Tuesday, June 10, 2025
Tuesday, June 10, 2025
Homeআলোচনাএকলব্য প্রযোজনা “অ এ অবলা কথা”

একলব্য প্রযোজনা “অ এ অবলা কথা”

দুলাল চক্রবর্ত্তী

দুবরাজপুর একলব্য সংস্থা নির্মাণ করেছে, একটি বুর্জোয়া এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের দ্বান্দ্বিক আধারে, সমাজের ভেতরে চলা বিচিত্র বিভেদে দ্বিখণ্ডিত অস্তিত্বের ব্যাখ্যা মূলক নাটক “অ এ অবলা কথা”। এ নাটক রচনা করেছেন সুরঞ্জনা ঘটক।

মফস্বল থিয়েটারের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও, নিজস্ব একটা চলন আছে। যা থিয়েটারের শ্বাশত ধারাকে নিজস্বতায় ধরে রেখেছে। আধুনিক হবার পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যেই প্রতিবাদের স্বরই প্রাধান্য পায়। নারীর নিজের অস্তিত্বের সংবাদ বহন করেছে, এই “অ এ অবলা কথা” নাটক। বলা উচিত এটি মেয়েদের মর্যাদা রক্ষাকারী নাটক।

দুবরাজপুরের প্রবীণ নির্দেশক বাপি কুন্ডু দক্ষতার সাথে এই নাটকের গল্পের সব বাঁকগুলিকে আলো, আবহ, মঞ্চ চিন্তার সুষম বিন্যাসে প্রচ্ছন্ন প্রচ্ছদে এনেছেন। নারী স্বাধীনতা এবং নারী প্রগতির যতই আলোচিত হোক না কেন, এই সমাজে চলমান অবক্ষয়ে মেয়েরা প্রতিনিয়ত অবদমিত এবং অবলা স্তরেই ভোগ্যপণ্য হিসাবেই গন্য হয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গকে প্রত্যক্ষ করাতেই একলব্য দুবরাজপুর, বীরভূমের অন্যতম একটি গভীর নাট্যানুরাগী প্রতিষ্ঠান এই নাটকের প্রযোজক দল।

নাটকের গল্পে বিনয় বাবু প্রতিষ্ঠিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী ঊষা গৃহিণী এবং প্রগতিশীল মানসিকতার এক কবি। মানুষের এবং যুগের যন্ত্রণা সংবাদ যার অন্তরে ধ্বনিত হয়। একই পরিবারে চরম স্বচ্ছলতায় দুধে ভাতে বেড়ে উঠেছে নিজের ছেলে সূর্য। অতি সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে পার্কে একটি মেয়েকে একা পেয়ে বন্ধু বান্ধব সহ শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশের কাছেও গেছে অপরাধের অবগতি। তাই মর্যাদা রক্ষায় পারিবারিক চাপান উতর চলছে। সত্য চাপা দিয়ে তুচ্ছতম ভুল ব’লে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা চলছে। একই বাড়িতে থাকা বিনয়ের ভাই বিজন, একদিনের বামপন্থী মতাদর্শের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের অত্যাচারে বর্তমানে পঙ্গু। অথর্ব প্রায় নির্বাক সে এক নজর নজরুল মাত্র। বিনয় সোচ্চার ঘটনার রঙ্গ বদলে দিতে। মা ঊষা তবুও ব্যথিত। নিজের অজান্তেই হয়তো নিজের গর্ভে থাকা ছেলের নারী লোলুপতার ভিত্তিতে লিখেছিল একটি কবিতা। এই বাড়িতেই বিনয়ের লোক দেখানো বদান্যতায় পেয়িং গেস্ট হয়ে আশ্রিতা হয়েছিল স্বামী বিচ্ছিন্না রাত্রি নামের আধুনিকা শিক্ষিতা এবং জীবন সহনশীলতার অন্তিম প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া তরুণী। যার সাত বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল দুর্বৃত্তরা। নাটকের এই পঞ্চভুজাকৃতি গঠনের কোণ গুলিতে তাই এসে দাঁড়িয়েছিল বিনয়, সূর্য, রাত্রি, ঊষা এবং নীরব দর্শক বিজন। ঘটনা প্রেক্ষিতে চাপা এবং সোচ্চার মর্মের দুই অভিঘাতে এদের মনে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন উপলব্ধি এসে বজ্রপাত ঘটিয়েছে এই গল্পে।

সত্যের জয়ে এক মেরুতে মিলে যায় পুরুষ তান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত রাত্রি এবং ঊষা, এই দুই নারী। অন্যদিকে উকিল পবিত্রবাবু, বিনয়বাবু এবং ভিক্টিম সূর্য নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্যাঁচ কষছে। এই নিয়ে চমৎকার সংলাপে একটি টানটান নাটক। যেখানে চরিত্রগুলোর নামকে যেভাবে বিশিষ্টতা দিয়ে চয়ন করা হয়েছে, তাতে বলা যায়, পবিত্রতার পথে সবিনয়ে সূর্য উঠেই রাত্রি এবং ঊষাকে গিলে খেতে যখন বদ্ধপরিকর, তখন পথের সন্ধান প্রায় পঙ্গু হয়ে বিজনে বসে চোখ তাকিয়ে দেখছে সময়। এর মধ্যেই চলছে কব্জির লড়াই। যা অত্যন্ত সময়োচিত ঘটনা প্রবাহে আমাদের চেতনাকে ছুঁয়ে যায়।

মফস্বল থিয়েটারে চরিত্র উপযুক্ত শিল্পী মেলা দুরহ ব্যাপার। তার মধ্যেই, রাত্রি চরিত্রে মন, মনন, যন্ত্রণা ক্লিষ্টতা সয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শ্রদ্ধা চক্রবর্তী এই নাটকের অন্ধকার রাত্রির কান্না হয়ে মুর্তিমান। উষা কিছুটা থতমত খেয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে ধাপেধাপে যে-ভাবে প্রতিবাদ মুখিনী হয়েছে, তাতে গোপা দত্ত সফল। বিজন চরিত্রে অক্ষম আর্তনাদে স্থবির বিশ্বজিৎ ব্যানার্জী (টপ) হতবাক বিস্ময়। যথেষ্ট ক্যাজুয়াল অভিনয়ে দক্ষ বাপি (মধুসূদন) কুন্ডু চাপা আক্রোশে চরিত্রটি ধরলেও আরো ক্রুরতা দম্ভ কোন এক মুহুর্তের ঝলকে তীব্র করে ধরলে ভাল হয়। নিপাট সুযোগ সন্ধানী চরিত্রে তন্ময় দে’র পবিত্র ভুমিকা মানিয়ে যায়। সৌম্যজিত চ্যাটার্জী অভিনয়ে আরো কিছুটা পরিশীলিত প্রকাশ কাঙ্খিত আছেই। একেবারে শেষের ছায়া নৃত্যে সৃজা ব্যানার্জী নিপুনভাবে প্রকাশিত। এই নাটকের আলো, আবহ এবং মঞ্চ ভাবনা ত্রয়, নাটকে চমৎকার মিশেছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পীদের নাট্য মনস্কতা প্রশংসনীয়। বিশেষভাবে দুই স্তরের আবহসঙ্গীত চয়নের বিশেষ প্র‍্যাক্টিস মন ছুঁয়ে যায়। সুন্দর প্রক্ষেপণে সায়ন্তন ওঝার কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। একইভাবে আলোতে অশোক চৌধুরী (ভন্ডুল) তাল মাত্রায় অনবদ্য। তাই ক্রমিক ভাবে, অ এ অবলা কথা নাটকের পরপর তিনটি প্রদর্শন ফিনিকের মিলন মেলায় নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে, কৃষ্ণনগর সিঞ্চনের সমৃদ্ধ নাটকের উৎসবে এবং কলকাতা সমকালীন সংস্কৃতির মোহনা মুখী উৎসবে তপন থিয়েটারে সম্প্রতি অভিনীত হয়েছে।

মফস্বলি নাটক প্রদর্শনের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেখান থেকে বেশ কিছুটা বেরিয়ে এই প্রযোজনা, দর্শকদের প্রসংশা ধন্য। দলের লক্ষ্য নারী মুক্তির সম্পর্কিত বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যা একটি জরুরী গ্রুপ থিয়েটার চেতনার কাজ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular