দেব নারায়ণ মাঝি
ভাটপাড়া আরণ্যক থিয়েটার গ্রুপের ‘জলের উপর পানি’ নাটকটির প্রথম প্রদর্শন দেখার সুবাদে এই লেখা। নাট্যকার সঞ্জয় আচার্য নাটকটির মাধ্যমে বর্তমান সমাজ ও সময়কালকে তুলে ধরতে চেয়েছেন যেটি খুবই প্রাসঙ্গিক।
নদীমাতৃক এই বাংলায় অনেক প্রান্তিক পরিবার বাস করে একেবারেই নদীর পাড়ে। নদীর ভাঙনের কারণে সারা বছরই তাদেরকে এক বিপদ সঙ্কুল জীবনের মুখোমুখি হতে হয়। নাটকের শুরু এমনই এক নদীর পাড়ের প্রান্তিক এলাকাকে কেন্দ্র করে। যেখানে মানুষজন জীবিকার জন্য যত না ব্যস্ত থাকে তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে বেঁচে থাকার অন্য লড়াইয়ে –একদিকে নদীর আগ্রাসি ছোবল অন্যদিকে ধর্মীয় লড়াই। উত্তরপাড়া ও দক্ষিণপাড়া – এই দুই পাড়ায় বাস করে বিশেষ দুই সম্প্রদায়ের মানুষ।
গল্প এগিয়ে চলতে থাকে তাদের পুরানো রাগ, অভিমান, প্রতিহিংসার দোলাচলে। একসময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় সেই বিবাদ। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা আমলারা নিজেদের স্বার্থে কেউই চায়না তাদের মধ্যে বিবাদ মিটুক। ঠিক সেই সময় তাদেরকে পথ দেখাতে এগিয়ে আসেন গ্রামের এক ‘মাস্টার’।
আদর্শবান ও সমাজ সচেতন মানুষটির উপদেশে তারা উপলব্ধি করে তাদের ভুল, বুঝতে পারে মিলে মিশে থাকলে বিপদের দিনে তারা যে কোনো সমস্যার মোকাবিলা করতে পারবে এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করতে পারবে। তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার লড়াই থাকলেও তারা যে মানবিক, তাদেরও যে একটা কোমল হৃদয় আছে সেটিও পরিস্ফুট হয়।
নাটকটি শেষ হয় এক সুন্দর বার্তা দিয়ে। সৃষ্টি হয় ‘ভাই ভাই সমিতি’র। নাটকটির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে এক টুকরো সমাজের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাপক।
সঞ্জয় আচার্য’র নির্দেশনা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রত্যেকের অভিনয় দক্ষতা মুগ্ধ করার মত। জীবনযুদ্ধে দগ্ধ এক নারী, ময়না তার অভিনয় ক্ষমতা দিয়ে চরিত্রটিকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। একদিকে রয়েছে বাঁচার লড়াই, অন্যদিকে পুরনো শত্রুতা।
এরমধ্যে ও যে একটি হৃদয়স্পর্শী মন রয়েছে সেটিও খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। নাটকটির অন্যতম একটি চরিত্র ফজল ভাই, প্রতিহিংসা পরায়ন একজন মানুষ তার স্ত্রীর মৃত্যুর পর বুঝতে পারে জীবনের অন্য এক আঙ্গিক। জীবনের সব লেনা দেনা শেষ হয় মনুষত্বে। খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এই দ্বৈত চরিত্র।
গ্রামের সহজ সরল মানুষ মাজু ভাইয়ের জীবন দর্শন আমাদের আর পাঁচটি চেনা মানুষের মত, আমাদের খুব পরিচিত। তার চরিত্র রূপায়িত হয়েছে পরিমিত হাস্য রসের মাধ্যমে। কিন্তু বিপদের দিনে সেই মানুষটির মধ্যে ও যে পরিবর্তন দেখা যায় সেটি ও খুব মনে ধরার মত।
বিশেষ একটি চরিত্র অন্ধ ফকির, দৃষ্টিশক্তি হীন হয়ে ও বাকি ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে ও যে সব কিছু অনুভব করা যায় সেটি খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
উপরি পাওনা তার উদাস করা বাঁশির সুর। সেট, আলো খুবই মানানসই ছিল। শুধু নদীর শব্দ এবং আলোর মাধ্যমে নদীর ঢেউ দেখাতে পারলে আরো দৃষ্টি নন্দন হতো।