দুলাল চক্রবর্ত্তী (ফারাক্কা)
২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিল বহরমপুর রঙ্গভূমি সংস্থা। করোনা কালে সামান্য থমকে গেলেও, সামলিয়ে উঠে চমৎকার কিছু থিয়েটারের ভূমিকায় সংস্থা এখন জেলার অন্যতম আদরনীয় নাট্যদল। প্রধান উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হলো, জেলার বিশিষ্ট নাট্য তথা চিত্রাঙ্কন শিল্প, নাটক ও সাহিত্য কাব্যবোধে উজ্জ্বল এক প্রতিভা– “প্রয়াত কৌশিক রায়চৌধুরীর জন্মদিন” হিসাবে ২রা অক্টোবরকে মহার্ঘতা দিতে, ওনার নামে স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করতে পারায়। বহরমপুরের বহু নাট্য প্রতিভা, স্মরণ উদ্যোগের অভাবে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। কিন্তু রঙ্গভূমির আন্তরিকতায় কৌশিক রায়চৌধুরী বছরের একদিন অন্তত প্রামাণ্য প্রণামে উজ্জ্বলতা পান। এমন সম্মান থেকে কত কীর্তিবান শিল্পী আজ শুধুই দেওয়ালের ছবি মাত্র হয়েছেন। এমন প্রয়াত কত বিদগ্ধজনই না নিদেন স্মরণ বঞ্চিত হয়ে আছেন, তা ভেবেই এই কথা কটি লেখা। শমীক বন্দোপাধ্যায়ে, উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, হর ভট্টাচার্য, সত্য ভাদুড়ির মতন প্রাজ্ঞ নাট্যজনের মুখোমুখি বসতে পেরেছি শুধু রঙ্গভূমি ভাবিত প্রসঙ্গে, কৌশিক রায়চৌধুরী স্মারক বক্তৃতার আয়োজনে। এবারে, ৪ জানুয়ারি এই মর্মেই, নাটকের দর্শন ও নাট্যকারের দর্শন শীর্ষক আলোচনায় নিজের জীবন নিংড়ে আত্মকথা আর চলমান স্থবির নাট্যাভ্যাসের বিস্তৃত আলোচনা করেছেন নাটককার তীর্থঙ্কর চন্দ। কত কিছুই তো শেখা হয়, এইসব আয়োজনে। সাথে চিরদিনই আছেন অভিনয়ে বা সাহচর্যে প্রবীণ অভিনেতে অরূপ ফুলাল দত্ত। এবারেও মঞ্চে নানান কাজে তিনিই রঙ্গভূমির চলমান মুখে, মুখোমুখি এক স্বীকার হয়েছিলেন।
ছয় সাত বছরেই, দলের নিজস্ব চিন্তায়, নিজেদের নাটকের নানা সম্ভার উঠে এসেছে। সব নির্মাণ উল্লেখযোগ্য নয়। তবে এসেছে নানা ধরন। যদিও ভাল মন্দ নিয়ে যেমন কথা আছে। তেমনই পারা না পারা নিয়ে ক্ষমাও আছে। কারণ বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত প্রতিবারের উৎসবে বাইরের কিছু নির্বাচিত ভাল নাটক এনে মানুষকে দেখিয়ে চিন্তিত করার মধ্যেই রয়ে গেছে সামাজিক যোগাযোগে নাট্য লেনদেনের সামগ্রিক সাফল্য। যা তুচ্ছতাচ্ছিল্য জনক নয় একেবারেই।
এবারে পঞ্চম বর্ষ রঙ্গভূমি জাতীয় নাটকের উৎসব ৬ থেকে ১০ই জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে অনুষ্ঠিত হলো। সর্বমোট ৭টি নাটক মঞ্চায়িত হয়েছিল। প্রায় সবকটি নাটকের বক্তব্যে ও রূপায়ণে কিছু নিজস্বতা ছিল। এই জাতীয় নাটকের মেলা উদ্বোধন করেছিলেন স্যাস পত্রিকা সম্পাদক সত্য ভাদুড়ি স্বয়ং। শুরুর দিনে তিনি প্রাঞ্জল ব্যাখ্যায় বর্তমান নাটকের অভিমূখী চরিত্র কথা আর সময়ের দাবির উপেক্ষিত চেহারাকে চমৎকার ভাবে আলোকিত করেছেন। এবারে অভিনীত নাটকের কিছু কথায় আসি।
প্রথম নাটক, রঙ্গভূমি প্রযোজিত মহাযুদ্ধের পরে। মূল গল্প সমরেশ বসু। নাটক ও নির্দেশনা রাজেন দাস। এ নাটকে ছিল এক ঘন্টার পরিসরের একটি অনুপম গল্প। আর গল্পানুসারে মানানসই ভাল মঞ্চ। আলো আঁধার পরিবেশে ভিক্ষাবৃত্তিতে নির্ভর দুই অন্ধের জীবন খোঁজার ইচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে এ নাটকে। এসেছে এক অন্ধ নারী। যে ধরিত্রীর মতো, প্রেমিকার মতো, মায়ের মতো বাঙময়। পুরুষের শ্বাশত গন্তব্যের মধ্যেই ভূমি আর নারী চিরকালীন বিবাদের কেন্দ্রে ছিল, আছে, নিশ্চিতই থাকবে। তাই দুউ জন্মান্ধের চার চোখের আলোহীন অন্ধকারকে পরাস্ত করেছে এ নাটকের অন্তর মথিত বক্তব্য আলো। যদি দৃষ্টিহীন এক পর্বত আরোহীর অন্তর্গত অন্তর আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা সেই চিত্তে উদ্ভাসিত হতে পারে। তবে মনের মরনে নারীও একজন পুরুষের প্রত্যাশিত মন পোশাকের ভিন্ন সাজ হয়ে বিজয়ের আখ্যান বটেই। দুই অন্ধের কামনা দ্বন্দ্বে তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে এক কাঙ্ক্ষিত মহাযুদ্ধ। পরের গল্প চলে শুধু ভেবে চলা চিন্তায়…. কি হলো, কেন হলো, এমনটাই কী বাস্তব? জাগে অনেক প্রশ্ন। অভিনয়ে রাজেন দাস এবং গৌতম মজুমদার সাত্ত্বিক সত্তায় সুন্দর ও সাবলীল দুই মঞ্চ অধিকার সাক্ষরিত আবিস্কার। তবে অস্পষ্ট আলোতে সবই জ্যান্ত, কিন্তু মুখাবয়ব উজ্জ্বলতা পেলে ভাল হতো। এদের অভিব্যক্তি-অনুভুতিতে অন্তরের তাগিদ বুঝে নিতে বেশ কষ্ট হয়েছে। মৌসুমী মতিলাল এই অন্ধ আগন্তুক নারীর ভূমিকায় ছিলেন। মন্দ নন। তবে অভিনীত চরিত্রের আলো অন্ধকার ঘিরে মানসিক বিন্যাসের চিত্ত-বৃত্তে আরো ব্যঞ্জনা এবং অন্ধের গবেষণা থেকে পাওয়া উপলব্ধি-প্রকাশ যুক্ত হলে কৃতি প্রযোজনা হবে ‘মহাযুদ্ধের পরে’ নাটকটি। মনে রাখা যেতে পারে মান্না দের মামা কৃষ্ণ চন্দ্র দে কীভাবে অমায়িক শাসনে হৃদয় জুড়ে বসেছিলেন।
দ্বিতীয় নাটক বিহারের দ্য প্লেয়ার্স আ্যক্ট প্রযোজিত চেকভকে দো রঙ্গ। ছোট নাটক। তবুও দুটি আন্তন চেকভের গল্পের দুই কল্পনা তরঙ্গে পুরুষের কামনা হয়ে নারী এখানেও দীর্ঘ প্রকাশের অভিমুখে প্রাধান্য পেয়েছে। একেবারেই পুরুষের গতিমুখে নারীর প্রকাশ ও বিচিত্রিতা এ নাটকের সার কথা ছিল। দুই ভিন্ন প্রকৃতির এবং ভিন্ন প্রবৃত্তির নারী এই নাটকের গল্পে উঠে এসেছে। ভাবিয়েছে নারীর অসীম সীমায় পুরুষের ঘুড়ি হয়ে উড়ে চলা উন্মত্ত ঢেউয়ের দ্যোতনায় সংযুক্ত এক জীবন একটি প্রাপ্তির আনন্দের সার কথাগুলি। যা অনিবার্য, যা চিরন্তন, যা চলমান পৃথিবীর শেষ কথা। যদিও বাংলা নাটকে চর্চিত, অনেকেরই জানা গল্পের চেনা নাটক। তবুও গুঞ্জন সিনহার নির্দেশনায় আর সাবলীল স্বাভাবিক দলীয় অভিনয় প্রকরণের কারণে প্রযোজনা শক্তি দর্শকদের আসনে বসিয়ে রেখেছিল। সাথে ছিল দলগত ঝকঝকে চমকে চরিত্রদের স্মার্ট প্রকাশ ব্যঞ্জনায়। সীমায়িত চয়নের আধুনিক এই নাটকের চরিত্র অনুযায়ী সাধারণ আঙ্গিকের চিন্তিত চলন এবং অনুশীলিত পরিবেশন তাই ক্লান্ত বা বিষন্নতা মগ্ন করেনি দর্শকের প্রত্যাশাকে।
তৃতীয় নাটক গয়েশপুর সংলাপের তাজমহল (পূর্ণাঙ্গ)। ২০২২ সালে স্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত হর ভট্টাচার্য লিখিত নাটক। ধর্মীয় রাজনীতির উপর আলোকিত একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার নাটক এটি। ঘটনার নাটকীয় মোচড়ের উচ্চতা বিহীন অস্তিত্বে, অন-উচ্চকিত স্বরের প্রযোজনা এটি। কিন্তু ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে, অনবদ্য মানবতার ও মানবাধিকার সংকল্পে প্রাণ প্রাচুর্যে ঢালা একটি গম্ভীর টেক্সট। হর ভট্টাচার্য সময়ের দিকে চোখ রেখেই, নিজের নিঃশ্চুপ অন্তরের অনেক জানলা খুলেই এক বিশ্লেষক মনোভাবে এই নাটক লিখেছেন। এসেছে কল্পনার তীব্রতা, কমেছে বাস্তব ঘটনা, সবই আছে সব চরিত্রের প্রয়োজনীয় সংলাপ আলাপের বিক্ষেপে, মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে। অভিনেতা নির্দেশক সুদীপ্ত দত্ত সেই শর্ত সংবাদে চোখ রেখে, শব্দ-সঙ্গীত বুঝেই নাটকের সামগ্রিক চালনা করেছেন। নাট্যে গান হয়েছে শ্রেষ্ঠ শক্তি। শ্বাশত শাস্ত্র পাঠে ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান। সে-ই প্রাণ মূল্যে, জীবন বোধের তরঙ্গে ঢেউ তোলা এ প্রযোজনা কতটা নাটক, কতটা আলোচনা, তাতে যদিও সংশয় আছে। কেননা দর্শকদের জন্যে উপভোগ্য বৈচিত্র্যময় ঘটনার মারপ্যাঁচ, টানাপোড়েনের প্রেক্ষাগৃহ জমানো নাটক এটি নয় ঠিকই। তবুও জরুরী। যান্ত্রিকতাবাদের ক্রম প্রসারিত জান্তব তান্ডবের বিরুদ্ধে। একটু স্থীর হয়ে ফ্যাসিবাদের আগ্রাসন চরিত্রের অনাদি পরিক্রমা চিনিয়ে দিতে। একটু ভাবতে, বুঝতে, ইতিহাসের পাতা থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদের ২০২৪ এ পৌঁছে যাবার অনায়াস পরম্পরা চিনতে। তাই প্রায় এক পরতে বাঁধা ফ্ল্যাট স্কেলের নাট্য সমীকরণটি আত্মগত করেই নাটকের প্রতিটি চরিত্র সংযত সাঙ্গীতিক আওতায় আটকে থেকে ব্যক্ত করেছে তাদের মন আর মনোভাবের পরিবর্তনকে। খুবই বিনীত আবেদনে। নাটকীয়ত্ব বর্জিত, তবুও রুঢ়তা, হিংস্রতা এনে বীভৎস শেক্সপীয়ার দর্শনের হত্যা রক্তের স্রোত দিয়ে ক্যাথারসিসের জাল বোনেনি। দর্শক যাতে শান্ত স্নিগ্ধতায় অনুভবকে জাগরিত করতে পারেন। তা-ই এর হয়ত নাটক না হতে পারা।গল্পের কেন্দ্রে সুদীপ্ত দত্ত( দারাসিকো)এবং সমরেশ সাহা (ঔরঙ্গজীব)। দুই মেরুতে দুই সেরা অভিনেতা অবশ্যই। সাথে পঙ্কজ সিনহা রায় (শাজাহান ও নিকোলাই মানুশ্চি), অর্পিতা দত্ত (জাহানারা), মিশি রায়চৌধুরী (জুবুন্নিসা) চমৎকার শক্তি। মনোজ প্রসাদের আলো কাব্য সঙ্গীতের ঝর্ণা তলায় এনেছে নাটকের স্তর বিন্যাসের পরতের পর্বে। সাথে অলোক দেবনাথে মেক আপ চোখে এনে দেয় মোঘল যুগের ছবি গুলি।
চতুর্থ নাটক কোচবিহারের কম্পাস দলের খেলনা ভাঙ্গার শব্দ। ২০০২ সালে সত্য ভাদুড়ির সম্পাদনায় স্যাস নাট্যপত্রে প্রকাশিত। সুভাষ সেনগুপ্ত লিখিত একটি মনস্তাত্ত্বিক গল্প ঘিরে খানা তল্লাশির নাটক। খুব বাস্তব প্রসঙ্গ, যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নাটকের নির্দেশক পার্থ বন্দোপাধ্যায়। এটি বিশ্লেষণাত্মক নাটক। উৎসের খোঁজে এগিয়ে চলা খননে, এই নাটকে আছে অনুসন্ধানে লিপ্ত আলাপিত কথার প্রাধান্য তীব্রতা। সন্তান ও অভিভাবকের পারস্পরিক লেনদেনের আলোকপাত নিয়ে একেবারে বাচিক অনুভূতির প্রকাশে এই নাটকটি চমৎকার নির্বাচন। তাই কম্পাসের এযাবৎ চলে আসা নাটকের বীক্ষণে চমকে দেয় এই নাটকের স্বর। সুন্দর মঞ্চ। আসবাবে ও চরিত্রে। কিছু অনুপস্থিত,..নেই,… রাখা হয় নি প্রয়োগ চিন্তার অভিনবত্বে। তবু কিছু আছে, ভগ্নাংশের অনুপাতে। যেন কেউ আছেন। অলক্ষ্যে। কেমন মজার না? চিন্তার মধ্যেই, অনুভূতির মধ্যেই আলো আর আলোচনা যেহেতু। তবে কোর্ট ড্রামার স্তর বিন্যাসে, বিচার চলাকালীন বিশেষ আলোতে চরিত্রের মুখ আলোকিত হওয়া খুবই জরুরী ব’লে মনে হয়েছে। যদিও সকলের অভিনয় যথেষ্ট স্বাভাবিক ও সাবলীল। কিন্তু সার্বিক অভিনয়েই আরো আত্মগত আত্মা নিযুক্ত হলে ভাল হয়। কেননা অন্তর্গত ও অন্তর্গূঢ় সংবাদ খোঁজার দাবি ওঠে। কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলির ভাঁজ এতো সহজে কেন খুলে যাচ্ছে? তাই অক্ষমতা নেই কিন্তু কিছু অসম্পূর্ণতা আছে….নিজেকে এই নাটকে, কেন চরিত্র নিয়ে শিল্পীরা আছেন, এই মর্মেই এক যন্ত্রণার খোঁজ অনুপস্থিত। সবার ঘরেই কম বাশি এই ছবি জ্বাজ্জল্যমান আছে। নিজের বাস্তবতাই বাধ্যতামূলক ভাবে অক্ষম করছে। তাই সব জেনেও সন্তান অনাগ্রহতার মধ্যেই, আমাদের প্রতিবেশি পরিবেশ কোন যন্ত্রণায় কাতর করেছে এই সময় প্রক্ষিপ্ত বাস্তবতায়। তা দেখার বাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। এদিন ছিলএকেবারেই প্রিমিয়ার শো, পরবর্তীতে এ নাটক কম্পাস দলকে বিশেষ সম্মান দিতে পারে। যদি আ্যাক্টিং স্কুলিং এর পারস্পরিক দেয়া নেয়ার উৎস মূলে গিয়ে যন্ত্রণার ঘর্মাক্ত আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায়। কেন বিচার, কার বিচার কোন সাপেক্ষে চলছে– এই ত্বত্ত্ব তথ্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে, ঝড় ওঠার কালো মেঘ ঘনিভূত করাতে পারলে, অসাধারণ হবে এই কোর্ট ড্রামা। সুন্দর মঞ্চ-মুহূর্ত আছে, তবে শুধু সাজানো নয়, আবিস্কার সম্ভব হওয়া দরকার। কারণ এই নাটকের কান্না বুকে বুকে ঘুরছে এই মৌলিক সংসারের আনাচে-কানাচেতে।
পঞ্চম নাটক, ২০২৩ এ স্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত অজয় শুক্লা লিখিত হিন্দি নাটক তাজমহল কি টেন্ডার থেকে বঙ্গানুবাদ তাজমহলের টেন্ডার। অনুবাদ অরিন্দম দাসগুপ্ত। প্রযোজনা বহরমপুর রঙ্গভূমি সংস্থা। এটিও একেবারেই সাম্প্রতিক নির্মাণ। নির্দেশনা অলোক মন্ডল। আজকের সময়ে যদি তাজমহল সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়, যদি শাজাহান নিজে এসে তার কাঙ্ক্ষিত স্মৃতি সৌধটি গড়ে তোলার আকাঙ্খা পোষণ করেন, তবে কীভাবে প্রশাসনিক তৎপতায় বিপর্যস্ত হবেন। তা দেখিয়েছে এই নাটক। এই সময়ের বাস্তবতায় সরকারি দপ্তরের কর্মপদ্ধতি,, ঠিকেদার আর আমলা আধিকারিক ইঞ্জিনিয়ারদের লেট লতিফ চেহারা দেখিয়ে এটি সুন্দর একটি প্রহসন নাটক। যথার্থই নাটকের চরিত্র অনুসারে চলার চেষ্টা করেছে নির্দেশনার যাবতীয় অলঙ্করণ। নাটকের কাস্টিং এ পাত্র পাত্রী নির্বাচনও ঠিকঠাক। কিন্তু ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠায় আরো দুরন্ত অভিনয় আর দ্রুতিসম্পন্ন ঝকঝকে প্রকাশ চেহারা দরকার আছে। ঝকঝকে বলতে দৃশ্য ভাঙ্গা-গড়ার মধ্যে আরও আনন্দিত, বিচিত্র, এবং বিবিধ সৃজন সন্ধান যুক্ত হওয়া দরকার। হাস্যরসের সন্ধানেও যেতে হবে। কারণ এটি কমেডি রসে মোড়া একটি উপাখ্যান। প্রশাসনের চেহারা ধরিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক পরিস্থিতি রচনা করতে ( যেহেতু সবার সবই জানা।, সেখানে অভিনয় চয়নের প্রচলিত প্রথার বাইরে আসা আর জানা ঘটনার মোচড়ে, কে মুচড়ে পড়েছে, কোথায় মুচকি হাসির জন্ম হচ্ছে, ইত্যাদিতে জমজমাট এ নাটককে হতেই হবে। এন এস ডি প্রযোজিত এই নাটক কলকাতা বিড়লা নাট্যমন্দিরে আমি ১৯৯৯ সালে দেখেছিলাম। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে, তাদের সে নাটক হতেই পারে, যেহেতু অনেক বড় সামর্থ্য আছে এন এস ডি’র। তথাপি সামান্য সামর্থ্যতেও এ নাটকের জয় হবেই। তার মধ্যেও সোমনাথ সেনগুপ্তের শাজাহান চরিত্রটি গ্রাফিক্যাল উত্থান পতনে নাটকের বিশেষ সম্মান। খুব ভাল লাগে রাজেন দাসের মাতাল গ্রামীণ রাজনৈতিক চরিত্রটি। অন্যান্য সকলে প্রচলিত চেহারায় আছে। নাটকের মঞ্চ ব্যবস্থা কিছু পরিবর্তন কাম্য, সাধারণ আলো। পৌনঃপুনিক ভাবে একই বেজে চলা হারমোনিয়ামের রিদ্মিক শব্দ গতি এবং নাট্যের গতি বৈচিত্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছে কিনা, তা ভাবা দরকার। আনন্দের কথা এক ঝাঁক নতুন তরুণ তরুণী সংযুক্ত হয়েছেন। চর্চিত হলেই এ নাটকও যুগাগ্নির স্বদেশী নক্সার মত ছুটতে পারবে বলেই বিশ্বাস।
ষষ্ঠ নাটক শান্তিপুর সাংস্কৃতিক দলের নাটক প্রমিথিউস বাউন্ড। মুল গ্রীক নাটক এস্কাইলাস। মঞ্চ সম্পাদনা ও নির্দেশনা কৌশিক চট্টোপাধ্যায়। এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ উপস্থাপনা। হাহাকারে, আর্তনাদে, চিন্তায়, চেতনায়, হত্যায়, মরনে, জীবনের চূড়ান্ত স্বীকার প্রমিথিউস বাউন্ড এক অপূর্ব উদ্ভাবনের প্রকৃয়ায় ভীত, চিন্তিত, সর্বপরি ফ্যাসিবাদের ধর্মীয় আগ্রাসনে সচকিত করে দিয়ে গেল। কারণ এখানে ধর্ম নিজের রাজনৈতিক চেহারা নিয়ে প্রমিথিউসকে অন্যায়ভাবে আক্রান্ত করেছে। সেই সুদুর অতীতের গ্রীক দেশীয় উপাখ্যান কীভাবে যেন এই সময়ের ক্ষমতা লোভী রাজতন্ত্রকেই চেনাচ্ছে। মৃত্যু ভয়ে ভীত করছে। সামগ্রিক ভাবে এই নাট্যায়নের সবটাই অন্যন্য শিল্প সুষমাতে ভরপুর। বক্তব্য রূপায়ণ স্বচ্ছ ও সুন্দর। অভিনয়, আঙ্গিকগত প্রয়োগে আলো স্বতন্ত্র। ভূমি থেকে আলোকপাত সাধারণ মঞ্চ স্থাপত্যে নান্দনিক। চরিত্রদের অলংকরণ ও বাচিক উচ্চারণ, সুরে লয়ে তাল বদ্ধ একটি নিরেট বুননে সমৃদ্ধ কলতান। উজান চট্টোপাধ্যায় যদিও দুরন্ত, বাকি সবাইও তা বলে দূরত্বে নেই। কৌশিক চট্টোপাধ্যায় ও শান্তিপুর সাংস্কৃতিক বেশ কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজেদের শক্তি দেখাতে পারলো।
সপ্তম নাটক বালুরঘাট নাট্যকর্মী দলের মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নিষাদ। নির্দেশনা অমিত সাহা। নীল-কৌশিক নির্মিত সামঞ্জস্যপূর্ণ মঞ্চ ব্যবস্থা অভিনয়ের অনুকূলে ছিল। একটি কিমিতিবাদী নাটক। নাটকের সবটাই বেশ ভাবনা চিন্তার মধ্যেই গড়ে তোলার ছাপ মেলে। মাত্র ৯০ মিনিট দর্শক আসনে বসে সবাই-ই বুঝে বুঝে ভাবলেন। জীবন সঙ্কট কি দেখলেন। খুব ভাল সাজেস্টিভ এবং সাংকেতিক মঞ্চ ও আসবাব। চমৎকার আবহ ও আলো। কিন্তু কিছুটা উচ্চকিত আবহ প্রক্ষেপণ। সংলাপ দেয়া নেওয়া বেশ যান্ত্রিক, প্রাচীন ঘরানার। তবে অভিনয় স্কুলিং এবং স্কিমিং ও মন্দ নয়। কিন্তু সমাপতন ব্লেন্ডিং অপরিচ্ছন্ন। মধ্যবিত্তের উচ্চতা প্রাপ্ত হবার অন্তর্ভুক্ত অন্তর্গত ও অন্তর্গূঢ় আর্তনাদ নাটকের প্রতিপাদ্যে আছে। কিন্তু বেশ কিছু চরিত্রের মুখের যান্ত্রিক সংলাপ আলাপে ম্লান লাগে টেক্সটের মূল বোধ ও বিচার। উচ্চতর সংলাপ বিনিময় বা প্রক্ষেপণ কমে এসে, চরিত্র উচ্চতা কমালে, নিশ্চিতই কান্নার স্বরূপ চিনতে পারতাম। জীবনের কান্না চেনাতেই তো এই রচনের উৎস। তাছাড়া মঞ্চে অবান্তর মুভমেন্ট বেশি। এতো ছোটাছুটি না করেও শব্দের মধ্যেই শাব্দিক বোধগম্যতায় এই হৃদয় মথিত কাব্য কবিতাগুলো রঙে রূপে বিচিত্রিতা পেলে এই নিষাদ এই সময়ের দামী নির্মাণ বলে সম্মানিত হতে পারে। নির্দেশককে এই দুই প্রসঙ্গে ভেবে দেখতে হবেই। তবে নারী ভূমিকাটি সমৃদ্ধ। অমিত সাহাও মন্দ নন। সকলেই দক্ষ, অভিজ্ঞ, কিন্তু কৃতিত্বে কেউই তেমন উল্লেখযোগ্য নন।
সব মিলিয়ে রঙ্গভূমি জাতীয় নাটকের উৎসবের সব নাটকের টেক্সটগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ছিল। তিনটি স্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত নাটক, একটি এস্কাইলাসের রূপান্তর, একটি মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নাটক এবং দুটি চেকভ ও সমরেশ বসুর গল্পের ডাইরেক্টরিয়াল স্ক্রিপ্ট। কিছু বাড়তি চাওয়া নিয়ে এই আলোচনা লেখা। কিন্তু কোন রূপায়ণই একেবারে ফেলে দেবার মতো কোনভাবেই নয়। আমার নিজস্ব নাটুকে বাতিকে যা-ই বললাম, তাও শেষ কথা নয়। যেহেতু বেশি নাটক দেখে থিয়েটার ওয়েভের প্রাবল্য মাথায় চলে, নিজে যা সামান্য বুঝি—তার উপর ভিত্তি করে কিছু কথা শেয়ার করলাম। হয়তো পাগলামি। পাগলের পেছনেই মানুষ আছে ভেবেই। এই প্রসঙ্গে আরো বিচক্ষণ নাট্যজনদের কাছে এসবের বিরুদ্ধে কিছু কথা না বোঝা থাকলে, তা জানতেই তো চাই।