সুব্রত কাঞ্জিলাল
চরিত্র: সৌরভ রায়। মাসিমা। প্রবীর দত্ত। ডাক্তারবাবু।। অঞ্জনা।। মিস্টার মিত্র।
(গভীর রাত। প্রশস্ত ব্যালকনির বাইরে অন্ধকার আকাশে মেঘ গর্জন করছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।
বছর চল্লিশের সৌরভ রায় শেক্সপিয়ার আবৃতি করছে।)
সৌরভ।। সোনা! হ লুদ, ঝকঝকে, মহামূল্য সোনা, এই একমুঠো, কালোকে সাদা করবে, কুৎসিত কে করবে সুন্দর, অন্যায় কে ন্যায়, নীচতা কে করবে অভিজাত , বৃদ্ধকে যুবক, কাপুরুষ কে বীর,। এ তোমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে যায় পুরোহিত ও চাকরকে। সুস্থ সবল মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেবে মারাত্মক বিষ। এই হল সেই বস্তুটি যা ধর্মের ক্রীতদাস। রাখি বন্ধন করে দানবের সঙ্গে মানবের। অভিশপ্তদকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাইয়ে দিতে পারে। বৃদ্ধ কুষ্ঠ রোগীকে বরণীয় করে তুলবে। চোরকে দেবে রাজকীয় সম্মান। ডাকাত কে বসিয়ে দেবে রাজ সিংহাসনে। এই হলুদ সোনা দেশে দেশে, মানুষে মানুষে যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়।
এই নাও রোমিও, ধরো এই স্বর্ণমুদ্রা। ভয়ংকর বিষধর সাপের চেয়েও মারাত্মক হলাহল। এই ঘৃণ্য জগতে তোমার বেআইনি নিস্তেজ ঔষধের চেয়ে অনেক বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটাবে এই সোনা। আমি তোমাকে এই বিষাক্ত সোনা বেচলাম। যেমন আমার মা আমার পিতার প্রতি প্রেম, আনুগত্য ও বিশ্বাস বেচে দিয়েছে আমার কাকার কাছে। কারণ একটাই। আমার পিতাকে খুন করা হয়েছে। পিতার সিংহাসনে অর্থাৎ ডেনমার্কের রাজসিংহাসনে আমার গর্ভধারিণী মায়ের প্রেমিককে বসাতে হবে যে।(শেক্সপিয়ার থেকে আবৃত্তি চলছিল) ফোন রিং। মদের বোতল থেকে খানিকটা গলায় ঢেলে নিয়ে ফোন ধরবে।
সৌরভ।। কি ব্যাপার, এত রাতে?
নারীকণ্ঠ।। তুমি কি করছো সৌরভ? (মঞ্চের কোন একটা জায়গায় মেয়েটাকে দেখানো যেতে পারে)
সৌরভ।। মাতাল হওয়ার চেষ্টা করছি-
নারীকণ্ঠ।। আবার পাগলামি শুরু করেছো?
সৌরভ।। আবার যে হ্যামলেট আমাকে ভর করেছে।
নারী।। তুমি কি মরতে চাও?
সৌরভ।। আমি যে বেঁচে আছি সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
নারী।। মারুতি প্রোডাকশন থেকে তোমাকে গাড়ি পাঠানো হয়েছিল। এলেনা কেন?
সৌরভ।। গাড়ি পাঠালেই বাধ্য ছেলের মত গাড়িতে উঠে পড়তে হবে এরকম চুক্তি তো আমি কারও সঙ্গে করিনি।
নারী।। আহ সৌরভ। বি প্রাক্টিক্যাল। বারবার তুমি সুযোগ হাতছাড়া করছো। কেন বুঝতে পারছ না যে, এরপর আর কেউ তোমাকে চান্স দেবে না।
সৌরভ।। চান্স পাওয়ার জন্য যারা স্টুডিও পাড়ায় লাইন লাগায়—-বারবার তুমি আমাকে তাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছো কেন?
নারী।। তোমার স্ক্রিপ্ট ওদের পছন্দ হয়েছে। তোমাকে ওরা ফাইন্যান্স করতে রাজি। প্লিজ, নিজের পায়ে আর কুরুল মেরো না।
সৌরভ।। ঠিক বলেছ। এবার বন্দুকের নল টা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে।
নারী।। বন্দুক?
সৌরভ।। বাবার রেখে যাওয়া রিভলবার। হঠাৎ করে খুঁজে পেয়েছি। ম্যাগাজিনের মধ্যে ছয় খানা গুলিও দেখলাম।
নারী।। কি যা তা বলছ! (আতঙ্ক)
সৌরভ।। আজকে থেকে টার্গেট প্র্যাকটিস করতে হবে। আরো কিছু গুলি দরকার।
নারী।। তোমার কি মাথা খারাপ হলো?
সৌরভ।। সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছি। সেই কারণেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। আমার 40 বছরের জীবনে কি কি ঘটেছে, আরো কি কি ঘটতে যাচ্ছে। যাক গে। আমাকে আর বিরক্ত করো না। এখন সাইলেন্সার লাগিয়ে টার্গেট প্র্যাকটিস করতে হবে। (ফোন কেটে দেবে। আবার খানিকটা মদ গলায় ঢেলে নেবে। সেই মেয়েটা আবার ফোন করবে। ফোন অন করে বলবে–)
সৌরভ।। বললাম তো, আমাকে ডিস্টার্ব করো না।
নারী।। পাগলামি কোরো না সৌরভ। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব।
সৌরভ।। এখন এই রাতে?
নারী।। তোমার সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে।
সৌরভ।। নাইট কারফিউ চলছে। পুলিশ ধরবে তোমাকে। (আবার ফোন কেটে দেবে) নিজেকে কি ভেবেছে মেয়েটা? এবিপি র সাংবাদিক? হাটু জলে সাঁতার কেটে ছবি তুলে ড্রামা বাজি করবে? (মদ খাবে) তবে হয়তো ভয়ও পেতে পারে! আমি প্রজেক্টটা ছেড়ে দিলে 100000 টাকার কমিশন হাতছাড়া হয়ে যাবে! (টেবিলের ড্রয়ার থেকে রিভলভার বার করবে। নাড়াচাড়া করে দেখবে ঠিক আছে কিনা। দানব মুখো একটা বারবি ডল এনে জানলার দিকে ঝুলিয়ে দেবে। তারপর ওটাকে টার্গেট বানিয়ে রিভলবার তাক করবে।) হাত কাঁপছে! মদের রিআ্যকশন? হবে হয়তো। তাহলে, তাহলে এখন কি করা? নেশা তো অনেকদিন ধরেই করছি, কখনো তো এভাবে নিজেকে আনফিট মনে হয়নি!!
(কিছু একটা ভেবে বাথরুমে ঢুকে যাবে। এই অবসরে বেলকনির রেলিং ডিঙিয়ে জনৈক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে পড়বে। বয়স 50 এর কাছাকাছি। দামি জিনস এর ট্রাউজার আর জ্যাকেট। মাথায় কালো ক্যাপ। নাম প্রবীর দত্ত। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। চোখে কালো চশমা। ঘরে ঢুকে চারদিক পর্যবেক্ষণ করবে। তারপর একটা চেয়ারে বসে পড়বে। সিগারেট ধরাবে। সেই সময় সৌরভ বেরিয়ে আসবে।)
সৌরভ।। আপনি? আপনি কিভাবে ঢুকলেন? বাড়ির সব দরজা তো বন্ধ!
প্রবীর।। তাহলে নিচ থেকে জলের পাইপ বেয়ে -উঠে পড়েছি—-বিশ্বাস হচ্ছে না? (হাসি)
সৌরভ।। ডোন্ট বি সিলি। আমার ব্যালকনির দিকে কোন জলের পাইপ নেই। এদিকে আমার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। হোয়াট এ স্ট্রেঞ্জ!!! কে আপনি? কি নাম? কোথা থেকে এসেছেন? কেনই বা এসেছেন? উত্তর দিন-
প্রবীর।। আমাকে চিনতে পারছেন না?
সৌরভ।। আগে কখনো দেখেছি বলে তো মনে হয় না। বলুন কে আপনি? কখন ঢুকলেন, কিভাবে ঢুকলেন?
প্রবীর।। জাস্ট এলাম। তখন আপনি সম্ভবত বাথরুমে ঢুকেছিলেন।
সৌরভ।। (রিভলভার তাক করে) আই সে হু আর ইউ? কি চাই আপনার?
প্রবীর।। আমার কিছু চাইনা। আপনার আমাকে চাই।
সৌরভ।। আপনাকে আমার চাই কি করে বুঝলেন?
প্রবীর।। টেলিপ্যাথি। আপনি বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
সৌরভ।। আপনাকে খুঁজতে যাব কেন? কে আপনি? কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না!
প্রবীর।। আপনার হাতের রিভলবার টা লোডেড নিশ্চয়ই?
সৌরভ।। ইয়েস।
প্রবীর।। সম্ভবত ওটা আমার জন্য——
সৌরভ।। মানে?
প্রবীর।। একজনকে খুন করতে চান তাই তো?
সৌরভ।। হ্যাঁ চাই। আপনি কিভাবে জানলেন?
প্রবীর।। বললাম তো টেলিপ্যাথি। আপনি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। খুন করবেন বলে।
সৌরভ।। আপনাকে!!! আপনি আমাকে পা জল (puzzle) করে দিচ্ছে ন! আপনাকে আমি খুন করতে চাইবো কেনো?
প্রবীর।। আশ্চর্য। বাবার রিভলবারটা অনেক খোঁজাখুঁজি করে বার করলেন তাহলে কেন? আমাকে মারবার জন্যই তো?
সৌরভ।। হ্যাঁ এ কথা ঠিক, যে আমি তিন জনকে খুন করবো বলে প্রস্তুত হচ্ছি। কিন্তু তাদের মধ্যে আপনি তো ছিলেন না।
প্রবীর।। কারা সেই তিনজন? কি নাম তাদের?
সৌরভ।। আপনাকে বলব কেন?
প্রবীর।। প্রমাণ রাখতে চান না? পুলিশে ধরা পড়ার ভয়?
সৌরভ।। এত কথা আপনি বলছেন কেন বলুন তো? আপনি এখান থেকে চলে যান!
প্রবীর।। বেশ । যাচ্ছি। তবে যাওয়ার আগে বলে যাই, সেই তিনজনের মধ্যে আমি একজন। যাকে তুমি হাতের সামনে পেয়েও খুন করতে পারলে না।
সৌরভ।। আপনার নাম?
প্রবীর।। আমি ডাক্তার প্রবীর দত্ত।
সৌরভ।। (চমকে উঠবে) ডাক্তার প্রবীর দত্ত?
প্রবীর।। হ্যাঁ। যাকে তুমি সন্দেহ কর যে তোমার মাকে যে লোকটা খুন করেছিল—-am আই রং?
সৌরভ।। (প্রবীর দত্ত র কাছে আসবে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবে) সত্যিই আপনি সেই প্রবীর দত্ত? কিন্তু আমি যাকে চিনতাম তার সঙ্গে তো আপনার চেহারায় মিলছে না?
প্রবীর ।। তখন আমি দাড়ি গোঁফ রাখতাম না। চুল ও অন্যরকম ছিল। কিন্তু কণ্ঠস্বর? সেটাতো বদলায়নি। তাছাড়া আমার কপালের এই দাগ টা—ভালো করে দেখুন। সেদিন পেপার ওয়েট ছুড়ে মেরেছিলেন——-ভুলে গেছেন?
সৌরভ ছিটকে আসবে। অতীত মনে করার চেষ্টা করবে। তারপর তিনটি গুলি চালিয়ে দেবে। গুলির শব্দে চারিদিক প্রতিধ্বনি উঠবে। বাইরের দরজায় করাঘাত শুরু হবে। সৌরভের মাসিমা চিৎকার করে বলতে থাকবে,
মাসিমা।। কি হলো–কি করছিস বাবু? গুলির শব্দ কেন? দরজাটা খোল-দরজা বন্ধ করে কি করছিস? দরজা খোল-
সৌরভ দরজা খুলে দিল। মাসিমা ভেতরে ছুটে আসবে। উন্মাদের মত বলতে থাকবে—
সৌরভ ।। মাসি, মাসি, আমি বদলা নিতে পেরেছি, আমি প্রতিশোধ নিয়েছি,
মাসি।। কি কি কি করছিস তুই? কিসের বদলা?
সৌরভ।। আমার মায়ের খুনিকে আমি আমি শাস্তি দিয়েছি।
মাসি।। এসব কি বলছিস তুই?
সৌরভ।। হ্যাঁ হ্যাঁ মাসি, আমি তোমার বোনের মৃত্যু র শো ধ তুলতে পেরেছি। বাবার রিভলবার দিয়ে গুলি চালিয়ে, ওই ওই ওই ওই দেখো তার লাশ ওখানে পড়ে আছে। (দেখা যাবে প্রবীর দত্ত ভ্যানিশ। ঘরে অন্য কেউ নেই । আবহ সঙ্গীতা আসবে।)
মাসি।। কোথায় কি? (ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে) আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না-
সৌরভ।। এইতো, এখানে লাশটা পরে আছে। এইতো দেখনা রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝেটা -ভালো করে দেখো দেখো!
মাসি।। না এখানে কিছু নেই। তুই ভুল করছিস । স্বপ্ন দেখেছিস।
সৌরভ।। না না না স্বপ্ন নয়। আমি নিজের হাতে লোকটাকে গুলি করেছি- (এবার লাশটা খুজবে! অবাক হবে!) এ কি-কোথায় গেল? এখানেই তো পড়েছিল-আমার গুলি লেগেছিল ওর বুকে– (ছুটে যাবে ব্যালকনিতে। ঘরের এখানে-ওখানে খুজবে)
মাসি।। কাকে খুঁজছিস? বল কাকে খুঁজছিস? ঘরে কেউ নেই!!! শান্ত হ—মাথা ঠান্ডা রেখে বোঝার চেষ্টা কর-
সৌরভ।। কি আশ্চর্য!!! গুলি খাওয়া লাশ ভ্যানিশ হয়ে গেল? তবে কি আমি গুলি করতে পারি নি? (এবার মানসিক যন্ত্রণা শুরু হবে! জ্ঞান হারাবে বাইরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমক।)
পরের দিন সকাল।
ডাক্তারবাবু ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মাসিমার সঙ্গে।
ডাক্তার।। তাহলে চলি মাসিমা
মাসি।। কেমন মনে হলো বাবা?
ডাক্তার।। অতিরিক্ত মানসিক স্ট্রেস আর আপনি যে বললেন, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, সেই কারণেই ফিজিক্যালি মানে শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েছে। যেভাবেই হোক ওকে খাওয়াতে হবে। আর কোনো মানসিক চিকিৎসককে দেখাতে হবে।
মাসি।। ও কি তাহলে, মানে অনেকে যে বলে-
ডাক্তার।। না না, সম্ভবত এখনো কোনো মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হবে না। ঘরে কয়েকটা মদের বোতল দেখলাম। এগুলো চলবে না। আমি চলি। আপনি আমাকে ঠিক সময় কল দিয়ে ছিলেন-নইলে হিতে বিপরীত হতে পারত! ইনজেকশন দিয়ে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ঘুমাবে। ওর এখন প্রচুর ঘুম দরকার। আর প্রোটিন।
মাসি।। শেষ রাতে ওই রকম একটা ঘটনা ঘটবে, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এর আগে তুমি একবার আমাকে দেখতে এসেছিল তাই মনে হল, তোমাকে কল দিই—-মানে বুঝতেই তো পাচ্ছো এই লকডাউনের বাজারে ডাক্তাররা তো যে যার নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। বিপদের সময় তোমাদের মতন দু একজন ছাড়া আমরাতো—–
ডাক্তার।। ভালোই করেছেন। তবে আমি তো একা থাকি। সাধারণত ওই সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকি। বছরখানেক হলো, ঘুম চলে গেছে। বোধহয় আমার মত আরো অনেকেই ঘুমাতে পারে না। চারদিকে যা চলছে, এটা কি পাগলামি বলবো? না? ভয়ংকর ষড়যন্ত্র!!! চলি চলি। পরে খবর নিতে আসব।
ডাক্তার বেরিয়ে যাবে। মাসি বিপন্ন হয়ে বসে পড়বে। ফোন আসবে।
মাসি।। হ্যালো, কে বলছেন–ও, সৌরভ তো অসুস্থ! হ্যাঁ! ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না! দিনরাত কি যে করে, কি যে দিনরাত ভাবে কিছুই বুঝতে পারিনা! আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন—কিন্তু ও তো ঘুমাচ্ছে। ডাক্তার এসেছিল, ওষুধ ইনজেকশন এ সব দিয়ে গেছে-ঠিক আছে কালকে আসুন! হ্যাঁ আপনার কথা বলব! (ফোন রাখবে। ডোরবেল বাজে। দরজা খুলতে যাবে) এখন আবার কে এলো!
অঞ্জনা আসবে।
মাসি।। তুমি কোত্থেকে?
অঞ্জনা।। সৌরভদা কোথায়?
মাসি।। শোবার ঘরে। ডাক্তার এসেছিল।
অঞ্জনা।। ডাক্তার-কেন? কি হয়েছে সৌরভ দা র? কাল রাতেও তো কথা হল!
মাসি।। এই বয়সে আমি আর ওকে সামলাতে পারছিনা। তোমরা তো ওর বন্ধু। একসঙ্গে নাটকের দলে অভিনয় কর। তোমরা বলতে পারো না ওর কি হয়েছে? কেন রাতের পর রাত ঘুমায় না? দরজা বন্ধ করে কি যেসব করে!! বাইরে থেকে শুনতে পাই, কখনো কখনো নাটকের সংলাপ বলছে! আবার কখনো কখনো–ওর বাবার রিভলভারটা বার করে কি যে সব বিড়বিড় করে বলে!! আজ কাল সারাদিন নেশা করে! বাজারহাট তো বন্ধ। কিন্তু মদের দোকান? ওটাকে খুলে রেখেছে!!! কি যে ছাই চলছে!!!
অঞ্জনা।। একটা কাজে আমি আটকে পড়েছিলাম। সিনেমার কাজ। আর্ট ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি। সৌরভ দার জন্য একটা কাজের ব্যবস্থা করেছি। আমি কি শোবার ঘরের দিকে যাব মাসিমা?
মাসি।। ডাক্তার বলল, ইনজেকশন দিয়েছে। অনেকক্ষণ ঘুমাবে।
অঞ্জনা।। তাহলে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। দেখা না করে যাব না।
মাসি।। বেশ তো। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, সারারাত ঘুমাওনি। কোথায় ছিলে?
অঞ্জনা।। শুটিং ছিল। ওখান থেকে ফোন করেছিলাম।
মাসি।। তাহলে চা করছি। সকাল থেকে আমারও কিছু খাওয়া হয়নি। ছেলেটাকে আমি আর সামলাতে পারছিনা। বলছিলাম যে, তোমাদের শুটিং কিভাবে চলছে? নাটক তো বন্ধ—–
অঞ্জনা।। নানারকম কায়দা কানুন করে করতে হচ্ছে। মদের দোকান খুলে রাখার মত, আমাদেরও খানিক টা ছাড় আছে। আমি বাথরুমে যাব। চোখেমুখে জল দিতে হবে।
মাসি।। যাও। (অঞ্জনা বাথরুমে ঢুকবে। চা বানাতে বানাতে মাসি কথা বলবে) তুমি কিভাবে এলে অঞ্জনা?
অঞ্জনা।। (বাথরুম থেকে) আমার স্কুটিতে!
মাসি।। তোমাদের শুটিং কবে থেকে শুরু হয়েছে?
অঞ্জনা।। বললাম তো।লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। কতদিন আর চুপচাপ বসে থাকা যায়। কোটি কোটি টাকা এই সেক্টরে লগ্নি হয়ে আছে। এখানে আইন মারাতে এলে বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
মাসি।। আমার হয়েছে যত জ্বালা। এখানে এসে আটকে পড়েছি। এক বছরের বেশি হয়ে গেল। বাবুকে বলছি আমাকে পাঠিয়ে দিতে। আর ভালো লাগছে না।
অঞ্জনা।। একা কিভাবে যাবেন? লোকাল ট্রেন তো এখনো চালু হয়নি। দূরপাল্লার কয়েকটা ট্রেন চলছে।
মাসি।। সেটাই তো সমস্যা। আসামে নাকি খুব কড়াকড়ি চলছে। নাইট কার্ফু। লকডাউন। (ডোরবেল) আবার কে এলো! (দরজা খুলে দিলে, প্রতিবেশী মধ্যবয়স্ক সোমনাথ বাবু আসবে) আপনি-মানে সৌরভ তো অসুস্থ—-কথা বলতে পারবেনা!
সোমনাথ।। আপনাদের বাড়ি থেকে ডাক্তারবাবুকে বেরোতে দেখে মনে হলো আপনাদের কেউ অসুস্থ। তাছাড়া অন্য আর একটা কারনে আমাকে আসতে হল।
মাসি।। ভেতরে আসুন।
সোমনাথ।। কাল শেষ রাতের দিকে আপনাদের বাড়ি থেকে গুলি চালাবার শব্দ শুনেছি। (এইসময় বাথরুম থেকে অঞ্জনা বেরোবে)
অঞ্জনা।। গুলির শব্দ, এই বাড়ি থেকে?
সোমনাথ।। হ্যাঁ। আমিতো ইনসোমনিয়া রোগে আক্রান্ত। মুঠো মুঠো ঘুমের বড়ি খেয়েও ঘুম আসেনা। তাছাড়া কাল বিকেল থেকে হাঁপানির টান উঠেছিল। আমি বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে ছিলাম। সৌরভের ঘর থেকে শব্দ টা বেরিয়েছে।
অঞ্জনা।। আর কোন শব্দ শুনেছেন?
মানে গান, যন্ত্রসংগীত, নাটকের ডায়লগ?
সোমনাথ।। হ্যাঁ তাও শুনেছি। সন্ধ্যার পর থেকে মনে হল, সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সংলাপ শুনেছি।
অঞ্জনা।। তাহলেতো পলাশীর যুদ্ধের সময় রাইফেল গোলাগুলি চলতেই পারে-
সোমনাথ।। তা পারে। তবে, আমি যে শব্দ টা শুনেছি সেটা কিন্তু-
অঞ্জনা।। সৌরভদা অনেক সময় রাত জেগে নাটকের মিউজিক রেকর্ডিং করে। স্পেক্টাকুলার সাউন্ড বাজাতে হয়। পশু পাখির ডাক, প্লেন ট্রেন কত রকম যানবাহনের ইত্যাদি শব্দ—-
মাসি।। হ্যাঁ মনে পড়েছে। আমি যখন সন্ধ্যের পর ওর জন্য কফি নিয়ে গিয়েছিলাম, তখন বাবু বলেছিল, রাতে মিউজিক রেকর্ডিং চলবে। আমি যেন যখন তখন ওকে বিরক্ত না করি।
সোমনাথ।। তাহলে আমি ভুল শুনেছি। কিন্তু তাই বা কি করে হবে। সৌরভ সে-ই সময় চিৎকার করে কাকে যেন বলছিল, খুন করবে। এবার মনে পড়েছে। সিরাজউদ্দৌলা না। হ্যামলেটের ডায়লগ বলছিল।
অঞ্জনা।। নাটকের ডায়লগ রিহর্স করছিল সম্ভবত।
সোমনাথ।। হবে হয়তো। আমি ঠিক মানে, হাঁপানির টান সহ্য করতে না পেরে হয়তো জিমিয়ে পড়েছিলাম।
অঞ্জনা।। পাড়ায় আর কেউ শুনেছি কি?
সোমনাথ।। বলতে পারব না। আমাদের বাড়িতে তো একেবারে মুখোমুখি। বারান্দা থেকে এ বাড়ীর অনেক কিছু দেখা যায়। শোনাও যায়। তাহলে আমি চলি। হ্যাঁ, সৌরভের কি অসুখ করেছে? করোনা নয়তো?
মাসি।। ডাক্তার স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। রাতের পর রাত জেগে থাকে। অনেকদিন ধরে ঘুমাতে পারছেনা। কি সব দুশ্চিন্তায়-
সোমনাথ।। ঠিকই বলেছেন। অনেকেরই চোখে ঘুম নেই। টিভি খবরের কাগজ খুললেই মৃত্যুর মিছিল দেখা যায়। যখন তখন বাজার হাট বন্ধ করে দিচ্ছে। গাড়ি চলছে না। স্কুল কলেজ বন্ধ। কাল শুনলাম, আমার এক খুড়তুতো ভাই এর 16 বছরের মেয়ে টা আত্মহত্যা করেছে। লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। বরাবর ফার্স্ট সেকেন্ড হত। এবার মাধ্যমিকে ও ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। পরীক্ষা হবে না শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা নাকি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
মাসি।। আপনি চা খাবেন?
সোমনাথ।। না। কিছুই ভালো লাগছে না। বাজার থেকে অক্সিজেন উধাও। আমার হাঁপানির টান উঠলে ইনহেলার নিতে হয়। সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না। শুনছি লাইভ সেভার ওষুধগুলো দশগুণ দাম হয়েছে। আমি চলি।। সৌরভ কেমন থাকে আমাকে একটা খবর দিতে বলবেন।
(চলে যাবে)
অঞ্জনা।। মাসি, কাল রাতে কি হয়েছিল?
মাসি।। সেটাই তো তোমাকে বলতে যাচ্ছিলাম। আমি এক তলার ঘরে থাকি। কিছুদিন ধরে আমার ও চোখে ঘুম নেই। নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুম আসে না। আসামে আমার ছেলেমেয়েরা রয়েছে। গতমাসে খবর পেয়েছিলাম বড় জামাই হাসপাতালে ভর্তি। বড় ছেলে ওখানে হোটেলের ব্যবসা করে। লকডাউন এর জেরে ব্যবসা লাটে উঠেছে।
অঞ্জনা।। সত্যি সত্যি সৌরভ দা কি গুলি চালিয়েছিল?
মাসি।। গুলির শব্দ আমিও পেয়েছিলাম। ওপরে ছুটে গিয়েছিলাম। বাবু তখন কি সব কথা বলছিল, চিৎকার করছিল, আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপরে তো অজ্ঞান হয়ে গেল।
অঞ্জনা।। ডাক্তারবাবু কখন এসেছিল?
মাসি।। এইতো তুমি আসবার খানিক আগে। কাছাকাছি থাকে। বাবুর ডায়েরিতে ফোন নাম্বারটা ছিলো। রাত তখন সাড়ে তিনটে।
অঞ্জনা।। আমাকে তো একটা ফোন করতে পারতেন। আমি না এলে কিছুই তো জানতে পারতাম না।
মাসি।। তোমার সঙ্গে ভালো কোন মানসিক রোগের ডাক্তার জানা চেনা আছে? মানে ডাক্তারবাবু বলে গেলেন, ওইসব ডাক্তার দেখাতে
অঞ্জনা।। কেন জানি না আমারও মনে হচ্ছিল, সৌরভ দা মেন্টাল প্রবলেমে ভুগছে।
(এই সময় ভেতর থেকে সৌরভ বেরোবে। চেহারা দেখে কোন অসুস্থতার লক্ষণ বোঝা যাবে না)
সৌরভ।। একা আমি ভুগছি না অঞ্জনা। যার মধ্যে বিবেক বোধ বুদ্ধি, একটা চিন্তাশীল মন রয়েছে আজকে তারাই আমার মতন আক্রান্ত। গতকাল একটা রিপোর্ট দেখছিলাম। মেন্টাল পেশেন্ট দের লম্বা লাইন পড়েছে মানসিক হাসপাতাল গুলোতে। কয়েক হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে গেছে
মাসি।। তুই উঠে এলি যে? ডাক্তারবাবু তোকে রেস্ট নিতে বলেছে।
সৌরভ।। 14 টা মাস ধরে দেশের কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দি হয়ে রেস্ট নিচ্ছে। কত যে কুম্ভকর্ণের জন্ম হয়ে গেল! আর অন্যদিকে——লুট চলছে। লুট।
অঞ্জনা।। তোমার মতন উন্মাদের সংখ্যাটাও বাড়ছে-
সৌরভ।। উন্মাদ হতে পারছি কই? এখনো যে কত রকম ভয়-ভীতি পিছুটান থেকে যাচ্ছে! এগুলোকে অস্বীকার করে, পেছনের পথটাকে কেটে ফেলতে না পারলে কোনভাবেই এগোতে পারবোনা।
মাসি।। তুই কি এখন কিছু খাবি? টিফিন করবো?
সৌরভ।। ভালো করে বেশ কড়া করে কফি আন তো–
অঞ্জনা।। আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে।
মাসি।। তোমার জন্য ডিম পাউরুটি আনবো?
সৌরভ।। ডাবল ডিম দিও। ওর আবার একটা তে পোষায় না।
(মাসি রান্না ঘরে যাবে)
অঞ্জনা।। কাল কি হয়েছিল?
সৌরভ।। কাল কখন বলতো?
অঞ্জনা।। শেষ রাতের দিকে?
সৌরভ।। কি আবার হবে? আমি নতুন নাটকের এডিটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। হ্যামলেট। এই সময় প্রেক্ষিতে শেক্সপিয়ারের নাটকের দারুন অ্যাডাপটেশন হতে পারে।
অঞ্জনা।। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম তখন রাত একটা বাজে। আমাদের শুটিংয়ের প্যাকআপ হয়ে গিয়েছিল। এত রাত্রে কোথাও যাবার উপায় ছিল না। তোমাকে ফোন করেছিলাম।
সৌরভ।। না তো। কারো ফোন পাইনি।
অঞ্জনা।। তুমি আমার ফোন পাওনি?
সৌরভ।। না।
অঞ্জনা।। ফোনে আমার সঙ্গে কথা হয়নি তোমার?
সৌরভ।। বলছি তো না।
অঞ্জনা।। সে সময় তুমি কী করছিলে?
সৌরভ।। বললাম তো। নতুন নাটকের প্রোডাকশন স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিলাম।
অঞ্জনা।। কি নাটক?
সৌরভ।। হ্যামলেট। বললাম তো এইমাত্র—
অঞ্জনা।। শেক্সপিয়রের হ্যামলেট’?
সৌরভ।। চরিত্রটা শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে উঠে এসেছে এটা ঠিক। তবে একেবারে আধুনিক মানে এই সময়ের একজন হ্যামলেটের কথা বলতে চাই।
অঞ্জনা।। হ্যামলেট তো ডেনমার্কের রাজকুমার ছিল। পাগল। বদ্ধ উন্মাদ। আবার দার্শনিকও বটে। থিয়েটারি জ্ঞানও তার ছিল অসাধারণ! আজকের দিনে যা ভাবা যায় না!
সৌরভ।। উন্মাদ না হয়ে তার কোন উপায় ছিল না। শেক্সপিয়ার হ্যামলেট চরিত্র সৃষ্টি করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, হিংস্র, মানুষখেকো সমাজে হ্যামলেটের সুস্থ থাকা যায় না। যারা নিজেদের সুস্থ বলে দাবি করে, তারা শয়তান। বর্বর।
অঞ্জনা।। তোমার হ্যামলেট কি খুনোখুনি করে?
সৌরভ।। করতেও পারে। সমাজটা তো খাদ্য ও খাদকের। হয় শিকার হও কিংবা শিকারি হও। মাঝা মাঝি কোনো রাস্তা নেই। খুন হবার আগে তুমি খুন করো—-নইলে বাঁচতে পারবে না!
অঞ্জনা।। তুমি কাকে খুন করলে?
সৌরভ।। এখনো কাউকে করে ওঠা হয়নি।
অঞ্জনা।। মাসি যে বলল, কাল শেষ রাতে তোমার ঘর থেকে গুলির শব্দ পাওয়া গেছে।
সৌরভ।। অসম্ভব। মাসি ভুল শুনেছে।
অঞ্জনা।। তোমাদের বাড়ির সামনে ওই যে দেখো ব্যলকনির ওপাশে যে বাড়িটা, একটু আগে ওই বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনিও গুলির আওয়াজ শুনেছেন।
সৌরভ।। সোমনাথ বাবু?
মাসি।। (কফি এবং খাবার দিতে আসবে) হ্যাঁ, সোমনাথ বাবু। তিনি নিজের কানে স্পষ্ট শুনেছেন গুলির আওয়াজ। আমিও তো শুনেছি।
সৌরভ।। আশ্চর্য!!
মাসি।। আমি যখন তোর ঘরে গিয়ে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? তুই তখন কাকে যেন দেখিয়ে বলছিলি, তুই তাকে খুন করেছিস!
সৌরভ।। তাই নাকি?!!
(নাটকীয় ভাবে হেসে ওঠে। তারপর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন সেই লোকটাকে সামনের দেখতে পাচ্ছে, যাকে সে খুন করেছে। মুখের এক্সপ্রেশন বদলাতে থাকে)
রহস্য ঘন আবহাওয়া সংগীত আসবে। অঞ্জনা ও মাসি দৃষ্টি বিনিময় করে। সৌরভ নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে।
সৌরভ।। মনে হচ্ছে, হ্যামলেট নাটকটা নিয়ে আমি এমনভাবে ডুবে গিয়েছিলাম, যে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ও ই যে একটা খুনের দৃশ্য আছে না-
অঞ্জনা।। একটা কেন ওই নাটকে অনেকগুলো খুনের দৃশ্য আছে। সৌরভদা, তুমি তো বলতে, নাটকের মধ্যে, চরিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়া যায় না। বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
সৌরভ।। হ্যাঁ। হ্যামলেট নাটকে শেক্সপিয়ার এমনটাই লিখেছেন। আধুনিক যুগে বড় বড় পরিচালকরা এই কথাই বলেন। আমার ব্যক্তিগত সত্তা বিলুপ্ত করে আমি কখনো অন্য একটি সত্তার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারি না। একটা চরিত্রকে ভেতর থেকে যেমন দেখতে হয়। বাইরে থেকেও দেখা দরকার।
মাসি।। কিন্তু তা হলে কাল রাতে তুই কাকে দেখি এ বলছিলি, ওই লোকটা তোর মাকে খুন করেছে। আর তাই সেই লোকটাকে খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছিস।
সৌরভ।। ওটাতো হ্যামলেট নাটকের ঘটনা। হ্যামলেটের কাকা খুনটা করেছিল। হ্যামলেট এর মায়ের ষড়যন্ত্রে হ্যামলেট এর বাবা খুন হয়েছিল। আমি এডাপটেশন করছি। মানে গল্পটাকে আমাদের এখানকার পটভূমিকায় ফেলতে চাইছি। আশ্চর্য ঘটনা হলো এই, আমার মাকেও খুন হতে হয়েছে। সেখানেও ছিল ষড়যন্ত্র। গভীর চক্রান্ত। যাকে বলে রাজনৈতিক চক্রান্ত।
মাসি।। তোর মাথাটা একেবারেই ই বিগড়ে গেছে। আমার দিদি খুন হয়নি। অসুখ হয়েছিল।
অঞ্জনা।। হ্যাঁ। আ মি ও তাই জানি। সবাই জানে। গতবছর করোণা পজিটিভ ছিল।
সৌরভ।। বাজে কথা। মিথ্যে কথা।
অঞ্জনা।। পাগলামি কোরো না সৌরভদা। মাসিমা মিথ্যা বলবেন কেন?
মাসি।। এক বছর ধরে এই রকম পাগলামি করছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুই আমাকে যেভাবে হোক আসামে পাঠিয়ে দিস। আমি আমার ছেলেদের ফোন করে বলে দেবো, আমাকে গৌহাটি স্টেশন থেকে ওরা নিয়ে যাবে।(ভেতরে চলে যাবে)
অঞ্জনা।। আমিও দেখছি, তুমি এক বছরের বেশি হল, পাগলামি করে যাচ্ছ। নাটকের দলটাকে একরকম তুলে দিয়েছ। ফিল্মএ তোমার জন্যে কাজ জোগাড় করে দিলেও তুমি সেখানেও যাচ্ছ না।
সৌরভ।। নাটকের দল আমি তুলে দিই নি। আমার বাড়িতে রিয়ার্সাল রেখেছি। সবাইকে ফোন করে বারবার আসতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও 2/3 জনের বেশি কেউ আসছে না। নতুন নাটক তুলতে পারছি না। গতবছর লকডাউন অনেকটা উঠে যাবার পর অন্য অনেক দল শো করেছে। আমিও কয়েকটা জোগাড় করেছিলাম। ঠিক করেছিলাম পুরোন নাটকগুলো তুলব। কেউ আসেনি। তাদের নাকি নাটকের নেশা চলে গেছে। মৃত্যু ভয় চেপে বসেছে।
অঞ্জনা।। ভয় পেয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক।
সৌরভ।। তাহলে আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন? শোনো অঞ্জনা, এর চেয়ে অনেক বড় বড় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, মহামারী, বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীতে ঘটে গেছে। কোনদিন থিয়েটারকে বন্ধ করতে কেউ পারেনি। রঙ্গমঞ্চের সৈনিকরা টিনের তলোয়ার হাতে জীবন মরণ লড়াই করে গেছে।
অঞ্জনা।। এ ভয় যে অন্যরকম ভয় এটা তুমি কেন বুঝতে পারছ না?
সৌরভ।। মৃত্যু ভয় আগে ছিল না বুঝি? সত্তরের দশক মনে আছে? নাট্যকর্মীরা পুলিশের ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করেছে! শত শত নাট্যকর্মী পঙ্গু হয়ে গেছে পুলিশের মারে, শহীদ হয়েছে!
অঞ্জনা ।। ওসব পাস টেন্স। এখন আমরা অনেক বেশি- সেফ গেম খেলতে চাই। হঠকারী করবার দিন নেই। এখন নাটক গ্রুপ থিয়েটার অনেকের কাছে নেশার বস্তু। আবার অনেকের কাছে বাণিজ্যের বস্তু।
সৌরভ।। অপরচুনিস্ট। সুবিধা বাদী।। রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া আমরা সংলাপ বলতে ভয় পাচ্ছি। আমরা একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছিনা, ভয় পাই তাই ওরা ভয় দেখায়। ভয় এমন একটা অস্ত্র যা দিয়ে গোটা মানব সমাজকে পঙ্গু করে রাখা যায়।
অঞ্জনা।। এসব কথা থাক। নিজের কথা ভাবো। একা তুমি কিছুই করতে পারবে না। কাল রাতে ওই ঘটনার পর, মাসিমা যে ডাক্তারকে ডেকে এনেছিলেন, তিনি বলেছেন, তোমাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।
সৌরভ।। (প্রবল হাসি) যাদের জেল আর পাগলা গারদে থাকা দরকার তারা ক্ষমতার অলিন্দে বসে আছে!!! আমাদের বলছে আমরা নাকি অসুস্থ। মাথা খারাপ হয়েছে গোটা সমাজের।
অঞ্জনা।। বি প্রাক্টিক্যাল সৌরভদা। তোমাকে আমরা এভাবে হারিয়ে ফেলতে চাইনা।
সৌরভ ।। কে বলছে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি? আমি খুঁজছি, শিল্পীকে খুঁজতে হয়! চেনা পথে শিল্পীকে হাঁটতে নেই! অচেনা পথ আবিষ্কার করে সবাইকে নিয়ে সেই সূর্য ওঠা সকালকে আবাহন করতে হয়!
অঞ্জন।। তোমার বাবাও ত এই ভাবে হারিয়ে গেছে।
সৌরভ।। হারিয়ে যায়নি। বাবাও নতুন পথের সন্ধান করতে গেছে। আমরা এখনো জানিনা কি সেই পথ!!!
অঞ্জন।। তাই যদি হয়, তাহলে তোমার মা বিধবার সাজ ধরেছিলেন কেন? তোমাকে দিয়ে তোমার বাবার শ্রাদ্ধ করানো হয়েছিল কেন?
সৌরভ।। বাবা যখন চলে যায়, তখন আমি সদ্য যুবক। আমার নিজস্বতা বলতে কিছু ছিল না। আজকের মত করে ভাবতে পারতাম না। প্রশ্ন জেগে উঠত। উত্তর খুঁজে পেতাম না। আজ বুঝতে পারি। উত্তর আছে। বাবা মরে নি। হয়তো বাবাকে ওরা কোথাও আটকে রেখেছে। বাবার উপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। ৭০ এর দশকে আমার বাবার মতন আরও অনেক মানুষকে এইভাবে ওরা নিরুদ্দেশ করে দিয়েছে।
অঞ্জনা।। আমি তোমার কথা সব বুঝতে পারি না। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? আমার জন্য কি তুমি—-
সৌরভ।। (প্রবল হাসি)
অঞ্জনা।। হাসছো কেন? তুমি কি বলবে, হ্যামলেট যেমন করে ওফেলিয়াকে ভালোবাসতো তুমি আমাকে সেই রকম ভাবে-
সৌরভ।। ওফেলিয়াকে খুন করেছিল হ্যামলেট—
অঞ্জনা।। তুমিও আমাকে খুন করবে?
সৌরভ।। করতেই পারি। তুমিতো জানো যে হ্যামলেট এর সময় ডেনমার্কে তখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চল ছিল। গুপ্তহত্যা, প্রকাশ্য সন্ত্রাস, অরাজকতা ব্যভিচার! এর মধ্যে কি বিশুদ্ধ প্রেম বাঁচতে পারে? তোমার কি মনে হয় না আজকে আমরা সেই রকম একটা বিষাক্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে টিকে আছি। চারিদিকে বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে প্রেম কি করে বাঁচবে? তাছাড়া, কোন সম্পর্ক চিরকালীন নয়! শাশ্বত কথাটা ভুল! সকালবেলা ফুল ফোটে বিকেলবেলা ঝরে যাওয়ার জন্য!
অঞ্জনা।। তাহলে আমরা সুখী নই? সুখ বলে কিছু নেই?
সৌরভ।। ছোট ছোট সুবিধা পাওয়াকে তোমরা সুখ বল। তোমরা তো গোটা জীবনটাকে উপভোগ করতে চাও না। অখন্ড জীবন। দুস্তর নদীর মত তরঙ্গ বিক্ষোভ ভরাজীবন। যে জীবন থামতে জানে না। যে জীবন বলে চলো সমুদ্রে। মহাসাগরে যে জীবনের উদ্বোধন ঘটে।
(ওদের কথাবার্তার মধ্যে সোমনাথ বাবু ফিরে আসবে)
সোমনাথ।। দরজাটা খোলা ছিল, তাই ঢুকে পড়তে পারলাম। তুমি দেখছি ভালই আছো।
সৌরভ।। আমি তো ভাল থাকার নাটক করি না। আমি পষ্ট করে বলতে চাই আমরা কেউ ভালো নেই। এইরকম একটা সমাজে শয়তানরা শুধু ভালো থাকে।
সোমনাথ।। আমি তোমার বাবার বন্ধু ছিলাম। তোমার বাবা আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল। তবুও আমরা কলেজ জীবনে, একটা সিগারেট, এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খেতাম। তোমার বাবা বিপদজনক পথে পা রেখেছিল। আমার সেই সাহস ছিল না। মেরুদন্ড সোজা করে হাঁটতে পারতাম না। তাই কেরানির চাকরি নিয়ে ঘাড় গুঁজে কলম পিষেছি। আলো বাতাশহীন ঘরের মধ্যে থেকে হাঁপানি ধরিয়েছি।
সৌরভ।। আপনি বসুন। গরম গরম কফি খাবেন?
সোমনাথ।। না বাবা। সময় হবে না। বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়েছি। তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরতে হবে। দশটার মধ্যে না গেলে বাজার উঠে যাবে।
সৌরভ।। আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন?
সোমনাথ।। হ্যাঁ। তুমি একটু সাবধানে থেকো। এই পাড়ায় তোমাকে নিয়ে কানাকানি হয়।
সৌরভ।। জানি তো। যে কোন মুহূর্তে আমাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করতে পারে।। দেশদ্রোহীর তকমা লাগাতে পারে। কারন আমি লকডাউন মানি না।। ভাইরাস ভীতি আমার নেই। আমি চিৎকার করে বলি, যা চলছে এরই নাম ফিয়ার বিজনেস।
সোমনাথ।। কাল রাতে তোমার এই ঘর থেকে গুলির শব্দ অনেকেই শুনেছে। আমি কথা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করে নি।
সৌরভ।। কেন করবে বলুন? ওরা তো আমাকে চেনে। আমি যে হ্যামলেট হয়ে ওদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছি। এটাই তাদের রাগ।
সোমনাথ।। হ্যাঁ। ঠিক করছো। এত বড় দেশে, আমাদের এই শহরে, কোথাও এতটুকু আলো দেখতে পাচ্ছি না। শ্মশান আর কবরের নিস্তব্ধতা নিয়ে আমাদের রাত জাগতে হয়।
সৌরভ।। আপনি বসুন। আপনি বোধ হয় আমাকে কিছু অন্য কথা বলতে এসেছেন—
সোমনাথ।। হ্যাঁ। কেমন করে সেই কথাটা বলব বুঝতে পারছি না।
অঞ্জনা।। আপনি বলুন। আমরা আপনার জন্য কি করতে পারি-
সৌরভ।। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে হচ্ছে আপনার বাড়িতে কোনো বিপদ হয়েছে-
সোমনাথ ।। তোমার কাকিমার ডেড বডিটা নিয়ে তিন তিনটে দিন বসে আছি।
(ভয়ংকর আবহ সংগীত আসবে!! সবাই চমকে উঠবে)
সৌরভ।। সেকি!!!
অঞ্জনা।। বসে আছেন কেন?
সৌরভ।। কাকিমার কি হয়েছিল? কবে মারা গেছে?
সোমনাথ।। তিন রাত আগে। প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল। আমার ছেলে মেয়েরা কেউ তো আমার সঙ্গে থাকে না। ওদের ফোন করেছিলাম। কেউ আসেনি। জ্বরের পরের দিন পুলিশ এসে আমাদের বাড়িতে সিল করে দিয়ে গেছে।
অঞ্জনা।। ডাক্তার আসেনি? পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেনি কেন?
সৌরভ।। পাড়ার মাতবর গুলো কি করছে?
সোমনাথ।। কেউ আসেনি। কেউ আসবে না। কেউ আসে না।
সৌরভ।। (আবার সেই অদ্ভুত হাসি। তারপর আর্তনাদের মতো বলে উঠবে) কি অদ্ভুত আঁধার নেমেছে এই শহরে, এই দেশে!!! কোথাও কোন মানুষের অবয়ব নেই! পশুরাও এমন পশু হয়ে উঠতে পারে না!!!
সোমনাথ।। (হু হু করে কান্না)
মাসিকেও দেখা যাবে এই কম্পোজিশন এর মধ্যে। আবহসংগীত এ বেদনার সুর বেজে উঠবে)
কয়েকদিন পরের ঘটনা। রাত গভীর। নিজের ঘরে সৌরভ মদ্যপান করতে করতে নাটকের সংলাপ বলছে।
সৌরভ । এ জগত মহা হত্যাশালা। জানো না কি প্রত্যেক পলক পাতে লক্ষ কোটি প্রাণী/চির আখি মুদিতেছে। সে কাহার খেলা? হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি। প্রতিপদে চরণেদলিত শত কিট- তাহারা কি জীব নহে? রক্তের অক্ষরে অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল/বিশ্ব পত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস।/ হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়/ হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কিট এর গহবরে / অগাধ সাগর জলে নির্মল আকাশে,/ হত্যা জীবিকার তরে, হত্যা খেলার ছলে,/ হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে-/ চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তারণে/ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে, মাসিমার সঙ্গে এক ভদ্রলোক আসবেন। লম্বা চওড়া স্বাস্থবান পুরুষ। পঞ্চাশের মতো বয়স। সুট পরনে।
মাসি।। বাবু, এই ভদ্রলোক তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
সৌরভ।। কে আপনি?
লোক।। আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে আসছি। আমাকে আপনি মিস্টার মিত্র বলতে পারেন।
সৌরভ।। ক্রাইম ব্রাঞ্চ? এ বাড়িতে কোন ক্রাইম হয়েছে কি?
মিত্র।। সেটাই তদন্ত করতে এসেছি।
সৌরভ।। স্বচ্ছন্দে করতে পারেন।
মিত্র।। 5 দিন আগে আপনাদের সামনের বাড়ির সোমনাথ রায়ের স্ত্রীকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলেন?
সৌরভ।। গিয়েছিলাম।
মিত্র।। ডেথ সার্টিফিকেট ছিলনা নিশ্চয়?
সৌরভ।। সেটা আমার জানার কথা নয়। প্রতিবেশীর বাড়িতে একজন বিনা চিকিৎসায় মরে পড়ে আছে। মরাটা তিনদিন ধরে বাড়িতে পড়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। পুলিশ ও না।
মিত্র।। থানায় জানানো হয়েছিল?
সৌরভ।। শুনেছিলাম জানানো হয়েছিল। থানা স্টেপ নেইনি।
মিত্র।। আমরা জানতে পেরেছি, ফলস ডেথ সার্টিফিকেট দেখিয়ে মরাটাকে পোড়ানো হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় কথা, কোভিড প্রটোকল মানা হয়নি।
সৌরভ।। (হাসি) এই যে আপনি আমার বাড়িতে ঢুকেছেন, প্রটোকল মেনে ঢুকেছেন? মরাটা ওই বাড়িতে আরো কিছুদিন রেখে দিলে কি প্রটোকল মানা হতো?
মিত্র।। সোমনাথ রায়কে আমরা এরেস্ট করেছি। আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নেই অন্তত এই ক্ষেত্রে। তবে—-
সৌরভ।। সোমনাথ কাকাকে এরেস্ট করেছেন!! ওই বৃদ্ধ মানুষ যার সম্প্রতি স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে!! অ্যারেস্ট করে কোথায় রেখেছেন? যেখানে রেখেছেন সেখানে প্রটোকল মানা হচ্ছে নিশ্চয়ই?
মিত্র।। সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দিতে বাধ্য নই।
সৌরভ।। তাহলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ টা কি?
মিত্র।। অভিযোগ একটা নয়। অনেকগুলো। আপনার বাড়িতে বেআইনি একটা রিভলবার রয়েছে।
সৌরভ।। ওটা আমার বাবার।
মিত্র।। লাইসেন্স আছে?
সৌরভ।। বাবা লাইসেন্স করেছিলেন।
মিত্র।। রিনু করা হয়নি নিশ্চয়।
সৌরভ।। না।
মিত্র।। রিভলবার টা কালকের মধ্যে থানায় জমা দিতে হবে।
সৌরভ।। তারপর?
মিত্র।। ডাক্তার প্রবীর দত্তকে আপনি খুনের হুমকি দিচ্ছেন?
সৌরভ।। লোকটা আমার মায়ের খুনি।
মিত্র।। সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। ডাক্তার প্রবীর দত্ত র বিরুদ্ধে মামলা করেছেন?
সৌরভ।। না।
মিত্র।। ডাক্তার দত্ত আপনার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
তারপর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা খবর পেয়েছি, ৭/৮ দিন আগে তার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল!
সৌরভ।। তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।
মিত্র।। আমাদের কাছে খবর আছে, ডাক্তার দত্ত কে আপনি এখানে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
সৌরভ।। মিথ্যা কথা।
মিত্র।। আমরা প্রমান পেয়েছি, আপনার মাসিমা অসুস্থ এই খবর তাকে জানিয়ে আপনি এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। তারপর আপনার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। তখন আপনি গুলি করে মেরে ছিলেন।
সৌরভ।। মিথ্যে কথা। সম্পূর্ণ ভুল। কোন প্রমাণ নেই।
মিত্র।। প্রমাণ আছে সৌরভ বাবু। আপনার প্রতিবেশীরা প্রমাণ করে দেবে।
সৌরভ।। আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন?
মিত্র।। সেটাই স্বাভাবিক।
সৌরভ।। ওয়ারেন্ট আছে?
মিত্র।। এখন জরুরি অবস্থা চলছে। স্পেশাল আইন রয়েছে। উইদাউট ওয়ারেন্ট, যেকোনো সময়, যেকোনো সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আমরা তুলে নিয়ে যেতে পারি। 6মাস পর্যন্ত বেল পাওয়া যাবে না।
সৌরভ।। তাহলে তাই করুন।
মিত্র।। হ্যাঁ, সেই রকম করার জন্য আমার উপর নির্দেশ আছে। তবে- আপনাকে আমি সুযোগ দিতে চাই। সুযোগ।
সৌরভ।। কারণ?
মিত্র।। দেখুন, আমরা রাষ্ট্রযন্ত্রের নাট বল্টু। কোন একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারক আমাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, আমরা হলাম সংগঠিত গুন্ডাবাহিনী। আমাদের সম্পর্কে কার্ল মার্কস বলেছিলেন, আমরা অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আওতায় পুলিশ মিলিটারি আইন-আদালত এগুলো হলো রাষ্ট্রযন্ত্রের পাহারাদার। তবে আমাদের সিস্টেমটা যতই খারাপ হোক না কেন। অমানবিক হোক না কেন, এই সিস্টেমের মধ্যে আমরা চাকরি করি, তাদের সবাই ব্যক্তিগতভাবে গুন্ডা নয়। জল্লাদ নয়। যেমন আপনার বাবা ছিলেন না। চাকরি বাঁচাবার জন্য আমারা অনেক কিছু করতে বাধ্য হই। তার মধ্যেও আপনাদের মত মানুষদের জন্য আমরা ব্যক্তিগতভাবে কন্সেশন দিতে প্রস্তুত।
সৌরভ।। মানে? কি বলতে চান আপনি? আমাকে অ্যারেস্ট করবে না?
মিত্র।। আপনি ভালো অভিনেতা। আপনার অভিনয় আমি দেখেছি। আপনি লিখেন ভালো। আপনার কবিতা পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার স্ত্রী একসময় আপনার সঙ্গে ইউনিভার্সিটির ছাত্রী ছিল। বিশাখা আমাকে আপনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছিল।
সৌরভ।। বিশাখা মজুমদার? রাস বিহারী তে থাকতো? শুনেছিলাম পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ।নিজেও ভালো কবিতা লিখত।
মিত্র।। আপনার কেস রিপোর্ট স্টাডি করে আমার মনে হয়েছে, আপনি শেক্সপিয়ারের নাটকের হ্যামলেট এর মত দিশাহীন। আপনার বাবার মধ্যে ও ছিল এক ধরনের পাগলামী। দুম করে পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। নইলে পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত উঠে যাবার সুযোগ তার ছিল।
সৌরভ।। বাবাকে বাধ্য করা হয়েছিল চাকরি ছাড়তে। ছত্রিশগড়ে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বাবাকে ট্রান্সফার করা হয়েছিল। ওখানকার একটা বনাঞ্চল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা চলছিল। বাবা সেই কাজ করতে চাননি। বাবার যুক্তি ছিল, আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না।
মিত্র।। এটাই তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। আপনার নাটকগুলো সেই কারণে রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলে বোধহয়?
সৌরভ।। নাটক মানেতো প্রতিষ্ঠানবিরোধী কথা বলা। শেক্সপিয়ার থেকে এই ঐতিহ্য শুরু হয়েছে।
মিত্র।। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এক ধরনের পাগলামী। যেমন আপনি বারবার করে বলে আসছেন আপনার মা কে খুন হন করা হয়েছিল। বাস্তবটা ছিল অন্যরকম। Covid-19 তার মৃত্যু হয়ে ছিল।
সৌরভ।। না। আমার মায়ের ভুল চিকিৎসা হয়েছিল। পরপর তিনদিন আর টি পি সি আই টেস্ট নেগেটিভ ছিল। ডাক্তার প্রবীর দত্ত র নার্সিংহোমে ভুল চিকিৎসা হয়েছে। আইসিইউতে রেখে দশ দিনের জন্য 25 লক্ষ টাকা ডিমান্ড করা হয়েছিল।
মিত্র।। আপনি তো কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না।
সৌরভ।। আমাকে না জানিয়ে কেন আমার মায়ের ডেড বডি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে?
মিত্র।। আপনাকে জানালে কি করতেন?
সৌরভ।। পোস্টমর্টেম করতাম।
মিত্র।। সরকার সেটা অনুমোদন করে না।
সৌরভ।। কেন করে না? কেন লাশগুলোকে পেশেন্ট পার্টির কাছে না দিয়ে হাপিস করে দেওয়া হচ্ছে? যদি কোন পেশেন্ট পার্টি পোস্টমর্টেম করতে চায় তাহলে কেন তার সন্দেহ মুক্ত করা হবে না?
মিত্র।। সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই সব দাবি করা যায় কি?
সৌরভ।। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, জনৈক আমেরিকান দম্পতি র সঙ্গে উল্টো রকম ঘটেছিল। মৃত স্ত্রীর পোস্টমর্টেম করে জানা গিয়েছিল, কোভিদ ভাইরাস এ মৃত্যু ঘটেনি।
মিত্র।। তাহলে তো হাজার হাজার ডেড বডি পোস্টমর্টেম করতে হয়!!
সৌরভ।। দেশের বহু বিজ্ঞানী সেটাই তো চাইছেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে প্রতিটি মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেম করা দরকার। তাহলে সরকার কেন আপত্তি করছে?
মিত্র।। এসব ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ আপনি। কি করে ডিফেন্ড করবেন নিজেকে? আপনার বিরুদ্ধে তো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যেমন ধরুন, আপনার দলের অনেকে অভিযোগ করেছেন। এমনকি আপনার নতুন প্রেমিকা অঞ্জনা দেবীও আমাদেরকে জানিয়েছে যে, আপনি সোজা পথে নেই। সরকারবিরোধী অ্যাক্টিভিস্ট-
সৌরভ।। অঞ্জনা এসব বলেছে?
মিত্র।। আপনার মায়ের ছোট বোন অর্থাৎ আপনার মাসি, যে মহিলা কত দেড় বছর ধরে এখানে রয়েছে ন। আপনার দেখাশোনা করছেন। তিনিও বলছেন, আপনি তাকে জোর করে আটকে রেখেছে ন। আপনার আচরণ সন্দেহজনক। কিছুদিন আগে আপনার এই ঘর থেকে গুলির আওয়াজ পাওয়া গেছে। আপনার মাসি তখন ছুটে এসে ছিল। আপনি মাসির কাছে স্বীকার করেছিলেন যে ডাক্তার প্রবীর দত্তকে আপনি খুন করেছেন
সৌরভ।। মাসিও আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে-
মিত্র।। তাহলেই বুঝে দেখুন। যাদের জন্য লড়াই করছেন, এই প্যানডেমিক সিচুয়েশনে, মানুষের মানবাধিকার, সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য এত যে ফেসবুক বিপ্লব করছেন, সেমিনার করছেন, নাটক লিখছেন, তার পরিণাম উল্টো হয়ে যাচ্ছে।
সৌরভ।। (দিশাহীন বিপন্নতায় ছটফট করতে থাকে) আপনি যা বলছেন, ঠিক বলছেন? প্রমাণ করতে পারবেন? আমার মাসি, আমার বান্ধবী অঞ্জনা আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে? আপনি প্রমাণ করতে পারবেন এসব কথা?
মিত্র।। আমাকে কোন কিছুই প্রমাণ করতে হবে না। সব প্রমান একটু একটু করে আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। আপনার বাড়ির সামনে সোমনাথ বাবু পুলিশি জেরায় স্বীকার করেছেন, তার মৃত স্ত্রীর বেআইনি ডেথ সার্টিফিকেট আপনি তাকে জোগার করে দিয়েছেন। তিনি এবং আরও কেউ কেউ থানায় অভিযোগ করে বলেছেন, ডক্টর প্রবীর দত্ত কে আপনি যে খুন করে এই দোতলার বারান্দা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলেন, তারা দেখেছে।
(ভয়ংকর আবহ সংগীত আসবে)
সৌরভ।। (আবার সেই অদ্ভুত হাসি এবং মদ্যপান)
মিত্র।। আপনারা লেখাপড়া করা মানুষ। ইংরেজি-বাংলা আরো কত ভাষার মোটা মোটা সব বই পড়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করেছেন। রাষ্ট্র কিন্তু আপনাদের ভয় পায়। রাষ্ট্র চায় আপনাদের আনুগত্য। পরিবর্তে রাষ্ট্রের কাছ থেকে আপনারা পেতে পারেন অসীম ক্ষমতা, আর্থিক সুবিধা। উল্টো দিকে দেখুন, আপনারা যাদেরকে জনগণ বলেন, দেশের নাগরিক বলেন, মানবসম্পদ বলেন। আসলে তারা মানুষরূপী এক ধরনের প্রাণী। ওরা অভ্যাসবশে চাষ করে, কলকারখানাতে মেশিন চালায়, মৈথুন করে, নারী সঙ্গম করে, বংশবৃদ্ধি করে, রাতের বেলা ভোস ভোস করে ঘুমায়। একই রকমভাবে অভ্যাসবশত নাচতে নাচতে ভোট দিতে যায়। কাকে ভোট দিচ্ছে, কাকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তুলে আনছে, কেন আনছে কোন কিছুই বাদ বিচার করে না। ওদের সামনে গিয়ে যারা ভোট চায়, তারাও জানে ভোটার গুলোকে কিভাবে নাচাতে হয়। সম্মোহিত করতে হয়। এই এদের জন্য আপনারা কেন জীবন বিপন্ন করছেন? ভাবুন! লক্ষ বার ভাবুন! আজ আমি চলি!
সৌরভ।। দাঁড়ান।
মিত্র।। বলুন-
সৌরভ।। আমাকে অ্যারেস্ট না করে চলে যাচ্ছেন?
মিত্র।। বললাম তো সুযোগ দিলাম। রাষ্ট্র যন্ত্রটা অবহেলার বস্তু নয়। ব্যবহার করার চেষ্টা করলে দেখবেন, অসাধারণ প্রতিদান পেতে পারেন।
সৌরভ।। আপনার স্ত্রী বিশাখা মজুমদার, আমার সম্পর্কে আর কোন কথা বলেনি?
মিত্র।। বলেছে। আপনাকে খুব পছন্দ করত। আপনি ওকে পাত্তা দিতেন না। হয়তো এই কারণেই আজও বিশাখা আপনার কথা ভাবে। কিছুতেই ওর মন থেকে আপনাকে মুছে খেলতে পারছে না।
সৌরভ।। আপনার স্ত্রীর মনের ভাব জানবার পর, আপনার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই?
মিত্র।। না। আসলে আমাদের চাকরিটাই এমন যে, ঘর সংসার স্ত্রী ছেলে মেয়ে এদের দিকে মন ও সময় দেবার অবকাশ থাকে না।
সৌরভ।। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রের নাট বল্টু হয়ে আপনাদের মধ্যে থেকে মানুষ নামক জীবনটা যন্ত্র হয়ে পড়ে।
মিত্র।। সেটাই স্বাভাবিক। মানুষের মন নিয়ে কি হবে সৌরভ বাবু? মন নিয়ে কি মরব নাকি শেষে? (হাসি) বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত গানটা প্রথম যৌবনে শুনেছিলাম! আর তখনই ঠিক করেছিলাম, জীবন তো একটাই! শরীরও একটা! চিতার আগুনে ছাই হয়ে যাওয়ার আগে শরীরটাকে নিয়ে জাগতিক যত রকম উপভোগ রয়েছে করে যেতে হবে! একবার হারিয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না!
সৌরভ।। চমৎকার বলেছেন। আপনি আমাকে সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার আমাকে তো করতে হবে। তবে যাবার আগে অফিশিয়াল ডিউটি মেন্টেন করবেন না?
মিত্র।। করলাম তো।
সৌরভ।। রিভলবারটা নেবেন না? ওটা বোধহয় আমার কাছে থাকা এখন থেকে বেআইনি-কি বলেন?
মিত্র।। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা আমি নিয়ে যেতে পারি। থানায় জমা থাকবে। রিনু করে নেওয়ার পর আপনি আবার ফেরত নিতে পারেন।
সৌরভ।। (রিভলবারটা বার করে) বাবা এটাকে কেন যে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল, জানিনা! হয়তো কোন ইঙ্গিত ছিল! আমার জন্য কোনো ইঙ্গিত! আমি জানতাম না এটার কথা! কিছুদিন আগে বাবার ফেলে রাখা অনেক জিনিস ঘাটাঘাটি করতে করতে এটা বেরিয়ে এলো! ম্যাগাজিনে ছটা গুলি ছিল! প্রবীর দত্ত কে খুন করার সময় তিনখানা ব্যবহার করা হয়েছিল! এখনো তিনখানা রয়েছে! আরও দুজনকে মারবো বলে ভেবে রেখেছি! এখন মনে হচ্ছে, আপনাকে মানে, রাষ্ট্রযন্ত্রের নাট বল্টু টা কে পৃথিবী থেকে সরাতে না পারলে- (পরপর তিনটি গুলি করবে)
মিত্র গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাবে। সৌরভ হাসতে থাকবে। দরজা খুলে ছুটে আসবে মাসি।
মাসি ।। আবার কি হলো? গুলি চালালি কেন?
সৌরভ।। বেশ করেছি। যদি ভালো চাও তো সরে যাও, এখনো একটা গুলি রয়ে গেছে। আমার খুন চেপে গেছে।
মাসি।। কি কি যা তা বলছিস?
সৌরভ।। ছি ছি ছি মাসি, তুমি ও আমার নামে পুলিশের কাছে নালিশ করেছ!!
মাসি।। আমি আবার কখন পুলিশে র কাছে নালিশ করলাম?
সৌরভ।। তুমি করেছ, সোমনাথ কাকা করেছে। অঞ্জনা করেছে। সবাই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছ। পাড়া-প্রতিবেশী আমার বিশ্বস্ত বন্ধুবান্ধব সবাই–
মাসি।। রোজ রোজ রাতে তোর কি হয় বলতো? মদ খেয়ে কী সব পাগলের মতন বলিস আর করিস?
সৌরভ।। তোমরা সবাই মিলে আমাকে পাগল বানিয়েছ। ডাক্তার প্রবীর দত্ত কে যেমন খুন করেছি। এইমাত্র পুলিশ অফিসার মিস্টার মিত্র কে ও– সেই ডাক্তারবাবু সোমনাথ বাবু এবং অঞ্জনা ছুটে আসবে।
সবাই।। কি হয়েছে? আমার কি হলো? আবার গুলি চলছে কেন.?
মাসি।। এই দেখুন আপনারা সবাই, আমি তো আর পারছি না
সোমনাথ।। আবার কাকে গুলি করলে সৌরভ?
ডাক্তার।। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?
সৌরভ।। লাশ টা খুঁজে পাচ্ছিনা কেন?
অঞ্জনা।। কার লাশ?
সোমনাথ।। কার কথা বলছো?
সৌরভ।। ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে এসেছিল। মাসি এই লোকটাকে ডেকে নিয়ে এসেছিল।
মাসি।। আমি আবার কাকে নিয়ে এলাম?
সৌরভ।। তুমিতো নিয়ে এলে। আমাকে ভয় দেখাল। আবার লোভ দেখালো-
অঞ্জনা।। হ্যালুসিনেশন
সৌরভ।। লোকটার বদ মতলব ছিল। আমি ধরে ফেলেছিলাম। তাইতো রিভলভার থেকে গুলি বেরিয়ে গেল-
ডাক্তার।। শান্ত হয়ে বস তো। মাথা ঠান্ডা করো সৌরভ। তোমার বোধ হয় অলীক স্বপ্নদর্শন ঘটেছে।
সৌরভ।। বিশ্বাস করুন আমার রিভলভার থেকে পরপর দুটো গুলি আমি –
সোমনাথ।। আমরা গুলির শব্দ পেয়েছি। তাইতো ছুটে এলাম।
অঞ্জনা।। এখানে কোন লাশ পড়ে নেই সৌরভদা। এখানে কেউ আসেনি। কাউকে তুমি গুলি করনি
ডাক্তার।। তুমি রোজ রোজ রাতে মদ খেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ছো। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে বুঝলেন।
সৌরভ।। লোকটা যে আমাকে বলল, আমার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তোমরা সবাই থানায় ডায়েরি করেছ।
মাসি।। ওকে এবার পাগলা গারোদে পাঠাতেই হবে। এছাড়া আর কোন পথ নেই।
অঞ্জনা।। সৌরভ দা সৌরভ দা তুমি তুমি শান্ত হও। আমার কথা শোনো। উদ্ভট কল্পনার জগতে কেন বারবার চলে যাচ্ছো? আমি বা তোমার এই মাসি তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করব কেন? পৃথিবীর সবাইকে তুমি ষড়যন্ত্রকারী ভাবছো কেন? শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় চারপাশের সব কিছুকে বোঝার চেষ্টা করো। তোমার নাটকেই তো বলা আছে যে ওরা আমাদের মধ্যে সন্দেহের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে যায়। অবিশ্বাসের বাঁতাবরণ তৈরি করে।
সৌরভ।। (চিৎকার করে ওঠে) তুমি কি বলতে চাও ওরা আমার মাকে খুন করেনি?
অঞ্জনা।। সেটা প্রমাণ করার জন্য তোমাকে শান্ত হতে হবে। পাগলের মতো আচরণ করলে কোন কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না।
সৌরভ।। (আবারও চিৎকার করে ওঠে) না না না না যারা শান্ত থাকে তারা শয়তান। নিজেদের যারা সুস্থ মনে করে তারা হয় বোকা নয় রাক্ষসের মত ভয়ংকর দানব। কথাটা আমার বাবা অনেক আগেই বুঝেছিলেন—–
অঞ্জনা।। আর ঠিক এই কারণেই তিনি শহীদের মর্যাদাও পেলেন না—-! ওই পথটা ভুল পথ!!
সৌরভ।। না না না। চোখের সামনে নিজের বাবা-মাকে খুন হতে দেখেও যারা শান্ত থাকার অভিনয় করে আমি তাদের কেউ নই। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। আমাকে তোমরা শান্ত হতে বোলো না। আমার মধ্যে হ্যামলেটের আত্মা যখন জেগে ওঠে তখন আমি সত্যিটা দেখতে পাই। আমি তোমাদের মতন অভিনয় করতে পারবো না। পারবো না পারবো না।
আচমকা রিভালবার নিয়ে শূন্যে গুলি করার চেষ্টা। করে । ডাক্তার বাবু এবং সোমনাথ বাবু রিভালবারটা কেরে নেবার চেষ্টা করলে ধস্তাধস্তির মধ্যে গুলি চলে গেল। সেইগুলিতে সৌরভের বুকটা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। রক্তাক্ত সৌরভ মাটিতে পড়ে যায়। সবাই হতবাক। মাসি কেঁদে ওঠে। ডাক্তারবাবু পাগলের মত ফোন করবার চেষ্টা করে, অ্যাম্বুলেন্সের জন্য।
সৌরভের মৃত্যু ঘটে।
সব শেষে মৃত্যুর কোলাহল থেকে রিভালবারটা হাতে তুলে নেয় অঞ্জনা। শেষ গুলিটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেবে।
পর্দা নেমে আসবে।
—————————————
বিদ্র – নাটকের সমস্ত রকম আইনি অধিকার নাট্যকারের।
লিখিত অনুমতি ছাড়া অভিনয় করা যাবে না।