Bangla Natok: অশ্লীল গল্পের খসড়া

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জিলাল

(চরিত্র: লেখক/লেখকের বউ/পুলিশের লোক/নাট্যকর্মী/চলচ্চিত্র পরিচালক/এডিটর)

লেখকের বউ চায়ের ট্রে নিয়ে লেখকের ঘরে আসবে।বিছানায় তখনো মশারি টাঙানো। জানলা গুলো বন্ধ। ছোট্ট ঘরখানা কাগজপত্র বই পত্র আরো অনেক কিছু ছড়ানো ছেটানো। টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া। লেখকের বউ জানলা খুলে দেবেন। বাইরে থেকে রোদ আসবে। মশারি খুলবেন। বিছানা গুছিয়ে দেবেন।

বউ।। এত যে পই পই করে বলি, ঘরটা গুছিয়ে রাখতে না পারো, এলোমেলো করো না। কে কার কথা শোনে। লেখকদের কি সৌন্দর্য জ্ঞান বলে কিছু নেই!! সব লেখক কি এর মত নোংরা থাকতে ভালোবাসে। বাইরে থেকে যারা আসে, তারা কি ভাবে? বউটা ঘর গুছিয়ে দেয় না!!! রাতের খাবারটাও দেখছি খায়নি। সাত সকালে কোথায় গেল-

(মোবাইল রিং হবে)

হ্যালো, আমি ওনার স্ত্রী বলছি। আপনি কে বলুন- বাড়িতে আসবেন-! আর কিছুক্ষণ পর ফোন করে আসুন। ঠিক আছে। ঠিক আছে তো বলে দিলাম। এদিকে যে কিছুই ঠিক নেই। মানুষটা গেল কোথায়! চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বয়স যত বাড়ছে, ঝামেলা ও তত বাড়ছে। বাইরে গেলে আমাকে বলে যাওয়াটা কি যায় না!! কদিন ধরে ফো নে র পরে ফোন। খালি একটাই কথা, দাদা কি বাড়িতে আছেন? গেলে দেখা হবে? আজ শুরু হয়েছে ভোর রাত্রির থেকে ফোন ফোন আর ফোন। ওর ফোনে না পেয়ে আমার ফোনে হামলা শুরু হয়েছে।

লেখককে এবার বারান্দার দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখা যাবে।

বউ।। কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

লেখক।। ছাদে-

বউ।। ছাদে কেন? এই সময় তো তুমি-

লেখক।। মাঝ রাত থেকেই তো আমি ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

বউ।। এঘরে মশারি টাঙানো ছিল। খাবার পড়ে আছে। আর তুমি ছাদে গিয়ে বসে আছো!!

লেখক।। গত রাতেও তো ছিলাম। ঘরের মধ্যে ভীষণ গুমট। ফ্যান চালিয়ে ও শান্তি পাই না।

বউ।। কতবার তো বলেছি একটা এসি লাগিএ নাও। দিনকে দিন যেভাবে গরম বাড়ছে-! রাতের খাবারটা খাওনি কেন?

লেখক।। ভুলে গিয়েছিলাম।

বউ।। আগে তো এরকম ভুল হতো না। আচ্ছা, কি সব শুনছি তোমার নামে? তুমি নাকি-!

লেখক।। চরিত্রহীন? খারাপ জায়গায় যাওয়া আশা করি? আজকাল খারাপ খারাপ গল্প লিখছি?

বউ।। তোমাদের চরিত্র যে সোনার পাথর বাটি, এটা আমাদের বাড়িতে সবাই জানতো। তাইতো বিয়েতে মত ছিল না। আমার জেদের সঙ্গে পেরে ওঠে নি। তবে এতদিন তোমার চরিত্র নিয়ে আমার কাছে কেউ কানাকানি করতে আসে নি। আজ শেষ বয়সে ই বা-

লেখক।। কানা কানি চলছে কেন এই তো? 

বউ।। এসব শোনবার এখন সময় নেই। সংসারে অনেক কাজ পড়ে আছে। পরে দেখা যাবে। ক’দিন ধরে ওরা আমাকে জ্বালাচ্ছে। আমার সঙ্গে আজকে একটা ফায়সালা করতে হব তোমাকে। আর শোনো, কোন এক কাগজের এডিটর আসবে একটু পরে।

(আবার মোবাইল রিং)

হ্যাঁ, চলে আসুন। উনি ঘরে আছেন। কি আশ্চর্য!! আপনি এতক্ষন বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে- উঠে আসুন উঠে আসুন। আপনারা এভাবে লজ্জা দিলে-। উনি আসছেন। এতক্ষণ নাকি বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে‌ ছিলেন। আমি নিচে যাচ্ছি। শানুকে বাজারে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার কি আজকে বাইরে বেরোনো আছে? 

লেখক।। আছে। তুমি দুকাপ কফি পাঠিয়ে দিও। যিনি আসছেন, তিনি কফি ভক্ত।

বউ।। উনি যে কি ভক্ত তা আমি জানি। কফি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আধ ঘণ্টার মধ্যে ভাগিয়ে দেবে। বোতল খোলার কথা যদি একবারও ভেবে থাকো-

এডিটর মশাই ঢুকে পড়লেন।

এডিটর।। কোন চিন্তা করবেন না বৌদি। পুজোসংখ্যার জন্য আমার এখন মাথার ঘা’এ কুকুর পাগল। বোতল খুলে বসার কোন সুযোগ নেই। এক কাপ চা কিংবা কফি খেয়ে পালাবো।

লেখকের বউ চলে যাবে। এবার গলা নামিয়ে এডিটার বলবে।

এডিটার।। আপনি কি আমাকে আর পছন্দ করছেন না? আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আমি আপনাকে ঠিকঠাক দাম দিচ্ছি না? অন্য কেউ বেশি দাম দিচ্ছে?

লেখক।। সাত সকালে এসব কি কথা? টাকা পয়সা নিয়ে আমি কখনো আপনার সঙ্গে মার্কেটিং করেছি?

এডিটর।। প্রয়োজন হয় নি। আপনাকে সেরকম সুযোগ আমি দেইনি। তার আগে ই—-উপযুক্ত দাম আপনাকে দিয়েছি!

লেখক।। তাহলে অভিযোগটা কিসের?

এডিটর।। আমাদের রাইভাল কাগজ বিরাট বিরাট করে বিজ্ঞাপন করেছে, আপনি তাদের এমন একটা গল্প দিয়েছেন, যেটা হট কেক হতে চলেছে। বিজ্ঞাপনটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে ওই কাগজের পূজোর সংখ্যা সবকটা কপি নাকি অ্যাডভান্স বুকিং হয়ে গেছে। গল্পটা কি খুব রসালো? কানাঘুষা শুনতে পাচ্ছি এক ধরনের অশ্লীল গল্প। পাবলিশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যানড হয়ে যাবে!

লেখক।। আপনি চাইলে আপনাকেও দিতাম।

এডিটার।। চাইলে মানে! আপনি কি চান না যে আমি ব্যবসা করি! একটু বেশি প্রফিট করি?

লেখক।। ঐরকম গল্প আপনি কখনো ছেপেছেন?

এডিটর।। কখনো ছাপিনি বলে, কোনদিন ছাপবো না এটা কি আমি বলেছি? আরে মশাই পাঠকের কথা ভেবেই তো আমাদের ইনভেস্ট করতে হয়। সিনেমা থিয়েটার লিটারেচার সব জায়গায় পাবলিক একটা জিনিসই চেটেপুটে খাচ্ছে। সেটা হলো পলিটিক্যাল ক্রাইম, আর খুল্লামখুল্লা সেক্স। perversion।

লেখক।। আইন আদালত সামলাতে পারবেন তো?

এডিটর।। (হাসি উদ্যাম) ওসব প্ল্যান করে রেখেছি! আমি বই ছাপবো ফাস্ট এডিসন minium 50000। তারপর আমি আর একজনকে দিয়ে কেস ঠুকে দেব আমার নামে। কাগজে কাগজে এমন হইচই ফেলে দেবো – তখন আমাকে গোপনে আরো পঞ্চাশ হাজার প্রিন্ট করতে হবে! অ্যাডভান্স কত চাই বলুন? ২ লাখ চলবে? এক্ষুনি আপনার ফোন পেতে পাঠিয়ে দিচ্ছি?

লেখক।। এখন পাঠাবেন না। রাত্রে আমি আপনাকে ফোন করবো। কফি এসে গেছে, ওটার সদগাছি করুন।

এডিটার।।(হাসি) জানতাম আপনি আমাকে বিমুখ করবেন না! আপনার সঙ্গে তো আমার আজকের সম্পর্ক নয়! কফিটা মারকাটারি হয়েছে। বলছি কি, গল্পের প্লট নিয়ে যান বাউল বৈষ্ণব ‌ সহজিয়া পন্থীদের আখড়ায়। ওখানে তো ফ্রি সেক্স চলে। এককালে তো আপনি ওদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন। সবই জানেন। বই বের করার পরে, দেখবেন কোন সিনেমা কোম্পানি

সিনেমা করবার জন্য আপনার কাছে চলে আসবে। ডাবল ভার্সন সিনেমা করবে নিশ্চয়ই। তার মধ্যে একটা থাকবে ইংরেজি। সাহেবদের দেশে এসবের ডিমান্ড দারুন। তাহলে ওই কথা রইল। এখন চলি। ও হ্যাঁ, আপনার যে গল্পটা পুজো সংখ্যায় দেবো ঠিক করেছিলাম, ওটা তুলে রাখছি। এই মালটা আগে দিন। আমাকে ডোবাবেন না কিন্তু। ১০ ফর্মার উপন্যাস হলেই চলে যাবে। (গুডবাই বলে প্রস্থান)

(লেখকের মোবাইলে ফোন আসবে। কথা বলতে বলতে- লেখক ও সুযোগ বুঝে ছাদে চলে যাবে। লেখকের বউ ফিরে আসবে।)

বউ।। আবার ছাদে চলে গেল!!বুড়ো বয়সে একটা কেলেঙ্কারি না করে ছাড়বে না দেখছি। লোকটা কি এতদিনে গড়ে তোলা মান সম্মান হারিয়ে লোক হাসাতে চায়! ছি ছি ছি!

এবার তো পাঁচজনের কাছে মুখ দেখানো যাবে না। আবার কোথায় গেল লোকটা? (বারান্দায় গিয়ে) এই যে শুনছো, তুমি কি আবার ছাদে গিয়ে বসেছ? দয়া করে নেমে এসো! কথা আছে! কি হলো? আমার কথা কানে যাচ্ছে? কি এমন মধু রয়েছে ছাদে?

এমন সময় ঘরে এসে ঢুকবে একজন নাট্যকর্মী।

নাট্যকর্মী।। বৌদি কেমন আছেন?

বউ।। ভালো না।

নাট্যকর্মী।। সেকি কেন? কি হয়েছে আপনার? নিচে অনেকক্ষণ ধরে ডোর বেল বাজালাম। শব্দ হলো না! ওটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে। তারপর দেখলাম সদর দরজা খোলা। কাজের লোক বলল আপনি নাকি দোতলায়। দাদা কোথায়?

বউ।। যমের বাড়ি।

নাট্যকর্মী।। কি বললেন-

বউ।। এখনো যায়নি। যাবার পথে। তুমি কি বিজ্ঞাপন টা দেখেছো?

নাট্যকর্মী।। কিসের বিজ্ঞাপন?

বউ।। তোমার দাদার নতুন কীর্তি র বিজ্ঞাপন—

নাট্যকর্মী।। ও হ্যাঁ। এবার পুজোতে দাদার একটা উপন্যাস বেরোচ্ছে। প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য । সম্ভবত এটা হবে বাংলা সাহিত্যে সাহসী এবং সৎ বাস্তববাদী উপন্যাস।

বউ।। তারপর শ্রী ঘর—

নাট্যকর্মী।। শ্রী ঘর কেন?

বউ।। তাইতো শুনলাম। অনেকে বলাবলি করছে। আমার কথা তো কিছু শোনে না। তুমি একটু তোমার দাদাকে বুঝিয়ে বলো না। এই বয়সে এসব করবার মানে কি? লেখালেখি করে যথেষ্ট নাম-টাম হয়েছে। আর কি চাই? (পায়ের শব্দ শুনে) উপর থেকে উনি আসছেন! আমি যাই! অনেক কাজ পড়ে আছে! তুমি যদি—-

নাট্যকর্মী।। ঠিক আছে ঠিক আছে। একটা কফি পাঠিয়ে দেবেন- (বউ চলে যাবে) এই যে দাদা, উপরে কি করছিলেন?

লেখক।। ওপর থেকে দেখছিলাম, চারপাশের মানুষগুলোকে লিলিপুটের মত লাগে। তুমি হঠাৎ উদয় হলে কেন?

নাট্য কর্মী।। আপনি ওপর তলার মানুষ। আমাদের কথা মনে রাখবেন কেন। আপনার সঙ্গে মাসখানেক আগে কথা হয়েছিল একটা নাটক লিখে দেবেন। অন্যরকম নাটক। যাকে বলে ঝাকুনি দেয়া নাটক।

লেখক।। তাই নাকি। সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। উপন্যাস লেখার এত তাড়া —–আর পারছি না। ভাবছি এবার রিটায়ার করব।

নাট্যকর্মী।। লেখকরা রিটায়ার করে নাকি?

লেখক।। তাতো জানিনা। আমাকে করতে হবে। মস্তিষ্ক আর কাজ করছে না। অভিজ্ঞতার ঝুলি খালি হয়ে গেছে। ইমাজিনেশন দিয়ে আর চালানো যাবে না।

নাট্যকর্মী।। কিন্তু আমাকে দেওয়া কথা সেটা তো রাখতে হবে। ভুলে যাবেন না আপনি শুরু করেছিলেন নাটক লেখা দিয়ে। আশির দশকে আপনি বাংলা থিয়েটার এ অন্য বৈচিত্র এনে ফেলেছিলেন।

লেখক।। তারপর দেখলাম, আমি আউট। তোমাদের থিয়েটার আমাকে হজম করতে পারল না। নিম্ন মেধা মধ্য মেধারা আমাকে টপকে এগিয়ে গেল। আমি বেশ বুঝতে পারলাম, তোমাদের ওখানে ওরাই সম্রাট। ওরাই মুকুটহীন বাদশা।

নাট্যকর্মী।। সেসব যুগ এখন আর নেই। বাংলা থিয়েটারের মঞ্চে অনেক কিছু বদলে গেছে। নিম্ন মেধা দের অবস্থান আরো ঘোলাটে হয়ে গেছে। যাকগে ওসব কথা। সব জায়গাতেই নিম্ন মেধাদের একটা বাজার থাকে। আমি একটা অন্য বাজারের কথা ভাবছি। আপনি আমাকে বলেছিলেন একটা সাহসী নাটক লিখে দেবেন। যে নাটকটা বাংলা রঙ্গমঞ্চে রীতিমতো কাঁপুনি ধরিয়ে দেবে। সমস্ত রকম ট্যাবু ভেঙে দেবে। নীতিবাদীদের চোখে সর্ষেফুল দেখিয়ে দেবে।

লেখক।। তুমি কি পর্নো চাইছো?

নাট্য কর্মী।। যদিও বিদেশে বহুদিন আগে থেকে থিয়েটারে পর্নো চালু হয়ে গেছে। ওখানকার দর্শক ওসব উপভোগ করে। আমি এতটা চাইছি না। এখানকার পাবলিক নিতে পারবে না। তাছাড়া নীতি বাগিশ দের দলটা দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলতে পারে।

লেখক।। আমি জানতে চাইছি কতটা হলে তোমার কাছে পারমিশেবেল মনে হবে।

নাট্য কর্মী।। বছরের পর বছর ধরে থোরবরি খাড়া চলছে। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। সম্পর্কের গল্পের মধ্যে আপনি ক্রুড রিয়েলিটিকে তুলে আনুন। যেখানে দেখা যাবে ‌ প্রত্যেকটি উচ্চ বিত্ত ফ্যামিলি গুলোর মধ্যে ফ্রি সেক্সের গল্প পাওয়া যাচ্ছে। ব্রথেল নামক প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

লেখক।। রীতিমতো বিপ্লব ঘটাতে চাইছো।?

নাট্যকর্ম।। কাউকে না কাউকে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে হবে। তা না হলে শিল্প সংস্কৃতি পানাপুকুরে হাবুডুবু খাবে যে।

লেখক।। তোমার কি মনে হয় যে, যৌন বিষয় নিয়ে স্বাধীনভাবে নাড়াঘাটা করা টাই প্রাপ্ত মনস্কতার পরিচয়? এই একটা মাত্র বিষয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?

নাট্য কর্মী।। বাকি দিকগুলো নিয়ে এত বেশি কথা বলা হয়েছে, চর্বিত চরবন হয়েছে যে—— এই একমাত্র দিক যেটাকে সব সময় অবহেলা করা হয়েছে।

লেখক।। বলছিলাম যে, রঙ্গমঞ্চের পাটাতনে দাঁড়িয়ে

জামা কাপড় খুলে ফেলবার সাহসী ছেলে মেয়ে——

নাট্যকর্মী।। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেক্স দেখাবার জন্য। তাহলে আপনাকে আর কি বলছি। মুখ ফুটে দর্শকরা বলতে পারছে না, তবে আমরা যারা পাবলিক সার্ভে করি, তারা খুব ভালো করে জানি, নিরামিষ রান্না দিয়ে আর চলছে না। নানা রকম মসলা দিয়ে কষাকষা আমিষ রান্না চাই।

লেখক।। তাহলে লোক শিক্ষার ব্যাপারটা কি হবে?

নাট্যকর্মী।। ঘোড়ার ডিম হবে। লোকশিক্ষা, পাবলিক চেতনা, এসব কথা যারা বলতো, আজকের দিনে তারা ফালতু হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে নাটক যখন জমানো যাচ্ছে না তখন দেখলেন না, উদোম খিস্তি শুরু হয়ে গেল। একাডেমি হাউসফুল। মঞ্চের উপর অভিনেতারা বেশ্যাবাড়ির খিস্তি মারছে। দর্শকের সেকি উল্লাস। নাটক হাউসফুল প্রতিটি শো। লিখুন দাদা লিখুন, রাজ কাপুরের একদিন রাত্রে গল্পটাকে সামনে রেখে একটা সিকুএল বানিয়ে ফেলুন। একদিন রাত্রে গল্পতে দেখানো হয়েছিল, আবাসনের ফ্লাটে ফ্ল্যাটে দুনম্বরী কাজ চলছে। আপনি দেখাবেন ব্রথেল চলছে।

ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটবে এক চিত্র পরিচালকের।

চিত্র পরিচালক।। আমার জন্য একটা পার্ক স্ট্রিট নাইট, কিংবা মেট্রোপলিটন সিটি নাইট লিখে দিতে হবে দাদা।

লেখক।। তুমি আবার কোত্থেকে উদয় হলে তরুণ তুর্কি চিত্র পরিচালক? আজ দেখছি আমার এই ঘরে, চাঁদের হাট বসতে চলেছে!

পরিচালক।। গন্ধে গন্ধে চলে এলাম দাদা। আর দেরি করা যায় না। টালিগঞ্জ ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা জবরদস্ত ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হবে। তার জন্য চাই এমন একটা চিত্রনাট্য যেটা এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারবে না।

লেখক।। সাংঘাতিক ব্যাপার। আমাকে তাহলে এখন বিশুদ্ধ সাহিত্য থেকে সরে আসতে হবে নাটক সিনেমা তে!!

পরিচালক।। বাংলা সিনেমার কিংবা ভারতীয় সিনেমার ক্রোনোলজিটা একবার ঘুরে দেখুন। আফটার ইন্ডিপেন্ডেন্ট। পাবলিকের মধ্যে এক ধরনের রোমান্টিক আবেগ চলছিল। সিনেমা ওয়ালারা সেটাকে উসকে দিয়ে, দেশ গড়ার আদর্শ সামনে রেখে একটার পর একটা সিনেমা বানিয়ে গেল। ৬২ চায়নার সঙ্গে বর্ডার নিয়ে ঝামেলা। দিল্লির পলিটিক্যাল লবি সেই সুযোগে এক ধরনের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ প্রচার করা শুরু করল। কটা ওয়ার পিকচার তৈরি হলো। সেভেন্টিতে কংগ্রেস ভেঙে ছত্রখান। দেশপ্রেম চুলোয় গেল। যে রাজ কাপুর আওয়ার া ৪২০ এসব তৈরি করেছিল, তিনি ববি বানিয়ে ফেললেন। সিনেমা তো চলে এলো সেক্স আর ক্রাইমের আধুনিক মসলা। ততদিনে দেশপ্রেমের পিন্ডি চটকে গেছে। অ্যাংরি ইয়ংম্যান অমিতাভ। পাবলিক তার পিছনে ছুটতে শুরু করল। আফটার ৯০ মার্কেট ইকোনমি। মেট্রোপলিটন সিটি গুলোতে নতুন নতুন আফ্লুএন্ট সোসাইটি রাইস করা শুরু করল। পুরনো সিনেমা হল গুলো ভেঙে একদিকে শপিং মল, অন্যদিকে আইনক্স-এর যুগ এসে গেল। হাতে হাতে মোবাইল। উত্তম-সুচিত্রার রোমান্টিক যুগ কবরে চলে গেছে। সত্যজিৎ মৃণাল ঋত্বিক ফসিল। লালটু লালটু মাকাল ফল নায়কের যুগ শেষ। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে হাতে হাতে সেক্স বম ঘুরছে। শপিংমলে সেক্স-টয় খুল্লাম খুল্লা বিক্রি হয়। লুকিয়ে দেখা পর্নোগ্রাফি এখন আর লুকিয়ে দেখার সিনারিওতে থাকছে না। মধ্যবিত্ত বাড়ির মায়েরা ১৩ বছর হতে না হতে নিজের মেয়েকে সেক্স এডুকেশন-এর পাঠ দিয়ে দিচ্ছে। এগুলো এখন আর ট্যাবু নয় দাদা। আমি আপনার কাছে অনেক আশা নিয়ে ছুটে এসেছি।

লেখক।। বাৎসায়নকে নিয়ে একটা আধুনিক প্যাকেজ বানিয়ে দিতে হবে?

পরিচালক।। ওটা আমি এখনই বলতে পারব না। আপনার সঙ্গে ফাইভ স্টার হোটেলে হোল্ ডে বুকিং নিতে হবে। প্ল্যানিংটা তখনই করব। আজকে আমাকে আপনার ডেট দিতে হবে।

লেখক।। তার মানে নিষিদ্ধ ব্যাপারটা আর থাকছে না। যেমন অশ্লীল, অশ্লীলতা বলে অভিধান থেকে শব্দ দুটো উঠে যাচ্ছে। আগে মেট্রোগলি বা তার আশেপাশে অত্যন্ত গোপনে পোস্ট কার্ড সাইজ পর্নোগ্রাফির স্টিল ছবি বিক্রি হত। ফুটপাতে বিক্রি হত পিনাপ করা এক ধরনের পর্ণমূলক গল্প। সিনেমার সেন্সর বোর্ড এ মার্কা সার্টিফিকেট দিত বিশেষ বিশেষ সিনেমাগুলোকে। বলছিলাম যে, এগুলো উঠে গেলে তোমাদের বিক্রি বাড়বে? 

পরিচালক।। প্ল্যানিং করতে হবে, নতুন রকম। এটা হল প্যাকেজিংয়ের যুগ। ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না। ছবির পাবলিসিটি করার জন্য এখন এমন এক ধরনের থিঙ্ক ট্যাংক হয়েছে, যারা কোটি টাকা নিয়ে এসব প্ল্যানিং করে দেয়।

লেখক।। সেটা তো বুঝলাম।

নাট্যকর্মী।। একটা কথা বলি দাদা। পাবলিক কিছুই খায় না। তাদের দিয়ে খাওয়াতে হয়। পাবলিককে আমরা বলি শুয়োরের বাচ্চার পাল। বানচোদদের না আছে বোধ বুদ্ধি বিবেক। দলের একটা দামড়াকে যেদিকে ছুটতে দেখবে পালে পালে সব কটা সেদিকে ছুটবে। পাবলিসিটি, মিডিয়া ওই সব শুয়োরের বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। ভোটের সময় ক’ শতাংশ মানুষ নিজের বুদ্ধিতে ভোট দেয় বলুন তো? একটা বড় শতাংশ ভোটার নেতা আর মিডিয়ার গ্যাস খেয়ে, ক্যাশ নিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়। 

লেখক।। আমি একটা অন্য কথা বলছিলাম। নাটক সিনেমা এসব পারফর্মি আর্টসগুলোতে একটা কথা খুব প্রচলন আছে। কিউরিসিটি। কৌতুহল। তাস খেলায় যেমন ট্রাম কার্ডটা শো করে দেবার পর খেলাটা ম্যারমেরে হয়ে যায়। একইভাবে কৌতূহলের নিরসন হয়ে গেলে ব্যবসা চৌপট।

চিত্র পরিচালক।। এরপরেও একটা কথা আছে। কিউরিওসিটিকে কিভাবে ব্যবহার করব। এমন অনেক পাবলিক আছে যারা নেশাগ্রস্তের মত একটা ছবি বারবার দেখতে আসে। সেক্স পারভারশন বোঝেন? ওটা এমনি একটা জিনিস পশুরাও লজ্জা পেয়ে যাবে।

লেখক।। জানি। পশুরা সারা বছর সেক্স করে না। ওদের একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। মানুষের কোন সময়, বয়স, বাদ বিচার কোন কিছুই নেই।

পরিচালক।। that’s রাইট। এটা কে ইন ক্যা শ করতে হবে। ঠিকঠাক মেকিং, তারপর মার্কেটিং। পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে না। রাজকাপুর তিনটে জিনিসের পেছনে সারা জীবন ঘুরে মরেছে। সেক্স, সিনেমা, বিগ ব্রেস্ট ফিমেল। কথাটা তার ছেলের।

লেখক।। আজ তোমাদের মত তিনজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, তিনটি গল্পের প্লট মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করছে।

নাট্যকর্মী।। বাহ। চমৎকার। তাহলে লিখতে বসে জান।

লেখক।। সবার প্রথমে এসেছিলেন একজন এডিটর কাম পাবলিশার। একটা বিখ্যাত ম্যাগাজিন নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন।

নাট্যকর্মী।। সম্ভবত দ্বিতীয় জন আমি। ২৫ বছর ধরে থিয়েটার এর সঙ্গে রয়েছি। সেরকম সাফল্য আজও পেলাম না। তবে সবাই আমাকে চেনে টেনে। পুরস্কার পুরস্কার এসেছে অনেক। এখানে ওখানে সেমিনার করতে যাই। নাট্য উৎসবের ফিতাও কাটতে হয়।

সত্যি কথা বলতে কি, I am not satisfied। থিয়েটারটা এভাবে আর চলবে না। মার্কেট ইকোনোমিতে ঢুকে পড়তে হবে।

পরিচালক।। আমি টিভি সিরিয়াল দিয়ে শুরু করেছিলাম। ভুল বললাম সিরিয়াল নয় টেলিফিল্ম। সিরিয়াল আমার চোখে র বালি। ওখানে নিউ কামারদের জায়গা। নিম্ন মেধার কাজ চলে। নিজের মত করে গোটা তিন সিনেমা বানিয়েছি। ওগুলো না হয়েছে আর্ট না হয়েছে কমার্শিয়াল। ফাইন্যান্স এর টাকা ফেরত আসে নি। এবার সেভ গেম খেলতে চাই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন। এবার একটা সেন্সেশনাল স্টোরি চাই।

লেখক।। আমি এবার অন্যভাবে খেলতে চাই। আমাদের এইসব বিশুদ্ধ সাহিত্যের বাজার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে গেছে। একটা ঝাকুনি দরকার। ভিসুভিয়াসের মতো অগ্নুৎপাত চাই। ভূমিকম্প টম্প না হলে জাতিটার ঘুম ভাঙবে না। চারিদিকে কেমন যেন ভেজা কাঁথা হয়ে আছে। কোথাও কোন আগুন জ্বলছে না।

পরিচালক।। তাহলে আমরা কবে বসছি দাদা?

লেখক।। খুব শিগগির জানিয়ে দেবো। এবার তোমাদের বিদায় নিতে হবে।

নাট্যকর্মী।। আমি কিন্তু রোজ ফোন করবো দাদা।

লেখক।। ঠিক আছে। (মোবাইল রিং, চাপা স্বরে কথা বলতে ব্যস্ত হবে)

ওরা দুজন চলে যাবে। লেখক কথা বলছে ফোনে।মিউজিক ট্রিটমেন্ট চলবে। একজন পুলিশ অফিসার কে সঙ্গে নিয়ে লেখক এর বউ আবার আসবে।

বউ।। আসুন আসুন। এই ঘরেই তিনি থাকেন। মানে ওনার লেখা পড়ার ঘর।

(লেখক বারান্দায় চলে গেছে)

এই শুনছো, কোথায় তুমি, ইনি তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ন।

লেখক।। (বাইরে থেকে) বসতে বল আসছি।

বউ।। সত্যি কথা বলুন তো ভাই, আপনাদের দেখলে বুকটা কেঁপে ওঠে। তাছাড়া আজকাল ওর নামে অনেকে অনেক কথা বলছে। কিছু হয়েছে?

অফিসার ঘরে ঢুকে চারিদিক দেখছিল।

অফিসার।। কিছু বললেন?

বউ।। ওর নামে কোন রিপোর্ট ডায়েরি হয়েছি বুঝি?

অফিসার।। না মানে- (লেখক ঢুকবে) নমস্কার স্যার। সম্ভবত আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না-

লেখক।। আপনি– মানে ঠিক-

অফিসার।। বেলগাছিয়া তে যখন ছিলাম, স্কুলের উঁচু ক্লাস থেকে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত আপনার কাছে বাংলা সাহিত্যটা টিউশন নিয়েছি। আমার স্কুল ছিল কুমার আশুতোষ বিদ্যামন্দির—

লেখক।। হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি তো সেই সময় সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলে। রবিবার এর কাগজের তোমার গল্প বের হতো। সেই তুমি এখন-

অফিসার।। যাক চিনতে পেরেছেন।

লেখক।।(বউকে) তুমি ওকে কখনো দেখনি। মানে আমাদের বিয়ের পর আমরা তো বেলগাছিয়া থেকে চলে আসি। খুব ভালো ছেলে। হায়ার সেকেন্ডারি তে দারুন রেজাল্ট করেছিল। ওর জন্য কিছু খাবার আনবে না?

বউ।। সেকি কেন আনবো না! আপনি ভাই বসুন। এতক্ষণে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আমি এক্ষুনি আসছি।

অফিসার।। না না আপনি ব্যস্ত হবেন না। তাছাড়া অন ডিউটিতে—-

লেখক।। ঘুষ খাওয়া যায়। মাস্টার মশাইএর বাড়িতে এসে চা মিষ্টি খাওয়া যায় না– (হাসি)

লেখক এই সময় তার বউকে আড়ালে ডেকে নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে কিছু কথা বলে। বউ সব কথা শুনে আরো বেশি রেগে যায়। এবং সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে যাবে।

অফিসার।। আপনার ছাত্র হয়ে আমার মধ্যেও এক ধরনের পুরনো নীতিবোধ বেঁচে আছে। তবে আপনার কাছে এসে –

লেখক।। ওসব বিসর্জন না দিলে বেশিদিন চাকরি করতে পারবে না। তারপর বল, কেমন আছো। বিয়ে করেছ কিনা। পুলিশের চাকরি ইনজয় করছো?

অফিসার।। বিয়ে করি নি। বিয়ে করার মতন মানসিক সুস্থিতি নেই। আমরা যে কেউ ভালো নেই এটা আপনি আগে বলতেন। তখন ঠিক বুঝতাম না। এখন বুঝি।

কিন্তু স্যার, এতদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, অথচ একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেছে–

লেখক।। with ইউনিফর্ম ‌ তুমি যখন এই বাড়িতে এসেছো তখনই আন্দাজ করতে পেরেছি। আমার নামে কেউ নালিশ করেছে থানায়?

অফিসার।। আপনার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয় না অনেকদিন। কিন্তু আপনার সব খবরা-খবর আমি রাখি। আপনার সাহিত্য আমি নিয়মিত পাঠ করি। কি করে যে বলি।, আপনার নামে একটা ডাইরি হয়েছে। আপনি নাকি একটি মেয়েকে তুলে এনেছেন। এবং একটি অজানা জায়গায় আটকে রেখেছেন।

লেখকের বউ জল মিষ্টির প্লেট নিয়ে আসছিল। তার হাত থেকে ঝনঝন করে পড়ে যাবে।

আলোর পরিবর্তন ঘটবে। দুদিন পরের ঘটনা। লেখকের স্ত্রী টেলিফোনে ছেলের সঙ্গে কথা বলছে।

বউ।। বলছি তো না, আমি এখানে আর এক দিনও থাকতে পারবো না। কেনই বা থাকবো? মান সম্মান কিছু আছে? সেদিন পাড়ার লোকেদের সামনে দিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে তোমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। প্রত্যেকটা খবরের কাগজে তোর বাবার ছবি

খবর বেরিয়ে গেল। এরপর পাড়ায় মুখ দেখানো যাবে? আমি তোর কাছে চলে যাব! কি বললি, অসুবিধা আছে। বৌমার মতামত নিতে হবে। আমি গিয়ে তোর বউকে বলবো আমাকে একটু জায়গা দিতে। তোদের ঘরের সব কাজ আমি করে দেবো।

বলছি তো না, আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না। প্রতিবেশীদের কৌতহলী দৃষ্টি আমি কি দিয়ে আড়াল করব বলতে পারিস। বেশ ঠিক আছে। আমি আবার দাদার কাছে চলে যাব। তোরা আমার কোন খবর নেবার চেষ্টা করবি না। (ঝপান করে ফোন কেটে দেবে) নিজের পেটের ছেলে আমার দুঃখ বুঝতে চাইছে না। ও ভাবছে আমি বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু দাদাও যদি আমার কথা বুঝতে না চায়? তখন কি করব? কোথায় যাব?

পুলিশ অফিসার আসবে।

অফিসার।। কোথাও যাবেন না ম্যাডাম। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না।

বউ।। তুমি তো সর্বনাশটা ঘটালে। পুলিশের উর্দি গায়ে চাপালে কি দয়া মায়া মুছে ফেলতে হয়।

অফিসার।। আমার কোন উপায় ছিল না- আমাকে আমার ডিউটি পালন করতে হচ্ছিল।

বউ।। চুপ করো। এইভাবে তুমি গুরুদক্ষিণা দিলে! তুমি তো আমাকেও অপদস্ত করলে।

অফিসার।। আপনাকে আমি বোঝাতে পারবো না ম্যাডাম, দুঃখ বলুন, অনুতাপ বলুন আমিও পাচ্ছি। এই চাকরিটা না করলে হয়তো, মাস্টারমশাইয়ের বিরুদ্ধে এইরকম অবাঞ্ছিত কাজ করতে হতো না। তবু ও আমি বলছি, মাস্টার মশায়ের কোন ক্ষতি হবে না। তিনি জামিন পেয়ে আজকেই ফিরে আসবেন। 

বউ।। তাই বলে কি ওই লোকটার গা থেকে সব কলঙ্কমুছে যাবে? সবাই তো বলবে জেল খাটা আসামি। দুদিন ধরে ছেলের সঙ্গে কথা বলছি। সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে কোন রকম সম্পর্ক রাখবে না। আমার মেয়েরও ওই একই কথা। সে তো আর এক ধাপ এগিয়ে বলল, আমি বাবাকে চিরকালের জন্য বর্জন করলাম।

অফিসার।। আমি বিরম্বনার মধ্যে পড়ে গেলাম ম্যাডাম। কোনদিন আমি ভাবিনি যে, আমি যাকে দ্বিতীয় পিতৃত্বে বরণ করেছিলাম, সেই তাকে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যেতে হবে।

বউ।। তাহলেই বুঝে দেখো আমার অবস্থার কথা। এতগুলো বছর যাকে দেবতার মত সম্মান করেছি—

অফিসার।। একটা কথা বলব? আপনি নিজে বিশ্বাস করেন যে, মাস্টারমশাই কোনরকম খারাপ কাজ করতে পারে?

বউ।। আমরা হলাম সেকেলে মানুষ। সাদামাটা মন।

কাউকে যখন ভালোবাসি ভরসা করি তখন সবটা দিয়ে বিশ্বাস করি। পুলিশের চোখ দিয়ে বিচার করে দেখি না। সেই জন্যই হয়তো খুব সহজে সামান্য আঘাতে আমরা ভেঙেচু রে যাই।

অফিসার।। মাস্টার মশাই এর কেসটা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। সেভাবে তদন্ত করে দেখার আগেই মাস্টারমশাই এর বিরুদ্ধে অপ্রিয় কাজটা করতে হলো। তবে কথা দিচ্ছি, এর রহস্য আমি বার করবোই।

লেখককে নিয়ে এডিটর ঘরে ঢুকবে।

এডিটর।। আপনি কোন চিন্তা করবেন না দাদা, আমরা বুঝতে পেরেছি, জানতেও পেরেছি, আপনাকে ফাঁসানো হয়েছে। আপনার কিচ্ছু হবে না। কেউ কোন কিছু প্রমাণ করতে পারবে না। আপনাকে যেমন আমি জামিন করে আনলাম, ভবিষ্যতে যদি কেস হয়, দেশের সবচেয়ে বড় দামি অ্যাডভোকেট আমি লাগাবো।

অফিসার।। মাস্টার মশাইকে যে ফাঁসানো হয়েছে, সেটা পরিষ্কার। আমার ওপর যেভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, তখনই বুঝেছিলাম-

এডিটর।। বুঝেছিলেন তো, ডিলে করতে পারতেন না? সঙ্গে সঙ্গে ধরে নিয়ে যেতে হল- কেন?

অফিসার।। আমি ক্ষমা চাইছি মাস্টার মশাই। আমার সামনে দুটো অপশন ছিল। সুন্দরবনে বদলি হয়ে যাওয়া, কিংবা আপনাকে অ্যারেস্ট করা—-

এডিটর।। আপনি সাক্ষী প্রমান জোগাড় করতে পারবেন? আর সেই মেয়েটাকেই বা কোথায় পাবেন?

অফিসার।। ওসব আমার ওপর ছেড়ে দিন। মাস্টারমশাইকে কলঙ্ক মুক্ত করবার দায় এখন আমার। আপনি আমাকে শুধু বলবেন, আসল ঘটনাটা কি?

এডিটর।। এখনো জিজ্ঞেস করছেন আসল ঘটনাটা কি? এর মধ্যে কোন ঘটনাই নেই——আমি তো শুনলাম, সনাতনবাদী একটা সংগঠন দাদাকে টাইট দিতে চাইছে। যেহেতু দাদা ওদের একটা মিটিংয়ে যেতে অস্বীকার করেছিল।

অফিসার।। এভাবে কাউকে মিথ্যা ভাবে হ্যারাসমেন্ট করা যায় না। মানহা নির মামলায় পড়ে যেতে হয়।

এডিটার।। আপনি পলিটিক্স বোঝেন? ওদের দরকার ছিল দাদার নামে মিডিয়াতে কলঙ্ক ছড়ানো। সেটা হয়ে গেছে। দাদা যদি এখন মানহানি র মামলা করে ওরা কোর্টের বাইরে আপস করে নেবে। আর যদি তখন দাদা—–

লেখক।। এসব নিয়ে আমি কিছুই ভাবছি না।

এডিটর।। আমিও সেটাই বলছি। এসব নিয়ে আপনাকে কিছুই ভাবতে হবে না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে অনেক বড় বড় লেখক দের এইরকম ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়। যেমন ধরুন বুদ্ধদেব বসু, সমরেশ বসু, এদেরও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল। অভিযোগ ওদের সাহিত্যে অশ্লীলতা।তারপর মানুষ একদিন সব ভুলে যায়। আপনি চান খাওয়া করে রেস্ট নিন দাদা। তারপর নিজের কাজ শুরু করুন। আমার তো মনে হয় আমাদের রাই ভাল গ্রুপ ওরাও এর মধ্যে জড়িত।

অফিসার।। ওরা জড়িত হবে কেন?

এডিটর।। দাদা এবার ওদের পুজো সংখ্যার বাইরে যাতে আর অন্য কোন পুজোসংখ্যায় লিখতে না পারে। এই যে যেটা হলো, এরপর কি কেউ ঠান্ডা মাথায় কলম ধরতে পারবে? তবে আমি বলব, দাদা, আপনাকে কলম ধরতেই হবে। এটা চ্যালেঞ্জ।

লেখক।। কথা যখন দিয়েছি, লেখা আপনি পাবেন।

এডিটর।। জানি দাদা জানি। আপনাকে তো অনেকদিন থেকে দেখছি । আপনার কথার খেলাপ হয় না। ওসব নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। আপনি বিশ্রাম করুন। আমি এখন উঠবো। অনেক কাজ পড়ে আছে। একটা কথা বলি, আপনার মিসেস এর মন মেজাজ ঠিক নেই। ব্যাপারটা সামলে নিতে একটু সময় লাগবে। তাই বলছিলাম যে—

লেখক।। আমি কারো সঙ্গে ঝগড়া করি না এডিটার মশাই। সবার মনের অবস্থা বুঝতে পারি।

এডিটর।। সেটাও আমি জানি। তবুও বললাম। কিছু মনে করবেন না। আমি রোজ খবরাখবর নেব। চলি।

এডিটর চলে গেলেন। লেখকের বউ অনেক আগেই একতলায় নেমে গিয়েছিল। এবার সে উঠে আসবে।

অফিসার।। আপনার কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই লজ্জিত!

লেখক।। লজ্জার কোনো কারণ নেই তোমার। তুমি যা করেছো- বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে।

অফিসার।। যদি কিছু না মনে করে ন, আসল ঘটনাটা কিছু বলবেন? যে যাই বলুক, ধোয়া থাকলে আগুন থাকবে। এটাই বাস্তব। মেয়েটি কে? কি কারনে আপনি—

বউ।। হ্যাঁ, আমিও জানতে চাই। মেয়েটা কে? কি সম্পর্ক তোমার সঙ্গে? সত্যি সত্যি মেয়েটাকে তুমি-

অফিসার।। আপনার উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা বিশ্বাস রেখেই বলছি, আপনি কখনো নোংরা কাজ করতে পারেন না এটা আজও বিশ্বাস করি। তাই বলছিলাম যে—-

বউ।। আমিও এতদিন বিশ্বাস করেছি, আমার স্বামীর সৎ, আদর্শবান, কোন খারাপ কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব না। আমার বাড়ির পরিবারের সকলের বিরুদ্ধা চারণ করে আমি ওর সঙ্গে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। ও তখন টিউশনি করে সংসার চালাত। যাদবপুরের কলোনী অঞ্চলে সস্তায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। অনেক লড়াই করেছে ও। আমাকেও করতে হয়েছে। তারপর একদিন দেশ জোড়া পরিচিতি হয়েছে। সরকারি বেসরকারি কত রকম পুরস্কার পেয়েছে। গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। কোনদিন আমাকে ভাবতে হয় নি, ওকে ছেড়ে আমাকে থাকতে হবে। আর এখন তো আমার বিষ খেতে ইচ্ছে করছে। মুখ বুজে না থেকে, ওকে বলতে হবে, এক মাসের বেশি হয়ে গেল আমাদের কাউকে ছাদে উঠতে দিত না কেন? দিনে রাতে ছাদে যাওয়ার দরজা টা বন্ধ করে রেখেছিল কেন? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে ছাদের ঘরে? আমি এই কথাটা এখন পর্যন্ত কাউকে বলিনি।

অফিসার।। ম্যাডাম কি বলছে স্যার, আপনি কিছু বলুন? সত্যি কি ছাদে র ঘরে রহস্য লুকিয়ে আছে?

বউ।। বিগত এক মাসের বেশি সময় ধরে তোমার স্যার বাড়িতেই রয়েছেন। চান খাওয়া করার জন্য নিচে নামে না। উপরে বাথরুম রয়েছে। ওর খাবারটা আমাকে এখানে এনে দিতে হয়। আগে তো এসব দেখিনি। মনের মধ্য সন্দেহ জাগলে ও, সরিয়ে দিয়েছি। কারণ ওকে আমি পাগলের মত বিশ্বাস করি। আজ ওকে বলতেই হবে, কাকে ও ছাদের ঘরে এনে রেখে ছিল?

লেখক।। একটা গর্ভবতী মেয়েকে।

অফিসার।। গর্ভবতী মেয়ে-!

লেখক।। হ্যাঁ। আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তার কথাটা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই বলতেও চাইনা।

অফিসার।। কিন্তু কিন্তু ছাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে ছিলেন কেন?

লেখক।। ওকে যারা খুন করতে চায়, তাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।

অফিসার।। কারা মেয়েটাকে খুন করতে চায়?

লেখক।। যারা মেয়েটাকে দিনের পর দিন ধরে ধর্ষণ করেছে-

অফিসার।। তারা কারা? কি পরিচয় তাদের? আপনি চেনেন তাদের?

লেখক।। সেটাইতো গল্প। এই গল্পটাকেই তো তোমাদের সনাতন সমাজ, আধুনিক সমাজ বলছে অশ্লীল গল্প। যাকে বলে পর্ণ জাতীয় গল্প।

অফিসার।। আপনি কি ওই মেয়েটাকে নিয়ে এবারের কোন পুজোসংখ্যা গল্প লিখেছেন?

লেখক।। আমি পর্ণ লিখব, তুমি বিশ্বাস করো?

অফিসার।। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস এর কোন মূল্য নেই আদালতের কাছে।

লেখক।। তাহলে আদালত পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। (মোবাইল রিং) হ্যাঁ বলছি, আপনি আসবেন? হ্যাঁ বাড়িতে আছি। তাহলে চলে আসুন।

অফিসার।। হেঁয়ালি না করে, আমাকে সবটা খুলে বলুন। আমি জানতে চাই—

লেখক।। খূলেই তো বলতে চাইছি। সেই জন্যই তো একটা প্লট ভেবেছি। একটা খসড়া তৈরি করছি। যেখান থেকে গোটা তিন ছোট গল্প, দু তিনটে নাটক, একটা সিনেমা করা যেতে পারে। কারণ-এটা জীবন্ত গল্প।  বানিয়ে বানিয়ে আমি গল্প লিখি না। গল্পের শিকড় থাকে দেশ, সমাজের মাটিতে। সেখান থেকে গল্পের নির্যাস উঠে আসে। 

বউ।। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এমন কি ঘটনা ঘটলো যে মেয়েটাকে এইভাবে ছাদের ঘরে লুকিয়ে রাখতে হবে?

অফিসার।। ঠিকই তো। আপনি খুলে না বললে আমরা কি করে বিশ্বাস করব? প্লিজ সবটা বলুন! আমি কথা দিচ্ছি, মেয়েটার কোন ক্ষতি হবে না।

এডিটার ফিরে আসবে।

এডিটর।। গাড়িতে উঠে সবে চাকাটা ঘুরতে শুরু করেছে, দিল্লি থেকে মিঃ খোরানা আমাকে ফোন করলেন। আপনি তো জানেন দেশের নামকরা অ্যাডভোকেট দের মধ্যে মি খোরানা একজন। আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। তিনি বললেন without remonaration তিনি আপনার পক্ষে দাঁড়াবেন। খবরটা তাই দিতে এলাম।

লেখক।। ধন্যবাদ। তবে এবার আমি ভাবছি, আদালতে কেসটা উঠলে, আমি নিজেই ডিফেন্ড কাউন্সিলের রোল প্লে করব।

এডিটর।। সে কি!!! আপনি তো চমকে দিচ্ছেন।

লেখক।। লেখকের কাজ চমকে দেওয়া নয়। সামাজিক সত্যকে প্রকাশ করা। পেশাদার উকিল বাবুরা সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। সমাজের আসল ছবিটা চাপা পড়ে যায়।

এডিটর।। আপনি পারবেন? এদেশের আইনে কত রকম জটিলতা রয়েছে। এমন সব ফাঁক ফোকর রয়েছে যেখান দিয়ে প্রতিদিন হাতি গলে যাচ্ছে।

লেখক।। ওসব আপনারা বুঝবেন। আদালতে যে প্রশ্নটা উঠেছে, আমি চরিত্রহীন। আমি একটি মেয়েকে অপহরণ করেছি। আমি অশ্লীল গল্প লিখি। আমার সাহিত্য অশ্লীল। এইসব অভিযোগের বিরুদ্ধে আমার তো কিছু বলার আছে। আমাকে প্রমাণ করতে হবে,-

(চিত্র পরিচালক আসবে)

পরিচালক।। এই দেখুন দাদা, একটা সান্ধ্য বুলেটিন

কি লিখেছে। মৌলবাদী একটি সংগঠন আপনাকে বহুবার নাকি ওদের হয়ে কিছু লেখবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তারপর যখন ওরা বুঝতে পেরেছে যে, আপনাকে কায়দা করা যাবে না। তখন আপনার নামে অশ্লীল গল্প লেখক হিসেবে আপনি সমাজে দূষণ ছড়াচ্ছেন, এইটা প্রমাণ করতে চাইছে। 

(নাট্যকর্মীও আসবে)

নাট্যকর্মী।। এই দেশের মানুষ তো মূলত অশিক্ষিত। মিডিয়া আর রাজনৈতিক দালালদের কথায় বাঁদরের মতো নাচে। সুতরাং আপনাকে ওরা শিকার করে ফেলবে। হয়তো আপনার জেল হতে পারে।

এডিটর।। সেই জন্যই তো বলছি, আপনি আমাদের উপর ভরসা রাখুন। আমরা হাইকোর্টের বড় বড় উকিল দেব।

অফিসার।। এরা ঠিক কথাই তো বলছে স্যার। আপনি রাজি হয়ে যান।

লেখক।। আমিও জানি আপনারা ঠিক কথাই বলছেন। একটা মৌলবাদী সংগঠন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস বদলে দিতে চাইছে। আগামী দিনে হয়তো ওরা এই কথাও বলবে যে, আগ্রার তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি, লালকেল্লা, অজন্তা ইলোরা, এবং আরো অনেক কিছু অশ্লীল। হিন্দু সনাতন ধর্মের পরিপন্থী। তাহলে বলতে হবে, কোণারকের সূর্য মন্দির, খাজুরাহ ো থেকে শুরু করে অসংখ্য হিন্দু মন্দির ওই একই অজুহাতে অর্থাৎ যৌন অশ্লীলতার অজুহাতে ভেঙে ফেলতে হবে।। সেন্সর করতে হবে হিন্দুদের শিবলিঙ্গ কে। ওটা তো চূড়ান্ত অশ্লীল যৌন ভঙ্গিমা। বাতিল করতে হবে, উলঙ্গ নারী কালী মূর্তিকে। বাতিল করতে হবে শ্রীকৃষ্ণের লীলা কাহিনী। গীতগোবিন্দ। সব রকম বৈষ্ণব কাব্য এমনকি মহাভারত বইটাকেও। ওই বইতে অবাধ যৌন জীবনের কথা বলা আছে। রবীন্দ্রনাথকে ওরা বাতিল করা শুরু করে দিয়েছে।

চৈতন্যদেব দুবার বিবাহ করেছিলেন, সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক, বেদ বিরোধী ছিলেন, বর্ণ প্রথার বিরোধী ছিলেন, অতএব তিনিও বাতিল। আমরা কি ভুলে গেছি শিল্পী ফিদা হোসেন কে ওরা কিভাবে হে নস্তা করেছিল? সুতরাং ভবিষ্যতে ও কি আমরা চুপ করে থাকবো? আমাদের তো এখনই বলতে হবে! আপনারা আমার কাছে যৌন আবেদনমূলক গল্প উপন্যাস চেয়েছেন। আপনাদের এই চাওয়ার মধ্যে ভঙ্গি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আমার কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে যৌনতাকে অশ্লীলতার কুৎসা দিয়ে বাতিল করা যাবে না। তাহলে তো বলতে হবে, আমরা আমাদের বাবা-মায়ের অশ্লীলতার ফসল? যৌনতা জীবনের একটা বড় অংশ! একান্ত অপরিহার্য অংশ। কিন্তু একমাত্র অংশ নয়। বেদ বলছে, অনন ময়ং হিসৌম্য মন। অন্নই ঈশ্বর। ত্রিভুবন। পেটে যদি খাবার না থাকে, বেদ বাইবেল কোরান মিথ্যে হয়ে যায়। আপনারা কি জানেন যে, সত্যজিতের পথের পাঁচালী কে একইভাবে অশ্লীল আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। দেশের দারিদ্র বিক্রি করছে ন সত্যজিৎ রায় এই অভিযোগ তোলা হয়েছিল। সত্যজিৎ বলেছিলেন, দারিদ্র, বেকারি, দুর্নীতি, এগুলো রাষ্ট্রের তৈরি। কোন লেখক শিল্পী এসব তৈরি করে না। দারিদ্র অনাহার ব্যভিচারের মতো অশ্লীল আর কিছু হয় না। এই অশ্লীলতা রাষ্ট্র বাঁচিয়ে রাখে। আমার বাড়ির ছাদের ঘরে যাকে আমি এনে রেখে ছিলাম সেই মেয়েটির নির্যাতনের কথাই আমি আদালতের দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলবো।

নাট্যকর্মী।। তার আগে আমাদেরকে বলুন দাদা।

পরিচালক।। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের সামনে কৌতুহল বাড়িয়ে আর কোন লাভ নেই। ছাদের রহস্যের ব্যাপারটা আমাদেরকে খুলে বলুন দাদা।

লেখক এই সময় তার টেবিলের চাবি খুঁজতে থাকবে। কিন্তু পাবেনা। এখানে ওখানে চাবিটার সন্ধান করবে। তারপর বউকে বলবে-

লেখক।। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। জেলে যাবার আগে চাবিটা তো আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। কোথায় রেখেছো বলো? কি হলো চাবিটা দাও।- দেরি করো না, চাবিটা দাও– মেয়েটা কেমন আছে আমাকে দেখতে যেতে হবে! কি আশ্চর্য, আমাকে যখন এই অফিসার ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তো আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম, টেবিলের ড্রয়ারে চাবিটা রয়েছে, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি ওদের লক্ষ্য কর। খেতে দিও। মেয়েটা খুব অসুস্থ। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

বউ।। তাড়িয়ে দিয়েছি।

লেখক।। কি বললে!

বউ।। জঞ্জাল বিদায় করে ডেটল ফিনাইল দিয়ে ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়েছি।

লেখক।। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল!

বউ ।। এখনো হয়নি। তাই আপদ বিদেয় করতে পেরেছি।

লেখক।। তাড়িয়ে দেবার সময় একবারও তোমার বিবেক জেগে উঠলো না, একটা বোবা কালা অসহায় মেয়েটাকে গর্ভবতী অবস্থায় তাড়িয়ে দেওয়ার পর কোথায় যাবে ও!

এডিটর।। এসব আপনি কি বলছেন দাদা? 

নাট্য কর্মী।। ড্রামাটিক সিচুয়েশন। মেয়েটাকে কোথায় পেয়েছিলে ন দাদা?

পরিচালক।। মেয়েটার পরিচয় আপনার জানা ছিল না?

লেখক।। আমাদের রাজ্যে হাজার খানিকের বেশি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। ঐরকম একটা স্কুলের মধ্যে লুমপেনরা মেয়েটাকে আটকে রেখে যৌন লালসা চরিতার্থ করছিল। প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। একদিন সন্ধের পর রিক্সা করে ওই অঞ্চল দিয়ে আসতে গিয়ে মেয়েটার আর্তনাদ  শুনতে পাই। আমাকে দেখে গুন্ডারা পালায়। মেয়েটাকে আমি ওখান থেকে উদ্ধার করে আনি। প্রথমে ভেবেছিলাম থানায় মেয়েটাকে নিয়ে যাব। পরে মনে হলো ওখানে গেলে মেয়েটার আরো বেশি সর্বনাশ হবে। তখন আমার বাড়িতে নিয়ে আসি। ছাদের ঘরে রেখে দিয়েছিলাম।

এডিটর।। তাহলে ম্যাডাম কিছুই জানতেন না?

লেখক।। আমার স্ত্রী ওদের বাপের বাড়ির এক আত্মীয়ের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম পরে সব কথা খুলে বলবো। মেয়েটাকে আমার এক পরিচিত ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলাম। সেই ডাক্তার বলেছিল মেয়েটা গর্ভবতী। 

বউ।। তুমি সব কথা আমার কাছে লুকিয়ে ছিলে—

লেখক।। বাধ্য হয়েছিলাম লুকোতে। কারণ আমি জানতাম, তুমি চেঁচামেচি করতে। পাড়া প্রতিবেশীকে ডেকে এনে একটা গন্ডগোল পাকাতে।

এডিটর।। কিন্তু দাদা আমি বলছিলাম-

লেখক।। আমার সেই ডাক্তার বন্ধুকে আমার বলা ছিল, আমি মাসখানেকের জন্য মেয়েটার দায়িত্ব নিতে পারি। তারপর মেয়েটাকে কোন উদ্ধার আশ্রম বা অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে। এরমধ্যে আমাকে যে জেলে যেতে হবে আমি তো ভাবতে পারিনি। তবে যাওয়ার আগে ওকে বলে গিয়েছিলাম । আমি ফিরে এসে মেয়েটার ব্যবস্থা করব।

নাট্যকর্মী।। চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স।

লেখক।। একজন মেয়ে হয়ে, আরেকটি অবলা, নিঃস্ব হায়, বোবা কালা মেয়ের সর্বনাশ করতে পারলে তুমি। ওতো মা হতে যাচ্ছিল। বাড়িতে কোন গর্ভবতী বিড়াল আশ্রয় নিলে, তাকেও তো গৃহস্থরা তাড়িয়ে দেয় না! এ তুমি কি করলে? এর মধ্যে মানবিকতা কোথায়? মেয়েটাকে আবার যদি গুন্ডারা তুলে নিয়ে গিয়ে ওইরকম একটা স্কুলে আটকে রাখে। দিনের পর দিন ধর্ষণ করে সেটা কি অশ্লীলতা হবে না? আর এই ঘটনা নিয়ে আমরা যদি নাটক লিখি, গল্প লিখি, সিনেমা তৈরি করি তাকে বলা হবে অশ্লীল সাহিত্য শিল্প। ঠিক তখনই আমাকে বা আমাদের জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার করে বলা হবে, আমরা অশ্লীল শিল্পের কারবারি। সামাজিক দূষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের কলম কালি তুলি । বল, তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর দাও-

রচনাকাল: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

(বিদ্র: নাটকের অভিনয়ের জন্য নাট্যকারের অনুমোদন প্রয়োজন। তা না হলে সেই অভিনয় বেআইনি ঘোষণা হবে।)

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -