তাপস চক্রবর্তী
নাট্যগুরু শম্ভু মিত্র তাঁর অভিনয় নাটক মঞ্চ বইটিতে অভিনয় কী? নামক পরিচ্ছদে এক জায়গায় বলেছেন কোনও শিল্পকলাই স্বাভাবিক নয়। স্বাভাবিক যে ঘটনাগুলো জীবনে ঘটে তারই মধ্যে থেকে বেছে নিতে হয়, সাজিয়ে নিতে হয়, তবেই সেটি হয় শিল্পকলা।
অতিসম্প্রতি তপন থিয়েটারে বেলঘরিয়া উজান প্রযোজিত সমরেশ বসুর ‘প্রাণ পিপাসা’ গল্প অবলম্বনে মৈনাক সেনগুপ্তের লেখা নাটক ‘সুপ্রভাত’ দেখতে গিয়ে উপরের কথাগুলো নতুনভাবে মনে এলো। মিউনাস আয়োজিত টানা ২৪ ঘণ্টা নাট্যোৎসবে তুহিনা বসু সেনের নির্দেশনায় এই নাটকটি অভিনীত হয়েছে। একটি বেশ্যা (প্রভাতী)ও এক প্রায় ভবঘুরের (দীপক)এক রাতের ঘটনা নিয়ে নাটকটি নির্মিত।
এক ঝড় বৃষ্টির রাতে ভবঘুরে মানুষটিকে প্রায় জোর করেই নিজের ঘরে নিয়ে যায় খদ্দেরের অপেক্ষায় থাকা বেশ্যা। তাদের গল্প এগোতে থাকে। গল্পও যতই এগোতে থাকে ততই স্পষ্ট হতে থাকে অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে তাদের একটি কমন সমস্যা আছে সেটি হল খিদের সমস্যা। প্রেমে পুরুষের কাছে প্রতারিত হয়ে তাদেরই কাছে প্রেম (যদি শরীরকে প্রেম বলে মেনে নেয়া হয়) বিলানোর মতো অসহ কাজটি বহু বেশ্যাকেই করতে হয়। এই গল্পেও ঘটনাক্রম সেরকমই। প্রভাতী বহু যুগের এই প্রতারণাসমগ্রের একটি উদাহরণ মাত্র। দুদিন না খাওয়া বৃষ্টিভেজা দীপক তার সর্ব অর্থে হেরে যাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সবকিছুই সন্দেহের চোখে দেখে। তাই আপাতভাবে বেশ্যার আপ্যায়ন সে গ্রহণ করতে ইতস্তত বোধ করে। যদিও নাটকের অন্তে এসে আমরা আসল কারণ বুঝতে পারি। পুরুষের প্রতারণা এবং পুরুষের দেয়া অসুখ দুটিতেই আক্রান্ত প্রভাতী খুব স্বাভাবিক কারণেই পুরুষদের প্রতি চূড়ান্ত অবিশ্বাসী, কিন্তু তারপরেও নিজে অভুক্ত থেকে মুখের খাবার তুলে দেয় সেই রাতের অতিথি দীপককে।
ভোরবেলা দীপকও প্রভাতীর হাতে দিয়ে যায় এক বন্ধুর (তপন) কাছ থেকে পাওয়া একমুঠো টাকা চিকিৎসার প্রয়োজনে। মূল কাহিনী এটাই। সাবপ্লট হিসেবে বন্ধু তপনের মৃত্যু, প্রভাতির প্রথম যৌবন, প্রেম, ইত্যাদি দেখানো হয়েছে অনেকটাই ছন্দোবদ্ধভাবে।
অভিনয় ভালোমন্দ মিলিয়ে মোটামুটি। প্রভাতীর চরিত্রে স্বয়ং পরিচালক তুহিনা বসু সেন খুবই চেষ্টা করেছেন প্রাণ প্রতিষ্ঠার। তাঁর চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গিতে যতটুকু চাপা লাস্য দরকার ততোটাই এসেছে।
তুহিনা এটা মনে রেখেছেন যে প্রভাতী কিন্তু খানদানি বেশ্যা নয়। এর জন্য অবশ্যই অভিনেত্রী ও পরিচালক হিসেবে তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। দীপকের চরিত্রে উদয় রাও সাধ্যমতো সঙ্গ দিয়েছেন কিন্তু দুদিন না খাওয়া একজন মানুষ যতখানি শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন ততোটা তাঁকে লাগেনি। এছাড়া বাকি চরিত্রদের সেরকম কিছু পরিসর ছিলনা। এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তাঁরা হলেন উদয় রাও, সপ্তর্ষি ভৌমিক, অহর্না নস্কর ও পর্ণা হাজরা। প্রযোজনায় বিশেষ সহযোগিতায় হিয়া সেন।
সামগ্রিক অভিনয়ের ব্যাপারে শম্ভু মিত্রের ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ গ্রন্থটি থেকে ধার নিয়ে একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, ‘অভিনয় শিল্পীকে তার নিজের স্বরলিপি নিজেই তৈরি করতে হয় যাতে দর্শক, যারা এসেছে দেখতে এবং শুনতে তাদের যাতে ওটা সত্যি বলে উপলব্ধ হয়।’
একটি একাঙ্ক নাটকে অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপনা কঠিন মেনেও বলতে হয় দীপক এবং প্রভাতী সমস্ত সন্ধি প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুতই সেরে ফেলেছে মাঝখানে কোনও মোচড় ছাড়াই। যেটাকে খুব predictable বলে মনে হয়েছে।
এই নাটকে আলো করেছেন জিতেন দাস, মঞ্চ উদয় রাও এং আবহ অতনু বাপী সেন। মঞ্চসজ্জায় ডিলেটিং-এর দিকে নজর দেওয়ার দরকার ছিল। বেশ্যাবাড়ির অন্দরসজ্জা আর একটু অন্যরকম হলে ভাল হতো। আবহ আলাদা করে মন্দ নয়, কিন্তু নাটকের নাটকের অংশ হিসেবে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। একথা ভুললে চলবে না যে আবহ ততটুকুই প্রয়োজন যতটা নাটকের চাহিদা। শ্রাবণী সেনের কণ্ঠে কাতিল সাইফির লেখা গজল ‘দর্দসে ইয়ে দমন ভরদে’ শুনতে খুবই শ্রুতিমধুর। তবে গানটা না থাকলেও অসুবিধা ছিল না।
যে কোনও অনামী দলের কোনও নাটক প্রযোজনা যে কী দুঃসাধ্য কাজ সেটা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সুতরাং তাদের নাটক নিয়ে আলটপকা সমালোচনা থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে বিখ্যাত রুশ নাট্যকার স্ট্যানিসল্যাভস্কির এক চমৎকার উক্তি আছে ‘সবচেয়ে মুখ্যুরাই সমালোচক হয়’।