে, এই রাজনৈতিক দলের হয়ে গণদাবী বিক্রি করেছিলেন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। সারারাত পোস্টার মেরেছেন। হাজত বাস করেছিলেন। জেলও খেটেছেন। ১৯৪৮-৪৯ এর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় মানিকতলা উল্টোডাঙ্গা ব্রিজের কাছে আইন ভঙ্গ করায়, মানিকতলা থানায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দিল্লিতে আই.পি.টি-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। কলকাতায় এসে হলেন স্যোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টারের সদস্য। উৎপল দত্তের সঙ্গে ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত টানা কাজ করেছিলেন। কাজেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল নাটকের চেতনা থেকে পাওয়া উপহার। ১৯৪৯ সালে ঋত্বিক ঘটকের নির্মাণে কালচারাল ক্লাবের জ্বালা এবং বহুরূপীতে শম্ভু মিত্রের পথিক প্রযোজনায় যুক্ত হওয়াই স্পষ্ট বোধে, শিল্প ও রাজনীতির সম্পর্ক পরিস্কার হয়ে গেছিল। ১৯৫০ সালে নাট্যচক্র, বহুরূপী ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াড নির্মিত হয়েছিল যথাক্রমে নীলদর্পণ, উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার, ও ভাঙ্গা বন্দর নাটক ক’টি। এগুলো গড়ে উঠেছিল আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক চেতনায় ও আপোষ হীন সংকল্পে। ছিলেন কর্তাসুলভ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র ও পানু পাল। এঁদের নেতৃত্বেই যে সব নাটকের সব প্রকাশ। অতএব তাপস সেনের শিল্পী জীবনের শুরুয়াতই হচ্ছে নব নাট্য আন্দোলনের সূত্রে। এখানে বামপন্থীদের আনাগোনা ছিল মতাদর্শগত কারণে। এরপর, ১৯৫১ সালে বহুরূপীতে শম্ভু মিত্রের বিভাব ও চার অধ্যায়, উত্তর সারথি দলে কানু বন্দোপাধ্যায়ের চালনায় নতুন ইহুদি, ক্যালকাটা থিয়েটারে বিজন ভট্টাচার্য নির্মিত কলঙ্ক, আর বাকি সব নাটক ছিল উৎপল দত্তের চালনায়। তিনটি নাটক একই বছরে। ভাঙ্গা বন্দর, বিসর্জন এবং অফিসার। প্রযোজনা মধ্য কলকাতা, ও সেন্ট্রাল স্কোয়াড ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তত্ত্বাবধানে। কাজেই রাজনীতি জীবন বোধে এসেই যাচ্ছে, এইসব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সান্নিধ্য ছেঁয়ায়। এটাই বাস্তব এবং সংযোগ সম্ভাবনা সম্ভবত।
তবে পি. এল. টি.সাথে পরেও বিক্ষিপ্ত ভাবে তিনি ক’টি নাটকের কাজ করলেও, ওই সময়টাই ছিল উৎপল তাপসের মতো দুই শ্রষ্টার পরম ও চরম সৃষ্টিশীল সময়। উৎপল তাপসের যুগলবন্দীতে নির্মিত নাটকের কিছু নাম, সাংবাদিক, অচলায়তন, পুতুলের বিয়ে, মার্চেন্ট অব ভেনিস, চাঁদির কৌটো (১৯৫২-৫৩), এরপর কালের যাত্রা (১৯৫৪), বিচারের বাণী (১৯৫৫), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৯৫৬), তপতী, সিরাজদ্দৌলা (১৯৫৭), ছায়ানট ও ওথেলো (১৯৫৮), অঙ্গার (১৯৫৯), ফেরারী ফৌজ (১৯৬১) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৬৩), জুলিয়াস সিজার, চৈতালী রাতের স্বপ্ন, ও প্রফেসর ম্যামলক (১৯৬৪), কল্লোল (১৯৬৫), অজেয় ভিয়েতনাম (১৯৬৬), তীর (১৯৬৭), যুদ্ধং দেহি (১৯৬৮), লেনিনের ডাক (১৯৬৯), টিনের তলোয়ার, ঠিকানা, ও সূর্য শিকার (১৯৭১) ব্যারিকেড ও বিসর্জন (১৯৭২), টোটা ও ক্রুশবিদ্ধ কুবা (১৯৭৩), দুঃস্বপ্নের নগরী (১৯৭৪), লেলিন কোথায় (১৯৭৬), এবার রাজার পালা (১৯৭৭), তিতুমীর (১৯৭৮), স্ত্যালিন ১৯৩৪ (১৯৭৯), মোটামুটি এই পর্যন্ত তাপস সেন ধারাবাহিক ভাবে রাজনৈতিক থিয়েটারের ঘরানায় বেড়ে উঠেছেন। অর্থাৎ ১৯৫২ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত তাঁর চেতনাকে ক্ষুরধার করে, রাজনৈতিক চিন্তার আলো দ্যুতিময় ক্ষুরধ্বনির শব্দ তুলেছিল। তখনই এক দায়বদ্ধ শিল্পীর, নির্মাণ শিল্পের মধ্যেই সচেতন আলোর রথ দুরন্ত গতিতে ছুটে গেছিল। শুধু তাই নয়। এই শুরুর সময় থেকে ১৯৬০/৬২ সালের মধ্যেই উৎপল দত্তের পাশাপাশি বহু নাট্য প্রতিভা কালের মাত্রায় যুক্ত হয়ে গেছিলেন। বরেণ্য আলোক শিল্পী তাপস সেনের সাথে পঞ্চাশের দশক থেকেই এসে যাচ্ছেন, ঋত্বিক ঘটক, পানু পাল, শম্ভু মিত্র, কানু বন্দোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, সলিল সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, অমর গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ রায়, সত্য বন্দোপাধ্যায় (চলচ্চিত্র), শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, তুলশী লাহিড়ী, জোছন দস্তিদার, পার্থ প্রতিম চৌধুরী, কৃষ্ণ কুন্ডু, তৃপ্তি মিত্র, শ্যামালন্দ জালান, নরেশ মিত্র, সবিতাব্রত দত্ত, শ্যামল ঘোষ, শেখর চট্টোপাধ্যায়, প্রমুখেরা। এঁদের প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক এবং শৈল্পিক চিন্তাভাবনায় জীবন কথার সারমর্ম ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিচালকের সাথে, যেমন রাসবিহারী সরকার, দেবনারায়ণ গুপ্ত, রাজিন্দর নাথ, বিধায়ক ভট্টাচার্য, কুমার রায়, ফ্রিডস বেনেভিটস, নেপাল নাগ, নিবেদিতা দাস, বীরেশ মুখার্জী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, মামনুর রসিদ (বাংলাদেশ), রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত, প্রতিভা আগরওয়াল, রবি ঘোষ, অনুপ কুমার, প্রেমাংশু বসু, দিলীপ রায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম ঘোষ, শ্যামল ঘোষাল, বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, উষা গাঙ্গুলী, সলিল বন্দোপাধ্যায়, অশোক মুখোপাধ্যায়, অসিত মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায়, নীলকন্ঠ সেনগুপ্ত, অসিত বসু, মনোজ মিত্র, সোহাগ সেন, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত, বদ্রী তেওয়ারি, ডলি বসু, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, গৌতম হালদার, স্বপন সেনগুপ্ত, সমর মিত্র, শুভ গুপ্ত ভায়া, পঙ্কজ মুন্সী, অনল মিত্র, প্রমুখ যথেষ্ট রাজনীতিজ্ঞ নাট্য বেত্তাদের সাথে তিনি গাঁট ছড়া বেঁধেছিলেন। ১৯৫২ থেকে মৃত্যুর ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলা নাটকের উল্লেখযোগ্য প্রায় সমস্ত প্রযোজনাই তাঁর হাতেই নির্মিত। তাই, সে-ই সব নাটকের মধ্যেই, আলোক শিল্পের নিজস্ব ভাষায় তাঁর রাজনৈতিক অবস্থার পরিচয় কিম্বদন্তী কীর্তি হয়ে আছে।
মাত্র একটা শৈল্পিক ঘটনার উল্লেখ করছি। নান্দীকারে যখন একা এবং শাহী সংবাদ নাটক দুটিতে তিনি তিনি আলোর পরিচালনায় ছিলেন। আর বিভাস চক্রবর্তীর সঙ্গে ১৯৭২ সালে নির্মিত চাক ভাঙ্গা মধু নাটক থেকে প্রায় সমস্ত নাটকেই ছিলেন আলোক শিল্পী তাপস সেন। এই নাটকের বিচিত্র গতি প্রকৃতি লিখেছিলেন মনোজ মিত্র। তার মধ্যে ছিল সেই মুহুর্তটি, সাপে কামড়ানোর পরে বিষ ঝাড়াবার পর্ব। শয়তান মহাজন সাপের বিষে মরে যেতে চলেছে, আর দরিদ্র ওঝা তার বিষ নামিয়ে দিচ্ছে। এই বিষ ঝাড়াবার পরে রোগীকে আগুনের তাপ খাওয়াতে হবে। এই প্রসঙ্গে তাপস সেন লিখছেন ” এই নির্দেশটুকুর জন্যে আমি পরিচালককে বললুম, মহাজনকে বাঁশের মাচায় উপুড় করে শুইয়ে দিতে। এক মালসা আগুন রাখলাম মাচার নিচে, তাপ দেবার জন্যে। মালসার পাশে লুকিয়ে বসালুম আমার আলো। তারপর দৃশ্যের সব আলো গুটিয়ে এনে আমার আলো থেকে ছুরির ডগার মতো ধারালো টকটকে আগুন আলো নিক্ষেপ করলুম মহাজনের মুখে। ওঝার বাড়ির উঠোনে জমেছে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া। সেই আবছায়ায় ওঝাবাড়ির মেয়ে পুরুষ বিষহরি মন্তর টন্তর আওড়াচ্ছে। প্রাগৈতিহাসিক বিকার আর সংস্কার—ছিন্নভিন্ন করছে ওই মালসার পাশে লুকানো আলোটা–“। এমন অজস্র মুহুর্ত তিনি নির্মাণ করেছিলেন, যা এই সামান্য লেখায় তুলে ধরা যাবে না। প্রতিভা অগ্রবালের কমলা নাটকে ডাইনিং টেবিলের উপর ঝোলানো আলোর মায়া, বিভাস চক্রবর্তীর অশ্বথামা নাটকের আলোক বৈচিত্র্য কথা, তরুণ মার্কিন নাট্য নির্দেশক জেমস. বি. হ্যাচ এর আমেরিকান হুর নাটকের নানা তলের উপরে থাকা নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত আলোক মহিমা আজো ভুলে যেতে পারেন নি অনেকে। বিভাস চক্রবর্তী মনে করেন রক্তকরবীর পরে চ্যালেঞ্জিং আলো অশ্বথামায় হয়েছিল। কুমার রায়ের কাছে পাগলা ঘোড়া, অপরাজিতা, ডাকঘর বাঙ্ময় আলোক কাব্য। নৃপেন্দ্র সাহা রাজা অয়দিপাউস, মহাকালীর বাচ্চাকে ধ্রুপদী আলো বলে উল্লেখ করেছিলেন। অসিত মুখোপাধ্যায় ভুলতে পারতেন না, পুতুল খেলা নাটকের একটা লেটার বক্সকে কীভাবে জীবন্ত চরিত্রে রূপ দিয়েছিলেন, সেই প্রয়োগ কথা। অর্থাৎ থিয়েটারের বিশিষ্ট পরিচালক সমালোচকদের নানা চোখে দেখা, নানা মনের উপলব্ধি ব্যাঞ্জনা, এবং সেই অজস্র মুহুর্তের যদি তালিকা করা যায়, তাহলে বুঝতে পারা যাবে, অসংখ্য নাটকে, অজস্র মৌলিক ভিন্নতা আর বিভিধ বিচিত্র প্রাপ্তি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নামজীবন, অসিত বসুর কলকাতার হ্যামলেট, জোছন দস্তিদারেত কর্ণিক, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ফেরিওয়ালার মৃত্যু, শঙ্খপুরের সুকন্যা, অশোক মুখোপাধ্যায়ের বেলা অবেলার গল্প, মেঘনাদ ভট্টাচার্যের কর্ণাবতী, গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ কাব্য, ফ্রিৎস বেনেভিটসের গ্যালিলিওর জীবন, পশ্চিম বঙ্গ নাট্য একাডেমির দুটি প্রযোজনা চৈতালী রাতের স্বপ্ন ও বলিদান,…. বলে শেষ করা যাবে না। উষা গাঙ্গুলীর কাশিনামা, ডলি বসুর দুই তরঙ্গ, এবং নান্দীকারের চোখ গেলো যাঁরা দেখেছেন, তারাই বলবেন। তাপস সেন কত বড় মাওএর শিল্পী। কারণ কেবলই তিনি বিশ্রাম হীন ভাবে ছুটে গেছিলেন একটা গোটা জীবনে। এক মঞ্চ থেকে ভিন্ন মঞ্চে, এক থেকে আরেক নাটকে। বিদ্যুতের কাজ। ভারী ভারী আলোক সরঞ্জামের টানাটানি, ঠেলাঠেলি, বিরামহীন উপরে ওঠা নিচে নামার মধ্যেই তাপস সেনে বছর দিন কিভাবে পেরিয়ে যেত। রাত দিন শীত গ্রীষ্ম বর্ষা কোন চুলোয় ঢুকে পড়তো, তিনি তার কোন হদিস সারা জীবনে পান নি। বিগত ষাট বছরের বিশেষ রাজনৈতিক বোধ, সচেতনতা, আর শিল্পী সত্ত্বা হৃদয়ে রেখে তিনি কেবলই এগিয়ে গেছিলেন।
বস্তুতঃ তাপস সেন ছিলেন এক সহযোদ্ধা মানুষ। সংগঠকের ভূমিকায়ও কর্মীর চেহারায় তাঁকে পাওয়া গেছে। ১৯৬২ সালে বামপন্থী চেতনাকে আঘাত হানতে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সময় সরকারি ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, “দ্য ওয়েষ্ট বেঙ্গল ড্রামাটিক পারফরম্যান্স বিল”। সারা রাজ্যের নাট্য মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। সেই সোচ্চার আন্দোলনে তাপস সেন লিখেছিলেন ” এই নতুন আঙ্গিকের নতুন নাটকের প্রযোজক পশ্চিমবঙ্গ সরকার জেনে রাখুন, এই আইন আমাদের সকল শিল্পপ্রেরণা ও শিল্পচেতনার প্রতি চরম অপমান”। ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের উত্তাল প্রতিবাদে, কৃষ্ণনগরের মিছিলের উপরে গুলি চালায় পুলিশ। কলকাতায় নীরব মিছিলে নামে শিল্পী ও নাট্যকর্মীরা। তাপস সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অনুপ কুমার সেই শিল্পী সমাবেশের দায় নিয়েছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। ১৯৬৭ সালে কংগ্রেস’কে সংখা লঘু করে বামফ্রন্টের উঠে আসার একটা সুযোগ এসেছিল। অথচ তখন বামফ্রন্ট নিজেদের মধ্যেকার দলাদলিতে দ্বিধা বিভক্ত অবস্থায়। তাপস সেন কিছু বন্ধুদের একত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না। বাধ্য হয়ে নিজেই শেষে একাই বৌবাজার পার্টি অফিসে এসে বলেছিলেন ” আপনারা যদি সংঘবদ্ধ না হন, তাহলে কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় আসবে। সাধারণ মানুষ চাইছে না কংগ্রেস আসুক। সময় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ “–। এ কথায় গুরুত্ব দিয়ে জ্যোতি বসু অভিমতে বলেছিলেন “তাপস সেন যা বলছেন আমাদের তা শুনতে হবে। উনি সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলেছেন। অন্যায় কিছু বলেন নি”–। জেনে রাখা দরকার, তাপস সেন কলকাতায় আসার পর কিছুদিন এস. ইউ. সি. রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেছেন। দু রাত্রি হাজত বাসও করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের হয়ে খেটেছিলেন। সব কাজেই ছিল ভরপুর আত্ম বিশ্বাস। কলকাতার রবীন্দ্র সদন মঞ্চের আগের নাম ছিল রবীন্দ্রস্মরণী। যার উদ্বোধন করতে উটকো একটা আন্দোলন হয়েছিল। ১৯৬৫ সালের মে মাসে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কংগ্রেস সরকার নাটকের অভিনয়ে বাধা দিয়েছিল। তাই সে সময় নাট্যকর্মীরা বাইরে মঞ্চ স্থাপন করে আলাদাভাবে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালনের পরিকল্পনা করেছিল। যে প্রতিবাদের প্রধান ছিলেন তাপস সেন এবং সবিতাব্রত দত্ত। কিন্তু মানুষ মনে রাখে নি সে কথা। ভুলে যায় সবাই সত্যকে। এমন দূর্ভাগ্য যে, উদ্বোধন নিয়ে আন্দোলনের ফলস্বরূপ নতুন রবীন্দ্র সদন কমিটিতে সত্যজিৎ রায়, শম্ভু মিত্র বহাল থাকলেও তাপস সেনকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। স্পষ্টবাদিতা এবং বিবেকের তাড়নায় তিনি কখনো পিছিয়ে না থেকে সত্যের দিকে এগিয়ে গেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বঞ্চনা ও অসম্মানের পরিপ্রেক্ষিতে, ওনার পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলার মানুষ তিনি কমই পেয়েছেন। বাঙালি মরলে তাকে শ্রদ্ধা যত করে, জীবিত কালে তাকে তা তো করেই না, বরং পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা বেশি করে।
কিভাবে হলেন আলোর উপাসক
আসামের ধুবড়ি জেলার সোনারঙে জন্ম হয়ে ছিল তাপস সেনের। সেই বসবাসের পাড়ার নাম ছিল ছাতিয়ানতলা। তাপস সেনের বাবা মতিলাল সেন, মা সুবর্ণলতা সেন। খুব ঝড় জলের এক রাতে জন্মেছিলেন বলে প্রথমে নাম রাখা হয়েছিল “বাদল”। জন্মের পর তিনি অনেকবারই মরার মতো হয়ে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের পঞ্চাননের অলৌকিক তেল মাখিয়ে সুস্থ হওয়ায় তাঁর নাম হয়েছিল পঞ্চানন। সংক্ষেপে পঞ্চু। তখন আবার আত্মীয়রা কেউ নাম রেখেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়। এরপর তাঁর মাসি মনোরমা দেবী নাম রাখলেন, তাপস। তাপস কুমার সেনগুপ্ত।
ছোটবেলায় ছাতিয়ানতলার কাছেই ছিল নদী। গদাধর আর ব্রহ্মপুর মিশেছে যেখানে। ছোট্ট তাপস একা একা গিয়ে জ্যোৎস্না রাতে ব্রহ্মপুত্রের বুকে আছড়ে পড়া ঢেউ দেখতেন। হয়তো তখন ব্রহ্মপুত্রে ভেসে চলা জাহাজের গতি তরঙ্গে তিনি দেখেছিলেন আজব সব আলোছায়ার তরঙ্গ। তিনি যে ঘরে জন্মেছিলেন, সেটা ছিল ছেঁচা বাঁশের বেড়ার ঘর। তাতে আবার ছিল কাচের জানলা। লাগোয়া ব্রহ্মপুত্র দিয়ে রাতের অন্ধকার চিরে যখন স্টিমার যাতায়াত করত। তখন তার সার্চ লাইটের আলোয় গাছপালা বাড়িঘর বিচিত্র রূপ নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠত। শিশু তাপস এক নৈসর্গিক আনন্দে মেতে উঠতেন নাকি? তাপস একটু বড় হয়ে মায়ের মুখে শুনেছিলেন এই সব গল্প কথা। বাবার ছিল বদলির চাকরি। তাই ছোটতেই বাবা মায়ের সাথে দিল্লীতে চলে এসেছিলেন। ১১ নং সেকেন্দ্র প্লেসে তিন কামরার ঘরে মতিলাল সেন বউ সন্তানদের নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। রাইসিনা বেঙ্গলি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে তিনি পড়তেন। সেখানে দুর্গা পুজো, সরস্বতী পুজোর সময় নাটক হত। পড়াশোনার বিপরীতে নাটক তাঁকে টানত। আলোকসম্পাতের দিকেই ছিল ঝোঁক। যদিও বিদ্যুতে ছিল ভয়। কিন্তু স্কুলের ড্রইং শিক্ষক প্রতাপ সেন আর সুশীল রায়চৌধুরীর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে নিজেই জড়িয়ে গিয়েছিলেন আলোর অলীক মায়ায়। হয়ে গিয়েছিলেন আলোক পূজারী। সে সময়েও কলকাতার নির্বাচিত ভাল নাটক গুলি দিল্লিতে অভিনয় হত। নাটকের চর্চায় আলোচনার বিশেষ স্থান ছিল। আলোক সম্পাত প্রসঙ্গেও আলোচনা চলত। আলোর ফোকাস নিয়েও কথা হত। নিজের অজান্তেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন মনোযোগী ছাত্র। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই দিল্লিতে রাজপথ নাটকে প্রথম আলোর কাজ করেছিলেন। স্থান দিল্লির তালকোটরা ময়দান। জানা গেছে, জল ভরতি কলসিতে বৈদ্যুতিক ধাতুর পাত ঢুকিয়ে তিনি ওয়াটার ডিমারের কাজ করেছিলেন। বন্ধুদের সহায়তায় স্টেজের নিচে মাটি খুঁড়ে সেখানে ফ্লাড লাইট বসিয়ে দিয়ে মঞ্চের উপরে সেটে বসিয়েছিলেন একটি লোকের বাড়ি থেকে খুলে আনা অরিজিনাল গেট। যা কিছু নিয়ে যা খুশি খেলায় মেতেই তিনি একেরপর এক আ্যচিভমেন্টের মুখোমুখি এসেছিলেন। তাঁর একান্তের বন্ধু শীতাংশু মুখোপাধ্যায় ওই গেটে এসে দাঁড়ালেই নিচে থেকে আলো জ্বলে শীতাংশুকে ভিন্নভাবে দেখাত।
এসব তখন দর্শকদের অবাক করে দিত। এই ধরনের নতুন চমকের স্বাদ পেতেই সে সময় দিল্লির নাট্য চর্চায় যত্রতত্র এই বাঙালি বাবুর ডাক পড়ত। তিনি প্রথাগত ধরা বাঁধা শিক্ষা রীতিতে আটকে পড়ে নি। কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াও অসমাপ্ত রেখেই চাকরিতে ঢুকেছিলেন। প্রথমে নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, পরে সি পি ডব্লিউ ডি-তে ওভারসীয়ার, তারও পরে দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট ইত্যাদিতে চাকরি করেছেন। চাকরি ধরেছেন আর বিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়েছেন। কারণ চাকরি আর বেতনে তিনি আনন্দ পান নি। নিরানন্দ ভরা অর্থ উপার্জন তাঁকে টানে নি। তাই মাত্র ১৯ বছর বয়সেই এতো সব কান্ড করে, কিছু আলো সংক্রান্ত কাজের সামান্য ধারণা থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন তিনি নাটক সিনেমায় আলোর কাজে যুক্ত হবেন-ই। ইতিমধ্যেই ১৯৪৪ সালে দিল্লিতে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের একটি শাখা স্থাপিত হয়েছিল। তাপস সেন ছিলেন তার ফাউন্ডার মেম্বার। তখন তাঁর সঙ্গী হিসাবে ছিলেন নিরঞ্জন সেন, বিশ্বনাথ মুখার্জী, সরলা গুপ্তা, ইন্দর বাজদানের মতন কৃতী মানুষেরা। বেঙ্গল ফেমিনের উপর আধারিত একটি প্রযোজনায় তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে প্রথম পেশাদার আলোক শিল্পী হিসাবে সাধনা বসুর নৃত্য নাটকে কাজ করেছিলেন। ভূষন্ডীর মাঠে ছায়া নাটকে নানারকমের রঙ্গিন আলো মিশিয়ে স্লাইড ব্যবহার করে একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন। দিল্লির নাট চর্চায় আলোচনার ঝড় উঠেছিল। মাত্র তিন চার বছরের সামান্য চর্চায়, এই সামান্য বয়সেই তিনি কচিসংসদ, রক্তকরবী, রামের সুমতি, বিদ্যাসাগর, সিরাজদ্দৌলা, ইত্যাদি নাটকে আলোক সম্পাত করেছিলেন। এরপর তিনি এই অভিজ্ঞতা নিয়েই বাবার অমতে, স্কুল শিক্ষক তারাচরণ দাসের হাতের লেখা লীলা দেশাই-এর উদ্দ্যশ্যের চিঠি পকেটে পুরে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন। দুটো বছর সেখানে দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। ওই চিঠিতে কোন কাজ হয় নি। নিজেই যেচে আলাপ করেছিলেন হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, গিয়েছিলেন নবযুগ চিত্রমের হরিগোভিলের কাছে। কিন্তু কাজের কাজ হয় নি। মাতুঙ্গায় কাকার আশ্রয়ে থেকে ঘুরে বেড়ানোই সার হয়েছিল। ফিল্মের কাজ না পেয়ে নাটকের কাজ করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন পৃথ্বীরাজ কাপুরের কাছে। সেখানে আলোক শিল্পী হয়ে নিযুক্ত ছিলেন রাজ কাপুর স্বয়ং। এভাবেই ব্যর্থ হতে হতে যখন ক্লান্ত অবস্থায় আছেন। তখনই কলকাতা থেকে বন্ধু সুশীল বন্দোপাধ্যায়ের ডাক পেলেন। এক চিঠিতে লিখিলেন, “বোম্বেতে পড়ে আছিস কেন? কলকাতায় চলে আয়”-। ব্যপারটা হল বোম্বে কাজ দিচ্ছে না, আর কলকাতায় কাজ তার অপেক্ষায় পড়ে আছে। ক্রমে কলকাতায় চলে আসাই বিধেয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উনি কলকাতায় এসে বিশাল প্রেক্ষাপটে বাংলা নাটকের অস্তিত্বের মুখোমুখি এসে ছিলেন। এখান থেকেই তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে সারা ভারতবর্ষের মঞ্চকে আলোকিত করেছেন তিনি। তাই হয়তো জীবনের শেষ ভাগে স্বয়ং পৃথ্বীরাজ কাপুর আক্ষেপ করে বলেছিলেন ” আমার থিয়েটারে সব আছে কিন্তু তাপস নেই”—
যাই হোক, কলকাতায় আসার উৎসাহ ছিল। ক্যালকাটা মুভিটোন প্রোডাকশন হাউজের দ্বায়িত্ব নিয়ে ক্যামেরাম্যান দিলীপ গুপ্তের সহকারী হবার ডাক পেয়েছিলেন। যদিও তা হয় নি। নিউ থিয়েটার্স প্রোডাকশন হাউজে শেষ পর্যন্ত কাজ জুটিয়ে নিতে হয়েছিল। সেখানে তখন কাজে অকাজে আসতেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, কালী ব্যানার্জী, সলিল চৌধুরী, নৃপেন গাঙ্গুলী, হৃষীকেশ মুখার্জীসহ অনেকে। এভাবে শুরু। তারপর ক্রমে সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ, নিরপেক্ষ ছদ্মনামধারী অমিতাভ চৌধুরী, ধনঞ্জয় বৈরাগী নামধারী তরুণ রায় প্রমুখদের সাথে আলাপ হল। আড্ডা গল্প চলতে শুরু হল। ক্রমে পরিচয়ের পরিধি বাড়তে লাগল। আলাপ হলো, এলগিন রোডের জাহাজ মার্কা বাড়িতে, একশ সিটের থিয়েটার হল, নাট্যদল, নাট্য ব্যক্তিবর্গ যথা শম্ভি মিত্র, উৎপল দত্ত, শ্যামালন্দ জালান, অহীন্দ্র চৌধুরী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম চৌধুরী ইত্যাদিদের সঙ্গে। চলতে থাকল প্যারাডাইস কাফেতে নিয়মিত আড্ডা। হৃষীকেশ মুখার্জী নিয়ে এসেছিলেন তাঁকে। তখন তিনি থাকতেন হাজরা পার্কের মেসের এক ডার্করুমে। ওই ঘরে কেউ থাকতে চাইতেন না বলেই এই আশ্রয় পাওয়া। তক্তাপোশের তলায় থাকত আলোক সরঞ্জাম আর উপরে তিনি শুতেন। পরে কিছুদিন ছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত আর অনাদি প্রসাদের সাথে এক ঘরে। এই দিন যাপনেই নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে তাঁকে নিদারুণ লড়তে হয়েছিল। সে সময়টা এমনই ছিল, সবার বুকেই স্বপ্ন। কাজের স্বপ্ন। ঋত্বিক ঘটক নাটক লিখছেন। জ্বালা দলিল। কখনো সিনেমার প্লট নিয়ে ভাবছেন। হৃষীকেশ মুখার্জী, বিমল রায়ের তথাপি ছবিতে কাজ করেছেন। মৃণাল সেনের পকেটে ঘুরছে সিনেমা তৈরির বাজেট। ষাট টাকার চাকুরে একমাত্র হৃষীকেশ মুখার্জী। আর সবাই বেকার। এভাবেই দলে দলছুট হয়ে তাপস সেন একটু একটু করে আলোর জগতে আসার পথ খুঁজে হাত পাকাচ্ছিলেন। এই লড়াইয়ের প্রসঙ্গে মৃণাল সেন অকপটে লিখেছিলেন, “আমরাও, বন্ধুবান্ধবরাও, যে শুরুতে খুব একটা নিশ্চিত ছিলাম, তাপস সম্পর্কে তাও বলব না। আমরা তখন প্রচন্ডভাবে ছবিমুখো হয়ে রয়েছি। মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছি।…. ঠিক সেই সময়েই তাপস যে তলে তলে এই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে— আলো নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেবে, আমার মতো সবচেয়ে কাছের মানুষও তা ভাবতে পারেনি। তারপর ধীরে ধীরে সবাই যখন বুঝলাম যে তাপস এক অর্থে দলছুট হয়ে যাচ্ছে (কিন্তু সত্যি কি দলছুট!) যাই হোক, বলতে দ্বিধা নেই, কিঞ্চিৎ অনিশ্চয়তা বোধ করেছিলাম বৈকি”–।
নিজের কীর্তি কথা বলার আলাপচারিতায় তাপস সেন উৎপল দত্তের মানুষের অধিকার ও সাংবাদিক নাটক দু’টির উল্লেখ করেছিলেন। যা হল, মানুষের অধিকারের প্রথম দৃশ্যের স্টেশনের মধ্যে এক অসাধারণ বিষন্নতার আলো সৃষ্টি করেছিলেন। বলিদান নাটকেও দিগন্ত বিস্তৃত অনুরূপ বিষন্নতাকে ধরেছিলেন আলোক উদ্ভাবনের প্রকৃয়ায়। সাংবাদিক নাটকের শেষ দৃশ্যে হ্যারি স্মিথ যখন রেডিওতে শুনছেন তার প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ। তাপস সেন রেডিওর মধ্যে আলো বসিয়ে এমন ভাবে প্লেস করেছিলেন, যে আলোতে রেডিও সঞ্চালন প্রকৃয়া স্বতন্ত্র হয়ে দর্শকের কাচগে ধরা দিয়েছিল। অন্য আলোতে হ্যারিকে অভিব্যক্তি সহ পাওয়া গিয়েছিল। যাতে রেডিওটি হয়ে উঠেছিল চরিত্র হঠাৎ রেডিও থেকে ছিটকে আদা আলো যেমন দর্শকদের হতচকিত করেছিল, একইভাবে হ্যারিও মৃত্যু সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল।
একদিন তিনিও প্রয়াত হয়ে আমাদের দুঃসংবাদটা শুনিয়ে ছিলেন। আমৃত্যু সচল ছিল তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ। বয়স ৮০ অতিক্রান্ত হবার পর রোগ ব্যাধি বেশ জাঁকিয়ে বসেছিল। চোখ, ইউরিন্যাল, কান একটু একটু করে অকেজো অয়ে পড়েছিল। তবুও তাপস সেন মহলায় হাজির হতেন। নিজের নড়বড়ে চেহারা নিয়ে যথা সময়ে। ইতিমধ্যে ২০০৩ সালে প্রিয় নাতি সৌমিত্রি হঠাৎ মারা যাওয়ায় মরমে আঘাত পেয়েছিলেন। আবার এই বছরই ২৬ মার্চ ৪৯ বছরের জীবন সঙ্গী স্ত্রী গীতা সেন প্রয়াত হলেন। এবার হয়ে গেল মস্ত গোলমাল। যে তাপস সেন কানে শুনে নাট্য দৃশ্য কল্পনা করতে পারতেন। যে তাপস সেন প্রেক্ষাগৃহের শব্দ পরিকল্পনার হিসাব নিতেন। তিনি বধির হয়ে গেলেন। কেবল চোখ দিয়ে সব বোঝার চেষ্টা করতেন। জীবনের নির্মম পরিহাস একেই বলে। সাথে ছিল চরম আর্থিক সঙ্কট। ২০০৬ সালের ২৮ জুন তিনি প্রয়াত হয়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেলেন। কমিটমেন্ট অনুসারে শিশুতীর্থের কাজ, সত্যজিৎ রবিশংকরের জীবন নিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি বাকি থেকে গেল। আজ আমরা তাপস সেন হারা। নতুন কোন তাপসের আবির্ভাব নিয়েই ভাবছি। সময় বলবে, কে জানে কখন কার উদ্ভব ঘটে।
কৃতজ্ঞতা- আশীস গোস্বামীর যাবতীয় রচনা।