দুলাল চক্রবর্ত্তী
সত্যজিৎ রায়-এর গল্প অবলম্বনে কলকাতা কাব্যকলা মনন ও দেবান্তরা আর্টস নিমার্ণ করেছে নাটক “ভূতো”। নাটকের যাবতীয় কল্পনা ও নির্দেশনা সুমিত কুমার রায়। গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন অন্তরা চ্যাটার্জি। এই উপস্থাপনার প্রযোজক দেবাশীষ চ্যাটার্জি। নাট্য উপযোগী গল্পের বিচিত্র চলন এবং রহস্যময়তা বিচার করে মঞ্চ ভাবনা ভেবেছেন দেবব্রত মাইতি। নাটকের আলো ছায়ার মায়ায় আলোক চিন্তা করেছেন দীপংকর দে এবং প্রক্ষেপণ করেছেন সমর পারুই। ঘটনার ভেতরের মোচড় বুঝে চমৎকার আবহ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন পার্থ প্রতিম রায় এবং আবহ প্রক্ষেপণ করেছেন স্নেহাশীষ দে। এই নাটকের বিচিত্রিতা বুঝেই রূপসজ্জার গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামলেছেন সুরজিৎ পাল। এছাড়া পোশাক পরিকল্পনা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন নবনীতা মুখার্জি দাস। পাপেট ও সিনোগ্রাফিকার উন্নত চিন্তায় গ্রাফিক্স রজত দে এবং সৌভিক ঘোষ ছিলেন। নাটকের আকর্ষণীয়
পোস্টার একেঁছেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। আর পাঁচটা নাটকের থেকে ভূতো একেবারেই আলাদা। যেহেতু সত্যজিৎ রায়ের গল্প, সেই হেতু গল্পের গতিপ্রকৃতি অনেকটা চলচ্চিত্রের মতন। কাহিনির বিস্তার যত্রতত্র যাতায়াতে, বারবার জিগজাগ ভাবে আত্মকথন ও কথা বলা পুতুলের সাথে শিল্পীর নিজস্ব উপস্থাপনায় এই গল্পের নিপাট চলাকে মঞ্চে অনাবিল মুক্তি দিয়েছেন দেবব্রত মাইতি। কারণ দৃশ্যান্তর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তার সাজেশন ছিল নিপুণ। তাই নাটকের মজবুত ভূমি পাওয়ায় এবং অত্যন্ত দ্রুত ও ছন্দ ময় গতিতে মঞ্চ প্রেক্ষিত পরিবর্তনের পেশাদারীত্বে, একটি সচল প্রকৃয়ায় এ নাটক তরতর করে গন্তব্যে এগিয়ে গিয়েছে। গল্পের প্রতিপাদ্য ছিল, কেউ কাউকে হাতে ধরে কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে আবিস্কারে নিয়োজিত করতে পারে না। মনের ভেতরের আকুতি আগ্রহের চেষ্টায় সাফল্য আসে। শেখা, রপ্ত করা, অনুশীলনে লেগে থাকা এবং তাকে সুষ্ঠ প্রায়োগিক পথে নিয়ে যেতে পারাই যে দক্ষতা। নাটকে, নবীন মুন্সীর কথা বলা পুতুলের মুখে কথা পৌঁছে দেবার মরীয়া চেষ্টা, আত্মার আত্মীয় করে পুতুলের মন দেহ ভঙ্গিমাকে চয়ন করার অধ্যাবসায়, সাথে তার নিজের ভেতর চুরমার করে নিজেকে লুকিয়ে ভুতোর কন্ঠে দেওয়া এবং ক্রমে চূড়ান্তে তা দর্শকদের মোহিত করতে পারার লড়াইটাই এই নাটকের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ কেন্দ্র। পরে ভূতো যখন স্বীকার অস্বীকারের দোটানায় দুমড়ে মুচড়ে পড়েছিল, তখনকার অবস্থা ক্লাইম্যাক্স পর্যায়ে দুরন্ত।

অর্থাৎ একটা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নাটকের জন্য থেকে ক্রমে দর্শকদের জীবনের হয়ে ওঠাকে কীভাবে যেন ছুঁয়ে যায়। দুই শিল্পীর খ্যাতি প্রতিপত্তির ওঠা নামার দ্বান্দ্বিকতায় গল্পের মোচড় এসে কি হয় কি হয় দশায় দর্শকদের কিছু অভাবনীয় বিস্ময়কর মুহুর্ত দিয়েছে। সবই অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে ঘটেছে সারা নাটকে, কোথাও কোন জার্ক বা ছন্দপতন নেই। অক্রুর চৌধুরী চরিত্রে যেমন অভিজিৎ ঘোষ দুরন্ত শক্তির আধার। ঠিক তেমে নবীন মুন্সীর ভুমিকায় পলাশ অধিকারী চরমভাবে নাটকের জ্ঞানে অভিজ্ঞ। তাই সারা নাটকে নবীন মুন্সী চরিত্রের অজস্র দোটানা মগ্নতা, দর্শকাসনে ঘাড় ঘোরাতে দেয় না। পুতুল নির্মাতা আদিনাথ পাল চরিত্রে গৌতম চক্রবর্তী চলনসই ছিলেন। কিন্তু অনেকটা হাইটের ও দ্রুততম পদচারণা সম্ভব এমন সঞ্চালিকা ও সাংবাদিক হিসাবে বিংশতি বসু এই নাটকের অন্য অনুচ্ছেদে যাবার উচ্ছ্বাস বটেনই।
কিন্তু এই নাটকের অদ্ভুত মঞ্চ ভাঙ্গাগড়া আর রহস্যময় একটি বিশাল অনুশীলিত ও চর্চিত সমন্বিত শক্তি হিসাবে সোহিন সুর, সুরঞ্জন মার্জিত, সপ্তাংশু বক্সী, সৌমী ঘোষ, তুহেলী বক্সী, তমসি দোয়ারি, আকাশ শর্মা ও বিশ্বরূপ বেহারা, এ-ই শিল্পী ক’জন বোধহয় নাটকের হওয়া না হওয়ার বিধাতা হয়ে থেকেছেন। তাই ভুতো অতুলনীয় এবং একটি সার্থক নাটক। গতি জাড্য মুভমেন্ট থেকে স্থিতি নির্ভর একান্তের একাত্মতা দৈত পর্বের নাট্য প্রকাশে, সত্যজিৎ রায়ের গল্প রচনা বিজ্ঞানের স্বকীয়তাকে খর্ব করেনি। এমন বিষয়ে ইতিপূর্বে কোন নাটক হয়েছে বলে শুনিনি। এই সমস্ত সাফল্যের পেছনেই এক বিরাট নাট্য অভিজ্ঞতা নিয়ে সুমিত কুমার রায়ের কল্পনা অঙ্গন ছিল বিচিত্র খেলায় মাতার ভিন্ন উন্মাদনা। প্রসঙ্গত নাট্যরূপের মজবুত বুননে অন্তরা চ্যাটার্জীর মুন্সীয়ানা স্বীকার করতে হবেই। সব মিলিয়ে কাব্য কলা মনন ও দেবান্তরা আর্টস টিমের শক্তি, সামর্থ্য ও ইচ্ছাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। গত ২ রা মে গিরিশ মঞ্চের পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে সত্যজিৎ রায়ের ১০৪ তম জন্মদিনে, Bureau of Indian Standards এর সাথে যৌথ উদ্যোগে এই নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছিল।