Bangla Natok: বাংলা নাটক – ‘অভিরামদের গল্প’

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জিলাল

চরিত্র: অভিরাম/ দিনু দা/ ঘটু দা/ চাঁদু/ বাসব হালদার/ পাখি মিঞা

রেল স্টেশনের পাশে যে রাস্তাটা লোকালয়ের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার পাশে সারিসারি দোকান। মঞ্চে দেখা যাচ্ছে দিনুদার সাইকেল রিপিয়ারিং শপ। বিপরীত দিকে ঘটুদার চায়ের দোকান। তখনো ভোর হয়নি। অভিরাম দোকানের সামনে খাটিয়া পেতে ঘুমোচ্ছে। রেলওয়ে স্টেশন কাঁপিয়ে পরপর কয়েকটা মেইল ট্রেন চলে যাবে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে অভিরাম। ভয়ের স্বপ্ন। কারা যেন তাকে মারতে এসেছে। ধরফর করে অভি উঠে বসে। জল খাবে। আতঙ্কিত চোখ মুখ নিয়ে পায়চারি করবে। তারপর আবার শুয়ে পড়বে।

এবার রাত কেটে ভোরের আলো ফুটতে থাকে। পাখি মিঞাকে গান গাইতে গাইতে আসতে দেখা যাবে।

পাখি মিঞার গান। খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়! গান শুনে অভি র ঘুম ভেঙে যাবে। খাট থেকে নিচে নামবে। পাখি মিঞাকে ডাকাডাকি করবে।

অভি।। এই যে পাখি মিয়া, পাখি মিঞা, শুনে যাও গো শুনে যাও-এ দিক পানে একবার আসো গো-তোমার সঙ্গে কথা আছে।

পাখি মিঞা।। (গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসবে) কি কথা গো মিঞা, নতুন আরেক খান পাখি চাই বুঝি?

অভি।। না গো না, আগেরবার যেটা দিয়ে গেছো, ওই যে দেখো ওইখানে ঝুলছে। কাল ময়না। বড্ড পাজি। আমার সঙ্গে ঝগড়া করে। খালি খালি রাগ করে।

পাখি মিঞা।। তাইলে রাতের বেলা বাড়ি ফেরার সময় তোমাকে একটা সবুজ টিয়া পাখি দে যাব কেমন।

অভি।। দাম দিতে পারব না গো। পকেট যে পয়সা নাই।

পাখি মিঞা।। তোমার কাছে আমি দাম চেয়েছি? যখন পয়সা থাকবে, তখন দিলেই হবে!

অভি।। তাছাড়া একটা কে সামলাতে পারছি না, আরো একটা নিয়ে কি করব?

পাখি মিঞা।। পেয়ার করবে। মহব্বত গো যাকে বলে ভালোবাসা, তাই করবে।

অভি।। দূর। ওসব আমার কপালে নাই। তুমি তো জানো, আমার বিয়ের রাত্রে বউ পালিয়ে গেছে।

পাখি মিঞা।। বউ হল খাঁচার পাখির মত। দানাপানি দিতে হয়। আদর সোহাগ দিতে হয়। দরকার হলে বউয়ের মানভঞ্জন পালা গাইতে হয়–অনেকটা টবে রাখা ফুল গাছের মত। মাটি কুপিয়ে সার দিতে হয়। পানি দিতে হয়।

অভি।। ওসব কথা থাক। ভোররাত্রে খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। কারা যেন আমাকে মারতে এসেছে। দোকানপাট ভাঙতে এসেছে।

পাখি মিঞা।। চারিদিকে এখন ভাঙা ভাঙির শব্দ। সবকিছু ভাঙছে। নদীর পাড় ভাঙছে। ঘর ভাঙছে। বন জঙ্গল ভাঙছে। পাখির বাসা ভাঙছে। ভাঙছে আর ভাঙছে। মানুষকে যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গিতে পেয়েছে। স্বপ্নে তাই তুমি আমি দুঃস্বপ্ন নিয়ে রাত জাগি। জানিনা এই দুঃস্বপ্নের রাত কবে ভোর হবে। ঘটুও রাত জাগছিল। এখানকার দোকানদারদের মধ্যে অনেকেই পালা করে রাত জাগে।

ঘটু।। (কাচের ক্লাসে অ ভিরামের জন্য গরম চা এনে দিল) এই যে অভি, চা নে। (পাখি মিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে) অমন করে কি দেখছো? তোমাকে চা দেওয়া হবে না!

পাখি মিঞা।। আমার অপরাধ?

ঘোটু।। পাখি ধরে ধরে আমাদের এই উদয়পুরটাকে পাখি শূন্য করে দিলে-

পাখি মিঞা।। কি করবো দাদা ভাই। এই সংসারে কেউ বাশ কেটে বাঁশি বানায়। কেউ বানায় ওসি।। পাখি না ধরলে পাখি না বেচলে পেট চালাবো কিভাবে?

অভি।। চা কোথায় পেলে ঘটু দা?

ঘটু।। মাঝরাতে এক গামলা চা বানিয়ে রাখি। রাত জাগতে হলে দরকার হয়।

পাখি মিঞা।। তোমরা বুঝি রোজ রাত জাগো?

ঘটু।। পালা করে এখানকার দোকানদাররা রাত জাগতে বাধ্য হচ্ছে। কানাঘুষো শুনে যাচ্ছে, যে কোনদিন বুলডোজার এসে এদিককার দোকানপাট সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।

পাখি মিঞা।। অনেক জায়গায় এইসব ঘটছে।

ঘোটু।। জানি তো। এদিকে ও হবে। তবে আমাদের মুখের উপর দিয়ে বুলডোজার কে যেতে হবে। এই যে অভি, দিনু দা কাল রাতে বলে গেছে, তার হয়তো আসতে দেরি হবে। তুই দোকানটা তাড়াতাড়ি খুলে দিস। (নিজের দোকান খুলতে যাবে)

অভিরাম চা খেতে গিয়ে পাখি মিয়ার দিকে তাকাবে।

অভি।। তুমি চা খাবে?

পাখি মিঞা।। না থাক। তুমি খাও-

অভি।। থাকবে কেন। এটা তুমি খাও। সকালবেলা খালি পেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছো।

পাখি মিঞা।। কিন্তু পকেটে যে পয়সা নাই-

অভি।। তার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।

পাখি মিঞা।। তুমি খাবে না?

অভি।। খাবো খাবো। ঘটু দাকে বললে, আর একটা দিয়ে যাবে।

পাখি মিঞা চা খেয়ে তৃপ্তি পায়।

পাখি মিঞা।। তাহলে খাই?

অভি।। বলছি তো খাও

পাখি মিঞা।। আহ আহ বড় তৃপ্তি হল গো। শরীরটা চ ন ম নিয়ে উঠলো। সারাদিন আজ আমি বিলের ধারে ফাঁদ পেতে অনেক পাখি ধরবো। যাওয়ার সময় তোমাকেও একটা দিয়ে যাব। (গান গাইতে গাইতে চলে যাবে)

ঘটু।। অভিরাম, তোর চা খাওয়া হলো? আমাকে দু বালতী জল তুলে দিবি? দিনুদা বলেছে, চা দু কে যেন দোকানে ঢুকতে না দেওয়া হয়। (গ্লাস নিতে আসবে, দেখবে অবিরাম কাচের গ্লাসটা হাত থেকে ফেলে ভেঙে ফেলে ছে।) ভাঙ্গলি তো? এক একটা গ্লাস এর কত দাম জানিস? আমার দোকানের বউনি হলনা। তুই গ্লাস ভেঙ্গে ফেললি! তোর মতো আহাম্মক আমি দুটো দেখিনি! এইজন্য তোর বউ পালায়!

অভি।। মা মানে ইচ্ছে করে ভাঙিনি। পাখি মিয়া চা খেতে চাইল-

ঘটু।। চা খেতে চাইল আর তুই মাগনায় দিয়ে দিলি। এখন তোকে কে চা দেবে? আমার দোকানের খাতায় তোর কত টাকা জমেছে জানিস? বাকি বকে না মেটানো পর্যন্ত আর এক কাপ চাও পাবি না! (ভাঙা কাঁচের গ্লাসের কাচের টুকরো তে অভিরামের হাত কেটে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে) তুই একটা আহাম্ম! কাটলি তো হাত? নে সর বলছি, তোকে আর কাজ দেখাতে হবে না! (ভাঙা কাঁচের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। ওই রামের হাতে সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ করে দেবে।)

অভিরাম।। আসলে আমার যে কি হয়! কিছুই বুঝতে পারি না!!! সব সময় চোখের সামনে একটা সাইকেল ভেসে উঠতে দেখি!

ঘটু।। সাইকেল সাইকেল করে তোর একদিন জীবনটা যাবে।

অবিরাম।। তা যাক। তবে যাওয়ার আগে একটা সাইকেল আমাকে কিনতেই হবে। সেকেন্ড হ্যান্ড হলেও চলবে। তোমার কাছে আমার তো হাজার টাকা জমানো আছে।

ঘটু।। হাজার টাকার আধখানা সাইকেল ও হবে না। টায়ার টিউবের দাম কিভাবে বাড়ছে জানিস?

অভিরাম।। দিনুদার কাছেও আমার হাজার টাকা জমানো আছে। আর কিছু জোগাড় হলে নিশ্চয়ই পুরনো একটা সাইকেল কিনে ফেলতে পারব।

ঘটু।। তারপর কি হবে? সাইকেল চালিয়ে কোথায় যাবি? কাকে চাপাবি তোর সাইকেলে?

অভিরাম।। (সলজ্য ভঙ্গিতে) সে আছে একজন!

ঘোটু।। তাই নাকি। একজন সে জুটিয়ে ফেলেছিস। তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সেই একজনের আগুনে পুড়ে তোর চরম শিক্ষা হয়নি। আবারো একজন জুটিয়েছিস।

এমন সময় দিনু দা অভিরাম অভিরাম বলে ডাকতে ডাকতে আসবে।

দিনু দা।। অভি, এই অভি, কোথায় রে তুই?

অভি।। এইতো আমি (এমনভাবে দীনুদার সামনে চলে যাবে, দিনুদার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। দিনু দা কপালে ব্যথা পাবে। চিৎকার করে উঠবে)

দিনু।। উফ হারামি, খচ্চর, নাকটা বোধ হয় ভেঙে গেল।

অভি।। (অপরাধী কন্ঠে) দেখতে পাইনি দিনু দা-

দিনু।। চোখের মাথা খেয়েছিস? শুয়ারের বাচ্চা! যমের অরুচি। আমার ঘাড়ে এসে আমাকে মারতে– উফ মাগো-দিনটা আজ ভালো যাবে না-

অভি।। ডাক্তার ডাকবো দিনু দা?

দিনু।। তোর বাপকে ডাক। তাকে জিজ্ঞেস করবো, এই হারামির বাচ্চাটাকে কিভাবে পয়দা করেছে–

অভি।। এর মধ্যে আমার বাবাকে টানছো কেন!

দিনু।। তাহলে কাকে টানবো, তোর মাকে? মুখে মুখে কথা বললে, মুখ ভেঙ্গে দেবো! কাল সারারাত কোথায় ছিলি.?

অভি।। কেন রোজ যেখানে থাকি। খাটিয়া নিয়ে এইখানে বিছানা পেতে শুয়েছিলাম।

দিনু।। শুয়ে থাকবার ডিউটি তোর? যেদিন বুলডোজার এসে দোকানপাট সব ভেঙে দিয়ে যাবে, তখন কোথায় শুবি? তোকে না বলেছিলাম ঘটু দের সঙ্গে রাত পাহারা দিতে?

ঘটু।। (নিজের দোকান থেকে কাজ করতে করতে) আমি ওকে নিতে চাইনি দিনু দা!

দিনু।। কেন নিতে চাস নি? আমি তো বলেছি, আমার দোকান থেকে পাহারা দেবার জন্য অভিরাম যাবে! আমার বউয়ের শরীর খারাপ! তার কাছে থাকতে হয় আমাকে! নইলে আমি নিজেই রাত পাহারা দিতাম!

ঘটু।। তুমি তো জানো দিনু দা, অভি রাত জাগতে পারে না। তাছাড়া ক্যালানে মদন। কখন যে কি ঘটে যাবে, তোমার এই ক্যালানে কার্তিক উল্টোপাল্টা কি করে বসবে।

দিনু।। জানি জানি। আমার বুকের উপর চেপে বসে তুর্কি নাচ দেখাচ্ছে। এই যে ক্যালানে কার্তিক, বাসব হালদার এদিকে এসেছিল? (দোকানের মধ্যে ঢুকে কাগজপত্র ফাইল ইত্যাদি নাড়াঘাটা করবে) ছেলেটা আমাকে ডাহা ফ্যাশন ফাঁসিয়েছে। পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না। হ্যাঁ বা না একটা কিছু তো বলবি। তোর লেজ ধরে অনেক দিন বসে আছি। ফল তো কিছু হচ্ছে না। ঝেড়ে কাসো বাবা। তখন আমরাও পেট ঝেড়ে হাগি।

ঘটু।। এত সকালে তুমি হালদারকে কখনো কি দেখেছো দিনু দা? সকাল দশটার আগে ওদের তো ঘুম ভাঙ্গে না!

দিনু।। আমাকে তো এতক্ষণ বসে থাকলে চলবে না। কোর্টে যেতে হবে। সবাই বলছে হালদারের মুখ চেয়ে আর বসে থাকা যাবে না। আইনের ঘন্টা নাড়াতে যেতে হবে।

ঘটু।। কথাটা আমি অনেক আগেই বলেছিলাম। এই শালারা কিছু করবে না। হেন তেন করে সময় পার করে দেবে। ওটাই তো ওদের রাজনীতি।

দিনু।। রাম পদ কালকে রাত্রে সাইকেল নিয়ে গেছে?

অভি।। হ্যাঁ। ২০০ টাকা দিয়ে গেছে-

দিনু।। ২০০ টাকা কেন? বিল হয়েছে ৬০০ টাকা!

অভি।। (ক্যাশ থেকে টাকাটা বার করে দেবে) বাকিটা পরে দিয়ে যাবে বলেছে-

দিনু।। তুই সাইকেলটা ছেড়ে দিলি কেন?

অভি।। বলল, অফিসে যেতে অসুবিধা হচ্ছে-

দিনু।। তাতে আমার কি? সাইকেলের দোকানে ও ধার বাকি চলবে? এটা কি মাসকাবাড়ি মুদির দোকান? দোকানে লম্বা ফর্দ ফেলে দিয়ে, মাগ ছেলেপেলে নিয়ে সারাবাস বসে কাণ্ডে পিন্ডে গিলে চললাম? আমি কি দান ছত্র খুলে বসেছি.? তোর মাইনের টাকা থেকে বাকি টাকাটা কাটা যাবে বুঝলি! যত্তসব! এই হারামজাদা ওখানে কি করছিস?

অভি।। সাইকেলে পাম্প মারছি দিনুদা–

দিনু।। গিরিজা বাবুর সাইকেলের লিক ধরেছিস?

অভি।। চেষ্টা করেছি। ধরতে পারিনি, দিনুদা-

দিনু।। জীবনে কি ধরতে পেরেছিস? বিয়ের রাত্রে নিজের বউটাকেও তো ধরে রাখতে পারিস নি! যা জলের বালতিটা নিয়ে আয়-

অভি জলের বালতি নিয়ে আসবে। সাইকেলের টায়ারের টিউব সেই বালতিতে চুবিয়ে দিনু দেখাবে।

দিনু।। কি দেখছিস?

অভি।। বুরবুর করছে-

দিনু।। এবার দেখ এটা কি? বল এটা কি?

অভি।। লিক-

দিনু।। তাহলে? এই লিক এখন কিভাবে বেরোলো?

অভি।। তুমি বার করলে।

দিনু।। দুইবার করতে পারলি না কেন?

অভি।। সেটাই তো ভাগ্য দিনু দা। আমার ভাগ্যটা গিরিজা বাব ুর সাইকেলের চোরা লিকের মত। জীবনের সাইকেলে যতবার প্যাডেল মারছি, ততবার চাকার স্পোক কে দরে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

দিনু।। জানি তো হবে না। সেই জন্যই তো রোজ বলি, রেলস্টেশনে গিয়ে তুই মুটে গিরি কর। আমার ঘাড় থেকে নাম। আমি বেরোচ্ছি। চাদু, ফেরেব্বাজ টা এলে দোকানে ঢুকতে দিবি না। ওর চাকরি নট হয়ে গেল।

ওদিকে চাঁদু হিন্দি গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছিল। দীনুদাকে দেখে লুকিয়ে পড়বে।

দিনো।। ঘোতন এলে বলবি, ওর সাইকেলের টাল আমি ওবেলা মেরে দেব (যাবার জন্য পা বাড়ায়)

অভি।। মেরেছি দিনু দা

দিনু।। কি মেরেছিস?

অভি।। ঘটনের সাইকেলের টাল মেরেছি।

দিনু।। টাল মেরেছিস মানে? তুই তো সাইকেল চালাতেই জানিস না! টাল মারলি কিভাবে?

অভি।। শিখেছি। চাঁদু আমাকে সাইকেল চালানো শিখিয়ে দিয়েছে।

দিনু।। আরিব্বাস। তাহলে তো তুই বাঁদর থেকে হনুমানের প্রমোশন পেয়ে গেছিস। এই ঘোটু, অভি কি বলছে দেখ। ও নাকি ব্যালেন্সের খেলাটা শিখে ফেলেছে। ডাবল ডিমের ওমলেট ওকে দে। আমি পয়সা দিয়ে দেব। 

অভি।। তারচেয়ে বরং আমাকে, একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল ব্যবস্থা করে দাও না-২০০০ টাকা আমি জমিয়েছি।

দিনু।। দূর ব্যাটা। পকেটের টাকা খরচা করে সাইকেল কিনতে যাবি কেন? একটা বিয়ে কর। ওটা শ্বশুর দেবে। ফ্রিজ টিভি ঘুমোবার খাট-

অভি ।। কি যে বলোনা তুমি। আমাকে কেন দিবে। আমি তো দো জবর।

দিনু।। দেবে দেবে। তুই একটা দো জ বউ জোগাড় করে ফেল। আমি তো শুনলাম অনন্ত দাসের মেয়েটা ময়না তোর সঙ্গে লাট খাচ্ছে। ময়নার আগের স্বামীটা গলায় দড়ি দিয়েছিল। কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। কি আর করবে। ঝুলে পড়লো। একেই বলে আহাম্মকের বাচ্চা। মুটে গিরি কর, নেতারা যেভাবে চুরি ডাকাতি করছে, তুইও কর। সেটা না পারিস রাজনীতি কর। স্বাধীন ব্যবসা। নো ইনভেস্টমেন্ট। সেন্ট পার্সেন্ট প্রফিট। (চমকে উঠলো) কি হলো? কি করলি তুই?

অভিরাম একটা সাইকেলের পাম্প দিচ্ছিল। অতিরিক্ত পাম্প দেওয়ার জন্য টায়ার ফেটে যায়।

অভি।। যা ফেটে গেল!!!

দিনু।। ফেটে গেল মানে?

অভি।। বুঝতে পারিনি

দিনু।। বানচোদ। বেরো বলছি এখান থেকে (অভিকে লাঠি নিয়ে তাড়া করবে)

অভি।। আর হবে না-

দিনু।। নিশ্চয়ই হবে। হাজার বার হবে। তুই বানচোদ এই দোকানে থাকলে আমার দোকানের লাল বাতি জ্বলে যাবে। খানকির ছেলে বেরো বলছি।

অভি।। মাফ চাইছি-

দিনু।। টায়ার টিউবের দাম জান জানিস কত?

অভি।। তোমার পায়ে পরি দিনু দা-আর হবেনা-

দিনু।। না না না আর একদিনও না। তুই আমার ঘর থেকে নাম।

ঘটু।। (দিনুর জন্য চা নিয়া আসবে) একটা কাজ কর দিনু দা। ওকে ঘটক ডেকে একটা বিয়ে দিয়ে দাও।

দিনু।। ঠিক বলেছিস। একটা রোজগেরে বউ দেখতে হবে। যে ওকে রোজগার করে খাওয়াবে। ও বাড়িতে বসে রান্নাবান্না করবে, বউয়ের শাড়ি ব্লাউজ সায়া কা চা কাঁচি করবে। বাসন মাজবে।

ঘটু।। আর অবসর সময় বেলুন ফাটাবে। ওর বউকে বলে দেবো। রোজ ডজন ডজন বেলুন এনে দেবে। ও বেলুন ফোলাবে, তারপর ফটাস ফটাশ করে ফাটাবে।

দিনু।। তুই ওকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছিস।

ঘটু।। বাহ রে আমি আবার কি করলাম! লাই যদি বলো তুমি কি কিছু কম দাও!! বয়সের গাছ পাথর নেই! দাম রা হাবা গোবা টাকে কে মাইনে দিয়ে পুষছে? (নিজের দোকানের দিকে চলে যাবে)

দিনু লাঠি নিয়ে তাড়া করে অবিরামকে বার করে দেবে। সেই সময় চাঁদু কে দেখতে পাওয়া যায়।

দিনু।। এই যে হারামির হাত বাক্স, তুই ওখানে কি করছিলি? আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথায় শট খাচ্ছিস?

চাঁদু।। সটকাবো কেন? মুততে যাচ্ছিলাম-

দিনু।। আমাকে দেখে মুত পেয়ে গেল? আমার টাকাগুলো কোথায়?

চাঁদু।। টাকা? কিসের টাকা?

দিনু।। এমন ভাব করছিস যেন টাকা কি বস্তু জানিস না। তোকে যে কুড়ি হাজার টাকা দিলাম কলকাতা গিয়ে মালের অর্ডার দিয়ে আসতে?

চাঁদু।। তাই বল। সেই টাকা। এই নাও সিলিপ। মাল বুক করে এসেছি। ওরা ট্রান্সপোর্ট ে পাঠিয়ে দেবে। বাকি টাকা ডেলিভারির সময় নিয়ে যাবে।

দিনু।। তা এতক্ষণ বলতে কি হয়েছিল? তোরা কি ঝেড়ে কাঁ সতে পারিস না!!

চাঁদু।। পারবো না কেন। তোমার অভিরাম বলে, —

দিনু।। কি বলে হারামির বাচ্চা?

চাঁদু।। না থাক। শুনতে হবে না।

দিনু।। কেন শুনতে হবে না? পেছনে আমাকে গালাগালি করে? হারামির বাচ্চা, কিছুক্ষণ আগে আমার টিউব ফাটিয়েছে! ওর ওর চাকরি খতম! তাড়িয়ে দিয়েছি! আর ঢুকতে দেবো না!

চাঁদু।। দুধ কলা দিয়ে এতদিন কাল সাপ পুষেছো। ছোবল তো তো মারবে –এটা আর নতুন কথা কি! আমাকে বলেছিল, কলকাতায় যাবার আগে, ২০ হাজার টাকা মেরে দিতে।

ঘটু।। বাজে কথা। মিথ্যে কথা। ওর কথা বিশ্বাস করো না দিনু দা–

চাঁদু।। বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে আমাকে বলতেই হবে। রোজ আমাকে বলে, যেদিন এখানকার দোকানপাট ভাঙ্গা পড়বে, সেদিন তোমার ক্যাশ বাক্স নিয়ে পালাবে।

দিনু।। কি শুনছিস ঘটু? এবার বিশ্বাস হলো?

ঘটু।। না হলো না। কথাটা চাঁদু র মুখ থেকে শুনছি। তামা তুলসী পাতা হাতে নিয়ে বললেও বিশ্বাস করব না

(অন্যত্র চলে যাবে)

দিনু।। আমি তো ভাবতেই পারি না ছেলেটার পেটে পেটে এত! এই শোন, আমি বেরোচ্ছি! একটা মিটিং আছে! কোর্টে যেতে হবে আবার! দয়া করে দোকানটা সামলাও–(চলে যাবে

চাদু হিন্দি গান শুরু করবে। লুকিয়ে রাখা মদের বোতল বার করে গলায় ঢালবে। ওদিকে ঘটু পাশের দোকানে চা দিয়ে ফিরে আসবে।

ঘটু।। ছি! ছি! চাঁদু, বোকা হাবা ছেলেটার নামে চুপলি করতে তোর লজ্জা করে না!!

চাঁদু।। না করে না। কারণ ওর দিদি টাকে নিয়ে আমি তো শুতে চাই না।

ঘটু।। কি বললি?

চাঁদু।। কি বলব মাইরি, ওর দিদিটা চাম্পুস। ফিগারখানা যাকে বলে সেক্সি। টকটকে ফর্সা রোগ।

অনেকেই লাইন লাগাচ্ছে। তুমিও চেষ্টা করে দেখো ঘটু দা। চান্স লো টকে যেতে পারে।

ঘটু অশ্লীল ইঙ্গিত সহ্য করতে না পেরে মার্বার জন্য হাত তোলে। চাঁদু সেই হাত ধরে ফেলে। এদিকে অ ভিরাম ফিরে আসে। হাত ছাড়িয়ে ঘোটু চলে যাবে।

চাঁদু।। (অভিকে) এই যে কলির কেষ্ট, ৩০০ টাকা দরকার যে-

অভি।। ৩০০ টাকা! কি হবে?

চাঁদু।। আমার সেরাদ্দ তো হবে। যখনই টাকা চাইবো প্রশ্ন করিস কেন? আমি কি তোর টাকা নিয়ে মদ খাই?

অভি।। তা তো বলিনি-

চাঁদু।। তাহলে কি বলতে চা স? মা গি বাড়ি যাই? তোর ময়না বিয়ে বাড়ি যাবে! পায়ের চটি নেই! আমার সঙ্গে দেখা হলে বলল, টাকাটা তোর কাছ থেকে আদায় করতে!

অভি।। তাই নাকি! আগে বলবে তো! কিন্তু আমার কাছে অত টাকা তো নেই।

চাঁদু।। ঠিক আছে। তোর ময়নাকে গিয়ে সেই কথাটা বলি।

অভি ।। না না। ময়না কে এ সব কথা বলোনা। দুঃখ পাবে। কষ্ট পাবে। তুমি বরং দুশো টাকা ওকে দিয়ে এসো-

চাঁদু।। মাত্র ২০০ টাকা! ওতে কি ভালো চটি হবে!

অভি।। এখনকার মতো চালিয়ে দিতে বল। পরে আমি বেশি দামের কিনে দেবো।

চাঁদু।। ঠিক আছে। তাই দে-

অভি।। (টাকা এনে দেবে) এই শোন, ময়নাকে বলিস, আমি কিছুদিনের মধ্যে একটা সাইকেল কিনব!

চাঁদু।। তাই নাকি। ঠিক আছে বলবো। ও হ্যাঁ। একটা ভালো সাইকেল আছে। বিডিও টা বিয়েতে হিরো হোন্ডা লটকেছে। ওর আগের সাইকেলটা বেচে দেবে বলছি ল।

অভি।। তাই নাকি?

চাঁদু।। দারুন কন্ডিশন। কি দেখতে মাইরি। ফিগারটা সেক্সি সেক্সি। হ্যান্ডেলটা পক্ষীরাজ ঘোরার ডানার মত। সামনের দিকে ট্রেনের ফোকাস এর মত দুটো লাইট আছে। তোর ময়নার গালের মত একটা বেল আছে। ঠুনা মারলে ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং বেজে ওঠে। দুই চাকার পোকগুলোতে পিচবোর্ড ফিট করে নিবি। চলবে যখন ফটাফট ফটাফট শব্দ হবে। মনে হবে হিরো হোন্ডা চলছে। পেছনে আবার একটা ক্যারিয়ার আছে। ঠিক তোর ময়নার পাছার মাপে।

অভি।। (চোখ দুটো উজ্জল হয়ে ওঠে) কত দাম রে? আমাকে দেবে?

চাঁদু।। দিয়ে বসে আছে। দামের কথা চিন্তা করতে হবে না। সস্তায় করে দেবো। আমার সঙ্গে অনেক দিনের চেনা জানা।

অভি।। দু হাজারে হবে?

চাঁদু।। হবে হবে। হাওয়াতে হবে। আমি তো আছি। কথায় বলে, মেরা স্বপ্না সুজুকি সামুরাই। তাহলে টাকাটা দে-অভি

অভি।। কাল দেব।

চাঁদু।। আবার কাল কেন। মালটা যদি ছিটকে যায়? আরে বাবা বিডিওর সাইকেল। চাপলে বুঝবি ভিডিও ভিডিও গন্ধ বেরোচ্ছে।

অভি।। আজ তো বৃহস্পতিবার-

চাঁদু।। তাতে কি হয়েছে? বৃহস্পতিবারে কেউ বাজার করে না? খাওয়া দাওয়া করে না? কেন বুঝতে পারিস না তুই, এতদিন অন্যের সাইকেলের অনেক পাম্পু মারলি। এবার নিজের জন্য কিনে ফেল। সরু সরু দুটো চাকার খেলাটা এবার নিজের মতো করে দেখ।। আজকের দিনে ওই খেলাটাই তো আসল। যাকে বলে ব্যালেন্সের খেলা। ব্যালেন্স-

আলোর পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। ওপর থেকে একটা মেরুন রঙের সা ও আরের নিচে একটা ছোট্ট লাঠি হাতে চাঁদু চলে আসবে। হাতের তালুতে সেই লাঠিটা স্থাপন করে কথা বলবে। আবহাওয়া সংগীতে মেরা নাম জোকারের মিউজিক বাজবে।

চাঁদু।। ব্যালেন্স। লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান। এটা হল ব্যালেন্সের খেলা। হাতে পায়ে ব্যালেন্স আনতে হবে। তাহলেই মজা। এদিক ওদিকে টাল খেতে খেতে ব্যালেন্স দেখাতে হবে। দু’পাশে গভীর খাদ। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। প্যাডেল মারতে মারতে এগোতে হবে।১২৩ ৩২১ সেজে কি আশ্চর্য মজা অবিরাম। সামনের হ্যান্ডেল এ তোর ময়না বসে আছে। বাতাসে তার চুল উড়ে উড়ে তোর চোখে মুখে লাগছে। ময়নার চুল ের মিষ্টি গন্ধ পাগল করে দিচ্ছে তোর শরীর মন। নেশা ধরে যাচ্ছে। অদ্ভুত নেশা।

অভি।। (মন্ত্রমুগ্ধের মত চাদুর আশ্চর্য খেলা দেখতে দেখতে বলে উঠবে) আমার বিয়ের ফুলশয্যার রাতে প্রথম বউ টিয়া ও বলেছিল, একটা সাইকেল কিনতে।

চাঁদু।। সব মেয়েই বলবে। যে ব্যাটাছেলে সাইকেল চা প তে জানেনা, বউকে নিয়ে সাইকেলে তুলে বেড়াতে যেতে পারেনা, এই ব্যাটা ছেলেকে মেয়েরা ঘেন্না করে।

তুই যদি সেদিন তোর বউকে সাইকেল চাপিয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতিস, তাহলে তোর বউ কনস্টেবল হারু ঘোষের সঙ্গে পালিয়ে যেত না। ওই লোকটা তোর বউকে অনেক কিছু দিয়েছে। সোনা দিয়েছে। বাড়ি দিয়েছে। ব্যাংকে টাকা দিয়েছে। কত কত শাড়ী গয়না দিয়েছে।

অভি।। সেদিন তো আমার কাছে সাইকেল ছিল না। সাইকেল কেনার টাকা ছিল না। বউ বলেছিল তাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে। ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে। কিন্তু আমার মা আর দিদিকে ফেলে রেখে স্বার্থপরের মত বউয়ের কথা কি করে শুনবো?

চাঁদু।। শোন আজকের দিনে মা-বাবা ভাই-বোন হল গরুর গাড়ির মতো অচল। শহরের রাস্তায় বাতিল হয়ে গেছে। আর বউ হলো হিরো হোন্ডার মত। কথাটা যদি না বুঝিস, তাহলে দেখবি, তোর আজকের ময়না অন্য আরেকজনের সঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবে।

অভি।। (বিভ্রান্ত) না না না তা হতে পারে না! আমি তোকে টাকা দেব-একটু অপেক্ষা কর-

(ছুটে গিয়ে ঘটোদার কাছ থেকে জোর করে টাকা বার করে নিয়ে আসে। চাঁদু কে টাকাটা দিতে, চাঁদু দ্রুত বেরিয়ে যাবে)

ঘটু।। সাইকেল সাইকেল করে তোর মাথাটা একেবারে গেছে। তুই ওই চিটিংবাজটাকে টাকা দিলি! ও তোকে সাইকেলে এনে দেবে? কবে তুই মানুষ হবি অভিরাম? কবে বুঝবি? আজকের দিনে নিজের ডান হাতকেও বিশ্বাস করতে নেই!

অভি।। চাঁদু কে আমি বিশ্বাস করি। ও আমাকে ঠকাবে না। ঠকাতে পারে না। ওকে আমার ছোট ভাইয়ের মতো মনে হয়।

বাসব হালদার একটা সাইকেল সহ আসবে।

বাসব।। কইরে অবিরাম, সাইকেলে কটা পাম্প মেরে দেতো। কাল রাতেও হার্ড পাম্প ছিল। সকালে বেরিয়ে দেখি চিত্তির। মনে হচ্ছে চোরা লিক আছে।

অভি।। রেখে যেতে হবে বাবু। দিনুদা না এলে, লীক ধরা যাবে না।

বাসব ।। ঠিক আছে। তাই রেখে দে। দিনু দা কে বলিস আমার কথা। এক এক সময় মনে হয় সাইকেলটা বেঁচে দি-

অভি।। বেচবেন বাবু? দাম কত নেবেন?

বাসব।। তুই নিবি?

অভি।। যদি দামে পোষায়–তাহলে দেখতে পারি- তবে চাঁদু আমার জন্য অন্য একটা দেখতে গেছে

বাসব।। তুই নিলে, যাহোক একটা দাম দিয়ে দি স। আমার জন্য এটা আর ফিট করছে না। কাজ বেড়ে গেছে। এখানে ওখানে ছুটতে হচ্ছে। তাছাড়া পরিবর্তনের দিনে সবকিছু চারদিকে বদলে যাচ্ছে। আমাকেও বদলাতে হবে। গতি বাড়াতে হবে। গতির যুগে একটা হিরো হোন্ডা চাই।

অভি।। এটাকে দেখে মনে হচ্ছে এখনো যান আছে। অনেকদিন চলবে। রং করে নিতে পারলে নতুনের মত দেখাবে। আপনি সত্যি সত্যি আমাকে এটা দিলে_চাদুকে বারণ করে দেব-

বাসব।। একেবারে মাগনাতে দিতে পারব না। কিছু একটা তোকে দিতেই হবে। আমি একটু ঘুরে আসি। এর মধ্যে দিনু দা এলে, আমার জন্য থাকতে বলিস। অনেক জরুরী কথা আছে। (চলে যাবে)

চোখের সামনে সাইকেল দেখতে পেয়ে অভি সেটাকে আদর করার মতো হাত বোলাতে থাকে। ওদিকে ঘটু একটা লাঠি নিয়ে এসে সাইকেলটাকে ভাঙ্গার চেষ্টা করে। অভিরাম অবাক হয়ে যায়। বাধা দেবার চেষ্টা করে।

অভি।। ও কি, সাইকেলটাকে মারছো কেন? সাইকেলটা তোমার কি করেছে? কারোর কোন ক্ষতি করে না সাইকেল-

ঘটু।। করে করে। অনেক মানুষের ক্ষতি করে। গরিব মানুষের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বিয়ের আসর থেকে কনে বউ তুলে নিয়ে যায়। সন্ত্রাসের আগুন জ্বালায়। দেয়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে পেছন থেকে গুলি চালায়। আমার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

অভি।। এসব কি বলছ তুমি!!! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!!!

ঘটু।। তুই ভুলে গেলি, এরকম একটা সাইকেল চেপে তোর বউকে নিয়ে থানার কনস্টেবল পালিয়ে গিয়েছিল।। এইরকম একটা সাইকেল চেপে আমার বিয়ের রাতে গুন্ডাগুলো এসেছিল।। ৫ লক্ষ টাকা আদায় করতে চেষ্টা করেছিল। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টাকাটা দিতে পারেনি তাই ওরা আমাকে শাসিয়ে বলেছিল, তিন দিনের মধ্যে টাকাটা না দিলে, আমার বউকে তুলে নিয়ে যাবে।

অভি।। তো মার বউকেও—-

ঘটু।। আমার বউকে সাত দিন সাত রাত একটা বাড়িতে আটকে রেখে, নরপশুর া ধর্ষণ করেছিল। তারপর মেরে ফেলেছিল। সেইসব জ্বলন্ত আগুনের মতো স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। রাতে আমার ঘুম হয় না। চোখের পাতা এক করতে পারিনা। পঁচিশটা বছর ধরে আমি জেগে বসে আছি। কবে পারবো নরপশুদের নিজের হাতে শাস্তি দিতে।

কান্নায় ভেঙে পড়ে ঘটু দা।

আমাদের অভিরাম চোখের জল মুছে, সাইকেলটার কাছে যায়। প্রেমিকার শরীরে হাত বোলানোর মতো হাত বোলাতে থাকে। 

অভি।। দূর দূর। সাইকেল আবার কাউকে মারতে পারে নাকি? সাইকেল তো সাইকেলই হয়! আমার মনে হচ্ছে, বিডিও বাবুর সাইকেলের থেকে এইটা অনেক বেশি সুন্দর। অনেক কম দাম। আমি এইটা কিনব।

অভিরাম সাইকেলে চেপে বসবে। তার উপর র আলোর ঝর্ণাধারা নেমে আসবে। গান শুরু হবে।

গান।। সাবাস আ মার হাওয়াই গাড়ি, দূর বিদেশে দেয় পা রি—-

একটা সময় অভি রাম মঞ্চের উপর সাইকেল চালাতে চালাতে বেরিয়ে যাবে।

আলোর পরিবর্তন। আশ্চর্য আবহাওয়া সঙ্গে থাকবে।

দৃশ্যান্তর ঘটবে।

রাত। এখানকার দোকানদাররা রাত পাহারা দিতে বেরিয়েছে। একটা মিছিল চলছে।

স্লোগান।। দোকান ভেঙে রাস্তা বানানো চলবে না চলবে না।

জীবন জীবিকার গ্যারান্টি চাই।

বেঁচে থাকার ভাত চাই।

মানুষের উন্নয়ন চাই।

গরিবের উন্নয়ন চাই।

গরিব মেরে বড়লোকের উন্নয়ন চলবে না চলবে না।

বাসব ও দিনুকে আসতে দেখা যাবে।

বাসব।। সকালে ও তোমার কাছে গিয়েছিলাম দিনু দা। তুমি জানো কোথায় গিয়েছিলে।

দিনু।। কোথায় আর যাবো। চোর কি বাজির মত কেবল ঘুরছি। এখানে যাচ্ছি ওখানে যাচ্ছি। কার কাছে গেলে সুরাহা হবে, কারা আমাদের পেছনে এসে দাঁড়াবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।

বাসব।। তোমাকে তো বলেছি, আমি যখন আছি তখন অত চিন্তা করার কোন কারণ নেই। তোমরা যা ভাবছো, ভেবে ভেবে মাথা গরম করছ, সেসব হবে না। তোমাদের হাতে মেরে, ভাতে মেরে আমি অন্তত উন্নয়নের রথচক্র এখানে চালাতে দেব না।

দিনু।। তোমার কথা শুনে মাঝে মাঝে প্রাণের জল আসে। কিন্তু সরকার থেকে অনেক দিন আগে নোটি শ ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে যত দোকান পাঠ রয়েছে সবাইকে সরে যেতে হবে। নইলে বুলডোজার নামবে।

বাসব।। হ্যাঁ, আগে ওই রকম সিদ্ধান্ত হয়েছিল বটে। তবে সরকার এখন চিন্তা ভাবনা করছে। এখানকার এতগুলো দোকানদারের ভবিষ্যৎ কি হবে। কোথায় যাবে। বিকল্প কি ভাবা যায়। আজ দুপুরে আমার সঙ্গে সরকারি অফিসারদের আলোচনা হয়েছে। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি, এখানে একটা দোকানও ভাঙ্গা যাবে না। বাড়াবাড়ি করলে আমিও ছেড়ে দেব না।

দিনু।। তোমার ভরসা তে এতদিন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলাম। কিন্তু কদিন আগে থানার ওসি বাহিনী এখানে এসে হুমকি দিয়ে গেছে। সেই থেকে দুশ্চিন্তায় নারী ছিড়ে যাচ্ছে।

বাসব।। তাই বুঝি বিকাশ বাবুদের কথায় নাচতে নাচতে কোর্টে গিয়েছিলে? সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে?

দিনু।। উপায় কি বল। বিকাশ বাবুরা যখন বলল, আইন আদালত না করলে প্রশাসনকে রুখে দেয়া যাবে না।

বাসব।। তোমরা কেন বুঝতে পারছনা দিনু দা, বিকাশ বাবুরাও তোমাদের নিয়ে রাজনীতি করছে।

দিনু।। আমাদের মত উলু খাগড়া দের নিয়ে সবাই রাজনীতি করে। নিজেদের আখের গোছায়। আমরা ভেড়ার পালের মত নাচতে নাচতে কসাই খানার দিকে চলে যাই।

বাসব।। তোমার কি মনে হয় কোর্ট স্টে অর্ডার দেবে?

দিমু।। আইন তাই তো বলছে। বিকাশ বাবু আমাদের কথা দিয়েছেন, স্টে অর্ডার বার করে দেবেন।

বাসব।। সরকার তখন হাইকোর্টে যাবে। সুপ্রিম কোর্টে যাবে। তোমরা পারবে ওইসব জায়গায় যেতে?

দিনু।। চেষ্টা করতে হবে। দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন শেষ কামড় দিতে হয়।

বাসব।। তোমরা একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছ না, আইন আদালতে যারা বসে আছে, তাদের অনেকে গরু ছাগলের মত বিক্রি হয়। আইন হয়তো কিনা যায় না। আইনের রক্ষকদের কেনা যায়।

দিনু।। জানি জানি এদেশে সবই হয়।

বাসব।। তাহলেই বুঝ। মাথা গরম করে হা হুতাশ করে কোন লাভ নেই। কোন কিছুই আগের মত নেই। সব বদলে গেছে। সেই আগেকার মানুষ ও নেই। মানুষের ধর্ম বিলকুল বদলে গেছে। তাই রাজনীতির গোলকধাঁধায় দেশটা ও ঢুকে পড়েছে। মানুষের ভেতরের আর বাইরের রং দেখে কিছুই আন্দাজ করা যাবে না। কোনটা আসল আর কোনটা নকল। তবে একটা কথা মনে রেখো, পরিবর্তনটা সত্য। ওটাকে আটকানো যাবে না। নতুন ভাবে বাঁচো। নতুন ভাবে পথ খোঁজো। নতুন রাস্তা বার করতেই হবে।

দিনু।। আমাদের এই বয়সে কি সেটা সম্ভব!!!

বাসব।। ভিকরির মত হাত পেতে দাঁড়িয়ে কোন লাভ নেই। জীবনের কাছে যা কিছু পাওনা গন্ডা আছে, সেসব আদায় করার জন্য তেজ থাকা দরকার। তেজটাই আসল।

দিনু।। তুমি ঠিকই বলেছ ভাই। আমাদের তেজ হারিয়ে গিয়েছিল। সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এবার আমরা বুঝিয়ে দেবো–

বাসব।। তুমি আমার কথার উল্টো মনে করলে। আমি বলেছি, পেছনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সামনের দিকে পথ চলা যায় না। এই যেমন আমি আমার সাইকেলটা তোমার দোকানে রেখে গেলাম। ওটা বাতিল করতে হবে। বেঁচে দেব। একটা হিরো হোন্ডা চাই। নইলে ঠিক মানাচ্ছে না। খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। তারপর চাই আর একটা ফোর হুইলার। এটাই সময়ের দাবি।

দিনু।। তোমার কথা এক এক সময় জটিল হয়ে ওঠে। কিছুই বুঝতে পারি না। আমাদের কাছে সময়ের দাবি বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছ?

বাসব।। ভাবো। গভীরে গিয়ে তলিয়ে ভাবো। কোন কিছুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সময় যখন বদলায়, বস্তু জগতের সব রকম অবস্থান ও বদলাতে বাধ্য। আমাকে এখন যেতে হবে। যদি পারি কাল একবার তোমাদের সঙ্গে দেখা করে, আলোচনায় বসতে হবে। নতুন পথ খুঁজতে হবে। (চলে যাবে)

ঘটু এতক্ষণ দোকান থেকে সব কথা শুনছিল। এবার এগিয়ে আসবে।

ঘটু।। হিরো হোন্ডা ছাড়া ওদের চলবে কেন। দানবটা যখন ছুটতে থাকে, চারপাশের শান্তি চুরমার করে, সবাইকে ভয় দেখিয়ে, বুকের মধ্যে কাপন ধরিয়ে, ধুলোবালি র ঝড় তুলে অন্ধকার করে দিয়ে যায়।

দিনু।। যা বলেছিস। আলোর গতির মত, চারদিকে সাইক্লোন তুলে ওরা ছুটছে। খালি ছুটছে আর ছুটছে।

কোন দিশা নেই।

ঘটু।। ভোট ভোট আর ভোট। ওদের দিশা একটাই। কিভাবে ভোটে জিতে উপরেওঠা যায়। ক্ষমতার চাবিকাঠি টা হাতের মুঠোয় ধরা যায়।

দিনু।। তোমরা কি বলতে চাও যে, বাসব হালদারের মতলব ভালো না?

ঘটু।। চারদিকে ধুলোর ঝড় উড়ছে। কনকনে ঠান্ডার দিনে যেমন জমাট বাধা কুয়াশার অন্ধকার ের কাছের জিনিস ও দেখা যায় না। এখন অবস্থাটা হয়েছে এরকম। তবে একটা কথাই বুঝি দিনু দা, আমাদের নিজেদের পথটা নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে। খুঁজে নিতে হবে। (নিজের দোকানের দিকে চলে যাবে)

দিনু হতাশ হয়ে বসে পড়ে। দূর থেকে কোলাহল ভেসে আসে। আতঙ্কিত কোলাহল। দিনু, ঘটু বোঝাবার চেষ্টা করে কি হয়েছে।

  • আসছে আসছে আসছে পুলিশের গাড়ি আসছে হাজারে হাজারে
  • বুলডোজার আসছে, বুলডোজার আসছে, সবাই পালাও পালাও পালাও
  • কেউ রেহাই পাবে না, সবকটা দোকান ভেঙ্গে গুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে।
  • পালাও পালাও পালাও পালাও পুলিশের গাড়ি আসছে-

মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছে। ছুটো ছুটি হাঙ্গামা বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যাবে। পরের দিন।

চাঁদু।। গুজব গুজব আর গুজব। (বাইরে থেকে আসবে) চারিদিকে গুজবে র ধুলো উড়ছে! আর তোমরা ও গুজবে কান দিয়ে খাবি খাচ্ছ!

দিনু।। চুপ কর। তোর আর কি। তোকে তো আমাদের মত সংসার চালাতে হয় না। থাকছিস থাকছিস গায়ে হাওয়া দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। কোন দায় নেই দায়িত্ব নেই।

চাঁদু।। আছে আছে দিনু দা। সবই আছে। নিজের এই পোড়া পে ট টা তো আছে। তাছাড়া তুমি হয়তো ভাবো, আমি তোমার দোকানের জন্য কিছুই করি না।

দিনু।। কি করিস? মাসের মধ্যে বেশিরভাগ দিন মাস্তানি করে ঘুরে বেড়াস! খালি কামাই কামাই আর কামাই! মাইনে কাটতে দেখলে, চোখ গরম করিস!

দোকানটা ভাঙা পড়ুক, তখন বুঝবি কত ধানে কত চাল।

চাঁদু।। তার আগে তুমি ব্যাপারটা ভালো করে বুঝো। তোমার অভিরাম সেটা তো বাস ব হালদারের সঙ্গে রফা করে ফেলেছে।

দিনু।। তার মানে?

চাঁদু।। দোকানগুলো যখন ভাঙ্গা পড়বে, সরকার তো বলেছে, সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেবে। তবে ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে গেলে, এই জমির দলিল দেখাতে হবে। ট্রেড লাইসেন্স দেখাতে হবে। যারা পারবেন না দেখাতে, তাদের ভাগ্যের বুড়ো আঙুল জুটবে।

দিনু।। সেসব জানি। এর মধ্যে নতুন কি আছে?

চাঁদু।। আছে আছে। নতুন কথাটা শুনলে হার্ট ফেল করবে। তোমার দোকানের দলিল, ট্রেড লাইসেন্স বছরখানেক আগে হাত বদল হয়ে গেছে।

দিনু।। কি যাতা কথা বলছিস-হাত বদল হয়ে গেছে মানে? কিভাবে হাত বদল হলো?

চাঁদু।। কয়েক মাস আগে তুমি বলছিলে, কাগজপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। হারিয়ে গেছে।

দিনু।। থানায় ডায়েরী করেছি। কাগজপত্র বার করবার জন্য হাঁটাহাঁটি করছি।

চাঁদু।। কিছুই পাবে না তুমি। সে গুরে বালি। অ ভিরামের নামে ট্রান্সফার হয়ে গেছে।

দিনু।। সেকি! কিভাবে হলো?

চাঁদ।। এদেশে সবই হয়। একটার পর একটা সরকারি সম্পত্তি জলের দলের বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের জল থেকে শুরু করে মাথার উপর আকাশটা কিনে নিচ্ছে যাদের ক্ষমতা আছে। আর এটা তো একটা সামান্য ব্যাপার। এমন দিন আসবে এসে গেল বলে, তাজমহল, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, কুতুব মিনার, সবকিছু হাত বদল হয়ে কর্পোরেটদের পকেটে ঢুকে পড় ছে।

ঘটু।। ওর কথা বিশ্বাস করো না দিনু দা। অভিরামের এত বুদ্ধি নেই যে, এইরকম জালিয়াতি করতে পারে। তাছাড়া কোন প্রমাণ নেই।

চাঁদু।। প্রমাণ আছে। সময় মত জানতে পারবে।

দিনু।। আপাতত আমি তোর কথা বিশ্বাস করছি না। তবে পুরোপুরি অবিশ্বাস ও করছি না। তুই যদি মিথ্যে কথা বলিস, আমিও ছেড়ে দেবো না।

চাঁদু।। ছেড়ে দিও না। তবে শুনে রাখ, এখানকার যত দোকানদার বুলডোজার আসবে বলে হইচই করছে। মিছিল করছে। আদালতে যাচ্ছে। তারা কেউ ক্ষতিপূরণের টাকা পাবে না। কারণ বেশিরভাগ দোকানদার কাগজ দেখাতে পারবে না। কথাটা মনে রেখ।

দিনু।। কথাটা তুইও মনে রাখিস। আমি ফিরে আসছি। কোর্টে যেতে হবে। আমাদের মামলা আজকে কোর্টে উঠবে। দোকানটা দেখিস। (চলে যাবে)

চাঁদু এখন অনেকটা স্বস্তি বোধ করে। ভাবতে থাকে তার ওষুধ কাজ করছে। গান গাইবে। মদের বোতল বার করবে।

চাঁদু।। জীবন এখন বাংলা হিন্দি কমার্শিয়াল ছবির মত। খাও পিও জিও। ঘোলা জলে মাছ ধরো। ঢিসুম ঢিসুম। লাইফের কোন মানে নেই। মাটির পাত্রে চা খাও। উসকে বাদ ফেক দো। বোকা হাবারা নীতি-নৈতিকতার কথা বলে। যাদের হেডে মাথা আছে, তারা সাপের মুখে চুমু খেয়ে, কল গার্ল নিয়ে হোটেলে বিছানা গরম করে। আমার এখন অনেক টাকা চাই। সুন্দরী মেয়ে ছেলে চাই। এখানকার এইসব দোকান থাকবে না। সবকটা, মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। বাসব হালদার দিল্লি যাবে। মন্ত্রী হবে। উদয়পুরটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খানকিবাড়ি করে দেবে। বাসব হালদারের দলের ভেতর থেকে আমি অনেক কিছু দেখেছি। বুঝেছি।

সাইকেল চেপে অভিরাম আসবে।

অভি।। এই যে চাঁদু, সাইকেল আমি পেয়ে গেছি। খুব সস্তা। বাসব বাবুকে আরেকটু তোয়াজ করলে, আরো সস্তা হয়ে যাবে। চোরা লীক আছে। ওটা কিছু না। নতুন টায়ার টিউব লাগিয়ে দিলে অনেক দিন চলবে।

চাঁদু।। বিডিও র সাইকেলটা তাহলে কি হবে?

অভি।। অনেক লোক আছে। ঠিক কিনে নেবে। আমার এইটা পছন্দ হয়েছে বেশি।

চাঁদু।। তাহলে আমাকে কি করতে হবে?

অভি।। আমার কাছ থেকে যে ২০০০ টাকা নিয়ে গিয়েছিলি, সেটা ফেরত দে।

চাঁদু।। ফেরত দিতে পারতাম। কিন্তু এদিকে কেশ জন্ডিস-

অভি।। মানে?

চাঁদু।। তোর ময়না, বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে, বমি জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। না হলে বাঁচবে না।

অভি।। আমার দিদি ও খবর পাঠিয়েছে, আমার মায়ের ও শরীর ভালো না। পেটে কি যেন হয়েছে। ডাক্তার অপারেশন করতে বলেছে। আমাকে অনেক টাকা ধার করতে হবে এখন। নইলে বাড়িটা বন্ধক রেখে-

চাঁদু।। তোর তো যাওয়া হবে না।

অভি।। কেন?

চাঁদু।। ময়না আমাকে বলেছে, দু তিন দিনের মধ্যে ও তোকে বিয়ে করতে চায়।

অভি।। বিয়ে! দু তিন দিনের মধ্যে!! তা কি করে সম্ভব? এই যে বললি ওর খুব অসুখ!

চাঁদু।। তোর ২০০০ টাকা ময়নাকে দিয়েছি। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ হওয়ার জন্য।

অভি।। টাকাটা দিয়ে দিলি?!!

চাঁদু।। না দিলে কিভাবে সুস্থ হবে? সুস্থ না হলে কিভাবে বিয়ে হবে তোদের? ময়না তো আর দেরি করতে চায়না? এক সপ্তাহের মধ্যে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে তোর সঙ্গে সংসার শুরু করতে চায়! তোর বিছানায় উঠতে চায়!

অভি।। কি যে বলিস না তুই!! এত তাড়াতাড়ি! এভাবে কি সম্ভব?

চাঁদু।। সম্ভব সম্ভব সব সম্ভব। অসম্ভবকে সম্ভব করেই তো লায়লা মজনু, রোমিও জুলিয়েট, হীরা রাঞ্ঝা দের প্রেম কাহিনী সুপার হিট হয়ে যায়। কথায় বলে লাভ স্টোরিতে যুক্তি তক্ক চলবেনা। কোন বাধা খাটবে না। মিয়া বিবি রাজি তো কউন কারেগা কাজী? ময়না বলেছে তুই যদি ওকে দু-একদিনের মধ্যে বিয়ে না করিস, তাহলে সুইসাইড করবে।!!

অভি।। সে কি!!! এ আবার কি কথা! আমি বিয়ে করব না এ কথা তো কখনো বলিনি! বরং দেখা হলে ময়না আমার সঙ্গে কথা বলে না! পাত্তা দেয় না! ঠোঁট উল্টে খোঁচা দিয়ে বলে, একটা সাইকেল কিনে, পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে প্রেম মারাতে এসো!

চাঁদু।। আরে বাবা ওসব ময়নার মনের কথা নয়। তাছাড়া মেয়েরা যখন পুরুষদের সামনে না না করে। তখন বুঝবি আসলে ওটা হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাকে ময়না বলেছে, সে তোকে বাজিয়ে দেখতে চায়।

অভি।। সবই তো বুঝলাম। এখন আমি এই সাইকেলটা কেনার টাকা কোথায় পাবো?

চাঁদু।। দোকানের ক্যাশ বাক্স হাতিয়ে কেটে পড়।

অভি।। না না সে কিছুতেই হয় না। দিনুদার কাছে ধরা পড়ে যাব। তাছাড়া এটা অন্যায়। বেইমানি।

চাঁদু।। কথায় বলে সমরে আর প্রেমে অন্যায় অন্যায় না।দিনু দার কথা না ভেবে ময়নার কথা ভাব। আমি চললাম। কাল আসবো। ময়নাকে আমি বলছি গিয়ে, সেও যেন বিয়ের জন্য তৈরি হয়ে থাকে। তাছাড়া এখন আমার আরো অনেক কাজ আছে।। বিয়ের জোগাড় করা কি? চারটি খানি কথা। পুরুত ঠিক করতে হবে। লগ্ন দেখতে হবে। কোথায় বিয়ে হবে সেটা দেখতে হবে। কালিবাড়ি নাকি শীতলা বাড়ি। তারপর আছে কজন খাবে নেমন্তন্ন তার অ্যারেঞ্জমেন্ট করা। আমি চললাম। ব্যাক গিয়ার মারিস না কিন্তু।

চাঁদু গান গাইতে গাইতে চলে যাবে। আনন্দ ও ধ্বন্দ্বে পড়ে যাবে অভিরাম। একদিকে তার অসুস্থ মা, অন্যদিকে ময়নার হাতছানি। কি করবে অভিরাম?

অভি।। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কি করব!! এতদিন পর আবার একটা মেয়ে ময়না যখন আমাকে বিয়ে করতে রাজি হল! আমি একটা সাইকেলের মালিক হতে যাচ্ছি!! এটা যে কি আনন্দ কাউকে বুঝাতে পারবো না! অন্যদিকে মায়ের শরীর খারাপ! অনেক টাকার দরকার! ময়না কি বিয়েটা পিছিয়ে দিতে রাজি হবে? সে কেন বুঝবে না যে, এই সময় আমার পক্ষে বিয়ে করা চলে না! আমার বিয়েতে মা দিদি কেউ থাকবে না!!? তাই কি হয়! (বিড়বিড় করতে করতে অন্যদিকে চলে যাবে)

বাসব হালদারের সঙ্গে দিনুদাকে আসতে দেখা যাবে।

দিনু।। তুমি ভুল করছ বাস ব। প্রশাসন যেভাবে হুমকি দিচ্ছে, খবরের কাগজ খুললে, প্রতিদিন যে ঘটনার ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তারপর হাত-পা গুটিয়ে তোমার ভরসায় বসে থাকা যায় না।

বাসব।। সবাই আমাকে অবিশ্বাস করছে। কিন্তু তুমি তো জানো, আমি কে, আমি কি? তাছাড়া তুমি আমাকে ছোটবেলা থেকে দেখছো। আজ পর্যন্ত আমাদের এই উদয়পুরে কেউ বলতে পারবে না যে, আমার দ্বারা তাদের ক্ষতি হয়েছে।

দিনু।। একটা কথা বুঝতে পেরেছি বাস ব, যে খেলাটা এখানে চলছে, সেটাকে থামানো বা বন্ধ করা তোমার কর্ম না।

বাসব।। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে কাউকে কাউকে আমি উপকার করতে পারি। যেমন ঘ টু আর তোমার জন্য একটা আলাদা ব্যবস্থা করতে এখনো পারি।

দিন।। কিসের আলাদা ব্যবস্থা? তাছাড়া কেনই বা তুমি আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করবে? এখানে প্রায় ১৬৯ জন দোকানদার আছে।। এতগুলো পরিবারের কপালে যা আছে, আমার ও তা হবে।

বাসব।। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ যখন শুরু হয়, তখন অনেক কিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। পুরনো স্থিতাবস্থা বজায় রাখাটা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাহলে জীবন থেমে যায়। কেন বুঝতে পারছ না পুরনো ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে রেখে নতুন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাবার নাম প্রগতিশীলতা।

দিনু।। অত বড় বড় কথা বুঝি না। ১৬৯ জন দোকান মালিকের লাশের ওপর দিয়ে কোনরকম প্রগতি আসতে পারে না।

বাসব।। এটা তোমার মানে তোমাদের রাগের কথা। এর মধ্যে কোন যুক্তি নেই।

দিনু।। এখানকার কয়েক হাজার মানুষের রুটি-রুজির সমস্যা নিয়ে একটাই তো যুক্তি সামনে এসে দাড়াচ্ছে। আমরা কি করে বাঁচবো? বুলডোজার মা টির সঙ্গে সব মিশিয়ে দেওয়ার পর, এতগুলো মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

বাসব।। তোমাকে সবার কথা ভাবতে হবে না দিনু দা। নিজের কথা ভাবো। এখানে মাল্টি স্টোরে জ বিল্ডিং হবে। শপিং মল হবে। আমি তোমার জন্য, তোমাদের কয়েকজনের জন্য সেখানে ব্যবস্থা করে দেব।

ঘটু।। (আড়াল থেকে সব শুনছিল। এবার এগিয়ে আসবে) আসলে আপনি বলতে চাইছেন, আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম বন্ধ করে দিতে। আইন আদালত করে কোন লাভ হবে না।

বাসব।। একদম ঠিক কথা। এখানে যারা আসবে শপিংমল করতে, তারা সব হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবে। তাদের সঙ্গে লড়াই করা কি মুখের কথা?

ঘটু।। এইতো আসল কথা বেরিয়ে পড়ল।

দিনু।। তাহলে এতদিন আমাদের সঙ্গে মানে আমাদের ভরসা দেওয়ার জন্য যেসব কথা বলেছেন—

বাসব।। আমরা রাজনীতির লোক। নানান সময় নানান কথা বলতে হয়। সেসব কথা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন।

ঘটু।। আমরা রাজনীতির লোক নই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়। আমাদের কিন্তু নানান সময় নানান কথা বলবার দরকার পড়ে না। তাই বলছি, আন্দোলন যেমন চলছে, সেই রকম চলবে। আসুক বুলডোজার। আমরা বুক পেতে দাঁড়াবো। আগুনের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালে, আগুনকে ভয় পাওয়া চলে যায়।

বাসব।। বুঝলাম। তবুও আরো একবার ভাববার সুযোগ দিচ্ছি। তোমাদের সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক। এরপর আমাকে দোষ দেওয়া চলবে না। কি যেন দিনু দা, আগে আমরা সবাই নিজেদের নাক দিয়ে নিশ্বাস নিতাম। দিনকাল বদলেছে। এখন অভ্যাস গুলো বদলাতে হবে। জীবনের প্রভুদের নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়াটা প্র্যাকটিস করতে হবে। (চলে যাবে)

মাথায় হাত দিয়ে হতাশায় বসে পরবে দিনু।

ঘটু।। ভয় পেলে নাকি দিনু দা?

দিনু।। ভয় না, আমি আমার নিজের কথাও ভাবছি না। ভাবছি এতগুলো মানুষ, এতগুলো পরিবার বুলডোজারের সামনে বুক চিটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে পারলে, অন্যরকম কিছু করতে পারবো কি?

ঘটু।। বুলডোজারের সামনে অন্য কাউকে যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, আমাকে তুমি পাবে। সেদিন ও পালিয়ে যায়নি। আজো পালাবো না।

দৃশান্তর।।

রাত। বাইরে দোকানদারদের রাত পাহারা চলছে। কে যেন গান ধরেছে—–

গান।। হাম ভুখ কে মর নে ওয়ালে, আজাডি কা ডনক বাজা–

অভিরাম খাটিয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছে।। চাঁদু সন্তর্পনে এগিয়ে আসবে। অ ভিরাম কে ঘুম থেকে টেনে তুলবে।

চাঁদু।। এই অভি, অভি, ওঠ বলছি-ওঠ ওঠ-

অভি।। (ধর্ মর করে উঠে বসবে) কি কি হয়েছে? গোলমাল? পুলিশ?

চাঁদু।। তোর বাপের বিয়ে হচ্ছে। নেমন্তন্ন খাবি না? লুচি মাংস মণ্ডা মিঠাই?

অভি।। কি যা তা বলছিস!

চাঁদু।। ক্যালানে মদন। আমার সঙ্গে তোর ময় না এসেছে—

অভি।। কোকো কও কোথায়?

চাঁদু।। ওই তো ওদিকে। রেল স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে বসে আছে।

অভি।। এখানে আসবে না?

চাঁদু।। কি করে আসবে? লজ্জা শরম নেই? এতগুলো লোক রাত পাহারা দিচ্ছে-ধরা পড়ে যাবে না?

অভি।। তাহলে আমি যাব?

চাঁদু।। সাধে কি তোকে ক্যালানে মদন বলা হয়। তুই এই সময় ওই দিকে গেলে সবাই সন্দেহ করবে না? এমনিতে জায়গাটা তেতে আছে! অচেনা কাউকে দেখলেই–পুলিশি জেরা চলছে!

অভি।। তাহলে আমি কি করবো?

চাঁদু।। বিয়ে করবি বিয়ে। আর হাতে একদম সময় নেই। কাল রাত বারোটা য় লগ্ন আছে।

অভি।। এখন তো ভাদ্র মাস-

চাঁদু।। আমাদের পুরোহিতের পঞ্জিকায় ভাদ্র মাসে একটাই লগ্ন আছে। অনেক অনেক চেষ্টা করে খুঁজে পাওয়া গেছে।

অভি।। কিন্তু ভাদ্র মাসে বিয়ে!!

চাঁদু।। হ্যাঁ ভাদ্র মাসে বিয়ে। স্পেশাল বিয়ে। যদি উল্টোপাল্টা করিস, ময়নাকে জীবনে আর পাবে না।

অভি।। কেন কেন?

চাঁদু।। বাসব হালদার ের পরিচিত একজন ময়নার বাবাকে বলেছে, যদি তার সঙ্গে ময়নার বিয়ে হয় তাহলে, ময়নার বাবাকে তিন লাখ টাকা দেবে।

অভি।। তিন লাখ-

চাঁদু।। হ্যাঁ। সেই টাকা দিয়ে ময়নার বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করবে। মাছের ব্যবসা। তরকারির ব্যবসা।

অভি।। আমি এখন কি করবো?

চাঁদু।। ওই টাকাটা তোকে জোগাড় করতে হবে, যদি ময়নাকে বিয়ে করতে চাস।

অভি।। অত টাকা কোথায় পাবো!!!

চাঁদু।। তাহলে ময়নার আশা ছাড়তে হবে।

অভি।। তুই কেন বুঝতে পারছিস নারে চাদু, অত টাকা কে আমাকে দেবে?

চাঁদু।। তার আগে বল, ময়নাকে তুই বিয়ে করতে রাজি কিনা।

অভি ।। বিয়ে করব না এটা তো বলছি না। কিন্তু-

চাঁদু।। ময়না দেখতে চায়, তাকে তুই কতটা ভালবাসিস। ময়নার জন্য তুই কতটা স্বার্থ ত্যাগ করতে পারিস। কতটা জলে নামতে পারিস-

অভি।। পারি পারি। ময়নার জন্য আমি সবকিছু পারি। কিন্তু-আমার হাতে যা নেই-সেটা কোথায় জোগার করব?

চাঁদু।। তোর হাতেই আছে। কদিন আগে বলছিলি, তোদের বাড়ির দলিলটা বন্ধক রেখে টাকা তুলবি।

অভি।। হ্যাঁ। মায়ের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার দরকার। ডাক্তার বলেছে কি একটা অপারেশন করতে হবে।

চাঁদু।। তোর মা এখন সিক ইন্ডাস্ট্রি। টাকা ঢেলে কোন লাভ নেই। মালটা টিকবে না।

অভি।। মা সিক ইন্ডাস্ট্রি!!?

চাঁদু।। তা নয় তো কি। ৭০ বছর জীবন দেখে গেল। এবার তোদের পালা। তোরা এইবার জীবনটাকে উপভোগ কর। গার্মেন্ট ধুকতে থাকা কারখানাগুলো বেচে দিচ্ছে। তুইও দে।

অভি।। আমার মাথা ঘুরছে। আমার দিদির বিয়ে হলো না টাকার জন্য। মা কতবার বলেছে, জমি জায়গা বন্ধক দিয়ে বিক্রি করে টাকা যোগাড় করবে। দিদির বিয়ের খরচা উঠে আসবে। দিদি রাজি হয়নি। আর আজ আমি-

চাঁদু।। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। ইস দুনিয়া মে ম্যায় তুম, তুম মেরি হো। ওর কুছ নেহি চাহিয়ে। সামঝা।

কেউ কারোর নয় অবিরাম। আমি আর তুমি মিলে খাবো দাবো তারপর যাব চলে। দলিলটা বার কর-

অভি।। দলিল-

চাঁদু।। হ্যাঁ দলিল। কিছুদিন আগে তোদের বাড়ি থেকে চেয়ে দলিলটা এখানে এনে রেখেছিলি। বলছি বার কর —

অভি।। আমাকে সময় দে।

চাঁদু।। ঠিক আছে ঠিক আছে। তুই সময় নিয়ে ভাবতে থাক, কে বড়, কে আগে, তোর মা নাকি ময়না। কাকে তুই চাস। তারপর যখন বুঝবি, ময়নাকে ছাড়া তোর পৃথিবী অচল। অন্ধকার। তখন দেখবি ময়না কে হিরো হোন্ডায় বসিয়ে বাসব হালদারের লোকেরা তুলে নিয়ে গেছে।

অভি।। না না না তা হবে না-

চাঁদু।। সেটাই হবে। সেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা বারবার হেরে যাবো। ওরা বারবার জিতে যাবে। আমরা মার খাবো। ওরা মার দেবে। আমাদের স্বপ্ন নিয়ে যাবে। চুরমার হয়ে যাবে আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ভালোবাসা।

অভি।। না-আমার ময়নাকে চাই। যৌবনের শুরুতে আমাকে অন্য এক ময়না বুকে লাথি মেরে চলে গিয়েছিল। আমি নাকি অযোগ্য। কা পুরুষ। অপদার্থ। একটা সাইকেল কিনতে পারি না।

চাঁদু।। তাহলে আজকে প্রমাণ করে দে, তুই পুরুষ। তোর একটা সাইকেল আছে। তুই সাইকেল চালাতে জানিস। সাইকেলের ক্যারিয়ারের একটা মেয়েমানুষ নিয়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখাতে পারিস।

অভি।। পারি পারি পারি ১০০ বার পারি। তুই একটু দাঁড়া। আমি আসছি। (দোকানের ভিতরে ঢুকে দলিলটা নিয়ে এলো। চাঁদু সেটা ছিনিয়ে নেবে।)

চাঁদু।। কাল রাত বারোটায় তোর বিয়ে। তৈরি হয়ে থাকিস। আমি এসে তোকে তুলে নিয়ে যাব।

অভি।। আচ্ছা, আমার বিয়ের পর সেই সংসারে আমার মা দিদির জায়গা হবে?

চাঁদু।। হিরো হোন্ডার চাকায় সাইকেলের টায়ার টিউব ফিট করে? ওরে নতুন দিনের নতুন মৌচাক থেকে মধু চেটে চেটে খাওয়ার নাম জীবন! বেঁচে থাকা!! সেই জীবনে অন্য কারোর জায়গা হতে পারে না। বুঝেছিস ক্যালানে মদন!

চাঁদু গান গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছে।

আত্মহারা অবিরাম নিজের মধ্যে কিছুটা সময় ডুবে যাবে। তারপর চাঁদুকে ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে যাবে।

দৃশ্যান্তর

একটু একটু করে ভোরের সূর্য উদিত হচ্ছে। পাখি মিঞা গান গাইতে গাইতে পেরিয়ে পড়েছে। ঘটু চায়ের দোকান সাজিয়ে তুলছে। পাখি মিয়া এগিয়ে আসবে।

পাখি মিঞা ।। (এদিক ওদিক তাকিয়ে) কোথায় গেল সে? তাকে তো দেখছি না! বাড়ি গেল নাকি? (ঘটুকে) তাকে দেখছি না কেন?

ঘটু।। আমি কি জানি! আমাদের এখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল!

পাখি মিঞা ।। বলছিল যে, একটা ময়না নেবে–

ভটু।। কথায় বলে আপনি খেতে ঠাঁই পায় না, শঙ্খরাকে ডাকে। তোমার আবার কি। বেচবার লোক পেলে—উদয়পুরের আকাশে যত পাখি আছে সব বেঁচে দেবে!!!

পাখি মিঞা ।। তা কেন। মাগনায় কাউকে কাউকে অনেক সময় টিয়া ময়না দিচ্ছি তো। বলছিলাম যে, চা এর জল গরম হয়েছে?

ঘটু।। হাত খালি নেই। দেরি হবে।

পাখি মিঞা ।। তাহলে অন্য কোথাও যাই। অ ভিরাম থাকলে হয়তো—(চলে যাবে)

দিনু দা কে আসতে দেখা যাবে।

দিনু।। আশ্চর্য কান্ড!!! সারারাত এইভাবে দোকান খোলা ছিল!!!

ঘটু।। অভি কাল রাতে বাড়ি গেছে।

দিনু।। সে কি। আমাকে তো কিছু জানালো না! চাঁদু কোথায়?

চাঁদু।। এইতো আমি। (দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে) এত সকালে যাচ্ছো কোথায় দি নু দা?

দিনু।। কলকাতা। আমাদের ইউনিয়নের কলকাতার নেতারা ডেকে পাঠিয়েছে। আজ হাইকোর্টে গিয়ে স্টে অর্ডার আনতে হবে।

চাঁদু।। এখানে হলো না বুঝি?

দিনু।। এখানে সম্ভব না। হরেক ঝামেলা। ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা বার করে দে।

চাঁদু।। টাকা তো অভি নিয়ে গেছে।

দিনু।। নিয়ে গেছে মানে?

চাঁদু।। বাড়ি যাওয়ার সময় আমাকে বলল, তুমি নাকি বলেছ ক্যাশ বাক্সে যত টাকা আছে নিয়ে যেতে।

দিনু।। আমি আবার কখন বললাম। আমার সঙ্গে তো দেখা হয়নি।

চাঁদু।। আমাকে বলল, ওর নাকি বিয়ে। তোমার কাছে টাকা রাখতে দিয়েছিল।

দিনু।। শুনছিস ঘোটু শুনছিস? ছেলেটা কে বোকা হবা গো বেচারা ভাবতাম! এখন দেখছি আমার গলায় ছুরি চালাতে পারে!

চাঁদু।। আমি বাধা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম যে, তোমার সঙ্গে দেখা না করে জানো—

দিনু।। রোজগার নেই, কোন কাজের যোগ্যতা নেই। আবার বিয়ে করতে বসেছে। ওর বাড়ির লোকেরাইবা কেমন! (হতাশায় বসে পড়ে) জীবনে মানুষ চিনতে এত ভুল হচ্ছে কেন!!! আমাদের এই উদয়পুরটার হলো কি!!! জালিয়াতি আর জালিয়া তে চারদিক ভরে গেল।। বিশুদ্ধ বাতাস কোথাও পাবো না! শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে!!

চাঁদু।। তাহলে এখন তুমি কলকাতা কিভাবে যাবে? তোমার টাকা লাগলে আমি তোমাকে ধার দিতে পারি। কিন্তু শরীর খারাপ হলে যাবে কি করে?

বাসব হালদার লোকজন নিয়ে ভয় দেখাতে এলো।

বাসব।। এসব কি শুনছি দিনু দা? তুমি নাকি কলকাতা যাচ্ছ স্টে অর্ডার আনতে। আমার কথা বিশ্বাস হলো না? ভরসা করতে পারলে না-

দিনু।। সারাদিন ভরসা করেছি। ভোট দিয়েছি। যখন যা বলেছ করেছি।

বাসব।। এখন দল বদল করতে চাইছ? জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে পারবে তো? ওদিকে তোমার ছেলেরা বলে বেড়াচ্ছে, আমি নাকি তোমাদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলেছি! আর সেই সব টাকা দিয়ে ভোট করেছি!

দিনু।। কি হয়েছে, কি করেছ, সবাই জানে। ওসব ঝাঁটির মধ্যে আমি যেতে চাই না। আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য, উন্নয়নের নামে, রাস্তা চওড়া করার অজুহাতে, এখানকার কয়েকশো দোকান ভেঙে ফেলা চলবে না।

বাসব।। আজ বুঝতে পারছি, তোমরা উদয়পুরটাকে কেউ কখনো ভালবাসনি। উদয়পুরের ভালো মন্দ বোঝার চেষ্টা কর নি। কতবার বলেছি, পুরনো দিন, পুরনো ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে থাকা যায় না। ডেড বডি আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। কিংবা কবর দিতে হয়। পরিবর্তনের সময় অনেক রকম উলটপালট হয়। তাতে করে ভয় পেলে চলবে কেন?

যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যাই। আমরা আছি। আমরা থাকবো। অন্য কোন শক্তি আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারবেনা। আর এখানে যদি বসবাস করতে চাও, আমাদের নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে হবে। অন্যের নাক আমরা কেটে দেব। (চলে যাবে)

ঘটু।। (ফিরে আসে) আড়াল থেকে অনেক কিছু দেখলাম, শুনলাম! ওদের কথায় কান দিও না! টাকা আমি দিচ্ছি! সময় নষ্ট না করে কলকাতা চলে যাও! যেভাবে হোক স্টে-অর্ডার বার করতেই হবে। কি হলো যাও। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করো। আমি এখানে আছি।

বিধ্বস্ত দিনুদা-কে কলকাতায় রওনা করিয়ে দিল ঘটু।

চাদুকে দেখা যাবে আড়াল থেকে সে ঘটনার উপর লক্ষ্য করছে। দিনের আলো পরিবর্তিত হতে হতে রাত নেমে আসে। অভিরাম কে বর সেজে আস তে দেখা যায়। সে আয়না বার করে সেজে নেবে। দূরে অদূরে রাত জাগা নিশাচর প্রাণী ও কুকুরের ডাক শোনা যায়।

চাদু আসবে।

অভি।। কিরে সব ঠিক আছে তো?

চাঁদু।। আছে আছে। সব ঠিক আছে। তবে সন্ধের লগ্নে পুর ুত বাটা আর এক জায়গায় বিয়ে দিতে গেছে।

অভি।। তাহলে আমার বিয়ে কখন হবে?

চাঁদু।। শেষ রাতে। কিচ্ছু ভাবিস না, পুরু ত ব্যাটা ঠিক চলে আসবে। টাকা এডভান্স নিয়েছে-

অভি।। আমি কটার সময় যাবো?

চাদু।। বারোটা কিংবা একটাতে চলে যাস। কোথায় যাবি মনে আছে তো? ওই যে পাহাড়ের উপর একটা কালীমন্দির-

অভি।। যদি কুকুর তাড়া করে? কিংবা পুলিশ ধরে?

চাঁদু।। বিয়ের বরকে কুকুর কিংবা পুলিশ কেউ তাড়া করবে না। তুই ময়নার বেনারসি শাড়ি বেলাউজ আর কি সব আনবি বলে ছিলি –

অভি।। হ্যাঁ হ্যাঁ। এই বাক্সটার মধ্যে সব আছে। মাকে তো সব বললাম, আমি বিয়ে করছি। দিদি তখন তার জমানো সামান্য কিছু কয় না আমাকে দিয়ে বলল, তোর বউকে দিস। বাক্সটার মধ্যে সব আছে।

চাঁদু।। তাহলে বাক্সটা দে। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

অভি।। মা আর দিদি আমার বিয়েতে থাকতে পারলো না। মনটা খুব খচখচ করছে রে-

চাঁদু।। কালকে তোর বউকে নিয়ে বাড়ি গিয়ে আর একবার সাতপাক করে নিলেই হল। আমি চলি।

চাদু বাক্স নিয়ে চলে গেল। অভিরাম নতুন স্বপ্ন দেখতে বসে। তার বিয়ে হয়েছে। বউ এসেছে। ফুলশয্যা হচ্ছে।

পাখি নিয়ে গান গাইতে গাইতে ফিরে আসে।

পাখি।। আরে, এটা কে? চেনা চেনা মনে হচ্ছে!

অভি।। সেকি আমাকে তুমি চিনতে পারছ না। আমি অভিরাম। আজ আমার বিয়ে-

পাখি।। তাই নাকি। কার সঙ্গে? কোন গ্রামে?

অভি ।। পাহাড়ের উপর কালী মন্দির ওইখানে বিয়ে হবে। ময়না গো ময়না। তুমি চেনো তাকে।

পাখি।। ময়না, মানে, হারান দাশের মেয়ে।

অভি।। হ্যাঁগো।

পাখি।। আগেও তো তার একবার বিয়ে হয়েছিল। তাছাড়া, মেয়েটা তো ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। হ্যাঁ, সন্ধের সময় দেখলাম বাসব হালদারের এক চালার হিরো হোন্ডায় চেপে কোথায় যেন যাচ্ছে।

অভি।। ভুল। ভুল দেখেছো তুমি। তাছাড়া আগে একবার বিয়ে হয়েছে তা আমি জানি। আমারও তো আগে একবার বিয়ে হয়েছিল।

পাখি।। কি জানি বাবা আমার তো অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমি চলি। মহাজনের বাড়ি থেকে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল। শেষ ট্রেনে ধরে আমাকে আসতে হলো। আমি চলি।

অভিরাম পাখি নিয়ে আর কথা বিশ্বাস করতে চায় না। সে এখনো স্বপ্ন দেখে।

এমন সময় বুলডোজার এর শব্দ শোনা যায়। চারিদিক থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছে। ঘোটু, দি ননাথ আরো অনেকে ছুটে আসে। একটার পর একটা দোকান ভাঙচুর হয়। ঘটু গুলি খেয়ে পড়ে যায়। অভিরাম ও পুলিশের হাতে মার খায়।

ভয়ংকর সেই দৃশ্য। যেন ভূমিকম্প হয়ে গেছে। চারিদিকে কান্নার রোল। ভগ্নস্তূপের মধ্যে থেকে অভিরাম উঠে দাঁড়ায়।

তার প্রিয় সাইকেলটা তুলে আনে। দিনু দা কে তুলে আনে। দিনু কাঁদছে।

দিনু।। সব শেষ হয়ে গেল। আর কোন আশাই নেই। ওই দেখ ঘটু ওখানে গুলি খেয়ে পড়ে আছে। চারিদিকে কত লাশ। লাশের পাহাড়।

অভি।। তবুও তোমাকে উঠতে হবে।

দিনু।। পারবো না পারবো না। মাজা কোমর ভেঙে গেছে। আর কোথায় যাব!!

অভি।। আমার কথা শোনো। ঝরে মাঝে মাঝে পাখির বাসা ভাঙ্গে। পাখির ডিম মাটিতে পড়ে থেতলে যায়। তবু ও পাখি কাঁদে না। স্বপ্ন দেখে। নতুন বাসার স্বপ্ন। চলো চলো দিনু দা, আমরাও নতুন বাসার খোঁজে বেরিয়ে পড়ি।

হাহাকারের মধ্যে ভোরের সূর্য জেগে উঠতে থাকে।

বিঃ দ্রঃ এই নাটকের সমস্ত রকম আইনি অধিকার নাট্যকারের। অনুমতি না নিয়ে অভিনয় করা যাবে না।  -সুব্রত কাঞ্জিলাল

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -