Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeনাটকনাটক নিয়ে বিরস সংলাপ

নাটক নিয়ে বিরস সংলাপ

সুব্রত কাঞ্জিলাল

প্রথমে কয়েকটা গল্প বলি। তবে গল্প হলেও কিন্তু ঘটনাগুলো মিথ্যে নয়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা শেয়ার অটোতে উঠে বসেছি। আরো চারজন যাত্রী না হলে অটো ছাড়বে না। আমার পাশের অটো চালক বললেন, একটা কান্না জড়ানো গরম নাটক লিখুন না দাদা। এই যে ছেলে মেয়েরা বিয়ের পর বাপ মাকে ফেলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টার উপর। বললাম, এই বিষয়টা নিয়ে অনেকগুলো নাটক চলছে। পত্র-পত্রিকায় গল্প লেখা হয়েছে। এইতো গত সপ্তাহে একটা প্রতিযোগিতার মঞ্চে এই বিষয় নিয়ে চারখানা নাটক দেখলাম।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে করমন্ডল এক্সপ্রেসে  আমার কামড়াতে সিট খুঁজতে গিয়ে দেখি, বহুদিনের পরিচিত এক বন্ধু আমার সামনের সিটে বসে আছে। সঙ্গে রয়েছে তার স্ত্রী। প্রায় দশ বছর পর দেখা। একথা সে কথার পর জানা গেল, স্ত্রীকে নিয়ে আমার বন্ধু চেন্নাই যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। বন্ধু পত্নীর হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। এখানকার ডাক্তার বাবুরা অপারেশন করে পেসমেকার বসাতে নিদান দিয়েছেন।

বন্ধু জানেন, হার্টের সমস্যার আসল কারণ। ওদের দুই ছেলে মেয়ে এখানকার লেখাপড়া মিটিয়ে একজন জার্মানিতে অন্যজন ইংল্যান্ডে ক্যারিয়ার তৈরি করতে ৪/৫ বছর আগে চলে গেছে। এদেশে ফেরার কোন আগ্রহ নেই তাদের। বন্ধু পত্নীর নিঃসঙ্গতা, সন্তানের প্রতি

সীমাহীন দুর্বলতার জটিল কারণগুলোর শিকারে পরিণত হয়েছে হৃদয় নামক যন্ত্রটি।

এই বিষয়টা নিয়েও ১০-১৫ বছর ধরে প্রচুর নাটক গল্প উপন্যাস লেখা চলছে।

এইরকম আরও একটি বিষয় বাঙালি নাট্যকার এবং গল্পকারদের কাছে লোভনীয় হয়ে পড়েছে। সেটা হলো বৃদ্ধাশ্রম ব্যবস্থা। কয়েকদিন আগে রাত এগারোটার সময় সোদপুর স্টেশনে নেমে বাড়ি ফিরবার অটোরিকশা দেখতে পেলাম না। শীতের রাত। কুকুর তাড়াতে তাড়াতে

হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবে যখন একটা সিগারেট ধরিয়েছি দেখলাম কে যেন আমাকে ডাকছে। পেছনে ফিরে দেখি সাইকেল রিক্সার চালক কানাই।

-এই যে স্যার, হাঁটবেন কেন? আমি তো আছি।

উঠে পড়লাম কানাই এর রিক্সায়।

-নাটক থেকে ফিরলেন স্যার?

-হ্যাঁ। তুমি যে এখনো বাড়ি যাওনি?

-আপনাদের জন্যই তো অপেক্ষা করছি! আজকাল তো আমাদের চোখেই পরেনা- আপনাদের।

-না না তা কেন! 

কানাই প্যাডেল করতে করতে আপন মনে গান ধরেছিল। সস্তা হিন্দি সিনেমার গান। তারপর বলল যে, আপনাদের পাড়ার মুখার্জিদা কে তার ছেলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিল। ছেলের বউয়ের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না। বললাম, শুনেছি। ছেলে নাকি বাড়িটা লিখিয়ে নিয়েছে।

কানাই বলল, মুখার্জীদাও নিজের বাপের সম্পত্তি ছোট ভাইদের ভোগা দিয়ে লিখে নিয়েছিল। বুড়ি মা টাকে ও কম জ্বালিয়েছে! মরবার আগে বাড়ির ঝিয়ের মতো ব্যবহার করত মায়ের সঙ্গে। কথায় বলে যেমন কর্ম, তেমনি ফল। স্যার আপনি তো নাটক লেখেন, এইরকম একটা লিখুন না। তেঁতুল গাছে কি আম হয়!

আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আমরা ঝগড়া মারামারি যাই করি না কেন, বুড়ো মা বাপ কে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাই না। ঝগড়া বাসি হতে দিই না। তাছাড়া বৃদ্ধাশ্রমে তারাই তো যায় যাদের অনেক টাকা আছে। সারা জীবন টাকার পিছনে ছোটার এটাই ফল স্যার। আমি কি ভুল বললাম স্যার?

কানাই ভুল কি ঠিক আমি জানি না। আমার সেই বন্ধু যে তার স্ত্রীকে নিয়ে চেন্নাই যাচ্ছিল। তার কথা মনে পড়ল। আপার বার্থ এ বন্ধু পত্নী যখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। করমন্ডল এক্সপ্রেস তখন ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে। জানলার বাইরে নিকষ অন্ধকার। বাংলার মাটি আকাশ পিছনে ফেলে অন্ধ্রপ্রদেশে ঢুকে পড়েছে। বন্ধুটি আমাকে বললেন,

বিশ্বাস কর সুব্রত, আমার ছেলে মেয়ে দুটো কে আমরাই তো পর করে দিয়েছি।

হায়ার এডুকেশন, ক্যারিয়ারের ঘোড়দৌড়ের মাঠে আমরাই তো ওদের নামিয়ে দিয়েছি। আমরাই তো ওদের কানে মন্ত্র দিয়েছি, এদেশে কিছু হবে না। সাহেবদের দেশে চলে যাও। আমার বউ আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধবদের প্রথম প্রথম নাক উঁচু করে বলতো, তার ছেলে মেয়ে ইংরেজদের দেশে চলে গেছে। কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে। ওদের দেশে গাড়ি কিনেছে বাড়ি কিনেছে। যাবতীয় ভোগ্য পণ্যের সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। বাপ মা হিসেবে আমাদের আর কি চাই?

আমার কথা হল সুব্রত, আমরা কেন বুড়ো বয়সে সন্তানের ঘাড়ে চেপে বসবো? ওদের বোঝা হয়ে থাকবো? এটাতো অপরাধ! আমার বউ এটা বোঝেনা। তাই হৃদযন্ত্র বিকল করে ফেলেছে।

আমাদের পাড়ার বিশু সরকারের ছেলে এমবিএ পাস করে অনেকদিন বসে ছিল। তারপর ঘটনাচক্রে একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম হলো। মেয়েটি বলেছিল যে, তার বাবা ছেলেটার ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেবে। কিন্তু শর্ত আছে। ছেলেটাকে নিজের বাপ মাকে ছেড়ে চলে আসতে হবে। এই শর্তে ই রাজকন্যা এবং রাজত্ব সে অর্জন করতে পারবে। বিশু সরকারের ছেলে একদিন আমার কাছে এলো আমার পরামর্শ শুনতে।

সে আমাকে বলেছিল, জেঠু, আমি তো নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসি নি। আমার জন্মের জন্য আমি দায়ী নই। সুতরাং আমার ভালো মন্দর জন্য আমাকেই তো পথ বেছে নিতে হবে। বাবা মায়ের কতগুলো ওল্ড ভ্যালুজ এর আমি কেন দাম দিতে যাব বলুন? দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে আমার বাবা-মা সাতটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এর দায় আমার নয়।

মনে পড়ে গেল পুরোনো দিনের কথা। গোড়া হিন্দু

ব্রাহ্মণ্য সমাজ সেযুগে যারা কালাপানি অতিক্রম করে বিদেশে যেত জ্ঞান অর্জনের জন্য কিংবা সামাজিক রাজনৈতিক কাজের প্রয়োজনে তাদের জাত মারা গেছে বলে এক ঘরে করে রাখা হতো।

প্রশ্নটা এখনও আমাকে ভাবায়। এই বাজার অর্থনীতির যুগে আমাদের সন্তানরা কি আমাদের কাছে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স? তাদের খাইয়ে পড়িয়ে বড় করে

দাঁড় করাবার পর তাদের কাছ থেকে আমরা কেন ডিভিডেন্ট প্রত্যাশা করব? এটাতো যুগ ধর্ম নয়। এটা হল বিচ্ছিন্নতার যুগ।

যৌথসমাজ যৌথ পরিবারের পৃথিবী আমরা এক যুগ আগে পিছনে ফেলে এসেছি। এটা হল মানুষে মানুষে মানুষের সঙ্গে সমাজের, এবং রাষ্ট্রের চরম বিচ্ছিন্নতার সমাজ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অনেকদিন ধরে চলছে। সুতরাং যে ছেলেটি তার ভবিষ্যৎ তৈরি করবার জন্য বাইরের পৃথিবীতে পা রেখেছে তাকে কোন  অজু হাতে পেছনে টেনে ধরতে পারি না। ধণতান্ত্রিক অর্থনীতি একথাই মানুষকে শেখায় যে, তুমি তোমার জন্য। তোমার শরীর মন একান্ত ভাবে তোমার নিজস্ব। তুমি অন্য কারোর সম্পত্তি নও। কিভাবে তুমিও অন্য কারোর ওপর অধিকার দাবি করতে পারো না। পুজির শাসন আমাদের আরো বলে যে, অতীতের ঐতিহ্য, অতীতের মতোই মৃত। পেছনের ভ্যালুজ গুলো পেছনে ফেলে রেখে তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হবে। যেমন যৌথ সমাজ ব্যবস্থা সাম্যবাদীদের অর্থাৎ কমিউনিস্ট দের এক ধরনের অলীক কল্পনা। নতুন পৃথিবীর জন্য ওইসব বস্তা পচা তত্ত্বগুলো কার্যকরী হবে না।

নর নারী র সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক চুক্তি থাকে। বৈবাহিক জীবন হল যৌন স্বাধীনতার এক ধরনের অপব্যবহার। পুরুষ তার বীজ নারীর গর্ভে বপন করে। আসলে সে গর্ভ ভাড়া নেয়। সন্তান ধারণ করার সময় নারীকে যে ধরনের কষ্ট সহ্য করতে হয় তার জন্য সন্তানের কাছ থেকে কোন বিনিময় প্রত্যাশা করা অপরাধ। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকে শুরু হয়ে যায় নারীর সঙ্গে তার সন্তানের বিচ্ছেদের ধারাবাহিকতা। 

অনেকটা এইরকম সত্য দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি গল্প সত্যজিৎ রায় আমাদের শুনিয়েছিলেন। অপরাজিত ছবিতে। স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করে অপু চাইছিল কলকাতা শহরে গিয়ে জ্ঞান সাম্রাজ্যের সমুদ্রে অবগাহন করতে। আর মা সর্বজয়া চাইছিল তার সন্তান তাদের পৈত্রিক পেশা অর্থাৎ পুরোহিতগিরি করুক। নিশ্চিন্তপুরের অন্ধকার গ্রামে তার পিতৃপুরুষের মত জীবন কাটিয়ে দিক। অপু মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে চায় নি। সে চেয়েছিল জীবন তো একটাই। সুতরাং এক জীবনে যতটা বিশ্ব দর্শন করা যায় সেটা করতে হবে। এইখান থেকে মায়ের সঙ্গে তার বিচ্ছেদ দীর্ঘ হতে থাকে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে কখনো অপরাধী ভাবে নি।

এই ছবি বাঙ্গালীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় নি। কারণ সেইসময়ের বাঙালি দর্শকরা সন্তানের এই দৃষ্টিকোণ মেনে নিতে পারে নি। আজ বাঙালি বদলে গেছে। ভারতবর্ষ দেশটা আগের মত নেই। প্রতিদিন সমাজ ভাঙছে। পুড়ছে। মানুষের সম্পর্ক গুলো আজকে আর আগের মতো নেই। আবেগের পিছল পথে দাঁড়িয়ে থাকবার অর্থ মৃত্যু। অথচ আমাদের নাটকে কিছু কিছু গল্পে অযৌক্তিকভাবে এইসব সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে সন্তানদের প্রতি, অর্থাৎ নতুন প্রজন্মের মানুষদের প্রতি দোষারোপ করা হচ্ছে। আজ পর্যন্ত এমন কোন নাটক দেখা গেল না যেখানে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করা হচ্ছে যৌথ পরিবারের ভাঙ্গন, নিউক্লিয়াস পরিবারের অমানবিক সম্পর্ক, প্রতিদিন মানুষের ও সমাজের ভাঙ্গনের জন্য আসলে ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। আমরা সবাই এই করুণ অবমানবিক বিচ্ছিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা । এই বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে কোন ভালবাসা নেই। মানবিক সম্পর্ক গুলো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। এর জন্য কে দায়ী?

বাবা-মা? সন্তান? নাকি রাষ্ট্র? তাহলে কেন নাটকের মধ্যে প্রশ্ন তোলা হবে না যে, এই ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলো। বদলে ফেলো। আমরা এক নতুন বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবো। এই দানবীয় বাজারমুখী ব্যবস্থাকে বদলে না ফেলা পর্যন্ত কোন সংসারে শান্তি আসবে না।

ডক্টর নরম্যান বেথুন বলতেন, ডাক্তারি শাস্ত্র দিয়ে আমরা রোগ নির্ণয় করে এটা বুঝতে পারি, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না ঘটানো পর্যন্ত, পৃথিবীকে রোগ মুক্ত করা যাবে না। নানা রকম ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয়ে রোগীরা আমাদের কাছে আসবে। আমরা ওষুধ দেবো। ওষুধ কোম্পানির ব্যবসা হবে।

আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হবে। মানুষ কোনদিন সুস্থ হবে না। বারবার আক্রান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসবে। আমাদের নাট্যকারদের অধিকাংশের মধ্যে এইসব প্রশ্ন মাথায় কিলবিল করে না। তারা ব্যক্তি মানুষকে আক্রমণ করে। এটাই তো রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়। ব্যক্তি মানুষকে অপরাধীর কাঠগড়ায় তোলো। রাষ্ট্র নিরাপদে থাকুক। এইসব কারণেই বাংলা থিয়েটারের অচলাবস্থা চলছে। বাজার অর্থনীতির যুগে প্রতিটি মানুষ যে বাজারের পণ্য, ক্রীতদাসের  মতো প্রতিদিন আমরা বাজারে আসি নিজেদের বিক্রি করতে এবং এটাকেই সুস্থ স্বাভাবিক জীবন বলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠেছি। আমাদের কনজিউমারে পরিণত করা হয়েছে। আমরা শুধুমাত্র একজন ভোটার। আমাদের যেন আর কোন সত্তা নেই। বাংলা থিয়েটারে এইসব বিষয় কেন উঠে আসছে না? নাট্যকার বা নাট্য কর্মীদের অজ্ঞতা?

সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব? নাকি অনুদান রাজনীতির প্রভাব? রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে শুরু করে সমাজ জীবনের সর্বত্র অবক্ষয়, সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনৈতিক ব্যভিচার, দুর্বৃত্তায়ন এসব থেকে বাংলা থিয়েটার মুখ ফিরিয়ে থাকবে? তাহলে কি বলতে হবে যে রোম নগরী যখন পুড়ছে তখন সম্রাট নীরো র মতো আমরা বেহালা বাজাচ্ছি? 

কি বলেন নাট্যকর্মীরা?

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular