বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৪
সবাই যে খুব ভেবেচিন্তে থিয়েটারে আসে, তা কিন্তু নয়। আবার থিয়েটারে এলেও সবাই যে থিয়েটারে থেকে যায়, তা কিন্তু নয়। অনেকেই স্কুল জীবনে অমল বা সুধা হয়ে প্রশংসা পায়, তাদের অনেকেই হারিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ পরবর্তীতেও থিয়েটারে আসে। উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের ছেলে সৌভিক মোদকের থিয়েটারে আসার গল্পটা বেশ চমকপ্রদ। থিয়েটার করবে বলে থিয়েটারে আসেনি সে। তার এক বন্ধু তাকে কথায় কথায় বলেছিল, জানিস, থিয়েটার করলে নানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার বেশ একটা সুযোগ হয়। বন্ধুর এই কথা শুনে আর নানা জায়গা ঘুরতে পাওয়ার লোভে সৌভিক থিয়েটারে এসেছিল। প্রায় ১৫ বছর তার থিয়েটারে থাকা হয়ে গেল। এখন থিয়েটারের সূত্রে কতটা ঘুরতে পারা গেল, সে হিসেব সৌভিক আর করে না। বরং থিয়েটারটা কতটা মন প্রাণ দিয়ে করা গেল – সেই হিসেবটাই সে করে। আর সেই হিসেবের খাতায় তার কাছে লাভের অঙ্কটাই বড় হয়ে উঠেছে। থিয়েটারে থাকতে থাকতে গভীরভাবে জড়িয়েছে থিয়েটারের সঙ্গে। বন্ধু অমিতের মাধ্যমে ঘুরতে পাওয়ার লোভে কলকাতার সবুজ সাংস্কৃতিক এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। সেই সৌভিক এখন বাংলা থিয়েটারের তরুণ প্রজন্মর উজ্জ্বল মুখ।
সবুজের THE NET ( নির্দেশক : রাজেশ দেবনাথ) নাটকে তার প্রথম অভিনয়। মূলত এই দলেই থেকে গেছে সৌভিক। তবে KOLKATA STC দলের একটি নাটকেও অভিনয় করেছে সৌভিক। তবে শুধু অভিনয় নয়, পাশাপাশি আলোক প্রক্ষেপণ ও আলোক পরিকল্পনার কাজেও নিজেকে দক্ষ করে তুলেছে। যে কয়েকটি নাটকে এ পর্যন্ত অভিনয় করেছে তার মধ্যে সৌভিকের প্রিয় চরিত্র হল SPOOK BOOK নাটকের গরিব আদমির চরিত্র তাকে খুব নাড়া দিয়েছে বলে সে জানিয়েছে। সে জানালো, এই নাটকের এই গরিব মানুষটি এমন একজন মানুষ, যারা কলকাতার সেই সব গরিব রিক্সাওয়ালা,যারা রাত্রিবেলা ফুটপাথে ঘুমায়,যাদের উচ্চ জাতের মানুষরা গরিব বলে এতটাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে যে,মৃত্যুর পরেও সে মনে করেছে সে মানুষ বা ভূত নয় – সে আসলে একজন গরিব মানুষই।যার জীবনের কোন দামই নেই। সৌভিক জানিয়েছে, এই চরিত্রে অভিনয় করতে করতে সে তার চোখে দেখা একটা চরিত্রের মিল খুঁজে পেয়েছিল।তাই নাটক তার কাছে জীবনেরই খণ্ডচিত্র।
থিয়েটারে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছে, রাজনৈতিক,সামাজিক,অর্থনৈতিক,শৈল্পিক,এবং অন্যান্য অনেক বিষয় বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ভাবে থিয়েটার জগৎকে প্রভাবিত করেছে এবং করছে। থিয়েটারকে গ্রামের থিয়েটার,শহরের থিয়েটার,মফস্বলের থিয়েটার হিসাবে দেগে দেওয়াটা তার পছন্দ নয়।তার মনে হয়, শৈল্পিক দিক থেকে থিয়েটার দেশ,রাজ্য,গ্রাম,শহর,মফস্বলের প্রাচীর মানে না। আসামের একটি নাটক দেখে এই ধারণা আরো গভীর হয়েছে তার মানে। সৌভিক জানিয়েছে, আসামের সেই নাটকের সংলাপ বা ভাষা সে বুঝতে না পারলেও নাটকের বক্তব্য তার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল।নানা মাধ্যমের সূত্রে অন্যান্য ভাষার নাটক দেখেও তার একই ধারণা হয়েছে। সেই নাটকগুলো মনে থাকলেও যে নাটকগুলো ভাল লাগেনি, সেগুলো সে মনেও রাখেনি।
নানা সুবিধায় পুষ্ট হয়ে অথবা অসুবিধাকে মেনে নিয়েও প্রতিনিয়ত থিয়েটার কর্মীরা যে থিয়েটার নিয়েই ভাবছেন, এই ব্যাপারটা তাকে থিয়েটারে থেকে যেতে সাহায্য করেছে।থিয়েটারে থাকতে থাকতে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। নানারকম রাজনৈতিক,অরাজনৈতিক মানুষ দেখলেও সৌভিক শেষ পর্যন্ত থিয়েটারেই থেকে গেছে।কিছু ব্যতিক্রম মানুষের জন্যই সে থিয়েটারে থেকে গেছে।নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বাধা বিপত্তির বেড়াজাল ভেঙে বিভিন্ন নাট্যদল এবং নাট্যশিল্পীরা যেভাবে থিয়েটার করে চলেছে সেই ব্যাপারটা তাকে প্রতি মুহূর্তে উৎসাহিত করে।
থিয়েটার করেও বাঁচা যায় বলেই মনে করে সৌভিক।সেক্ষেত্রে থিয়েটারকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে বলে সে জানিয়েছে।তার অভিনীত নাটকগুলি হল : THE NET,No, OR IT MAY BE, স্পার্টাকাস, অবাস্তব গল্প, রবি ঠাকুরের দুই নারী চরিত্র, এই বেশ ভাল আছি,লেডি ম্যাকবেথ, রাজা অয়দিপাউস,গালি দিবেননি কাক্কা মোমবাতি,SPOOK BOOK, একদিন সেইদিন ইত্যাদি। বাড়ির মানুষজন, মা- বাবা, বন্ধুরা এবং দলের নির্দেশক উৎসাহ দেয় তার থিয়েটারে। এখন বেড়াতে যাওয়ার মোহে নয় থিয়েটারকে ভালবেসেই থিয়েটার করে সে।