Bangla Natok: লাইসেন্স (সাদাত হাসান মান্টোর কাহিনী অবলম্বনে একসংলাপী নাটক)

- Advertisement -

অনুপ চক্রবর্তী

চরিত্র: আব্বু

আব্বু ।। নীতি! মেরি জান! কী দারুণ সুন্দর চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস রে তুই টাঙ্গাটা রে নীতি! কী সুন্দর তোকে দেখতে লাগছে রে! আহা! এই টাঙ্গার ঘোড়াটার মতোই তোর তেজ! টগবগ টগবগ। টগবগ টগবগ। কী দারুণ দেখতে লাগছে রে তোকে নীতি! মেরি জান! যেন সকাল বেলার সোনালী রোদের মতো সোনালী আলো ঝিকমিকিয়ে উঠছে তোর দুই ডাগর চোখে! আহাহা! কী কাজল কালো চোখ দুটো তোর হরিণীর মতো রে নীতি! রাস্তার দুধারে সবাই কেমন দেখছে তোকে। তবে সকলের দেখাটা একই রকমের নয়। আগেও তা অনেকবার লক্ষ্য করেছি ৷ কেউ দেখছে অবাক হয়ে। কেউ খুব তারিফ করছে। কেউ দেখছে মুগ্ধ হয়ে। কিন্তু আবার অনেকে দেখছে তোকে লোভীর মতো। কুদৃষ্টিতে। কামুকের মতো। আবার কেউ দেখছে তোকে প্রচন্ড হিংসে নিয়ে। কী ভয়ানক ঘৃণা আর হিংসে ওদের! একজন আওরাত টাঙ্গা চালাচ্ছে বলে। ওরা এত হিংস্র কেন! কেন এত হিংসুটে ওরা! ওই যে একজন টাঙ্গাওয়ালা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল তোর দিকে কটমট করে তাকাতে তাকাতে৷ কেন? তুই কি ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিস? ওরা তো জানে আমি বেঁচে নেই বলে পেটের দায়ে তোকে টাঙ্গা নিয়ে বেরোতে হচ্ছে। তুই তো সুযোগ দিয়েছিলিস পরপর দুজনকে। সবই তো জানি আমি। সব তো দেখে যাচ্ছি তোর পাশে থেকে থেকে প্রতিটা মুহূর্তে। কিন্তু তোকে তো ছুঁতে পারছি না। কী করব রে নীতি৷ আমি যে বেঁচে নেই। আমি যে ভূত। কিন্তু দেখে তো যাচ্ছি। তুই দীনাকে টাঙ্গাটা ভাড়া দিলি পাঁচটা করে টাকা দেওয়ার চুক্তি করে। প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা দীনা আসত পাঁচটাকা নিয়ে আর তোকে অভয় দিয়ে বলত, “বৌদি আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আমরা সবাই অসহায়। আব্বু শুধু আমার বন্ধুই না, ভাইও ছিল। আমি যতখানি পারব, নিশ্চয় করব।”

কিন্তু এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন দীনা তোকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। দেখে আমার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। ওর কথা শুনে তোর ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু এসব কিছুই না করে তুই শুধু ঠান্ডা গলায় বললি, ‘দাদা, আমি বিয়ে করতে পারব না।‘ আর তাই সেদিন থেকেই দীনার ব্যবহারও গেল বদলে। প্রথম কিছুদিন অন্য কারোর হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে পাঠানো শুরু করল, তারপর কখনও চারটাকা দিত, কখনও তিন। এরপর হঠাৎ শরীর খারাপের অজুহাতে কিছুদিন এলই না। তারপর বলল শরীর খারাপের জন্য কদিন টাঙ্গা চালানো হয়নি বলে রোজগারও হয়নি, আর টাঙ্গাটার মেরামত না করালেই নয়। তুই সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একদিন দীনাকে বললি, “দাদা তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমার টাঙ্গা-ঘোড়া বরং আমাকেই ফেরত দিয়ে দাও।” দীনা ছিল নাকি আমার দোস্ত। এমনই দোস্ত যে উপকার করার ছল করে এসে লোভীর মতো তোকে শাদি করতে চাইল। থুঃ থুতু ফেলতে সাধ জাগে এমন দোস্তের মুখে। ও কিন্তু পারল না তোকে কব্জা করতে। হেরে গেল। তুই ভাগিয়ে দিলি ওকে। কেননা তুই যে আমাকে তুলতে পারিস নি রে নীতি। দীনার প্রস্তাবে তোর চোখ দিয়ে টপ টপ করে গরম পানি ঝরে পড়ে পড়ে তোর গোলাপের পাপড়ির মতো দুটো গাল ভিজিয়ে দিল। আর তা দেখে আমার মধ্যে ঘূর্ণি ঝড় উঠল। নীতি ! নীতি! নীতি! আমার সোনামণি! এত- এত ভালবাসিস তুই আমাকে নীতি! এখনও! আমার মরণের পরেও! মেরি জান! কেন এখনও এতখানি ভালবাসছিস আমাকে নীতি! আমি তো তোকে কিছুই দিতে পারছি না। পাল্টা পারছি না দিতে তোকে আমার মহব্বৎ। আমার যে শরীর নেই রে নীতি। হায় আল্লাহ! (প্রচণ্ড আবেগে ডুকরে কেঁদে ওঠে)।  

এর কিছুদিন পর এল আমার আর এক নকলি দোস্ত। মাঝে। টাঙ্গাটা চালাতে। কিছুদিন পর সেই ইবলিসটাও তোকে শাদী করতে চাইল। আর তুই ওকে স্পষ্ট না বললি। তারপর তারও ব্যবহার গেল বদলে। তারপর অসহায় হয়ে তুই টাঙ্গা-ঘোড়া অজানা এক কোচোয়ানের হাতে তুলে দিলি। এক সন্ধ্যায় সে মাতাল অবস্থায় টাকা দিতে এসে তোর হাত ধরতে গেল। সেদিন অনেক কথা শুনিয়ে লোকটাকে বাইরে বের করে দিলি তুই। দেখছিলাম সেসব অসহায় হয়ে। দেখতে দেখতে চুরমার হয়ে যাচ্ছিলাম। কেননা কিছুই করতে পারছিলাম না তোর ইজ্জত বাঁচাতে। আমি যে ভূত। আমার যে শরীর নেই। আমার শরীর থাকলে ঐ মাতালের হাতটা আমি গুঁড়িয়ে দিতাম। আঃ আল্লাহ ! আমাকে কি শুধুই দেখেই যেতে হবে আমার সর্বস্ব এই নীতির এই হেনস্তা, এই অপমান। নীতি! ইনায়ত! আমার সর্বস্ব! এত গভীরভাবে তুই আমাকে এখনও ভালোবাসিস! সোনামণি আমার! এখনও কেন এত ভালোবাসিস তুই আমাকে!

তোকেও আমি কিন্তু প্রথম দিন দেখে এমনিই ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিলাম রে নীতি। মনে পড়ছে তোকে প্রথম দেখার সেই দিনটা। ষোল বছরের একটা মেয়ে। রোগা। অথচ মজবুত। শ্যামলা রঙ। অথচ উজ্জ্বল। কানে ছোট্ট রুপোর দুল। সোজা সিঁথি। টিকালো নাক। নাকের ডানদিকে ছোট্ট তিল। লম্বা কামিজ। ঘন নীল সালোয়ার। আর মাথায় ওড়না। আহাহা! কী অপরূপ রূপ! আমি দেখলাম তোকে। আর দেখে মরলাম। একদমই তলিয়ে গেলাম এক অতল মহব্বতের দরিয়ায়। তুই নরম গলায় বললি, “দাদা, স্টেশন যেতে কত নেবে?” তোর রিনরিনে গলায় এসরাজের পাগল করা সুরের মতো তোর কথা শুনে আমার বুকেতে দিল দোলা। ঠোঁটেতে আমার বদমাশের হাসি খেলে গেল। বললাম “এক টাকাও না!” তোর মুখেতেও এবার যেন একটু হাসি। তুই শুধোলি “কত নেবে স্টেশন যেতে?” আমার বুকেতে তখন উথাল পাথাল। চোখ দিয়ে তোকে যেন গিলছিলাম। বললাম, “তোর থেকে আর কী নেব, আয় টাঙ্গায় বস ।” তুই তোর কামিজ ঠিক করতে করতে বললি, “এরকম অদ্ভুতভাবে কথা বলছ কেন তুমি?” আমি হেসে বললাম, “আয়, টাঙ্গায় বোস, যা ইচ্ছে দিস।” তুই কিছুক্ষণ ভাবতে সময় নিলি। মনে হয়। আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলিস না। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃহাঃ! কিন্তু আমাকে তোর ভাল লেগে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত। তাই অল্প একটুক্ষণ দোটানায় থেকে তারপর টাঙ্গায় পা দিয়ে বললি, “জলদি স্টেশন নিয়ে চল।” আমি ফিরে তাকিয়ে বললাম, “খুব তাড়া দেখছি সোনা?” তুই অস্ফুটে বললি “এ বাবা, তুমি তো,”……হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!

টাঙ্গা চলতেই থাকল, ঘোড়ার পায়ের নিচ দিয়ে দৌড়ে গেল কত রাস্তা। আমার ঠোঁটেতে দুষ্টুমির হাসি ক্রমশ বেড়েই চলছিল। আর তুই ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছিলিস। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! অনেকক্ষণ পর তুই ভয়ের গলায় বলে উঠলি, ‘’এখনও স্টেশন এল না?” আমি উত্তরে বললাম “এসে যাবে। তোর আমার স্টেশন তো একটাই,”। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! তুই বললি ‘’তার মানে”?  আর আমি – আমি তোর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম, “সোনা, তুমি যখন আমার দিকে প্রথম তাকিয়েছিলে তখনই আমাদের স্টেশন এক হয়ে গেছিল। তুমি এটুকুও বোঝো না? তোমার দিব্যি আমি বানিয়ে বলিনি।” তুই মাথার ওড়না ঠিক করতে করতে আমার দিকে আড়চোখে তাকালি। তোর চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল আমার কথার মানে তুই বেশ বুঝেছিস। তোকে দেখে মনে হচ্ছিল আমার কথাটা তোর খুব একটা খারাপ লাগেনি। তাই না? বল নীতি। সত্যি করে বল। তুই কি ভাবছিলিস বলব? তুই ভাবছিলিস দুজনের স্টেশন এক হোক অথবা নাই হোক, ছেলেটা বেশ চৌকশ; তবে ও কি কথা রাখবে? আমাকে কি স্টেশনে পৌঁছে দেবে ও?” হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! ক্রমশ চিন্তায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছিলিস তুই।

আর সেইসময় ঘোড়াটা নিজের ছন্দে দৌড়চ্ছিল বেশ। চারদিকে ঘুঙুরের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিল না। বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম তোকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ টাঙ্গা থামিয়ে ঘোড়ার লাগামটা জঙ্গলের একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে একলাফে তোর পাশে এসে বসলাম। তুই একদম চুপ। আমি তোর হাতদুটো আচমকা ধরে বললাম, “এই হাত দুটো আমাকে দিয়ে দাও।” তুই অস্ফুটে শুধু বললি, “আমার হাত ছাড়ো।” কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার হাতের ছোঁয়ায় তোর বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকছিল। তুইও মরলি। আমার প্রতি মহব্বতে তলিয়ে গেলি তুই। বল নীতি। তাই নয় কি? হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! আমি তোকে বললাম “দেখো এই টাঙ্গা, ঘোড়া আমার জীবনের সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু আল্লাহর কসম, দরকার হলে এদের বেচেও আমি তোমাকে সোনার বালা কিনে দেব। নিজে ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে থাকব কিন্তু তোমাকে সারা জীবন রাণী করে রাখব। তুমিই আমার প্রথম প্রেম। আল্লাহর কসম তোমাকে না পেলে আমি তোমার সামনেই নিজের গলা কেটে ফেলব।” তারপর তোর হাত ছেড়ে বললাম “আজ কি হয়েছে আমার? চলো তোমাকে স্টেশনে ছেড়ে আসি।” তুই অস্ফুটে বললি, “না, তুমি আমার গায়ে হাত দিয়েছ।” আমি ঘাড় নামিয়ে বললাম, “আমাকে ক্ষমা করে দাও, ভুল হয়ে গেছে।” তুই বললি” এই ভুলটার প্রায়শ্চিত্ত করবে না?” তোর গলায় একটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের সুর ছিল, তা যেন আমাকে বলছিল “পারবে তোমার টাঙ্গাটাকে ঐ টাঙ্গাটার আগে নিয়ে যেতে? পারবে? বলো?”

আমি ঘাড়টা খানিক তুলে তারপর বুকে হাত রেখে বললাম, “আব্বু তোমার জন্যে জান কবুল করে দেবে।” এবার তুই ডানহাতটা বাড়িয়ে বললি, “হাতটা ধরো।” আর আমি হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম, “নিজের প্রাণের কসম খেয়ে বলছি, আব্বু আজীবন তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকবে।” তুই সেদিন তোর আত্মীয়দের সাথে বেড়াতে এসেছিলিস। তারা যখন তোর জন্যে স্টেশনে অপেক্ষা করছিল, সেইসময় তুই তোর এই আব্বুর সঙ্গে ভালোবাসার নদী পার হচ্ছিলিস। তোকে আমি ছিনিয়ে নিলাম তোর কাছ থেকে, তোদের পরিবারের কাছ থেকে, এই সমাজের খাঁচা থেকে। আমার ভালবাসার জোরে। হ্যাঁ। শুধুই আমার এই ভালবাসার জোরে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো উদ্দাম আমার এই ভালবাসা। উত্তাল ঢেউয়ের মতো আমার এই প্রেম। বন্যার মতো আমার এই মহব্বৎ। যা তোকে ভাসিয়ে দিল আমার আকুল দিলের মহব্বতের অকূল দরিয়ায়। তুই ধরা দিলি আমার ভালবাসার বাঁধনে। তুই আমার হলি। আমি তো আগেই তোর হয়ে গেছিলাম। তাই পরের দিনই আমার সাথে তোর শাদী হয়ে গেল। আর তারপর থেকে আমরা দুজনেই কী দারুণ আনন্দে ছিলাম বল নীতি। তোকে সাজাবো বলে তিলতিল করে টাকা জমিয়ে তোর জন্যে সোনার বালা কিনে আনলাম। সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা কিনে আনলাম। কিনব না? তুই যে আমার রাণী। আমার ভালবাসার ধন। পরম ধন। সিল্কের সালোয়ার- কুর্তা পরে তুই যখন তোর এই আব্বুর সামনে দিয়ে হাঁটতিস, তখন আমার বুকের মধ্যে আমার হৃদপিণ্ডটা লাফ দিয়ে উঠত। আমার বুকের মধ্যে রক্ত ছলকে ছলকে উঠত। আমি যেন পাগল হয়ে যেতাম। দিওয়ানা হয়ে যেতাম। তখন মনে মনে বলতাম, “আল্লাহর কসম, তোর মত সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।” তোকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, “নীতি, তুই আমার রাণী।” এভাবেই ভালবাসায়, আদরে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিন।

হায় আল্লাহ! কোথায় মিলিয়ে গেল সেইসব দিন! কেন ফুরিয়ে গেল আমার জীবন! কেন লুপ্ত হয়ে গেল আমার শরীর! কেন আমি আর কোনদিনই তোকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারব না “নীতি, তুই আমার রাণী।”! হায় আল্লাহ! কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব দিন! আমি তো কোনো পাপ করিনি। কোন অপরাধ করিনি। আমি তো তোকে ভালবেসেছিলাম। আর তাই ভালবেসে তোকে শাদী করেছিলাম। ভালোবাসা কি পাপ? ভালোবাসা কি অপরাধ? কিন্তু এরা মেনে নিল না । মেনে নিল না এই সমাজ। এই রাষ্ট্র। এরা এদের তৈরি আইনের বলে আমাকে তুলে দিয়ে গেল। বলল ষোল বছরের একটা নাবালিকা মেয়েকে শাদী করে আমি নাকি অপরাধ করেছি। তাই আমাকে ওরা জেলে পুরে দিল। জেল হয়ে গেল আমার। নাবালিকাকে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে বিয়ে করবার অপরাধে দুবছরের জেল হয়ে গেল আমার। হুঁঃ! অপরাধ! ভালবাসা নাকি অপরাধ!

আদালতে আমার সাজা শুনে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু এটুকুই বললি, “আমি বাবা মায়ের সঙ্গে যাব না। ও বাড়িতেই তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব।” আমি তোর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, “সাবধানে থাকিস। আমার টাঙ্গা-ঘোড়া তোর জিম্মায় রেখে যাচ্ছি। নিয়মিত ভাড়া তুলতে ভুলিস না কিন্তু।” তোর বাবা-মা অনেক সাধ্যসাধনা করেও তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারল না। শুরু হল তোর একলার জীবন। টাঙ্গা ভাড়া বাবদ যে পাঁচটাকা তুই রোজ পেতিস তাতেই দিব্যি দিন কেটে যেত তোর। সারা সপ্তাহে একদিন দেখা আর বাকি ছদিন শুধু তোর এই আব্বুর অপেক্ষা, এভাবেই কাটতে লাগল তোর প্রতিটা দিন। জমানো যা টাকা-পয়সা ছিল তা আমার জন্যে খাবার কিনতে আর যেতে আসতেই খরচ হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ আমার চোখ তোর কানের ওপর পড়ল। দেখলাম তোর কানে দুল নেই। মানে আমার জন্যে খাবার কিনতে তুই তোর দুলদুটো বেচে দিয়েছিস। তোকে জিজ্ঞেস করতে একটা কমলালেবুর দিকে তাকিয়ে থেকে তুই বললি, “কে জানে, হারিয়ে গেছে বোধ হয় কোথাও।” দুঃখে আমার বুক ভেঙে গেল। আমি প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বললাম, “প্রতিদিন আমার জন্যে এত কিছু আনার কী দরকার? আমি যেভাবে আছি, বেশ ভাল আছি।”

দেখা করার সময়ও ফুরিয়ে এসেছিল। তুই আর কথা না বাড়িয়ে শুধু ম্লান হেসে বাড়ি ফিরে গেলি। মনে হয় বাড়ি ফিরে সেদিন ভীষণ কেঁদেছিলিস। দেখা করার সময়ে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিলিস নিজেকে। কেননা তুই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলিস যে তোর এই আব্বুর শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে। মনে হয় ভেবেছিলিস তোকে না দেখতে পাওয়ার কষ্টেই বোধ হয় আমার শরীরের এই হাল। একলা থাকার কষ্ট, জেলের পচা খাবার আর হাড়ভাঙা খাটুনি এসবই জানা ছিল তোর, শুধু আমার হার্টের রোগের কথা বাদ দিয়ে। সেটা জানাইনি তোকে। তুই আরো দুঃখ পাবি বলে। হাসপাতালে শুয়ে মরবার কয়েক মূহূর্ত আগে বিড়বিড় করে তোকে বলেছিলাম, “যদি জানতাম এত তাড়াতাড়ি আমি মারা যাব, তাহলে আমি তোকে বিয়ে করতাম না নীতি ৷” বলেছিলাম তোর এই দুর্দশার জন্যে শুধু আমিই দায়ী। বলেছিলাম আমাকে ক্ষমা করে দিস। আর আমার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে আমার টাঙ্গা-ঘোড়ার যত্ন নিস। আর চান্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলিস ওর বাবা ওর জন্যে ভালবাসা পাঠিয়েছে। আমি মারা যাবার দিনই তোর সমস্ত কিছু হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। হায় আল্লাহ ! তারপর চোখের সামনে দেখেছি দিনের পর দিন তোর কী ভয়ানক কষ্ট! প্রিয়তমা আমার! আমার নীতি! আমার ইনায়ত! মেরি জান! আমার কলিজা!

একটা সময় আমি চলে গেলাম বটে। কিন্তু তোকে তো বলতে পারলাম আমি তোর পাশে সর্বদা আছি ভূত হয়ে। মরে গেলেও আমি তোকে ছেড়ে যাইনি। কেননা তোকে আমি ছেড়ে যেতে পারিনি। ছেড়ে যেতে চাইনি বলেই ছেড়ে যেতে পারিনি।

আমার ঐদুটো ইবলিশ নকল দোস্তদুটো বেইমানি করার পর সত্যিই তুই বিপদে পড়লি। তাই এভাবে কিছুদিন কাটানোর পর হঠাৎ একদিন তোর মাথায় এল, ‘’নিজে চালালে কেমন হয়’’। ঠিকই ভেবেছিলিস। আব্বুর সঙ্গে বেরিয়ে অনেকবার তো নিজেই টাঙ্গা চালিয়েছিস। আর এ শহরের সমস্ত রাস্তাও তো এখন তোর চেনা।

তারপর তোর মনে হল, লোকে কী বলবে।

তারপর নিজেকেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললি, ‘’মেয়েরা কি পরিশ্রম করে না নাকি? মেয়েরা আজকাল অফিসে যায়। তারপর আবার বাড়িতেও হাজার কাজ করে। খেটেই তো খাব, এতে অসুবিধে কোথায়?’’ ঠিক। ঠিক। সাচ বাত। ঠিকই ভেবেছিলিস।

তারপর বেশ কিছুদিন ভাবার পর তুই আল্লাহকে স্মরণ করে একদিন রাস্তায় টাঙ্গা বের করলি। প্রথম দিন থেকেই বাকি সব কোচোয়ানদের চোখ টাটাল। আর পুরো শহরে খবর রটে গেল এক সুন্দরী রমণী টাঙ্গা চালাচ্ছে। সব জায়গায় শুধু তোকে নিয়েই আলোচনা শুরু হল। তুই যে রাস্তা দিয়ে টাঙ্গা চালিয়ে যেতিস সেই রাস্তায় অসংখ্য লোক অপেক্ষা করে থাকত সওয়ারি হবে বলে।

প্রথম প্রথম তোর টাঙ্গায় চাপতে লোকে ভয় পেলেও কিছুদিনের মধ্যেই সে ভয় গেল কেটে। এরপর থেকে আর এক মিনিটও তোর টাঙ্গা খালি পড়ে থাকত না। সব্বাই তোর টাঙ্গায় চাপবার জন্য হুড়োহুড়ি করত।

কিন্তু কিছুদিন এভাবে চালাবার পর তুই বুঝতে পারলি সারাদিন এভাবে টাঙ্গা চালালে তোর আর ঘোড়ার, দুজনেরই শরীর যাবে ভেঙে। তাই স্থির করলি এবার থেকে সকাল সাতটা থেকে বারোটা অবধি চালিয়ে একটু বিশ্রাম নিবি। তারপর আবার দুপুর দুটো থেকে ছটা অবধি চালাবি। এতে তোর ধকল খানিক কমল। রোজগারও খুব মন্দ হচ্ছিল না। তুই ঠিকই করেছিস দমে না গিয়ে। হাল না ছেড়ে দিয়ে। লড়াই চালিয়ে যা রে নীতি।

আমি তোর পাশে সর্বদা আছি রে নীতি। এই ছুটন্ত টাঙ্গাতেও তোর পাশে বসে আছি। লোকে দেখছে তোকে লোভীর মতো। নোংরা চোখে। আর ফিকফিক করে কদর্য হাসি হাসছে হায়েনার মতো। ওঃ! হায় আল্লাহ! আমি বদলা নিতে পারছি না তোকে এই অপমান করার। পারলে আমি কোতল করে দিতাম ওদের। আল্লাহ! আল্লাহ! তুমি এই শয়তানগুলোকে দোজখে পাঠিয়ে দাও। এই ইবলিশের দলকে। আমি দেখেছি তোর গাড়িতে উঠতে চায় অনেকে সুন্দরী আওরাত দেখে। তোর শরীরের দিকে লক্ষ্য থাকে শুধু ওদের। কিন্তু ওরা জানে না তুই তো তোর হৃদয়, মন, প্রাণ, শরীর সমস্ত কিছু শুধু একজনকেই দিয়ে দিয়েছিস চিরকালের মতো। আমাকে। তোর এই আব্বুকে। ওরা জানে না তোর হৃদয় থেকে তোর শরীর আলাদা হয়ে যাবে না কোনদিন। তাই যতই কামুক লোভীর মতো ওরা তোকে দেখুক, কোনদিনই তোকে পাবে না ওরা।

তবে তুই ক্রমশ বুঝতে পারছিলিস লোকে তোর টাঙ্গায় চড়ে স্রেফ তোর সান্নিধ্য পেতেই। উঠে অকারণেই খানিক এদিক-ওদিক ঘোরে, অশ্লীল রসিকতা করে, অদ্ভুত সব কথা বলে তারপর কোথাও একটা নেমে পড়ে। তুই এটাও টের পাচ্ছিলিস যে তুই নিজেকে না বিক্রি করলেও লোকে একটু একটু করে প্রতিদিন তোকে কিনে নিচ্ছিল। তুই এও বুঝতে পারছিলিস যে শহরের বাকী কোচোয়ানরা আজকাল তোকে নোংরা মনে করে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এ লড়াই ছাড়ার কোন বিকল্প এল না তোর মাথায় ।

আরে! একি! শহরের কমিটির লোকেরা তোকে ডেকে এসব কী বলছে! বলছে তুই টাঙ্গা চালাতে পারবি না। কেন। কেন। কেন। কেন রে। হারামজাদারা! তুই মুখের ওপর জিজ্ঞেস করলি, “কিন্তু কেন হূজুর?” সাব্বাশ নীতি।

আরে! ঐ হারামীরা বলছে লাইসেন্স ছাড়া তোর টাঙ্গা চালানো অপরাধ। আরে! কুত্তারা বলছে লাইসেন্স না নিয়ে এবার রাস্তায় বেরোলে টাঙ্গা আর ঘোড়া দুটোই বাজেয়াপ্ত হবে।”

এবার তুই মোক্ষম প্রশ্নটা করলি, তাহলে বলুন হুজুর কিভাবে পাব এই লাইসেন্স?” সাব্বাশ নীতি।

আরে বেজন্মার বাচ্চারা এটা কী বলছে!

ওরা বলছে মেয়েদের লাইসেন্স দেওয়া হয় না।

শয়তান! ইবলিশ! বেজন্মা! শুয়ারের বাচ্ছার দল! ওঃ হায় আল্লাহ। ওরা তোর রুজিরোজগার বন্ধ করে দিচ্ছে। তোর মুখের রুটি কেড়ে নিচ্ছে। তোকে ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে দেবে না। ওঃ! হায় আল্লাহ! আমি কিছু করতে পারছিনা। শুধু নিষ্ফল আক্রোশে ফেটে পড়ছি। কিন্তু তুই হলি নীতি। তাই দেখছি তোর জলভরা চোখে আগুন জ্বলে উঠছে। তুই আবার ওদের প্রশ্ন করলি, “হুজুর আমার টাঙ্গা-ঘোড়া সব কেড়ে নিন। কিন্তু আমাকে বলুন মেয়েরা যদি চরকা চালাতে পারে, কয়লা কাটতে পারে, ঝুড়ি বুনতে পারে তাহলে আমি টাঙ্গা চালালে অসুবিধে কোথায়? হুজুর আমার ওপর দয়া করুন, এভাবে আমার রুটি কেড়ে নেবেন না। আমি কীভাবে রোজগার করব তা দয়া করে বলুন!”

আরে! ওরা এ কী বলছে উত্তরে !

ওরা তোকে বলছে “বাজারে গিয়ে ধান্দা শুরু কর। ওতে রোজগার অনেক বেশি।” তোকে বেশ্যাগিরি করতে বলছে।

হায় আল্লাহ! ধ্বংস করে দাও এই ইবলিশ দুনিয়াটাকে!

নীতি! নীতি রে! তোর চোখ দিয়ে গরম পানি ঝরেই চলেছে। ঝরেই চলেছে। ঝরেই চলেছে। বুঝতে পারছি তোর ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। তুই শুধু মৃদু স্বরে “আচ্ছা” বলে বেরিয়ে এলি৷। আ আ আ আ…….

তারপর প্রচণ্ড জোরে টাঙ্গা চালিয়ে এসে সোজা কবরস্থানে এসে থামলি। এরপর এক মূহূর্ত স্থির হয়ে আমার কবরের সামনে দাঁড়ালি। তারপর মাথা নিচু করে বলছিস, “আব্বু, আজ তোমার নীতি কমিটির অফিসে মারা গেছে।” নীতি! নীতি! নীতি! আমার নীতি! আমার নীতি! নীতি রে! নীতি রে! আ আ আ আ আ আ আ ……হায় আল্লাহ…. (ভয়ানক আর্তনাদ করে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়ে আব্বু।)

সমাপ্ত

বিঃ দ্রঃ নাটকটি অভিনয় করার জন্য অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। নচেৎ আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -