নৈতিক রায়
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের চিরন্তন এক অভিভাবক হিসেবে দর্শক মানসে জাজ্বল্যমান এক নাম ছবি বিশ্বাস (Chabi Biswas)। ১২৫ বছর আগে ঠিক আজকের (১৩ জুলাই) দিনে উত্তর কলকাতার এক বনেদী পরিবারে তার জন্ম। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বারাসাতের জাগুলিয়ায়। ‘দে বিশ্বাস’ জমিদার পরিবার। ‘দে’ তাদের পদবি ছিল। আর ‘বিশ্বাস’ তাঁর পূর্বপুরুষ পেয়েছিলেন আকবর বাদশাহের কাছ থেকে। স্বভাবতই এই অভিনেতার চাল-চলনে বনেদীয়ানা প্রকট।
বাবা ভুপতিনাথ দে বিশ্বাসের চার ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোটছেলে শচীন্দ্রনাথ দে বিশ্বাস, যিনি আমাদের বাংলা সিনেমাপ্রিয় মানুষের নয়নের মণি ‘ছবি বিশ্বাস’। ছবি নামটি তাঁর মেয়েরি দেয়া নাম। সেই নামের তাঁর খ্যাতি ও সমৃদ্ধি। ছোট বেলা থেকেই সুদর্শন ছিলেন বলেই মা এই নাম রেখেছিলেন। হিন্দু স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। মূলত এই সময় থেকেই তিনি বেশ কয়েকটি অপেশাদার থিয়েটার ক্লাবের সাথে যুক্ত হন। কিন্তু কিছুদিন পরে এই থিয়েটার জীবন থেকে সরে আসতে হয়, এক বীমা কোম্পানীতে চাকরী নেবার সুবাদে। পরে অবশ্য পাটজাত দ্রব্যের ব্যবসাও করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি আবার মঞ্চে ফিরে আসেন, তবে এবারে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে। ১৯৩৮ সালে সতু সেনের ডাকে ‘নাট্যনিকেতন মঞ্চে’ পেশাদার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। নানান জনপ্রিয় নাটক যেমন ষোড়শী (১৯৪০), সীতা(১৯৪০), কেদার রায় (১৯৪১) এবং শাহজাহান (১৯৪১) প্রভৃতিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। এবং দর্শকের মন জয় করেন। মোট ৩৯ টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি।
যদিও ইতিমধ্যে তার চলচ্চিত্রে পদার্পন হয়ে গেছে। ১৯৩৬ সালে তিনকড়ি চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ ছবিতে। এরপর চার-পাচটি ছবিতে কাজ করলেও সেগুলি বাণিজ্যিকভাবে সফল হয়নি। সাফল্য তাকে ধরা দিল, ১৯৪১ সালে নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছবি থেকে। ঠিক পরের বছরই পরপর ১৩ টি ছবি মুক্তি পায় তার অভিনয়ে। এরপ্র থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার অভিনয় দক্ষতা আজও বাঙ্গালির অন্তরে সযতনে সাজানো আছে।
১৯৫৬ সালে তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ সিনেমা তাকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার এনে দেয়। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রশংসিত হয় এই সিনেমাটি। কাবুলিওয়ালায় নাম ভূমিকায় তাঁর অভিনয়, অদ্যাবধি তাঁর অভিনীত চরিত্রের অন্যতম মাইলফলক। এরপর সত্যজিৎ রায়ের সাথে তাঁর প্রথম কাজ জলসাঘর সিনেমায়। যে সিমেনার অভিনয় প্রসঙ্গে স্বয়ং পরিচালক বলেছেন- ‘একদিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃশ্যকারিতা অন্যদিকে তার পুত্র বাৎসল্য ও সঙ্গীত প্রিয়তা এবং সবশেষে তার পতনের ট্রাজেডি, একাধারে সব গুলির অভিব্যক্তি একমাত্র ছবিবাবুর পক্ষেই সম্ভব ছিল।‘ অজয় করের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘সপ্তপদীতে’ সুচিত্রা সেনের বিপরীতে তার অভিনয় আজও উজ্জ্বল। যা তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। তাঁর অভিনীত আর এক প্রবাদপ্রতীম চরিত্র ‘দাদাঠাকুর’। স্বয়ং শরৎচন্দ্র পণ্ডিত তখনও জীবিত, তাঁরই জীবদ্দশায় বায়োপিক নির্মাণ হয়, যেখানে কোনো প্রস্থেটিক মেকাপের ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না। দাদাঠাকুর হলের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছেন, তাকে ঘিরে নির্মিত ছবির দাদাঠাকুর দেখতে ভীড় জমিয়েছেন, অথচ আসল দাদাঠাকুরকে কেউ চিনতে পারেননি। এখানেই একজন অভিনেতা কালজয়ী থাকেন। সেদিন শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের সফরসঙ্গী তাকে বলে বলেছিলেন, ‘দেখুন আপনি জীবিত অথচ আপনাকে না নিয়ে ছবি বিশ্বাসকে নিয়েছে।‘ জীবনের দাদাঠাকুর চটজলদি উত্তর- ‘ছবি দেখে লোকে বিশ্বাস করবে বলেই তো ছবি বিশ্বাসকে নেওয়া’।
আর এক কিংবদন্তি অভিনেতা বিকাশ রায় ছবি বিশ্বাস সম্পর্কে বলেছিলেন, “ছবিদা ছিলেন লাস্ট অফ দ্য এরিষ্টোক্রাটস্। তা কী অভিনয়ে, কী পারিবারিক চালচলনে।” তাঁর সাথে ছবি বাবুর এই কাহিনীও অনেকেরই জানা। একবার দার্জিলিংয়ে বাজে আবহাওয়ায় শ্যুটিং বন্ধ, সবাই মিলে তাসের জুয়ো খেলছেন। সব টাকা ছবি বিশ্বাস জিতে নিলেন, বিকাশ রায়ের কাছে সিগারেটটুকু কেনার পয়সাও নেই। রাতে মনের দুঃখে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। ‘ছবিদা’ মান ভাঙাতে ডেকে তুলে সিগারেট খাওয়ালেন। নিজে বিনিদ্র, বিকাশ রায়কেও ঘুমোতে দেবেন না। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলে গা থেকে কম্বল কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘‘আমার সিগারেট ফুঁকলি ফুসফুস করে, আর আমার সঙ্গে জেগে থাকবি না, এত বড় বেইমানি তোকে আমি করতে দেব! আমি তোর দাদা না?’’
টলিউডে তাঁকে ঘিরে এরকম নানা ঘটনার চর্চা আজও হয়ে চলেছে। ছবি বিশ্বাস এক দিন শুনলেন, কমেডিয়ান-চরিত্রের অভিনেতা নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, নাকি তাঁর নামে বদনাম করে বেড়াচ্ছেন। একদিন তাঁকে পাকড়াও করলেন। গম্ভীর হয়ে নৃপতি বললেন, ‘‘বদনাম করার মতো কাজ করেছেন, তাই বদনাম করে বেড়াচ্ছি।’’ সে আবার কী! ওখানে দাঁড়িয়েই বোঝানো শুরু করলেন তাঁর অভিনয়ের ভুলচুক, খামতিগুলো। কেমন হবে হাঁটা, তাকানো, ডায়ালগ থ্রো, টাইমিং— সব। সে দিন থেকেই নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছবি বিশ্বাসের ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড। ভালবাসা, বন্ধুতা অটুট ছিল আজীবন। সাথে সাথে সহ অভিনেতার পারস্পরিক সম্পর্কের খতিয়ান এর চেয়ে অধিক আর কি হতে পারে!
বাংলার আর এক দাপুটে অভিনেতা পাহাড়ী সান্যাল আর ছবি বিশ্বাসের একটা গল্প খুব বেশ প্রচলিত। যদিও বহুশ্রুত ও কথিত হতে হতে বয়ান পাল্টেছে কিন্তু যার সারবত্তা হল এ রকম: পাহাড়ী সান্যাল রেগেমেগে গজগজ করছেন, এটা নেই, ওটা নেই, সেটা নেই, এ ভাবে কাজ হয়! কোথাও একটুও শান্তি নেই!’ ছবি বিশ্বাসের তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘‘শান্তি এখানেই ছিল, এতক্ষণ!’’
‘ঝিন্দের বন্দী’ নাটকে কমল মিত্রের সঙ্গে তরবারি-যুদ্ধে দৃশ্যে অবতীর্ণ ছবি বিশ্বাস, এ দিকে ব্যবহৃত হচ্ছে আসল স্প্যানিশ সোর্ড। দু’জনের মধ্যে ১২ নম্বর মার অবধি চলবে, প্রতিটা মার ভালোভাবে রিহার্সড। ছবি বিশ্বাস সে দিন কী মনে করে ৩-এর পর ৬ নম্বর মার চালিয়ে দিলেন, কমল মিত্রের খাকি কোটের হাতা ভেদ করে তরোয়ালের ডগা ঢুকে গেল তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ে। রক্তে ভেজা জায়গাটা ডান হাতে চেপে ধরেই পরের দৃশ্যে অভিনয় করলেন কমল মিত্র। সিনের পর ছবিদাকে চেপে ধরতে বেমালুম অস্বীকার, ‘‘তুমিই তো মারের ভুল করলে ভাই!’’
এভাবেই সে সময়ের অভিনেতাদের পারস্পরিক সম্পর্কের এই কথাগুলি যেমন আনন্দ দেয়, তেমন তাদের সম্পর্কের গভীরতাকে চিহ্নিত করে। অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যের সাথে ছিল তার গভীর বন্ধুতা। একদিন ভানুর বাড়িতে সকাল সকাল কলিং বেল বেজে উঠল, ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতেই ভানু দেখলেন, দরজার সামনে দুটো বড় সাইজের ইলিশ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একটি লোক। একগাল হেসে লোকটি ভানুকে বললেন, ছবিদা এটি পাঠিয়েছেন! কিছু বোঝার আগেই ভানুর হাতে ইলিশ ধরিয়ে, লোকটি চলে গেলেন। ভানুর স্ত্রীর মনে হয়েছিল নিশ্চিতভাবে ছবিদা রাতে তাঁদের বাড়িতে আসবেন। তাই ঠিক হল সন্ধ্যা নাগাদ ভানুর বাড়িতে এলেন ছবি বিশ্বাস। পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। ঘরে ঢুকেই ভানু ও তাঁর স্ত্রীকে দেখে একগাল হাসি। তারপর বলে উঠলেন, ভাইটি ঘটির রান্না আর পছন্দ হচ্ছে না। তাই বাঙালের হাতের ইলিশ খেতে এলাম!
খুব কম লোকেই জানেন, ঋত্বিক ঘটক ‘কত অজানারে’ ছবি শুরু করেছিলেন ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে। ছবিবাবু ব্যারিস্টারের রোলে, যে পার্ট তাঁর তুড়ি-মারা কাজ। শ্যুটিংয়ে ঋত্বিক বারবার কাট করছেন, ‘‘হচ্ছে না ছবিদা। উকিল হয়ে যাচ্ছে, ব্যারিস্টার হচ্ছে না।’’ হতভম্ব ছবি বিশ্বাস ঋত্বিককেই বললেন, ব্যারিস্টারের অভিনয় দেখিয়ে দিতে। ঋত্বিকও তা-ই করলেন। ফ্লোরে সবাই তখন তটস্থ! ছবি বিশ্বাস কিন্তু ঋত্বিকের ফরমায়েশ মতোই শট দিলেন। পরে বলেছিলেন, ‘‘এ ঢ্যাঙাও (অন্য ‘ঢ্যাঙা’টি হলেন সত্যজিৎ রায়) অনেক দূর যাবে।’’
সদা উজ্জ্বল এই অভিনেতা বাঙালির গর্ব। তাই ঘরে ঘরে আজও তাঁর অভিনীত সিনেমায় দর্শক বুঁদ হয়ে থাকে।