ডালিয়া চৌধুরী
নাট্যকার মৃণাল দে রচিত অণুনাটকের সম্ভার নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো এক সন্ধ্যায় থিয়েটারে মৃণাল। সম্প্রতি জপুর সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ তৃপ্তি মিত্র সভাঘরে আয়োজন করে এক অণুনাটক উৎসব। মোট ৭ টি নাট্যদল মৃণাল দে রচিত অণুনাটক মঞ্চস্থ করে।
ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের নাটকগুলির মধ্যে ছিল, ‘ভয় এবং ভয়’ (দমদম সংবেদ)। এই নাটকে এক কিশোরী স্কুল বাসের চালক ও হেল্পার দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এই কথা জানতে পারলেও প্রাথমিকভাবে তার পুলিশকর্মী বাবা ও অফিসকর্মী মা সমাজে ও স্কুলে মেয়ের বদনামের ভয়ে কোনো অভিযোগ আনতে পারে না বা স্কুলেও জানাতে পারে না। অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতার এই ভয় অবশেষে তাঁরা জয় করেন।
‘কুলগ্ন’ (জপুর সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ) নাটকে এক পরিবারে একদিকে বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা ও তাঁর শিক্ষা দীক্ষা আদর্শ মেনে চলা ছোট ছেলে ও অন্যদিকে লোভী উচ্চাকাঙ্ক্ষী বড় ছেলের সংঘাত ও দ্বন্দ্বকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন অভিনেতারা। এ নাটকে শেষে আদর্শেরই জয় হয়।
মামার ধামা (বাকসা ব্রাত্য নাট্যজন) নাটকে চার ভাইবোন ফাঁকা বাড়িতে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি দুস্টুমি খেলাধুলা করে। এমন সময় তাদের মামা এসে হাজির হয়। তারা অফিস ফেরত মামার জন্য নানারকম খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলেও বারবার কোনো না কোনো কারণে সে খাবার খাওয়া হয় না। এই নিয়েই মজার এক একটা কান্ড নিয়ে হাস্যরসের এই নাটক জমে ওঠে।
‘অপলাপ’ (ক্রান্তিকাল, সোদপুর) নাটকটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তাসের ঘর’ গল্প অবলম্বনে রচিত। এটি নাটক মানুষের অদ্ভুত মনস্তত্ত্বকে তুলে ধরেছে। সদ্য বিবাহিত মেয়েটি শ্বশুরবাড়িতে বাপের বাড়ির সম্বন্ধে আর বাপেরবাড়ি গিয়ে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে বড় বড় কথা বলতে ভালোবাসে। এতে দুই বাড়িতেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবশেষে তার এজাতীয় আচরণ যে সবাইকে বড় করে দেখানো ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, তা বুঝতে পারে।
‘খুড়ো’ (বরানগর দৃশ্যকাব্য) নাটকটি বনফুলের গল্পের নাট্যরূপ। এই নাটকে প্রধান চরিত্র খুড়ো আদ্যন্ত একজন শিল্পী একজন সাধক। তাই তাঁর সাংসারিক বিষয়, ও দারিদ্য কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না। গ্রামের লোকজন এরকম উদাসীন খ্যাপাটে মানুষটির ওপরে বিরক্ত হলেও তাঁকে ভালোবাসে। তাঁর সংসারের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে এরকমই গ্রামের এক যুবক আসন্ন শীতের লেপ তোষক বানানোর জন্য খুড়োকে টাকা দিলে খুড়ো সেই টাকায় তাঁর বহুদিনের অভিষ্ঠ একটি একতারা কিনে আনে। আসলে প্রকৃত শিল্পীই দুঃখ দারিদ্য ভুলে তার শিল্পকেই আঁকড়ে ধরে। যুবকটি শিল্পী মনের খুড়োর এই আদর্শের কাছে হার মানে। তাঁকে তিরস্কারের বদলে শেষে খুড়ো আর যুবকের দ্বৈতকণ্ঠে সুরের মূর্চ্ছনা যেন শিল্পের জয়গান করে।
‘জলই জীবন’ (ঐকতান, দক্ষিণেশ্বর) একটি সমাজসচেতন মূলক নাটক। নাটকের কলাকুশলীরা এক পাগল চরিত্রের দ্যোতকে জলের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেছেন।
‘অমল আলো’ (সাউন্ড ক্রিয়েশন) নাটকটিও সমাজ সচেতনমূলক। এক কিশোরী মায়ের সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে জীবন সংশয় দেখা দেয়। নাবালিকা বিয়ের কুফল এই নাটকের মূল উপজীব্য। এই বার্তা দিয়েই নাটক শেষ হয়। প্রতিটি নাটক দর্শকনন্দিত হয়েছে।
এরই মাঝে ছিল ‘মৃণাল দের অণুনাটক ও থিয়েটারে মৃণাল’ বিষয়ক আলোচনা। বক্তারা ছিলেন সৌমিত্রকুমার চ্যাটার্জি ও গৌতম ভট্টাচার্য্য। মৃণাল দে-র সুহৃদপ্রতীম গৌতম ভট্টাচার্য্য তাঁর বক্তব্যে মৃণাল দের প্রায় ৫০ বছরের নাট্যচর্চার কথায় তাঁর লড়াই ও মানবিক মৃণাল দে কে তুলে ধরলেন। অপর বক্তা নাট্যকার নির্দেশক অভিনেতা সৌমিত্রকুমার চ্যাটার্জী মৃণাল দের বেশ কিছু অনবদ্য নাটকের উল্লেখ করে, সংক্ষিপ্তভাবে তার প্রাসঙ্গিকতাকে তুলে ধরেন। নাট্যকার শ্রী মৃণাল দে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জপুর সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণকে ও উপস্থিত দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
জপুর সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গনের পক্ষ থেকে গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আশা করা যায়, তাদের এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে অণুনাটক চর্চাকে আরো জনপ্রিয় ও উজ্জ্বলতর করে তুলবে।