দেবা রায়
বাংলাদেশের অনন্য এক নাট্য প্রতিভা ৭৬ বছরের মামুনুর রসিদের ১৯ তম জন্মদিন পালন। পাঠক নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, হ্যাঁ মামুনুরের বয়স ৭৬ হলেও জন্মদিন পালন হল মাত্র ১৯ বার। চার বছর অন্তর অন্তর তার জন্মদিন আসে, যদিও সেটা ইংরাজী ক্যালেন্ডালের ভিত্তিতে। এমন এক নাট্য প্রতিভা, যার প্রশংসায় বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিল্পীরা একযোগে তার জন্মদিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে এসেছেন নানা প্রান্ত থেকে।
তাঁর এই জন্মদিন পালনে এক আনন্দ ও মিলন মেলার আয়োজন ছিল এই দিন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ২৯ ফেব্রুয়ারী থেকে ২ মার্চ এই তিনদিনের নাট্যানুষ্ঠান। প্রথমদিন অনুষ্ঠানের উদবোধন করেন অভিনেত্রী ফিরদউসি মজুমদার। এইদিন ছিল, গান নাটক আর স্মৃতিচারণা।
তাঁরই বয়ানে আমরা পাই, তিনি মনে মনে নিজেকে ২৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে ভাবতে ভালোবাসেন বেশী, কারণ এই সময়েই তাঁর জীবনের মূল্যবান ঘটনাগুলি ঘটে গেছে, নানা ভাবে আদৃত সব ঘটনা, সেই সময়েই তাঁর নাটক, প্রেম ও বিবাহ। নানান সংগ্রেমের সাথে যুক্ত থেকেছেন তিনি। ব্যর্থতা আর সাফল্যে ঘেরা এই সময়ের জীবন যাপন। তাই তিনি ঐ সংগ্রামের সময়টাকে আজীবন ধরে রাখতে চান।
এমনি অনুষ্ঠানে আসেন কৃতী সব শিল্পী, তাঁরই হাত ধরে তৈরী আরণ্যক নাট্যদল থেকে পাওয়া সেইসব কৃতী অভিনেতারা এই সন্ধ্যায় তাকে শুভেচ্ছা আর উপহার নিয়ে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চলে আসেন। এমনি এই অনুষ্ঠানে এই সময়ের এক বরেণ্য অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী মামুনুর রসিদকে নিজের আঁকা মামুনুরের মুখচ্ছবি উপহার দেন। অভিনেতার কাছে থেকে সবচেয়ে বড় এই উপহার গুরুদক্ষিণা হিসেবে, এই সন্ধ্যা সাক্ষী থাকল। চঞ্চল চৌধুরী মনে করেন, তিনি যদি মামুনুর ভাইয়ের সংস্পর্শে না আসতেন তাঁর থিয়েটার বা অভিনয় জীবনে আসাই হত না। তাই অভিনেতা হিসেবে তিনি যেটুকু পরিচয় অর্জন করেছেন তার সম্পুর্ণ কৃতিত্ব তিনি মামুনুর ভাই আর আরণ্যক নাট্যদলকেই দিতে চান, এবং দিয়েছেন এই সন্ধ্যায়। এইদিন অভিনেতা আলমগীরও উপস্থিত ছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। আলমগির মামুনুর ভাইকে তার ছোটভাইয়ের মত দেখতে পান বলে, একবার আলমগীর তাঁকে বলেছিলেন- ‘আপনাকে দেখতে আমার ছোটভাইয়ের মতো লাগে।‘ সেইদিন মামুনুর ভাই তাকে বলেছিলেন,’ওকে, আজ থেকে আমি আপনার ছোটভাই, আর আপনি আমার বড়ভাই’। সেই থেকে আজও সেটাই মেন্টেইন্ড হচ্ছে। এরপর অভিনেতা, গায়ক ফজলুর রহমান বাবু বলেন- ‘আমাদেরকে তৈরি করেছেন মামুনুর রসিদ, উনি বাংলাদেশের নাটককে সমৃদ্ধ করেছেন, এবং আমাদেরকেও ঋদ্ধ করেছেন।‘ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অভিনেত্রি ডলি জহুর। তিনিও তার সুস্থতা কামনা করেন, আবারও মঞ্চে একসাথে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অভিনেতা আজিজুল হাকিম মনে করেন- ‘আমার বাবা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, কিন্তু মামুনুর রসিদ আমাকে একজন মানুষ হিসেবে, একজন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে, একজন নাট্য শিল্পী হিসেবে, যেভাবে লালন পালন করে আজকে এই পর্যায়ে এনেছেন, তার জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।‘ অভিনেত্রী সুষমা সরকার মনে করেন- ‘প্রত্যেকের জন্মদিনই বিশেষ, কিন্তু ওনার জন্মদিনটা চার বছর ঘুরে ঘুরে আসে, আমরা সেইদিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি…’
মামুনুর রসিদের স্মৃতি চারণায় উঠে আসে তার এই দীর্ঘ নাট্য জীবনের নানান, কথা। কলেজ জীবনে একটি নাটক লেখা শুরু আর সেটা সফল হবার পর থেকেই তার এই নাট্যকর্ম জীবনও শুরু। তখন নাটকের এই ব্যবস্থাপনা ছিল না, পাড়া, স্কুল, কলেজ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ৬৮ সালে উনি টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন। সেখানেই নাটক লেখা শুরু করেন, তারই অব্যবহিত পরে মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আর সেইখান থেকেই কলকাতার নাটক দেখার সৌভাগ্য হল, এইভাবেই ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারী আরণ্যক নাট্যদলে প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। ২০ ফেব্রুয়ারি কবর নাটক মঞ্চায়ন দিয়ে আরণ্যকের যাত্রা শুরু। এরপর থেকে আজও চলছে, যাদের সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা রাঢ়াঙ, যা ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে। তিনি মনে করেন তাঁর প্রতিটি নাটকেই শ্রেণী সংগ্রামের বক্তব্য থাকে। এবং বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগণ তাদের কথাই থাকে তাঁর নাটকে। তিনি তার জন্মদিন চার বছর পর আসা নিয়ে বলেন, এ যেন- ‘দূরাগত মাদলের ধ্বনি’।
এর বাইরেও ছোট পর্দার শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনয় শিল্পী সঙ্ঘ’ আয়োজন করে তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানটি, বাংলাদেশ শিল্পকলার একাডেমীর সেমিনার কক্ষে আয়োজন করা হয়। এখানে দেশের শিল্পীদের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন নাট্য সংঘঠনের কর্মীরাও যোগ দেন। এই সংগঠন এই নাট্য প্রতিভাকে, ‘নাট্যশিল্পীদের অনন্য অভিভাবক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কলকাতা থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সামিল ছিলেন কলকাতার অতি পরিচিত নাট্যদল ‘অনীক’-এর পরিচালক অরূপ রায় ও সংগঠক অভিজিৎ সেনগুপ্ত। তাঁরা একবাক্যে তাঁর প্রতিভার কথা স্বীকার করে তাঁকে পুষ্প স্তবক দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান।