“মাভূমি” গৌতম ঘোষের একটি স্বল্প আলোচিত ছবি

- Advertisement -

সুব্রত রায়

১৯৭৪ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে তৈরি করেন অসামান্য এক তথ্যচিত্র “Hungry Autumn”। এই তথ্যচিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষের নির্মমতা তুলে ধরলেন তাই নয়, তার সাথে তুলে ধরলেন এই দুর্ভিক্ষের কারণ এবং তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্যরূপ। ছবিটিকে বাংলা তথা ভারতীয় ছবির জগতে এক অসামান্য ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে আজও গণ্য করা হয়। ১৯৭৬ সালে ছবিটি প্রকাশ্যে আসে এবং সারা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

ছবির মূল চরিত্র রামাইয়া একজন অল্পবয়স্ক ভুমিহীন কৃষক। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের হায়দ্রাবাদ রাজ্য ছিল নিজামের শাসনাধীন। তৎকালীন নিজাম কৃষকদের কাছে চড়া হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারদের জায়গীর প্রদান করে এবং তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় তাদের অঞ্চলের শাসন ব্যাবস্থা পরিচালনার। এই সকল জমিদাররা ছিল মূলত ধনী এবং উচ্চবর্ণের। তৎকালীন তেলেঙ্গানা অঞ্চলের জনসংখ্যার বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন দলিত ভূমিহীন কৃষক। ছবিতে রামাইয়া হল সেই প্রকার একটি চরিত্র। জমিদার চড়া হারে খাজনা আদায় করতে শুরু করলে দলিত ভূমিহীন কৃষকরা আন্দোলন শুরু করে এবং খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। জমিদার বাহিনী শুরু করে কৃষকদের উপর নির্মম অত্যাচার। চলতে থাকে নির্দ্বিধায় ঋণ, লুট, ধর্ষণ। রামাইয়ার স্ত্রী ধর্ষিত হয় সেই সময় তৎকালীন CPI(Communist party of India) তেলেঙ্গানা অঞ্চলের দলিত ভূমিহার কৃষকদের নিয়ে তৈরি করে সশস্ত্র বাহিনী। রামাইয়া সেই বাহিনীতে যুক্ত হয়। গেরিলা কায়দায় সেই সশস্ত্র আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যে। অত্যাচারী নিজাম তার সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী পাঠিয়ে এই আন্দোলনকে বলপূর্বক থামাবার চেষ্টা করে। ফলে অত্যাচারের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভারতের পুলিশ বাহিনী রাজাকারদের নিজামশাহীর এই অত্যাচার বন্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে ভারত সরকার মিলিটারি পাঠিয়ে রাজাকার বাহিনীকে নিকেশ করে ও নিজামশাহীর এই অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটে।

“Hungry Autumn”এর মধ্য দিয়ে গৌতম ঘোষ সারা বিশ্বের কাছে তাঁর চিন্তা, চেতনা এবং সৃষ্টিশীল মননকে যেন একটা রাজনৈতিক ছন্দে ও সুরে বেঁধে ফেলেছিলেন। তাঁর সামনে পড়েছিল গোটা উপমহাদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ইতিহাস যা তখনও পর্যন্ত প্রায় অধরাই পড়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন এই দেশের প্ৰকৃত ইতিহাস লুকিয়ে আছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে। উপলব্ধি করেছিলেন ওরা কাজ করে আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য ও নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমায় এই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা উঠে এসেছে বার বার। গৌতম ঘোষ কোনও ব্যাতিক্রম নন। মৃণাল সেন বার বার শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তাঁর ছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন এবং তার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্রকে সামনে এনেছিলেন। গৌতম ঘোষ এক্ষেত্রে অনেকটাই অন্যরকম। তিনি তাঁর কাজ শুরু করেন সমাজের সবথেকে নিচুতলার দলিত মজদুরদের লড়াইয়ের চিত্র থেকে। এক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনকে। কিশন চন্দরের একটি ছোট গল্পকে কেন্দ্র করে তৈরি করেন তাঁর প্রথম কাহিনীচিত্র “মাভূমি”(১৯৮০)।

কিন্তু তেলেঙ্গানা আন্দোলন তারপরেও চলতে থাকে। নিজামের রাজত্বকালে ধনীব উচ্চবর্ণের জমিদাররা কংগ্রেস পার্টির সাথে যুক্ত হয়। ছবির এই অংশটি রাজনৈতিকভাবে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রচরিত্র এবং সামন্ততন্ত্রের বিকাশের বিশ্লেষণে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন শাসন ক্ষমতা। শাসন ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন অর্থ। অর্থের জন্য প্রয়োজন জমিদারী প্রথা জমিদারের প্রয়োজন ক্ষমতা এবং এই ক্ষমতার জন্য প্রয়োজন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া। এ যেন এক মিথজীবী সম্পর্ক। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। একে অপরের পরিপূরক। এই সবকিছুর মধ্যে নিপীড়িত ভূমিহীন দলিত কৃষক। গৌতম ঘোষ ছবিটিতে ইতিহাসকে তুলে ধরার সাথে সাথে প্রতিনিয়ত এই সকল রাজনৈতিক প্রশ্নের সামনে মানুষকে তথা সমাজকে দাঁড় করিয়েছেন। ছবিটি প্রত্যেকটি মুহূর্তে মানুষকে ভাবতে বাধ্য করেছেন ছবিটি একটি কাহিনীচিত্র হলেও ছবির বিভিন্ন মুহূর্তে পরিচালক তেলেঙ্গানা কৃষক আন্দোলনের আর্কাইভ ফুটেজ ব্যাবহার করেছেন, যা ছবিটিকে অনেক বেশি জীবন্ত করে তুলেছে এবং জন্ম দিয়েছে এক ভিন্ন আঙ্গিকের নান্দনিকতার। ১৯৮০ সালে ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয় ভারতীয় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এবং ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় চলচ্চিত্র মহলে। তাছাড়া কার্লোভি ভ্যারি চলচ্চিত্র উৎসবে এবং কায়রো ও সিডনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি প্রদর্শিত হয় এবং ভীষণ ভাবে প্রশংসিত হয়।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -