Bangla Natok: নাটক – যদুবংশ কুপোকাত

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জিলাল

চরিত্র: দেববর্মা/ বিদূষক/ অন্ধক নেতা/ বৃষ্ণী নেতা/ ভোজ নেতা/ নিপুনিকা/ নর্তকী কুঞ্জ কি/ নগর কোটাল/ দ্বাররক্ষী/ জানুক এক মাতাল দুর্বৃত্ত/ ও অন্যান্যরা

মহাভারতের এক অধ্যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্ত। যাদবগণ সংঘের রাজ্যে নাটকের পর্দা উঠবে। মঞ্চে আমরা দেখব যাদবগণ সংঘের মুখ্য সচিব দেব বর্মা মহাশয়ের প্রাসাদের অংশ। আজ তার মেয়ের স্বয়ম্বর সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পর্দা খোলার পর দেখা যাবে যে, প্রাসাদ কে নানা ভাবে সাজানো হয়েছে। লতা পাতা ফুল রঙিন রঙিন কাপড় ইত্যাদি দিয়ে বিয়েবাড়ির আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে। নহবত বাজনা দিয়ে নাটক শুরু হবে। নানারকম গুঞ্জন চলছে। তারপর শুরু হবে নর্তকীর নাচ। গুজরাট প্রদেশের নাচ। Garbaa উৎসবে যে নাচ প্রদর্শন করা হয়।

ভেতর থেকে বিদূষক উৎসব বাড়ির পোশাক পড়ে বেরিয়ে আসবে।

বিদূষক।। বাহু বা বাঃ চমৎকার সাজগোজ হয়েছে। যাদবগণ সংঘের মুখ্যসচিবের মেয়ের বিয়ে বলে কথা।

নর্তকী।। প্রাতঃ প্রণাম বিদূষক মহাশয়।

বিদূষক।। প্রণাম প্রণাম। আজ দেখছি তোমারও উচ্ছ্বাস বানের জলের মতো উথলে উঠেছে।

নর্তকী।। আপনার গৃহিণীর সাজসজ্জা দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন না যেন। সে কিন্তু এক কাঠি উপরে আছে।

বিদূষক।। সে ভয় নেই কুঞ্জ কি। গৃহিণী পাঁচ বছরের পুরাতন হয়ে পড়েছে।

নর্তকী।। সেই জন্য বোধহয় সাজসজ্জার ঘটা কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। প্রায় শেষ রাত থেকে প্রসাধন কর্ম শুরু হয়েছে।

বিদূষক।। বয়স বাড়লে মেয়েরা তাদের দেহ বল্লরী নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যৌবন যত যত পশ্চিমে হেলে পড়তে শুরু করে,, আতঙ্ক সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া বিয়ে বাড়ি বলে কথা। আমাদের মুখ্যসচিব দেববর্মার গৃহিণী ও তো নববধূর সাজ ধারণ করেছে। দেখলে মনে হবে, আজ বুঝি তার স্বয়ম্বর সভা। আমার তো ভয় হচ্ছে, আমন্ত্রিত সভাসদগণ সুতনুকা র পরিবর্তে দেববর্মার গৃহিণী কে পছন্দ করে না ফেলে ন।

নর্তকী।। তাহলেই বলুন, মেয়ের মা যদি সাজসজ্জায় মেয়েকে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করে, আমরা চাকর-বাকর মানুষেরা একটু সাজগোজ করলে পাড়া-প্রতিবেশী র চোখ টাটা বে কেন?

বিদূষক।। আরে বাবা ওরা হলো মনি ব। ওদের যা মানাবে সেটা চাকরবাকরদের মানাবে কেন? এই যে দেখছো জলের মতো টাকা খরচা হচ্ছে, এসব আসলে আভিজাত্য প্রদর্শনের উৎকট প্রচেষ্টা!!! আভিজাত্য দেখাবার জন্য মুখ্যসচিব তার মেয়ের স্বয়ম্বর সভা আয়োজন করেছে। নইলে এদের গুষ্টি তে আগে কখনো কেউ স্বয়ম্বরা হয়নি।

নর্তকী।। তাইতো বলি। স্বয়ম্বরা হবার ব্যাপারটা রাজাদের ব্যাপার। আগে কখনো কেউ শোনেনি, আমলা গামলা শ্রেণীর পরিবারের কেউ স্বয়ম্বর সভা ডেকেছে।

বিদূষক।। বাম হাতে র পয়সা রোজগার শুরু করলে, খরচা করতে হবে তো। আভিজাত্য দেখাতে না পারলে সমাজে কেউকেটা প্রমান করা যায়না। এটাই তো এখন যদু বংশের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।(চরিত্র থেকে বেরিয়ে) এদেশের স্বাধীনতার 75 বছরে এমনটাই চলছে! অনেক নেতা মন্ত্রী এমনকি পৌর প্রতিনিধি মেয়ের বিয়েতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচা হয়ে যাচ্ছে!

নর্তকী।। আবার দেখুন বিদূষক মশাই, রাজকন্যার জন্য রাজপুত্রদের কিংবা ভিনদেশের রাজাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। অথচ এখানে যারা আসছে তারা সবাই বলতে গেলে আধ বুড়ো। কেউ রাজা ন, রাজ পুত্র নয়। সামান্য যাদব গোষ্ঠীর বিভিন্ন নেতা।

বিদূষক।। শুধু নেতা বললে ভুল হবে। বলতে হবে যাদব গণ সংঘের যুযুধান নেতা। এটাই হলো শ্রীকৃষ্ণের গন রাষ্ট্রের মজা। এখানে কেউ রাজা নয়। সবাই আমলা গামলা। অথচ সুযোগ পেলে সবাই বড় বড় কাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, অন্যের পেছনে দেবে বলে। এই যেমন ধরো আমি আমলা দেববর্মার বিদূষক। তিনি আমাকে খুবই ভরসা করেন। ভালোবাসেন। এত ভালবাসেন যে, সুযোগ পেলেই আমার পিছনে আছোলা বাঁশ দিতে দেরি করেন না।

নর্তকী (হাসি)

বিদূষক।। হেসোনা হেসোনা। বংশ দন্ড অতীব বেদনাদায়ক উপহার। প্রভু আমার উপর আজকে কন্যা কর্তা র দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আমন্ত্রিত যারা আসছেন, আমাকে তাদের আপ্যায়ন করতে হবে। রঙ্গ রসিকতা করে মন ভোলাতে হবে। তাইতো এরকম উদ্ভট পোশাক পড়ে সেজে এসেছি।

নর্তকী।। যাকে বলে শ্রী শ্রী কৃষ্ণ ঠাকুরের সাজ ধারণ করেছেন।

বিদূষক।। বিখ্যাত মানুষের সাজসজ্জা অনুকরণ করাটা সাধারণ মানুষের বৈশিষ্ট্য। তবে তোমাকে একান্তে জানিয়ে রাখি, কেষ্ট ঠাকুর আজ এই স্বয়ম্বরসভায় আসবেন না।

নর্তকী।। কেন কেন আসবেন না কেন?

বিদূষক।। কি মুশকিল আর কত বিয়ে করবেন? 16000 রমণীকে তিনি গ্রহণ করেছেন! ভু ভারতে এইরকম দৃষ্টান্ত আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না! আমরা একজন কে সামলাতে পারিনা, আর তিনি–ওদিকে আবার মামিমা শ্রীরাধিকা র সঙ্গে লীলা করতে করতে-তিনি এখন রাজনৈতিক আসরে বলা যায় পড়ন্ত সূর্য! লোকে পড়ন্ত সূর্যের দিকে দরজা বন্ধ করে দেয়! যাদব নেতাদেরও একই অবস্থা! শ্রীকৃষ্ণের পর যাদব গণ সংঘের ক্ষমতা এখন কোন দিকে যাবে কেউ বুঝতে পারছে না! অন্ধক বংশের হাতে? নাকি ভোজ বংশের হাতে? কুকুর বংশ, বৃষ্ণী বংশ সবাই সুযোগের অপেক্ষায় ফণা তুলে আছে! সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে।

নর্তকী।। এবার বুঝতে পারা গেল যে আমাদের আমলা বাবু মানে মুখ্যসচিব দেববর্মা কি অংক কষছে ন।

বিদূষক।। নর্তকী হলেও তোমার তো ঘটে বেশ বুদ্ধি ধারণ করো। ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পালাবদল এর প্রেক্ষাপটে কোন বংশ যাদব গণ সংঘের ক্ষমতায় আসছেন সেটা তো ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। তাই যুযুধান প্রায় সব পক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

নর্তকী।। দেববর্মার তিন তিনটে কন্যা। আজকে সুতনুকার স্বয়ম্বর সভা। এরপর আরো দুজনের স্বয়ম্বর সভা আহ্বান করা হবে। সুতরাং, তিন কন্যার সুবাদে তিনটে বংশকে খুশি করা যাবে। তারপর জামাইয়ের লেজ ধরে আমাদের প্রভূ অপার ক্ষমতার অধিকারী হবেন।

নর্তকী।। এমনও তো হতে পারে যে তখন আমলা গিরি ছেড়ে পুরোদস্তুর নেতা বনে যাবেন।

বিদূষক।। তাই বলতে পারি, বাপের অংকে মেয়েরা হল বিয়োগ চিহ্ন।

দুজনেই হেসে ওঠে। নর্তকী আবার নাচা শুরু করে দেয়। এই সময় নিপুনিকা প্রবেশ করবে। খুব সেজে এসেছে। পায়ে মল। নাচের ছন্দে ভঙ্গিমায় মঞ্চে প্রবেশ করবে। প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে নাচবে।

বিদূষক।। আরে আরে এ আমি কাকে দেখছি? এই কি সেই মহিলা যাকে পাঁচ বছর আগে বিবাহ করেছিলাম? নাকি অন্য কেউ?

নিপুনিকা।। ফাজলামি করো না তো। পুরনো হয়েছি বলে নিজের বৌকে চিনতে পারছ না?

বিদূষক।। কি করে চিনবো বল? চোখে তো সর্ষেফুল দেখছি! ঠিক যেমন পাঁচ বছর আগে দেখেছিলাম! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আজ বোধহয় তোমার স্বয়ম্বর সভা।

নিপুনিকা।। বিদূষক গিরি করতে করতে তুমি তো দিনের পর দিন বাড়ি ফেরো না। প্রভুর চামচা বাজি করতে করতে আমাকে ভুলে বসে আছো।

নর্তকী।। তা যা বলেছ। রাজপ্রাসাদে মেনকা রম্ভা দের নিয়ে তোমার বরের দিন কাটে। ওদের পেছনে লেগে, প্রভুর মনোরঞ্জন করে করে রুচি বিকার দেখা দিয়েছে। বউ এর কথা মনে পড়বে কেন।

নিপুনিকা।। সবাই বলে, বিয়ের সময় আমি ছিলাম শীর্ণকায়। গায়ে মাংস ছিল না। আমার দিদিরা বলতো, বিয়ের জল গায়ে পড়লে আমি নাকি পদ্মিনী হয়ে যাব।

বিদূষক।। আমার তো মনে হয় হস্তিনী হয়েছ। তোমাকে ধারণ করতে গিয়ে আমি কতবার যে পালঙ্ক থেকে আছাড় খেয়েছি, তার হিসেব কে রাখে।

নিপুনিকা।। অসভ্য। মুখে কোন আগ ল নেই।

নর্তকী।। সে যাই হোক। আমাদের যাদব গণ সংঘের নারী-পুরুষেরা একটু বেলেল্লা হয়। রতিশাস্ত্র নিয়ে আমরা একটু বেশি নির্লজ্জ। প্রভাসে এখন গোধন উৎসব চলছে। বাইরে গিয়ে একবার দেখে এ সো সেখানে নারী-পুরুষে কি রকম ব্যভিচার চলছে। উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো প্রকাশ্যে রতি উৎসবে মেতে উঠেছে। লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়ে বাবার সামনে মেয়ে, ছেলের সামনে মা মাসি পিসির যা করছে-ভাদ্র মাসের কুকুর ও লজ্জা পাবে।

নিপুনিকা।। ওখানে যা হয় হোক। তাই বলে আমার স্বামী কেন-ওখানে যাবে? আজকে আমি তোমার পাশে পাশে থাকবো বুঝেছ?

বিদূষক।। কথায় বলে ভগবান ও দশ চক্করে ভূত হয়। আমিতো প্রভাসের নাগরিক। আমলা দেববর্মার মুখ্য সচিব। তবে হ্যাঁ, প্রভাসের ওই উৎসব চালু করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। প্রথম প্রথম একটা উদ্দেশ্য ছিল। সমস্ত উচ্চ নিচ বংশের মানুষেরা সেখানে মিলিত হবে। নানা মতের আদান-প্রদান ঘটবে। সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা হবে। যাদব রা সঙ্ঘবদ্ধ হবে। প্রথম প্রথম সুফল দিয়েছিল। তারপর কেষ্ট ঠাকুর চলে গেলেন হস্তিনাপুরে। ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে গিয়ে তিনি কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ টা অনিবার্য হয়ে উঠল। কৃষ্ণ ভেবেছিলেন, হস্তী না র রাজ সিংহাসন দখল করবে যাদবরা। মানে ভারত শাসন করবে যদুবংশ।

বাইরে গোলমাল শুরু হয়েছে। দ্বাররক্ষী ছুটে এসে বলল-

দ্বাররক্ষী।। সর্বনাশ হয়েছে বিদূষক মশাই, একদল মাতাল এই বাড়িতে ঢুকতে চাইছে। কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। সম্ভবত ওদিকের পাঁচিল টপকে অনেকে ঢুকে পড়েছে।

বিদূষক।। সেকি এ বাড়িতে ঢুকবে কেন?

দ্বাররক্ষী।। মদ খাবে। কি আবদার!

বিদূষক।। মদ খাবে মানে? তারা জানে না এটা মুখ্যসচিবের বাড়ি? আজ এখানে স্বয়ম্বর সভা বসবে।

রক্ষী।। মাতালদের সেসব হুস থাকলে মাতলা মি করবে কেন আর ঢুকতেই বা চাইবে কেন।

বিদূষক।। মগের মুল্লুক নাকি?

নিপুনিকা।। এখন কি হবে স্বামী? প্রভাসের মাতালরা যে আস্ত রাক্ষস! মেয়েছেলে খো র।

কুঞ্জকি।। মা মাসি জ্ঞান করেনা।

নিপুনিকা।। কেনই বা করবে বল? ওদের নাটের গুরু কৃষ্ণ ঠাকুর তিনি কি করেন?

দৈত্যের মতো চেহারা জানুক দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়বে। প্রথমেই সে নর্তকীকে তারা করবে। তাই দেখে নিপুনিকা পালাবে। বিদূষক বিপন্ন কি করবে বুঝতে পারছে না। রক্ষী ও ভয়ে কাঁপছে।

জানুক।। ভয় পাবার কোন কারন নেই। আমি একটু নিরিবিলি খুজছিলাম মদ খাবো বলে। প্রভাসের মেলায় ভাদ্র মাসের কুকুর গুলো কামড়াকামড়ি শুরু করেছে। তাই এইখানটা আমার পছন্দ হলো।

বিদূষক।। পছন্দ হলো মানে? এটা কি আপনার বাপের বাড়ি?

জানুক।। (অশ্লীল হাসি) তুই কেহে বুড়ো ভাম?

দ্বাররক্ষী।। এ মা, আপনাকে বুড়ো ভাম বলছে! কি আস্পর্ধা!!

জানুক।। ছিরি ছিরি কেষ্ট ঠাকুর এর এই গোটা দেশটা আমার বাপের বাড়ি। বুঝলি বুড়ো ভাম। মেলা প্যাচ প্যাচ করিস না। শান্তিতে মদ্যপান করতে দে।

দ্বাররক্ষী।। কিন্তু আপনি কি জানেন না যে, কৃষ্ণ ঠাকুরের বড় ভাই বলরাম দেশে মদ তৈরি নিষিদ্ধ করেছে ন।

জানুক।। বলরাম? নিষিদ্ধ করেছে মদ? ওই লোকটা নিজেই তো দিনরাত মদে চুর হয়ে থাকে!

বিদূষক।। না না এটা ঠিক হচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে আমার প্রভু এসে পড়বেন। তারপর তিনি যদি দেখেন এখানে এইসব হচ্ছে, আর চাকরি থাকবে না।

দ্বাররক্ষী।। বলরাম মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছেন। আসলে নিয়ম সব সময় অপরের জন্য। নিয়ম যারা তৈরি করে তাদের জন্য না। আচ্ছা ওটা কি মদ?

জানুক।। তুই কি পান বিশেষজ্ঞ?

দ্বাররক্ষী।। মনে হচ্ছে কাদম্বরী-

বিদূষক।। মাল না ট্রেনে কি করে বললে? আমার কিন্তু মনে হচ্ছে মাধবেক।

জানুক।। আপনিও দেখছি বিশেষজ্ঞ। রোজ কতটা টানাটানি করেন মশাই?

বিদূষক।। একবিন্দু না। ঘরে সুন্দরী পাঁচ বছরের পুরনো বউ আছে। একদম পছন্দ করেনা।

জানুক।। কোনটা বলুন তো? আমি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যেটা ভিতরে ঢুকে গেল?

বিদূষক।। আপনাকে দেখে দুজন ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

জানুক।। একটা কে আমি চিনি। নর্তকী। কয়েকবার ব্যবহার হয়েছে। দ্বিতীয়টা নিশ্চয়ই টাটকা মাল?

বিদূষক।। তা আর বলতে। বৃন্ত যুক্ত সুগন্ধি পুষ্পের মত।

জানুক।। তাহলে ওটা কে ই আজ চেখে দেখতে হয়-

বিদূষক।। নিশ্চয় নিশ্চয়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়। বিফলে মূল্য ফেরত।

জানুক।। তাহলে এই আমি বসলাম। মালটাকে নিয়ে আসুন। ভালো বকশিস দেবো।

বিদূষক।। কি বললেন, আমি নিয়ে আসবো! মানে?

জানুক।। এইতো এতক্ষণ মালের গুনো গান করছিলেন। জান জানে নিয়ে আসুন।

বিদূষক।। (এবার বুঝতে পারে তার কি ভুল হয়েছে) আরে না না, আমি ওভাবে বলতে চাইনি, মানে আমি ওর-

এবার ভেতর থেকে দেববর্মা আসবে। জানুক নিপুনিকা কে ধরার জন্য ভেতরে যাবে।

দেব বর্মা।। বুঝলে বিদূষক, দারোকা রাজ্যের পুরোহিত সন্দীপন মুনি, রাজা অগ্রসেন, সেনাপতি অনাবৃষ্টি, প্রধানমন্ত্রী বি কদ্রু, মন্ত্রী বাসুদেব, বলভদ্র, আরো অনেকে আমার কন্যাকে আশীর্বাদ প্রেরণ করেছেন। এমনকি শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত। খবর পেলাম এই প্রজন্মের সমস্ত নেতারা আজকে স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত থাকবেন। আচ্ছা তখন থেকে গন্ডগোল হচ্ছে কেন?

বিদূষক।। প্রবাসে গোধন উৎসব চলছে আপনি কি জানেন না। উৎসব মানে মাতালদের পোয়াবারো। (ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে)

দেববর্মা।। মাতাল? তারা কোথায়? নানা আমার এখানে ওসব চলবে না! তুমি আবার কোথায় যাচ্ছে? এখানে দাড়াও।

বিদূষক।। আগে দাঁড়িয়ে তো আছি। কিন্তু ওদিকে যে-

দ্বার রক্ষী।। আপনার বাড়ি মাতালরা লুট করে নিয়েছে। রক্ষা করবার কেউ নেই।

দেববর্মা।। কেন কেন কেউ নেই কেন?

দ্বাররক্ষী।। কারণ প্রশাসনে যারা রয়েছে, নগর কোটাল, নগর শাসক, আরো সবাই আজকের দিনে মাতাল হয়ে গেছে। কেউ কাউকে শাসন করবার নেই।

দেববর্মা।। তাইতো। ভেতরে দেখলাম একগাদা মাতাল। এখানে ওখানে বসে পড়েছে মদের পি পে নিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম ওরা বুঝি আমার বাড়ির চাকর বাকর। তারপর মনে হলো আরে আমার বাড়িতে এত চাকর কোথা থেকে এলো!! ঐতো ভিতরে কারা যেন চিৎকার চেঁচামেচি করছে।

নর্তকীকে দেখা যাবে বাঁচাও বাঁচাও বলে ছুটছে। তার পেছনে ছুটছে জানুক।

দেববর্মা।। এই কে আছিস, আমার বাড়ির রক্ষী গুলো, মাতাল মাতাল গুলোকে ধরে আন-

দ্বাররক্ষী।। তাতো হবার নয়। ওদের ধরতে গেলে নগর কোটাল এর অনুমতি লাগবে।

দেববর্মা।। আমি মুখ্য সচিব, আমার অনু মতির কোন দাম নেই?

দ্বাররক্ষী।। সেটা নগর প্রশাসক জানে।

এইসময় জানুক নিপুনিকা কে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে আসবে। বিদূষক বিপন্ন। নিপুনিকা চিৎকার করছে। জানুক বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। বিদূষক পথ আটকাবে।

বিদূষক।। সত্যি ভাই জানুক তোমার ক্ষমতা আছে। আমিতো নিপুনিকা কে আজকাল তুলতে পারিনা। আর তুমি কিরকম অনায়াসে, তুলোর বস্তার মতো কাঁধে তুলে নিয়েছো। তবে এবার তুমি ওকে নামিয়ে দাও।

জানুক।। নামিয়ে দেওয়ার জন্য তো কাঁধে তুলিনি। আমি এখন এই মেয়ে ছেলেটাকে নিয়ে গোধন উৎসবে চলে যাব। ওখানে ভাদ্র মাসের কুকুর গুলো কিভাবে কামড়াকামড়ি করছে, দেখতে দেখতে আমারও যে কামড়াকামড়ি করতে ইচ্ছে করছে।

দেববর্মা।। বেশতো। ইচ্ছে যখন করছে তাই করো। নিপুনিকা কে তুমি নিয়ে যাও।

বিদূষক।। আপনি কি বলছেন প্রভু?

দেববর্মা।। যা বলছি হ্যাঁ, ওটা কে তুমি নিয়ে যাও। আমি তোমাকে দিলাম-

বিদূষক।। আপনি দিলেন মানে? কে আপনি? কার জিনিস কাকে দিচ্ছেন? আপনি দেবার কে?

(চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে) আপনি কি দেশের প্রধানমন্ত্রী, নাকি অর্থমন্ত্রী, যে এই দেশ আর তার সম্পত্তি নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে বিক্রি করে দিতে চাইছেন?

দেববর্মা।। এটা কি হলো?

বিদূষক।। কোনটা?

দেববর্মা।। নাটকের ডায়লগ বল। নাটক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছ কেন?

বিদূষক।। ঠিক আছে ঠিক আছে। আপনি কিউ দিন।

দেববর্মা।। তুমি দেবে। তুমি কিউ মিস করেছ।

বিদূষক।। কার জিনিস কাকে দিচ্ছেন? কে আপনি?

দেববর্মা।। আমি তোমার প্রভু। ওই মেয়ে ছেলেটা তোমার বউ। একদিন ওটাকে আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। আজকে আর একজনকে দান করে দিচ্ছি। এটা আমার অধিকার।

বিদূষক।। অধিকার মাড়াবেন না। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।

দেব বর্মা।। ঠান্ডা ঠান্ডা ঠান্ডা বরফের মতো মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। নইলে তুমি আমার বিদূষক কিভাবে হবে।

রক্ষী।। ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক। ঠান্ডা মাথায় মুরগির ছাল ছাড়ানো থেকে শুরু করে মানুষের চামড়া ছাড়াতে হবে তো।

বিদূষক।। ঠিক বলেছ। ঠান্ডা মাথায় কাজ হাসিল করতে হয়।

দেববর্মা।। সেটাই তো তোমাকে বোঝাতে চাইছি। একটা মেয়েছেলে গেলে আরেকটা আসবে। আমাদের কোনো ক্ষতি নেই।

বিদূষক।। ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক। জানুক, এদিকে একটু শুনে যাবেন। আমার কথা শুনলে, আপনার উপকার হবে। নিপুনিকা আমার পাঁচ বছরের ব্যবহার করা বউ। তারচেয়ে বরং অন্দরমহলে ঢুকে গিয়ে দেখবেন, আজকের স্বয়ংবর সভা র স্বয়ম্বরা হবার জন্য একটি কচি খুকি সাজগোজ করে বসে আছে। আপনি বরং ওটাকে নিয়ে চলে যান।

জানুক হুংকার দিয়ে ভেতরে চলে যাবে।

দেববর্মা।। এটা কি হলো? এটা তুমি কি করলে? আমার সঙ্গে ইয়ার্কি?

বিদূষক।। যাকনা আপনার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে। কিবা এমন হবে। ব্যবহার করে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।

দেববর্মা।। এটাকি খুব ভালো হলো?

বিদূষক।। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি ভালো হয় না। নিপুনিকা তুমি এখন প্রস্থান করো।

নিপুনিকা ভেতরে চলে যাবে। দেববর্মা উদ্বেগের সঙ্গে পায়চারি করছে। নগর কোটাল হুংকার দিয়ে আসবে।

কোটাল।। কই? কই? তারা সব কোথায়?

দেব।। এইযে নগর কোটাল এতক্ষণ কি করছিলে?

কোটাল।। ঘাস কাটছিলাম। আপনারা তো আমাকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ থেকে শুরু করে জুতোসেলাই সবই করিয়ে নিলেন। নগর কোটালের চাকরিটা আগে জানলে নিতাম না।

বিদূষক।। আপনি কি করে জানলেন যে এ বাড়িতে ডাকাত পড়েছে?

কোটাল।। আমাদের রাজ্যে যত বড় বড় বাড়ি গজিয়ে উঠেছে, সেসব তো ডাকাতির পয়সায়। সুতরাং চম্বলের ডাকাতদের এখন এখানে মৃগয়া ভূমি হয়েছে। এটা জানতে নগর কোটাল হতে হয় না। কুলি মজুর তারাও জানে।

দ্বাররক্ষী।। বিষে বিষক্ষয়। ডাকাত আর ডাকাতের দ্বন্দ্বে অমৃত ক্ষয়।

কোটাল।। (বাইরে মুখ বাড়িয়ে তার বাহিনীকে নির্দেশ দেয়) প্রাসাদ ঘিরে ফেল। কোন ব্যাটা যাতে পালাতে না পারে। মহাশয়, আপনার প্রাসাদের গঠন টা আমাকে একবার বুঝিয়ে বলবেন?

দেববর্মা।। এর আগে তো একবার এসেছিলেন। নতুন করে বুঝিয়ে বল বার কি আছে?

কোটাল।। এসেছিলাম? আপনার প্রাসাদে?

বিদূষক।। কি আশ্চর্য! এর মধ্যেই ভুলে গেলেন? মাত্র তো এক বছর আগের ঘটনা! সৈন্যবাহিনীর তহবিল তছরুপ এর দায় আমাদের এই মহাসচিব ধরা পড়েছিলেন! তখন আপনি তদন্ত করতে এসেছিলেন! কি মনে পড়েছে?

কোটাল।। হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে পড়েছে। এইবার সব মনে পড়েছে। তাইতো বলি, গরিব চাষাভুষোর বাড়িতে ডাকাত পড়ে না কেন। (তার বাহিনীকে) তোমরা শুনছো, একজন ডান দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ো। আর একজন বা দিকের দরজা দিয়ে ঢুকে যাও। মাঝখানে দরজা দিয়ে তিনজন ঢুকে পড়ো। বাকিরা আমার সঙ্গে এসো।

বাহিনীতে আছে মাত্র দুজন। তারা কে কোথায় যাবে বুঝতে পারেনা। বিদূষক হাসতে থাকে।

দেববর্মা।। তুমি হাসছো! আমার পেছনে ফাটছে!

বিদূষক।। এই দৃশ্য তে হাসি ছাড়া অন্য কিছু চলে না। ব্যাপারটা বুঝতে পারলে আপনিও হাসবেন। (চরিত্র থেকে বেরিয়ে) এ দেশের পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা দপ্তর, সিবিআই সবাই জানে, কোন নেতা মন্ত্রীর কটা বাড়ি, সে বাড়ির গঠন কেমন, দেশী বিদেশী কোন কোন ব্যাংকে কত টাকা আছে! সব নখদর্পণে! তবুও নাটক করে যাচ্ছে!

দেববর্মা।। তোমাকে সাবধান করছি, নাটকের বাইরের কোন ডায়লগ বলবে না।

বিদূষক।। নাটক টা এমন যে লোভ সামলাতে পারছিনা।

এইসময় জানুক কে দেখে কোটাল ধরে ফেলবে।

কোটাল।। আর কোন চিন্তা নেই। একে আমি চিনি। নিয়ে গিয়ে হাড়গোড় ভেঙে দেবো।

দেববর্মা।। দাঁড়ান দাঁড়ান কোটাল মশাই। কার হাড়গোড় ভাঙ বেন? একটু বিবেচনা করে দেখলে হয় না?

কোটাল।। আবার বিবেচনা কি? ডাকাত ধরে ফেলেছি!

দেববর্মা।। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। কে যে কোন দলের সঙ্গে জুড়ে আছে-শেষে একটা কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়!

বিদূষক।। ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় এ ব্যাটা হ্যাঁ হ্যাঁ আমার চোখ ভুল করে না। একে আমি মেথরপট্টিতে মাল খেলতে দেখেছি।

দেববর্মা।। আরে না না আমার তো মনে হচ্ছে এ ব্যাটা, অন্ধক নেতা কৃতবর্মা র লোক।

রক্ষী।। আমার তো মনে হচ্ছে এ ব্যাটা যদু কুলোপাতি শ্রীকৃষ্ণের কোন রক্ষিতার কেউ হবে।

দেববর্মা।। এইবার মনে হচ্ছে আমি ঠিক চিনেছি। এ কে বৃষ্ণী দলের মিছিলে দেখেছি।

কোটাল।। কি মুশকিল। তাহলে আমাকে খবর দেওয়া হল কেন। আপনারাই ঠিক করুন, একে ধরা যাবে কিনা।

দেববর্মা।। না না একদম মাথা গরম করা যাবে না। আজ আমার মেয়ের স্বয়ম্বর সভা। গোলমাল চাইনা। এমন কোন কাজ করা যাবে না যাতে সব ভুন্ডুল হয়ে যায়।

কোটাল।। ঠিক আছে ঠিক আছে। এখন আমি একে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছি। ওর তো এখন জ্ঞান নেই। ও ঠিক বুঝতে পারছে না কী হতে যাচ্ছে। কারাগারের বাইরে বসিয়ে রেখে দেবো। পরে যা হোক একটা কিছু করা যাবে। তাহলে আমি এখন চলি।

দেববর্মা।। সেটাই ভালো। আপনি এখন চলুন। আমাদের এখন পরবর্তী কাজের জন্য চলতে হবে।

কোটাল।। (দু পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে) তাহলে আমরা চলি?

বিদূষক।। চলুন-

কোটাল।।। (আবার দু পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে) তাহলে সত্যি সত্যি চললাম?

দেববর্মা।। মিথ্যে মিথ্যে কেউ চলতে পারে নাকি?

কোটাল।। তাহলে শেষ বারের মত চললাম? কি বলেন মুখ্যসচিব মহাশয়?

দেববর্মা।। (বিদূষক কে) লোকটা এইরকম করছ কেন?

বিদূষক ।। বয়স তো আপনার কম হলো না। যদু বংশের আদব-কায়দা এখনও শিখলেন না? এটা হল জাতীয় বৈশিষ্ট্য.!

দেববর্মা।। মানে?

বিদূষক।। যদু বংশের এটাই ধারা। খালি হাতে কেউ কোনো কাজ করে না। পান খাওয়ার পয়সা দিতে হয়।

রক্ষী।। কেউ কেউ বলে মিষ্টি খাবার পয়সা। (হাসি)

কোটাল।। নজরানা আমাদেরও দিতে হয় বুঝলেন। এই মুখ্য সচিবের কাছে আমার নিজের কোন কাজ নিয়ে গেলে উনি কি খালি হাতে করে দেবেন?

দেববর্মা।। না দেব না। প্রশাসন চালাতে গেলে দেয়া যায় না। আমি কখনো খালি হাতে বাপের কাজও করে দিই না।

বিদূষক।। এটাই তো যদু বংশের জাতীয় বৈশিষ্ট্য।

দেববর্মা।। ঠিক আছে ঠিক আছে। নগর কোটাল, তোমার পাওনাটা তুমি পাবে। তবে এখন না। আজকের ঝামেলা মিটে যাক। পরে এসো।

কোটাল।। নিশ্চয়ই আসব। তখন কিন্তু ভুলে যাবেন না।

দেববর্মা।। ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। জাতীয় বৈশিষ্ট্য বলে কথা। (সবাই হেসে ওঠে)

কোটাল।। তাহলে এবার আমি সত্যি সত্যি এলাম। মানে চলে গেলাম।

(জানুকে নিয়ে সবাই চলে যাবে)

দেববর্মা।। বাঁচা গেল। নগর কোটাল ঠিক সময় না আসলে কি যে হতো-

বিদূষক।। কিছুই হতো না।

দেববর্মা।। কি যে বলোনা। তোমার আশকারাতে জানুক যদি আমার মেয়ে সুতনুকাকে তুলে নিয়ে যেত?

বিদূষক।। যেত না যেতে পারত না

দেববর্মা।। কিভাবে বুঝলে?

বিদূষক।। আপনার মেয়ে তো ঘরে নেই।

দেববর্মা।। সেকি!! কোথায় সে?

বিদূষক।। কাল রাত্তির থেকে সে বাড়িতে নেই।

দেববর্মা।। আশ্চর্য। মেয়ের মা আমাকে তো সে কথা বলল না।

বিদূষক।। হয়তো ভেবেছেন, ঠিক সময়ে ফিরে আসবে মেয়ে।

দেববর্মা।। বিদূষক, আমি এখন কি করবো? চোখের সামনে সর্ষেফুল দেখছি! হলুদ হলুদ! তবে কি আর কোনো আশা নেই? এই যে বছরের পর বছর ধরে অংক কষে গেলাম! কিভাবে কোন পথে রাজনীতির কোন গোলকধাঁধায় ঢুকে গেলে ক্ষমতার শীর্ষ চূড়ায় উঠে যেতে পারবো!

বিদূষক।। পারবেন পারবেন। মাথা ঠান্ডা রেখে ফেলুন পা। আপনার মেয়ে যখন, তখন সে নিশ্চয়ই বুঝবে, আ ধ বুড়ো নেতাদের গলায় মালা দিলে ক্ষমতা অর্থ দুটোই হাতের মুঠোয় চলে আসবে। সুতরাং স্বয়ংবর সভা শুরু করার আগেই সুতনুকা ঠিক ফিরে আসবে।

দেববর্মা।। মাথা আমার এখনো ঠান্ডা আছে। তাই কখন ফিরে আসবে তার জন্য চুপচাপ বসে থাকতে পারবো না। তুমি এক্ষুনি নগর কোটাল এর কাছে চলে যাও। গিয়ে বল, যেখান থেকে পারে আমার মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যত টাকা লাগে আমি সব দেব। হা করে কি দেখছ? যাও বলছি!

দুশ্চিন্তায় দেববর্মা পায়চারি করতে থাকে। বাইরে প্রভাসের গোধন মেলা থেকে নানা রকম হাসি মশকরা উল্লাস চিৎকার ভেসে আসতে থাকে।

দৃশ্যান্তর

এবার দেখা যাবে মঞ্চ আলোকিত করে বিভিন্ন নেতা বসে আছেন। কুঞ্জ কি তাদের নাচ-গান করে মনরঞ্জন করছে।

নিপুনিকা নেতাদের বরণডালা নিয়ে বরণ করতে আসবে। দেববর্মা অতিথিদের সামনে হাত জোড় করে বিগলিত হয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ করছেন।

অন্যদিকে বিদূষক নেতাদের পরিচয় করাচ্ছেন। মাঝে মাঝে শঙ্খ ধ্বনি, উলুধ্বনি পুষ্পবৃষ্টি চলবে।

বিদূষক।। মাননীয় সভাসদগণ, আজকের স্বয়ম্বর সভায় যারা উপস্থিত রয়েছেন, তাদের পরিচয় পর্ব শুরু করি। এইযে প্রথম ব্যক্তি কে বরণ করা হচ্ছে, ইনি হলেন, অন্ধক বংশের নেতা। (আড়ালে) ভয়ঙ্কর কৃষ্ণ বিরোধী! এবার আসুন আমরা যাকে বরণ করে নিচ্ছি, ইনি হলেন বৃষ্ণী বংশের নেতা। কৃষ্ণের মাহাত্ম্য প্রচারক। এইবার যাকে বরণ করা হচ্ছে, ইনি হলেন ভোজ নেতা। ভোজ বংশের প্রবীণ নেতা। ভয়ঙ্কর সুযোগ সন্ধানী। কখনো কৃষ্ণ বিরোধী। কখনো কৃষ্ণের সমর্থক।

জনৈক ব্যক্তি।। এবার আপনার পরিচয়টি বলুন।

বিদূষক।। বলবো বলবো। আপনাদের পাশে আমি নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর। যাকে বলে এলেবেলে ব্যক্তি।

জনৈক ব্যক্তি।। আর এই যে মহিলা যুবতী, সুন্দরী, শঙ্খিনী নারী তিনি কি আজকের সভায় স্বয়ম্বরা হবেন?

দেববর্মা।। না না একদম না। আজকের সভার যিনি স্বয়ম্বরা হবেন তিনি এখনো, মানে, সভায় আবির্ভূতা হন নি।

বিদূষক।। তবে অনতিবিলম্বে তিনি সশরীরে, সালংকারা হয়ে সভায় উপস্থিত হবেন।

অন্ধক।। আমার কিন্তু (নিপুনিকা কে) খুবই পছন্দ হয়েছে!

ভোজ।। (স্বগত) মেয়ে ছেলে দেখলেই পছন্দ হয়ে যায়! বাদ বিচার নেই!

বৃষ্ণী।। এবার ওনার পরিচয়টা হোক।

দেববর্মা।। এর পরিচয় হলো, নিপুনিকা। বিদূষক এর স্ত্রী। আপনারা কি পানাহার করতে চান?

ভোজ।। এমন ভাব করছেন যেন পানাহারের আয়োজন টাই মুখ্য!

অন্ধক।। পানাহারের উত্তম আয়োজন থাকলে আমার আপত্তি নেই। তবে এই মহিলা যদি আমার পেয়ালা তে পানিও পরিবেশন করেন।

বিদূষক।। এইজন্যই বলেছিলাম, নিপুনিকা, তুমি পাঁচ বছরের পুরনো। এত সাজ সেজো না। ঘাটের মরাদের চোখ টাটাবে। আমি বলছিলাম কি, নর্তকী যদি পানাহার পরিবেশন করে-

ভোজ।। দেখুন মশাই, আপনাদের এখানে পানাহার করতে আসিনি। আমার সময়ের দাম আছে। আপনাদের মেয়েকে তাড়াতাড়ি হাজির করুন। মালাবদল সেরে নিয়ে গোধন মেলায় ফিরে যেতে হবে।

অন্ধক।। সময় আমারও হাতে একদম নেই। প্রভাসের মেলায় বেশিক্ষণ অনুপস্থিত থাকা যাবে না। যেকোনো মুহূর্তে রাজনীতির দাবার চাল উল্টে যেতে পারে।

বৃষ্ণী।। আমার একটা কথা আছে। আগেভাগে মেয়েকে শিখিয়ে-পড়িয়ে রাখা হয়নি তো, কার গলায় মালা দিতে হবে।

দেববর্মা।। আজ্ঞে না। আগেভাগে শেখাতে যাব কেন? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না যে-

বিদূষক।। রাজনীতির ছক্কা পাঞ্জা র চালে, ক্ষমতায় কে আসতে পারবে।

বৃষ্ণী।। দময়ন্তী থেকে দ্রৌপদী, সবার স্বয়ম্বর সভা তে এক ছবি। কাকে মালা দিতে হবে, আগেভাগে ঠিক করা থাকে।

দেববর্মা।। নানা আমার এখানে সে সব কিছু নেই। এখানে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলবে।

অন্ধক।। তবু ভালো। আমার বয়স কিন্তু 55। নিয়মিত সূর্য প্রণাম করি। রীতিমতো কর্মক্ষম। রাজনীতির ধারা তে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়, এবার ক্ষমতায় আমরা আসছি। কৃষ্ণের দৌরাত্ম্য শেষ। মেয়েকে জানিয়ে দেবেন।

বিদূষক।। (দর্শকদের) বুঝুন অবস্থাটা! এটা হুমকি? নাকি অন্য আঙ্গিক?

অন্ধক।। কিছু বললেন?

বিদূষক।। বলছি যে, সুস্থ প্রতিযোগিতা তে আপনি জিতবেন।

অন্ধক।। জিতে কি হবে?

বিদূষক।। কামিনী কাঞ্চন ক্ষমতা প্রাপ্তি। সুতনুকা আপনার গলায় মালা দেবে।

ভোজ।। তারমানে আমরা কি তাহলে ভ্যা রান্ডা ভাজতে এসেছি?

বৃষ্ণী।। আমরা কিন্তু আঙ্গুল চুষি না। যারা চুষে চুষে আঙ্গুল সাদা করে, তাদের আঙ্গুল কেটে দিতে পারি।

ভজ।। শুরু করুন, শুরু করুন। সময় নষ্ট করবেন না।

বিদূষক।। এই শুরু হলো বলে। আর কয়েকটা মুহূর্ত।

বৃষ্ণী।। বেশ বেশ। এখানে যত কম থাকা যায় ততই মঙ্গল। চারপাশে যা চোর ছ্যাচ্চর-

অন্ধক।। কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা হলো?

বৃষ্টি।। ঠাকুর ঘরে কে? উত্তর, আমি তো কলা খাইনি!!! চোর ডাকাত কে আজকাল চোখে আঙ্গুল দিয়ে চিনিয়ে দিতে হয় না!

অন্ধক।। নিশ্চয় নিশ্চয়। কথায় বলে চোরের মায়ের বড় গলা। গায়ে ফোসকা লেগেছে বোধ হয়?

বৃষ্ণী।। গায়ে তো লাগবেই ফোসকা। আপনাদের অপপ্রচারের ঢাক চারদিকে বাজছে। আমরাই নাকি শ্রীকৃষ্ণের সামন্তক মনি চুরি করেছি।

অন্ধক।। প্রমান করুন, আপনারা ধোয়া তুলসী পাতা।

বৃষ্ণী।। বলছি তো, আমরা চুরি করিনি। অক্রুর চুরি করেছে। শ্রীকৃষ্ণের আত্মীয়। নিকটাত্মীয়।

ভোজ।। তাহলে তো ব্যাপারটা দাঁড়াল এইরকম যে, থুতু তোমাদের নিজেদের বুকে এসে পরল। কারণ লোকটা তোমাদের দলের নেতা।

বৃষ্ণী।। আশ্চর্য! একজন নেতার পদস্খলনের জন্য গোটা দলকে দায়ী করা যায় না! আমরা তো তাকে মানে অক্রুর কে বিতারিত করতে পারি।

অন্ধক।। দুর্নীতির অভিযোগে বি তারণ? তাহলেতো ঢাকি শুদ্ধ বিসর্জন দিতে হবে!

বৃষ্ণী।। (তেরে যাবে) আপনি কি বলতে চান বলুন তো? বলুন বলুন-

অন্ধ ক।। আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে সরকা রি ক্ষমতায় থাকার সুবাদে, সমস্ত সুবিধা আপনারা কেন পাবেন? এই কারণে আমরা বাধা দেব। আপনাদের নামে প্রচার করব।

বৃষ্ণী।। আমরাও পাল্টা প্রচার করব।

দুজনে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। বিদূষক মজা দেখে। দেববর্মা বাধা দিতে যায়। বিদূষক তাকে আটকাবে।

বিদূষক।। আপনি কি গাধা? ঝগড়া করছে করুক! তাতে আমাদের কি? ঝগরা করে ওরা সময় নষ্ট করুক! আপনার মেয়ে এখনো ফিরে আসেনি!

ভোজ।। এই দুই বংশ মিলে দেশটাকে উচ্ছন্নে দিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দেশের 80% পুরুষ খতম হয়ে গেছে। হাজার হাজার যুবতী মেয়ে ছেলে বিধবা হয়ে ঘুরছে। আরো আছে অনূঢ়া নব যৌবনে পদার্পণ করা যুবতীদের বিরাট সংখ্যা। ফলে যা হবার হচ্ছে। দেশে বেলেল্লাপনা বেড়েই চলেছে। ওদিকে কৃষকদের ফসল কেন বার কেউ নেই। তাঁতী কাপড় বুনছে, পড়বার কেউ নেই। দেশের অর্থনীতি ভেঙে খানখান। আর অর্থনীতি ভেঙে গেলে কি হয়?

বিদূষক।। দুর্নীতিবাজ দের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

ভোজ।। ওপর তলা থেকে নিচের তলা সবকটা দুর্নীতিবাজ।আখের গোছাতে সবাই মুখোশ পড়ে ভালো ভালো কথা বলে। আড়ালে মুখোশ খুলে ফেলে চুরি করে। ডাকাতি করে। সত্যি কথা বল বার কেউ নেই

বিদূষক।। লাখ কথার এক কথা বলেছেন। একবার এক দেশে এক রাজা মৃগয়া তে গিয়ে বললেন, সবাই জঙ্গলটা ঘিরে ফেল। যার পাশ দিয়ে হরিণ পালাবে, তার মাথা কাটা যাবে। একটা বোকা লোক দাঁত বার করে হেসে হেসে বলল, মহারাজ আপনার পাশ দিয়ে যদি হরিণটা পালায়, তখন কি হবে?

ভজ।। আজকাল এইরকম বোকা লোকের সংখ্যা একদম কমে গেছে।

অন্ধক।। বিদূষক মশাই কি বলতে চাইছেন, বোকা লোকটা সে আর আমরা হলাম মহারাজা?

বিদূষক।। একদম না। আমি বোকা হতে যাব কেন। বোকারা কোনদিন বিদূষক হয় না।

দেববর্মা।। হ্যাঁ হ্যাঁ, ও আমার বিদূষক। ওকে আমি আপনাদের কাছে রেখেছি, আপনারা যাতে রসে বসে থাকতে পারেন সেই ব্যবস্থা ও করবে।

কুঞ্জকি, নিপুনিকা মদ পরিবেশন করতে এলো।

দেববর্মা।। হ্যাঁ হ্যাঁ, দাও দাও সবাইকে সূরা পরিবেশন করো। হে-হে-হে বুঝলেন, এই সূরা হলো খুবই উৎকৃষ্ট শ্রেণীর। অর্থাৎ কাদম্বরী। আপনাদের জন্য আনা হয়েছে। অনেক মূল্য গচ্চা দিতে হয়েছে।

বৃষ্ণী।। এই সূরাতেই দেশের নৈতিক মেরুদণ্ডটা গলে গলে যাচ্ছে।

অন্ধক ।। যাবেই তো। আমার পাশে যিনি বসে আছেন, ভোজ বংশের কুল প্রদীপ, মাননীয় নেতা। ব্যবসাটা এদেরই।

বৃষ্ণী।। শ্রীকৃষ্ণ এই ব্যবসায় ঢালাও মদত দিয়ে যাচ্ছেন।

অন্ধক।। কৃষকের ফসলের উপর চড়া হারে কর দিতে হয়। মদের ব্যবসা তে সরকার অনুদান দিয়েই যাচ্ছে।

ভোজ।। থামুন তো আজেবাজে কথা। এবার একটু রসের কথা হোক। নারী আর সূরা দুটোই সম্মুখে। রসালাপ ছাড়া এখন সময় কাটবে কি করে?

বিদূষক।। আমি তাহলে কিছু রস পরিবেশন করি?

বৃষ্ণী।। তুমি তো ব্যাটা ছেলে। শ্যাওড়া গাছের শুকনো ডাল। রস কোথায় পাবে তুমি?

অন্ধক।। তা যা বলেছেন। চোখের সামনে এই দুজন তখন থেকে ঘোরাঘুরি করছে, এরাইতো রসের ভান্ডার। বলি কা ত করো তোমাদের রসের ভান্ডার। আমরা কুপোকাত হয়ে গড়াগড়ি খাই।

ভোজ।। ওহে সুন্দরীরা, তোমরা তখন থেকে মৌনি হয়ে আছো কেনো? আমি কিন্তু এখনও সুরাপান শুরু করি নি!

দেববর্মা।। তাইতো। ব্যাপারটা এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি। আপনি কি সুরা পানে অভ্যস্ত নন?

অন্ধক।। উনার জন্য বড় বড় পিপে আনতে হবে মহাসচিব মহাশয়। উনি এই রকম ছোট ছোট পেয়ালা তে পানাহার করেন না।

ভোজ।। আপনার কথার প্রতিবাদ আমি করবো না। প্রকাশ্যে সত্যি কথা বলতে আমার অঙ্গ কম্পিত হয় না। আমি জলচর প্রাণী। আমার জল অবশ্য কাদম্বরী সূরার জল। তবে, যতবার কাদম্বরীর রসের রসিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করি, ততবার মনে হয়, কোন উদ্ভিন্নযৌবনা ললনা পেয়ালায় চুমুক দিয়ে, অর্থাৎ অধর স্পর্শ করে এঠো করে দিতে না পারলে, আমি শান্তি পাই না।

দেববর্মা।। (সবাই হেসে ওঠে) তাহলে নর্তকী, নিপুনিকা তোমরা অধর স্পর্শ করে দাও!

বিদূষক।। (স্বগত) এরা যদি দেশের মাথা হয়, তাহলে শরীরের অবস্থা কী হবে, কিরকম হতে পারে, ভাবতেও শিউরে উঠছি। অথচ দেশের নাগরিকরা এদের দেখে চোখ বুজে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে ওঠা দূরের কথা, এদের নিয়ে ভাবতেই চায়না।

দেববর্মার অনুরোধ ফেলতে নাপেরে নর্তকী সূরার পেয়ালায় ঠোঁট স্পর্শ করিয়ে দেয়। নিপুনিকা সরে যাওয়ার চেষ্টা করলে, সবাই মিলে তাকে ঘিরে ধরে। নানাভাবে ঠোঁটের কাছে সুরার পাত্র এনে অনুরোধ করতে থাকে, যেন সে ও ঠোঁট স্পর্শ করে। এইসময় নিপুনিকা বিপন্ন হয়ে বলে ওঠে-

নিপুনিকা।। এসব আপনারা কী করছেন?

সবাই মিলে।। তোমাকে অনুরোধ করছি তুমিও আমাদের সূরা পাত্রে তোমার অধরসুধা স্পর্শ করিয়ে দাও।

নিপুনিকা।। তাহলে আপনাদের জাত বজায় থাকবে?

সবাই।। কেন কেন জা ত বজায় থাকবে না কেন?

নিপুনিকা।। আমি যে অচ্ছুৎ কন্যা

সবাই।। তুমি যাই হও না কেন, তুমি অধর স্পর্শ না করালে, আমরা স্বয়ম্বর সভা ত্যাগ করব।

দেববর্মা।। সর্বনাশ। এখন আমার কি হবে? নিপুনিকা, নিপুনিকা, তুমি ওদের অনুরোধ ফিরিয়ে দিও না! ঠোঁট স্পর্শ করে দাও।

নিপুনিকা।। কিন্তু আমি যে তা পারি না।

সবাই।। কেন পারো না? কেন নিজের দাম বাড়াচ্ছো?

নিপুনিকা।। আপনারা কেন বুঝতে পারছেন না, আমি নারী নই।

সবাই।। (হেসে ওঠে) কি বললে? তুমি নারী নও? তাহলে তুমি কি?

নিপুনিকা।। (কেঁদে ফেলে)

সবাই।। তুমি কি পুরুষ?

বিদূষক।। না। ও নারী পুরুষ কোনটাই না।

সবাই।। তাহলে কি হিজড়া?

বিদূষক।। নপুংসক। সুগন্ধি নপুংসক।

সবাই।। কি বললে?

বিদূষক।। চরম সত্যি কথাটা বললাম।

সবাই।। রসিকতা, এটা কি তোমার রসিকতা?

দেববর্মা।। আসলে রসিকতা আমি করেছি বিদূষক এর সঙ্গে। বিদূষক আগে কিছুই জানত না। আমি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।

বিদূষক।। সব জেনেও আমি নিপুন কাকে পত্নীর সম্মান দিয়েছি।

সবাই।। (হো হো করে হাসে) পত্নী!!!

নপুংসক কে পত্নীর সম্মান।

তোমার মত মূর্খ ভূ-ভারত আর কেউ নেই।

বিদূষক।। তা ঠিক। আমি বোকা। মূর্খ। তবে একটা কথা জানি, পুরাণের দেবদেবী থেকে শুরু করে রাজমাতা কুন্তি, কারোর সন্তানের বাবার ঠিক নেই। বাবার খোঁজ নেই। সবাই জারজ। আমার পত্নীর সেই আশঙ্কা নেই। ও জারজ সন্তানের মা হতে পারবেনা।

মুহুর্তের মধ্যে হাসি থেমে যাবে। কাঁদতে থাকা নিপুনিকা কে বুকের কাছে টেনে নেবে বিদূষক।

বিদূষক।। তুমি কেন কাঁদছো নিপুনিকা? তোমার তো কোনো অপমান হয়নি! আমিতো তোমাকে কখনো অমর্যাদা করিনি! তোমাকে কেউ পতিতা বানাতে পারবে না। মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেব কিন্তু তোমাদের অমর্যাদা করেননি।

এইসময় কোটাল ও রক্ষী ছুটে আসবে।

কোটাল।। কি দৃশ্য দেখে এলাম রে বাবা, বাপের জন্মে ভুলবো না।

দ্বাররক্ষী।। এরকম বেলেল্লাপনা জন্মে দেখিনি।

কোটাল।। গোধন উৎসব এখন নরক গুলজার উৎসব চলছে। মান্যগণ্য, , চোর ডাকাত চিটিংবাজ, মহারাজ, কবিরাজ, অধিরাজ, সবাই মিলে কৃষ্ণের সামনে মদ্যপান করছে। মদ্যপান করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বলরাম,সা ত্যা কি , কৃতবর্মা, বভ্রুবাহন, এমনকি সেদিনের ছেলে গদ ও গলা পর্যন্ত মদ খেয়ে—

রক্ষী।। ঝিনচ্যাক ঝিনচ্যাক নাচ চলছে-

দেববর্মা।। (গলা নিচু করে) আমার মেয়ে, আমার মেয়ে সুতনুকা সে কোথায়? তাকে খুঁজে পেলে?

কোটাল।। মেয়েদের কথা আর বলবেন না, কে যে কার গলা ধরে ঝুলছে, চেনা মুশকিল।

দেববর্মা।। তোমাদের তো পাঠালাম আমার মেয়েকে নিয়ে আসতে। তার কি হল?

দ্বাররক্ষী।। আপনার মেয়ে তো? ওরে বাবা, তাকেও তো দেখ লাম, এই এই পর্যন্ত খেয়েছে! তারপর-

দেববর্মা।। আস্তে আস্তে মাননীয় অতিথিরা শুনে ফেলবে যে-চিৎকার করছো কেন?

দ্বাররক্ষী।। টাল খাচ্ছে টাল। একবার এর কোলে, আর একবার ওর কোলে। কখন যে কার কোলে টলে পড়ছে, মাগীটা তাও জানে না।

দেববর্মা।। হারামি, আস্তে আস্তে। বলছি না এখানে খিস্তি করবিনা। মহাজন’ ব্যক্তিরা বসে আছে। তোমরা তাকে ধরে আনলে না কেন?

কোটাল।। চেষ্টা করেছিলাম, কতবার যে হাতের নাড়া ধরে বললাম, ওঠ ছুড়ি তোর বিয়া।

দ্বাররক্ষী।। কিছুই কিছু শুনতে চাইল না। উল্টে আমাদেরও খাইয়ে দিল।

বিদূষক।। কি খাইয়ে দিল কোটাল মশাই?

কোটাল।। কি আবার, চুমু। ঠোঁটে ঠোঁট সাঁটিয়ে লম্বা লম্বা চুমু।

দ্বাররক্ষী।। এবং গলা অবধি মদ।

দেববর্মা।। ওরে তোদের গুষ্টির পায়ে পরি, ওকে পাজা কোলে করে নিয়ে আয়, বেঁধে নিয়ে আয়, যা চাইবি তাই পাবি। আমার মান-সম্মান যে গেল।

বিদূষক।। যা যাবার, তা যাবে। যা কোনদিন ছিল না, তা কি করে যাবে?

দেববর্মা।। কি বললে?

বিদূষক।। তেমন কিছু না। বলছিলাম যে, যদু বংশের আবার মান সম্মান।

কোটাল।। ঠিক আছে ঠিক আছে। তিন গুণ পারিশ্রমিক দিলে, বেঁধে নিয়ে আসতে পারি। তাহলে এবার যাচ্ছি। চলো ভাগ্নি –

দ্বাররক্ষী।। আমি ভাগনি নয় মামা। ভাগ্নে-

কোটাল।। ওই হল। কাপড় তুলে এখন কেউ দেখতে চাইবে না ভেতরে কি মাল ঝুলছে। (প্রস্থান)

বিদূষক।। এবার কি করবেন?

দেববর্মা।। (বোকা বোকা হাসি) আসছে, এবার নিশ্চয়ই আসছে!

অন্ধক।। কে আসছে?

দেববর্মা।। আজ্ঞে কন্যা-

বৃষ্ণী।। ওটা কন্যা? আপনার মেয়ে?

দেববর্মা।। হ্যাঁ। স্বয়ম্বরা হতে আসছে

অন্ধক।। তাহলে আমরাও আসছি।

দেববর্মা।। তার মানে? কোথায় আসবেন?

ভোজ।। ওটা মেয়েছেলে নাকি বারাঙ্গনা?

বৃষ্ণী।। কুলটা-

অন্ধক।। বেশসা-নগর নটি-

সবাই চলে যাবার জন্য পা বাড়ায়-

বিদূষক।। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই ভালো। আপনারা এখন প্রভা সে গিয়ে চরিত্র বজায় রাখুন। তবে যাবার আগে একটা গল্প শুনে যান। ভালো লাগবে। শিক্ষনীয় গল্প। একেবারে সত্যি গল্প। শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামা একবার পঞ্চপান্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী কে বলেছিলেন, কি জাদু করেছো দিদি, ৫ পাঁচটা ডাকাবুকো রাজপুরুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে বশীভূত হয়ে আছে। গোপন কথাটা একটু শোনাবে? ওষুধ টা একবার বলো না! তাহলে আমিও আমার স্বামীর প্রতি প্রয়োগ করি! তারতো ১৬০০০ গোপিনী মানে রক্ষিতা! তাহলেই বুঝুন, ধর্ম সংস্থাপন করতে এসেছে যে লোকটা তার প্রিয়তমা মহিষীর যদি এই বক্তব্য হয়, মানে গোপন দুঃখ থাকে, তাহলে এই রাজ্যের নারীদের কি দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে বুঝতে পারছেন তো? 

অন্ধক।। হ্যাঁ বুঝতে পারলাম। ঠিক আছে। আমি স্বয়ম্বর সভাতে থাকলাম।

বৃষ্ণী।। আমিও থাকলাম।

ভোজ।। আমিই বা বাদ যা ই কেন? আমিও থাকলাম।

অন্ধক।। বিদূষক ঠিকই ইঙ্গিত করেছে। একটামাত্র লোকের বেহিসেবি জীবনযাত্রা র জন্য সারা দেশের মানুষের মূল্যবোধকে যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে, তার একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার।

বৃষ্ণী।। দেখুন মশাই, তিনি হলেন অবতার। মানে ভগবানের প্রতিভূ। তিনি 16000 গোপিনী কে নিয়ে যেটা করছেন সেটা হল উচ্চাঙ্গের সাধনা।

ভোজ।। উচ্চাঙ্গের সাধনা করতে শুধুমাত্র মেয়েছেলে লাগে নাকি?

বৃষ্ণী।। দোহাই আপনাদের, তিনি হলেন-

অন্ধক।। ভগবানের ছায়া-

বৃষ্ণী।। তিনি যা পারেন, সাধারণ লোকে সেটা পারবে কেন? তাকে এভাবে নিচের দিকে টেনে আনবেন না! তাছাড়া আপনারা শুধু দোষটাই দেখছেন! তিনি যে কংস রাজা র হাত থেকে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, এটা ভুলে যাচ্ছেন কেন?

বিদূষক।। ওয়ান মিনিট প্লিজ-

দেববর্মা।। আবার ইন্টারপশন-

বিদূষক।। এটাকি হিন্দি সিনেমার ডিসুম ডিসুম? একা নায়ক ডিসুম ডিসুম করে ভিলেন আর তার বাহিনীকে খতম করে দিল?

দেববর্মা।। আবার বাই ডায়লগ?

বিদূষক।। কি করবো বলুন। নাটক টাইতো এরকম।

দেববর্মা।। আমি কিন্তু নাটক বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।

অন্ধক।। ঠিক আছে ঠিক আছে। ডায়লগ বলুন, নাটকে ফিরুন।

ভোজ।। সব নেতাই প্রথম জীবনে দু’চারটে ভালো ভালো কাজ করে। তারপর সারা জীবন ধরে সেই সব ভাঙিয়ে আখের গোছায়।

অন্ধক।। মিথ্যা ইতিহাস কানের কাছে বারবার বললে সেটা সত্যে পরিণত হয় না বুঝলেন। কংস বধ তিনি একা করেননি। এটা মনে রাখবেন। কংস বধ হয়েছিল সমস্ত বংশের সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলনের পরিনাম। শ্রীকৃষ্ণের চাটুকার লেখকরা উল্টাপাল্টা প্রচার করে লোকটার ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছে।

বিদূষক।। That’s রাইট। আমি সেটাই বলতে চাইছি। জনগণ ইতিহাস তৈরি করে। কোন ব্যক্তি নয়।

বৃষ্ণী।। তারমানে কৃষ্ণ যাদবদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য কিছুই করেননি?

ভোজ।। করেছিলেন। সব নেতারা প্রথম জীবনে দু একটা ভাল কাজ করে ন, তারপর সারা জীবন বসে খায়।

বৃষ্ণী।। অকৃতজ্ঞ। আপনারা সবাই কি বলবো, বলবার ভাষা খুজে পাচ্ছি না। একটা কথা ভেবে দেখুন তো, এই যে তিনি সুকৌশলে, উদ্ধত দুর্বিনীত ক্ষত্রিয় শক্তিকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিলেন একইসঙ্গে ঐক্যবদ্ধ ভারতের সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেন, শান্তি স্থাপন করার চেষ্টা করছেন সে সব বুঝি কিছু না?

ভোজ।। শান্তি? সেতো শ্মশানের শান্তি!!

অন্ধক।। শ্মশানে মানুষ থাকে না, থাকে প্রেতাত্মা। কৃষ্ণ এই দেশকে প্রেতাত্মার দেশ বানিয়ে ছাড়ছে। তবে আমরা তা হতে দেব না। সবাইকে বোঝাচ্ছে মানে সাধারন অশিক্ষিত গরিব মানুষদের বোঝাচ্ছে, তিনি নাকি তাদের লোক।

ভোজ।। আমি তোমাদেরই লোক এই কথা বলে ধাপ্পাবাজি শুরু হয়েছে। আগামী হাজার বছর ধরে এই ধাপ্পাবাজি টা চলবে।

বৃষ্ণী।। কৃষ্ণ ধাপ্পাবাজ?

অন্ধক ।। আরো অনেক কিছু। এবার তার মুখোশ খুলে গেছে। তাইতো হস্তিনাপুর থেকে পালিয়ে এসেছে। ওখানে তাকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল, যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন। গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ গুলো এবার কি করবে?

ভোজ।। প্রত্যেকটি ঘরে শোকের ছায়া নেমেছে। শস্যখেত জ্বলে পুড়ে গেছে। নদী নালা রক্তে লাল। পশ্চিমের আকাশে চিল শকুন ছাড়া অন্য কিছু নেই। গাছে গাছে সবুজ পাতা আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে।

বৃষ্ণী।। আপনারা সমালোচনা করা ছাড়া অন্য কিছু জানেন না।

অন্ধক।। এবার শুরু হবে এইখানে কৃষ্ণ বি তারণ। ঘরে ঘরে সব তৈরি হচ্ছে। আমার কথা মিলিয়ে নেবেন।

কোটাল রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে আসবে।

কোটাল।। যুদ্ধ-যুদ্ধ-যুদ্ধ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

সবাই।। কোথায় কোথায়?

কোটাল।। সমস্ত যাদব নেতারা মাতাল হয়ে রাজনীতির তর্ক বিতর্ক করতে করতে উন্মত্ত হয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। সবাই এক একটা মুসল অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়েছে।

মঞ্চেও শুরু হয়ে যাবে অন্ধক ইত্যাদি নেতাদের মধ্যে হাতাহাতি মারামারি। দেববর্মা বাধা দিতে গেলে বিদূষক তাকে আটকাবে।

বিদূষক।। লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন। আগুন

কোটাল।। অন্ধক বংশের লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে বৃষ্ণী দের উপর। চলছে নির্বিচার হত্যা লীলা।। সাত্যকি নিহত। (প্রবল হাসি)

বিদূষক।। এইবার এইবার যদুবংশ হবে কুপোকাত। (হাসি)

কোটাল।। ভোজ বংশের লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্ধক বংশের লোকজন।

বিদূষক।। নারদ নারদ নারদ নারদ

দেববর্মা।। আমার মেয়ে, আমার মেয়ের কি খবর পেলে? কোথায় সে?

কোটাল।। জানিনা। তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

দেববর্মা।। (আর্তনাদ) সুতনুকা! তুই একি করিলি মা!!!

বিদূষক।। কৃষ্ণ তিনি কি করছেন এখন?

কোটাল।। তিনিও হত্যা শুরু করেছেন। যাকে পাচ্ছেন হাতের সামনে তাকেই হত্যা করছেন। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে

দেববর্মা।। বিদূষক বিদূষক একি হলো? (উদভ্রান্তের মত) এরকম কেন হলো?

বিদূষক।। যা হবার তাই হল। মহামতি, কৌরব কুলশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম মৃত্যুর আগে কি বলে গিয়েছিলেন মনে আছে? বিভেদ, একমাত্র বিভেদ ই গণতন্ত্রের মূল কেটে দেয়! যাদব গণতন্ত্রের মূল এ ভাবে কেটে যাচ্ছে! সমূলে উচ্ছেদ হতে যাচ্ছে! এটাই অনিবার্য ছিল! (হাসি)

দেববর্মা।। তুমি হাসছো বিদূষক?

বিদূষক।। হ্যাঁ হাসছি। কারণ সময়ের চেয়ে বড় বিদূষক আর কেউ নেই। (হাসি) (নর্তকী ও নিপুনিকা ছুটে আসবে)

নর্তকী।। এসব কি হচ্ছে বিদূষক?

বিদূষক।। ক্রান্তিকাল আসন্ন। বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে।

নিপুনিকা।। এসবের মানে কি?

বিদূষক।। ভূমিকম্প যাকে বলে সমাজবিপ্লবের ভূমিকম্প।

বাইরে থেকে মুসল অস্ত্রের বিস্ফোরণ শব্দ আসতে থাকলো। ভেতরে নেতারা মারামারি করতে করতে লুটিয়ে পড়েছে। প্রাসাদের বড় বড় গম্বুজ, পিলার সব ভেঙে পড়েছে। ইট কাঠ পাথরের বালি র ধোঁয়ায় মঞ্চটা যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল।

প্রবল ভূমিকম্পে মেদিনী কাঁপছে। পাগলের মত দেববর্মা তার মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। নর্তকী এবং নিপুনিকা বিদূষক এর কাছে ছুটে আসবে। রক্তাক্ত অবস্থায় দ্বাররক্ষী বাইরে থেকে ছুটে আসবে।

দ্বাররক্ষী।। কৃষ্ণ, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ মারা গেছেন!

বিদূষক।। কি বললে?

দ্বাররক্ষী।। সামান্য এক ব্যাধের তীরের আঘাতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন।

বিদূষক।। (উন্মত্তের মতো হাসি) শুনছেন আমার মান্যবর প্রভু, দেববর্মা, দম্ভের সঙ্গে, স্বৈরাচারী কন্ঠে যে লোকটা একদিন বলেছিল, সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ-অর্থাৎ সর্বধর্ম ত্যাগ করে কেবলমাত্র আমাকে স্মরণ নাও! আমার পুজো করো! আমি সেই সর্ব শক্তিমান পুরুষ! আমিই শ্রেষ্ঠ! আমি আদি অনন্ত! (প্রবল হাসি) আজ সেই লোকটা সামান্য ব্যাধের হাতে মারা গেল! এর থেকে বড় হাসির সংবাদ আর কি হতে পারে?

নিপুনিকা।। তুমি এভাবে হাসছো কেন স্বামী? আমা র খুব ভয় করছে!

বিদূষক।। তোমার ভয় পাবার কোন কারণ ঘটেনি। যা ঘটছে তা আনন্দের ঘটনা। যদুবংশ ধ্বংস সমাজবিজ্ঞানের নিপুন শল্যচিকিৎসা। বদ রক্ত বেরিয়ে গেলে স্বাস্থ্যহানি ঘটে।

নর্তকী।। তুমি হয়তো ঠিকই বলছে বিদূষক। যারা মরেছে তাদের মৃত্যুতে আমাদের দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। দেশের লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের কিচ্ছু যায় আসেনা।

বিদূষক।। বাহ চমৎকার বলেছ। মরছে যারা তারা হলো কতগুলো স্বার্থান্বেষী, কুচক্রি, শাসন ক্ষমতার মাথায় বসে থাকা গুন্ডার দল আর তাদের চাটুকাররা। গোধন উৎসবে কোনদিন কখনো শ্রমজীবী মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না।

নিপুনিকা।। সবকিছু ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা কোথায় যাব? কি করবো? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

নর্তকী।। হ্যাঁ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কি ভয়ঙ্কর একটা ভূমিকম্প ঘটে গেলো। মনে হচ্ছে শহরটা এক লহমায় মাটির তলায় চলে গেল। আমি খানিকক্ষণ আগে বাইরে গিয়ে দেখলাম, এই বাড়িটার মতন আশপাশের সমস্ত বাড়ি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

বিদূষক।। ইতিহাসের পটপরিবর্তনে র সময় সম্ভবত এইরকম ঘটে। আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের মাথার উপর আছে অনন্ত নীল আকাশ। পায়ের নিচে রয়েছে আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। পাখির বাসা মাঝে মাঝে ঝড়ে উড়ে যায়। ডিমগুলো মাটিতে পড়ে থেঁতলে যায়। পাখি তো ভয় পায় না। নতুন ভাষার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

নিপুনিকা।। পাখি বাসা বানাতে পারে। আমরা তো পারি না। জন্মের পর থেকে বড়লোকদের প্রাসাদে বন্দি জীবন যাপন করি। খাঁচার জীবনটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

নর্তকী।। এবার অভ্যাসটা বদলাতে হবে নিপুনিকা। ছেলেবেলা থেকে কত হাত বদলে বদলে আজ এইখানে এসে ঠেকেছে আমার জীবন। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি একজন নারী। মা হবার অধিকার আমার আছে। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করবা র স্বপ্ন আমি কেন দেখতে ভুলে গেলাম!

বিদূষক।। আমিও তো চাষার বেটা। জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে, শহরে এসেছিলাম রোজগার করতে। পেটের জন্য হয়ে গেলাম বিদূষক। পেটে আগুন, মনের আগুন, শরীরের হাজার যন্ত্রণা ভুলে থাকতে হয়। স্বপ্নের গলা টিপে মেরে রাজা মহারাজা আমলা গামলা কসাই ব্যাপারি দের হাসাতে হয়। ভেতরের মানুষটাকে যতবার বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি, ততবার রাজনীতির থাপ্পড় খেয়ে ভেতরের মানুষটা আত্মহত্যার পথ খুঁজে বেড়ায়।

নিপুনিকা।। তাহলে আমরা এখন কোথায় যাব? কে দেবে আমাদের আশ্রয়?

দেববর্মা।। (মরবার অভিনয় থেকে হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ায়) কোথায় আর যাবে, জেল। এযুগের কংসের কারাগার।

নিপুনিকা।। মানে?

ভোজ।। (দেববর্মার মতন উঠে দাঁড়ায়) নাটকটা সিডিশন আইনে পড়ে যাবে! তখন হয়তো আমরা কেউ কেউ রেহাই পেলেও, নাট্যকার পরিচালক পার পাবে না!

দেব বর্মা।। বাই ডায়লগ। সবাই মিলে বাই ডায়লগ দিয়ে নাটকের পিন্ডি চট কে দিচ্ছে। কিছুতেই আর কনসেনট্রেট করতে দিচ্ছে না।

অন্ধক।। নাটকটা যখন শুনেছিলাম, দারুন লেগেছিল। এখন মনে হচ্ছে, চলবে না। এযুগের কংস রাজারা চলতে দেবে না।

বৃষ্ণী।। এসব ইতিহাস, নাকি বানিয়ে বানিয়ে-

বিদূষক।। বানাতে যাব কেন? এটাই তো আসল ইতিহাস!

দেববর্মা।। প্রমাণ আছে?

বিদূষক।। নিশ্চয়ই আছে। মহাভারত, গীতা, বিষ্ণুপুরাণ, আরো অনেক বই আছে।বুঝলে বন্ধু, পড়তে হবে। নইলে পিছিয়ে পড়তে হবে।

নর্তকী।। গরিব মানুষ এসব পড়াশোনা অভ্যাস করে ফেললে, রাজা মহারাজাদের পিছিয়ে পড়তে হবে।

দেববর্মা।। বারবার ইল্যুশন কেটে দিচ্ছ কেন? নাটকের বারোটা বেজে যাচ্ছে।

অন্ধক।। সেই বেদের যুগ থেকে শুরু হয়েছে গরিব মানুষদের ইল্যুশন এ ডুবিয়ে রাখা। বাস্তবটাকে পরিষ্কার করতে দিলেই রাজাদের রাজ্যপাট চলে যাবে।

দেববর্মা।। এটা কি ব্রেখট হচ্ছে?

নিপুনিকা।। তাহলে নিশ্চয়ই আমার জন্ম কাহিনী ও ওখানে আছে।

বিদূষক।। আছে বৈকি। নিপুনিকা হল যাদব গণ সংঘের মহাসচিব দেববর্মার জনৈক রক্ষিতার সন্তান।

দেববর্মা।। সে যুগে মহাজন’ ব্যক্তিদের অর্থাৎ রাজপুরুষদের ডজন ডজন রক্ষিতা থাকতো। তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া ডজন ডজন জারজ সন্তান থাকতো। মহাভারতের কৌরব ও পাণ্ডবদের অনেকেই তো জারজ সন্তান।

নিপুনিকা।। হ্যাঁ থাকতো। কিন্তু তারা সমাজে স্বীকৃতি পেত। আপনি আমাকে স্বীকৃতি দিলেন না কেন? বিদূষক-এর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তামাশা করলেন কেন?

দেববর্মা।। কি আশ্চর্য, যাদব গণ সংঘের মহাসচিব তামাশা করবে নাতো কি ইল্যুশন ভাঙার জন্য বিপ্লব করবে?

বিদূষক।। একদম ঠিক। যদুবংশ ধ্বংসের কারণ গুলো নিশ্চয়ই বোঝা গেল এবার?

নর্তকী।। একটা কথা বলব?

দেববর্মা।। বাই ডায়লগ চলবে না। 

নর্তকী।। যদুবংশ ধ্বংসের সবকটা কারণ আমরা কি এখন দেখতে পাচ্ছি না?

বৃষ্ণী।। সেটা পাবলিক বলবে। মানে নাটকের দর্শকরা বলবে।

দেববর্মা।। তোমরা বলতে দিচ্ছ কোথায়? নিজেরা ই. তখন থেকে বকবক করে যাচ্ছ। আরে বাবা নাটক তো শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। এবার পাবলিককে ভাবতে দাও। বুঝতে দাও। এই কে আছিস, পর্দা ফেলে দে। আলো নিভিয়ে দে। মেকআপ তুলে বাড়ি যেতে হবে। অনেক রাত হয়ে গেলো বাবা। আজকাল যখন-তখন বাস বন্ধ হয়ে যায়। অনেক রাত হয়ে গেছে এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

মঞ্চের সব আলো নিভে গেল। পর্দা পরতে থাকে। বিদূষক, নিপুনিকা আর নর্তকী মঞ্চের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়বে। বাকিরা মঞ্চ ত্যাগ করবে। তারপর বিদূষক রা তিনজন পর্দার বাইরে চলে আসবে।

বিদূষক।। রঙ্গমঞ্চের নিয়মে আলো নিভে যাবে, পর্দা পড়বে। রঙ্গমঞ্চের বাইরে যে জগত আছে তারও একটা নিয়ম আছে। এখানে থাকে জীবন্ত সব মানুষ।

নর্তকী।। এতক্ষণ পর্দার ওপাশে কৃত্রিম আলোর নিচে এক ধরনের মিথ্যা পাটাতনে দাঁড়িয়ে অতীতের একটা সময়ের কথা বলছিলাম।

বিদূষক।। সেই অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসে আমরা নতুন করে খুজবো, বিশ্লেষণ করবো যাদব গণতন্ত্রের ধ্বংসের কারণ গুলো।

নিপুনিকা।। আমাকে খুঁজতে হবে আজকের নিপুনিকা দের যন্ত্রণা। স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা।

বিদূষক।। গণতন্ত্রের সুর যখন কেটে যায়, যদুবংশ যখন ধ্বংস হয়, তখন দেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের কোন ভূমিকা থাকে না কি? আমরা কি আমাদের কর্তব্য পালন করি? এই দুই নারীকে যে সমাজ অপমান করে, লাঞ্ছনা করে, নারীত্বের সম্মান দেয় না: সেই সমাজের প্রতি আমাদের কোনো ভূমিকা নেই? কি হবে তার উত্তর? বলুন? আপনারা কি উত্তর খুঁজবেন না? কোন দায়িত্ব নেই আপনাদের?

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -