Crisis: নাট্যকর্মীর চোখে ‘বর্তমান সময়ের সংকট’ 

- Advertisement -

দেবাশিস রায় 

আলোচ্য শব্দবন্ধে ‘বর্তমান’(Present) আর ‘সংকট’(Crisis) এই শব্দ দুটির মধ্যে  সংকট অর্থাৎ বিপদ, অসুবিধা, জটিল অবস্থা, কোন ঠাঁসা ইত্যাদি শব্দ নিহিত আছে এবং ‘বর্তমান’ বললে আজ বা ২০২৩  বোঝাতে পারি। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে বর্তমানে দাঁড়িয়ে নাট্যকর্মীরা সংকটে রয়েছে।

কিসের সংকট?

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তিন দিক থেকেই সংকট। অধিকাংশ নাট্যকর্মীদের আর্থিক নিরাপত্তা বলতে প্রায় কিছুই নেই। যাদের আর্থিক নিরাপত্তা আছে, তারা পার্ট টাইম থিয়েটার করেন, সেটাকে অনেকে বলে থাকেন শৌখিন নাট্যচর্চা। এদিকে একদন নব্য যুবক ওক বুক স্বপ্ন নিয়ে নাটকে আসে, কিন্তু আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা তাদেরকে এই ক্ষেত্র থেকে ছিটকে সরিয়ে নিয়ে যায়। নাটক সম্পর্কে মানুষের মধ্যে এখনও নেগেটিভ মানসিকতা কাজ করে। তার একটা কারণ যেহেতু এই শিল্প কর্মীদের কোনও অর্থ দেয় না, সেই জন্য বাপ-মা এই কাজের সাথে যুক্ত থাকাকে সময়ের অপচয় মনে করে। এরপর রাজনৈতিক কারণ হল, কর্মীরা রাজনীতি মানে ধরে নেন বোধ হয় ক্ষমতায় থাকা কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হয়ে থাকা। হ্যাঁ সেখানে থাকলে কিছু আয়ের সম্ভাবনা থাকেই। তাহলে নিশ্চই এবার বুঝতে পারছেন এই শিল্পচর্চায় সংকটটা কোথায়?  

সংকট (Crisis) কেন?

সংকট স্বভাবে, সংকট শিক্ষায়, সংকট সংস্কৃতিতে, সংকট যাপনে, চর্যায়। সমাজে আমাদের প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বর্তমান সংস্কৃতি কেড়ে খাবার সংস্কৃতি। বর্তমান সংস্কৃতি তৈলমর্দনের সংস্কৃতি। অতএব একজন নাট্যকর্মীর মূলবোধ, নিষ্ঠা, সততা তাকে আদর্শ শিল্পীতে উত্তীর্ণ করে। আর সেটা না করলে সংকট আমরা নিজেরাই আহবান করছি।

সংকটের কারণ কি? নীতি? (Ethics)

সংকটের কারণ এর আগে উত্থাপীত হয়েছে। যদিও কারণ হিসেবে যেমন নিজের দিকে আঙ্গুল ওঠে সাথে সাথে সেই ব্যক্তি বা কর্মীর বেড়ে ওঠার দিকটাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। অধিকাংশ সময়ের আমরা অনুমান নির্ভর হয়ে যে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হই। অর্থাৎ কোনো কাজে একজন নাট্যাকর্মীর প্রাথমিক শর্ত তার দর্শন ও অবজা্রভেশন। আমরা বিবেচনা করার আগে সন্দেহ করি। আমরা নেগেটিভ মানসিকতায় যাপন করি, অথচ পজিটিভের জন্য মরণপণ লড়াই দিয়ে দি।

বর্তমান পরিস্থিতির জটিল অবস্থা কে বা কারা করল?

যদি এককথায় বলতে হয় তাহলে সোজাসুজি বলতে হয়। নাট্যকর্মীদের জীবিকা নিয়ে কোনো সদর্থক পরিকল্পনা বা ভাবনা রাষ্ট্রের নেই। যা আছে তা হল পাইয়ে দিয়ে নিজের করা রাখার পরিকল্পিত শাসন। যারা এইসব করে তারা সমাজের গণ্যিমান্যি, তাদের দেখে সমাজের সাধারন মানুষের মনে পুলক জাগে। তারা সাদা চোখে সেই রঙ্গিন মানুষগুলিকে উচ্চতায় নিয়ে যায়। অথচ যার এসব কিচ্ছু নেই, কিন্তু দক্ষতা আছে, তাকে কিন্তু সমাজের সেই সকল মানুষ ঘুরেও দেখে না। সমাজের আর পাঁচটা ক্ষেত্রের জীবিকা যেইভাবে নির্ধারিত সেইভাবে এই ক্ষত্রের জীবিকা নিয়ে কোনো ভাবনা রাষ্ট্র বা সরকার ভাবে না।

তাহলে এখন এই সংকট কি প্রমাণিত?

অবশ্যই প্রমাণিত, বাংলার আপামর নাট্যকর্মী যারা ক্ষমতার অলিন্দে আনাগোনা করে না, তারা তাদের মধ্যে দিয়ে কাজ করে চলেছেন। সেখানে সংকটের মধ্যেই এইসব লরাই হাসিমুখে করে যেতে হয়। তাই এই প্রশ্নগুলো চলেই আসে। এই সংকট যখন অনুভূত হয়েছে  তখন তার অস্তিত্বও আছে ধরে নিয়ে যদি এগোতে থাকি তাহলে আমাকে একটা পালটা প্রশ্ন করতে হয়। কি বলুন তো?

‘মানুষ তোমরা কেমন আছো?’ একজন মানুষকে যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তাহলে সেই  মানুষ কি উত্তর দেবে সেটা পর্যবেক্ষন করা খুব জরুরী। কিন্তু সেই কাজটা এখানে এতো স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়।

ধরা যাক  এখানে আমাকে প্রশ্ন করা হল ‘আমি কেমন আছি’? আমি সাথে সাথে উত্তর দেব ‘চলছে’। চলছে অর্থাৎ আটকাচ্ছে না। আমি উত্তর দিয়ে নিজের মনে মনে ভাবলাম সত্যি কি আটকাচ্ছে না!

আমাকে কাল মেয়ের স্কুলের ফিস দিতে হবে, আমাকে কাল বাজার করতে হবে, আমাকে কাল মেডিসিন কিনতে হবে, আমাকে ওমুক করতে তমুক করতে হবে, অর্থাৎ কাল আমার বহুটাকার প্রয়োজন। অথচ আমি আজও টাকা পাইনি। গতকাল পাবার কথা ছিল পাইনি। 

তাহলে তাদের চলছে না। অথচ কি বললাম? ‘চলছে’। অর্থাৎ আমি চাইলাম কি চাইলাম না, মুখে একটা মুখোশ পড়ে নিলাম। আমি আমার এই অবস্থাটা কাউকে বলতে চাইলাম না। কেন চাই্লাম না?

কারণ একসময় যখন চেয়েছিলাম তখন কোন বন্ধু বা আত্মীয় আমাকে সাহায্য করেনি, বরং আমাকে করুণা করে চারটে জ্ঞানের কথা উপদেশ দিয়ে বিদেয় করেছিলেন। তারপর থেকে ধীরে ধীরে আমি  নিজেকে সমস্ত বিষয় থেকে আলাদা করে নিয়েছি, এবং তাতে মনে করেছি আমি তো ভালোই আছি।

অথচ একদিন আমার ঘরে যখন প্রত্যক্ষ সংকট এসেছে, আমি তা মোকাবিলা করতে  পারিনি বা পারি না। পারা যায়ও না। সকাল থেকে রাতে  ঘুমোতে যাবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত বাজার আমাকে গ্রাস করে রেখেছে যে। আমি সেখান থেকে কোনভাবেই মুক্তি পেতে পারি না।

সকালে উঠে যে পেস্ট আমি ব্যাবহার করবো সেটায় ব্র্যান্ড। যে ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজবো সেটায় ব্রান্ড। টয়লেটে যাব সেখানেও ব্র্যান্ড। কোন কমোড সাদা বেশী। আমি খাবার খাবো সেটাও কোন দোকান থেকে আসবে। আমি যে সাবান ব্যাবহার করবো, আমি দাঁড়ি  কাটবো তার শেভিং ক্রীম, রেজর সবেতেই ব্র্যান্ড। 

এই ব্রান্ডের নামে এজেন্টরা উপভোক্তার কাছে কৌশলে ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে। আমরা তাকে নিয়ে  প্রতিযোগিতায় মেতে উঠি। পরিবারের আপন জনেদের সাথে বিরোধ বাঁধে। সামর্থের বাইরে গিয়ে আমি বাজারের হাতছানিতে আহ্লাদিত হয়ে ছুটে যাই সেই সকল দ্রব্য ক্রয়ের দিকে।

পকেটে রেস্ত না থাকাটা যেন লজ্জার, যেন অসম্মানের, যেন হেরে যাওয়া। এসব কিছু কাটিয়ে আমি কিন্তু অসমর্থ হয়েও কিন্তু কিনছি কারণ ততক্ষণে বাজারে লোন কোম্পানী বন্ধুর মতো আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তোমার টাকা নেই তো কি! লোন কোম্পানি আছে তো, সে দেবে টাকা, যেন সে আমাকে দয়া করবে এরকম ভাব। চড়া সুদের চরাম চরাম  চড়েও আমার সম্বিত ফেরে না। কারণ আমাকে ‘ভালো’ থাকতে হবে। 

ভালো থাকা (well being) মানে কি? 

‘ভালো’ থাকার শেষ কোথায়? যে ব্যাক্তি বিশ লাখে ফ্ল্যাট কেনে  আর যে ব্যাক্তি পাঁচ কোটীতে ফ্ল্যাট কেনে তাদের দুজনের ভালো থাকা কি এক? আবার যে ব্যাক্তি মাত্র ৫০ হাজার টাকা জোগার করে একটা ঘর বানায় তার ভালো থাকা আর যে ব্যাক্তি সরকারী সাহায্যে ঘর বানায় তাদের ভালো থাকা কি এক? অথচ এই চার ব্যাক্তিই কিন্তু সকাল হলে একিই বাজারে গিয়ে জিনিষ কেনেন। কেউ পচা টম্যাটো টিপে দেখে নিতে গেলে বিক্রেতা বাঁধা দিচ্ছে আর সেই পচা টমেটো  পাশ থেকে অন্য একজন না বেঁছেই নিয়ে নিচ্ছে। বিক্রেতা ‘লো আর্নার’ আর ‘হাই আর্নারে’র প্রভেদ বুঝে নিয়ে সেই ব্যাক্তির চারিত্রিক ত্রুটিটি সবার সাথে বিমিময় করছে।

বাজারে তা প্রচারও হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই ব্যাক্তির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে তিনি অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ।

দর না করে জিনিস না কেনার মানুষটা পেশায় কে?

দালাল (Brokar)। এভাবেই তিলে তিলে মানুষের চরিত্রের এক অদ্ভুত পালটে যাওয়া চলতেই থাকছে। লক্ষ্য করে দেখবেন বাজারে কোন জিনিসের মোড়ক বেশীদিন থাকছে না। প্রতিনিয়ত, পালটে পালটে যাচ্ছে। দোকানী মাল মেপে দেবার ঝামেলা পোয়াতে চাইছে না।

জনজীবন ক্রমে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। কে শিক্ষিত কে অর্ধশিক্ষিত বা কে অশিক্ষিত সেটা গুলিয়ে গেছে। বলা ভাল গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ সমগ্র পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়। আমি যা চাইছি তাই জানতে পারছি।

এইসব অলিখিত চর্চার উদ্দেশ্য কি?

আসলে মানুষের মধ্যে চাহিদা নির্মানই ধনীক দেশগুলির মূল লক্ষ্য, যার ফলে কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে ‘ভোগবাদী’ সমাজে পরিণত করা যায়। সীমাহীন  ভোগের মাত্রা ছাড়িয়ে ‘আধুনিকতার’ বয়ানে মানুষকে ঋণে জর্জরিত করে রাখাই বহুজাতিক সংস্থার কাজ। কারণ এই পথেই তাদের মুনাফা বৃদ্ধি হয় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের কৃষক ও শ্রমিক উৎপাদন থেকে মুখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে, আর প্রতিযোগিতার বাজারে  টিকে থাকার জন্য ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। এর ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারা পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের দৈনন্দিন চাহিদার চেহারা।

তাহলে চারিত্রিক চ্যুতিতে নেপথ্যের কারণ কি? 

সাধারণ বা দেশজ খাবার না খেয়ে ফাস্ট ফুডের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। ভারতীয় খাদ্যের বিকাশ না ঘটিয়ে অন্য দেশের খাদ্যের প্রতি নির্ভরতা বাড়িয়ে তোলা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নামান্তর। এরফলে মানুষের লৌকিক সংস্কৃতির অবলুপ্তি ঘটে চলেছে।

উন্নততর সমাজ ব্যবস্থার লক্ষ্যে পৌছানোর অন্যতম হাতিয়ার যে ‘সৃষ্টি’ তাকেই ধ্বংস করা হচ্ছে এক অদ্ভুত ঢঙে। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৃষ্টিতে নেমে আসছে এক অন্ধকারময় অবস্থান। নৈতিকতার প্রশ্নে মানুষের উল্লম্ফন চরিত্রে তার সৃষ্টিশীলতা বণিকের তত্বাবধানে লালিত হচ্ছে। আধুনিকতা মানে কি এই যে আমি আমার নিজস্ব সংস্কৃতিকে বর্জন করে অপরের সংস্কৃতি নির্ভর হব! আধুনিকতা মানে  পুরনোকে বাদ দিয়ে আরো উন্নত মানসিকতা গড়ে তোলা, অবশ্যই রুচিশীল থেকে যা উৎপাদন নির্ভর।

তাহলে কি উৎপাদন হলেই সমস্যা মিটে যাবে?

তা যাবে হয়তো। কিন্তু এটা ধাক্কা সামলানো যাবে। শ্রমজীবী মানুষ চাহিদাভিত্তিক। চাহিদাসর্বস্ব নয়। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের দিক খুলে দিতে পারে।  কিন্তু সেদিকে নিয়ে গেলে বিশ্ব বাজারে মুনাফা শুয়ে পড়বে। এইসবের প্রভাব খুব বেশী পড়ছে মানুষের মননশীল পরিবেশের ওপর।

যে পরিবেশ মনুষ্য সমাজের বিকাশ ঘটাতে পারে। এইখানেই চক্রান্তকারীরা ওত পেতে বসে থাকে। এই সাংস্কৃতিক  বিকাশকে ধ্বংস করতে না পারলে সেই মুনাফালোভী বেনেয়ারা সমগ্র পৃথিবীর ওপর দাদাগিরি ফলাতে পারবে না।

তাহলে কি দাদাগিরি চলতেই থাকবে?   

যে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে, যে দেশে বহু মানুষ এখনও দুবেলা ভালো করে খেতে পায় না, যে দেশের শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নগামী, শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হওয়া সত্বেও বিদ্যালয়ে না গিয়ে শিশুশ্রম বহাল আছে, যে দেশে নারীর সম্মান প্রতিদিন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, যে দেশ শিশুর জন্য বিনামূল্যে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপস্যুল দিতে পারে না, যে দেশ দেশের মানুষের জন্য বিনামূল্যে আয়োডিন লবণ খাওয়াতে পারে না, যে দেশ তাঁর নাগরিকের জন্য এক গ্লাস পানীয় জল দিতে পারে না।

সেই দেশের বুকে কটা ওভারব্রীজ, আর কতটা রাস্তা হল, কত কালো টাকা সাদা হল এইসব বিষয়গুলো নিতান্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের দিনান্তের জাবড় কাটা। সমগ্র নাগরিকের স্বাচ্ছন্দের কথা আজ আলোচ্য বিষয় নয়।

সংকট দূরীকরণে কাদের ভূমিকা বেশী থাকা দরকার

বেকারের বেকারত্ব ঘোচানোর সমস্ত প্রক্রিয়া আজ অনালোচিত। এসব নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন করে না। কারণ ওরা আমাদের সঙ্ঘবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়েছে, কখনো ধর্মে, কখনও বর্ণে, কখনও শিক্ষায়, কখনও অর্থ উপার্জনে, কখনও সংস্কৃতিতে, কৃষ্টিতে, শিল্পে, সাহিত্যে, নাটকে।

তাহকে নাট্যকর্মীর সংকটের সমাধান নেই?     

এই আলোচনা এবার বাংলা নাটকের সংকট দিকে মুখ ফেরাবে। বাংলা নাটকের সংকট নিয়ে আলোচনা করতে হলে সবার আগে বর্তমানের নাটক চর্চার দিকগুলি আলোকপাত করা প্রয়োজন। বর্তমানে  বাংলা নাটকের ঝোঁক মূলত ইতিহাসাশ্রয়ী চরিত্র, মানুষের ব্যাক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েন, কাল্পনিক উদ্ভট কিছু নাটক, রিমেক, পাশ্চাত্যের অনুকরণে সামাজিক অবক্ষয়ের চরিত্রায়নের এক কিম্ভূত মিশেল বা পরীক্ষানিরীক্ষার নামে এক  অস্বাভাবিক ও অলৌকিক ভাবনার নাটক।

এই সকল নাট্যচর্চায় সমসময়ের  প্রতিফলন দেখা যায় খুব কম। বা দেখা গেলেও তা খুব সচেতনভাবে নিজের গা বাঁচিয়ে প্রযোজনা নির্মানের প্রবণতা চোখে পড়ে। অর্থাৎ সকল প্রযোজনারই একটা ঝোঁক দেখা যায় তাদের নিজ নিজ প্রযোজনার আকর্ষন নির্মানের ক্ষেত্রে।

নাটককে আকর্ষনীয় করতে নাট্যের নৈতিকতা (Theatre Ethics) 

দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে, বা দর্শক ঝাপিয়ে পড়ে নাটক দেখতে আসতে পারে এই কথা মাথায় রেখে যখন নাট্য নির্মানের অপচেষ্টা চলে তখন সেই প্রযোজনার মানও নিম্নমেধার দিকে পরিচালিত হয়। কারণ একটা বড় সংখ্যার দর্শকের বিনোদনের প্রতি ঝোঁককে কাজে লাগালে তা বাজারে বেশী সমাদৃত হতে পারে।

অর্থাৎ  বাজারের সমাদর এখানে মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ পূর্ব-আলোচনার নিরিখে বাজার সর্বস্বতাই বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্দেশ করে। অতএব বাজারমুখী এইসব নাট্যচর্চা খুব বেশীদিন স্থায়ী হয় না।

তার ফলাফল আমরা দেখতেও পাই লক্ষাধিক টাকা খরচে নির্মিত জনপ্রিয় নাটকগুলি ৩০ টা অভিনয়ে ছুঁতে হিমসিম খেয়ে যায়। কারণ বাজারের একটা চরিত্র আছে, সে একই জিনিস বেশীদিন পছন্দ করে না।

আমরা দেখতে  পাই একই দ্রব্যের মোড়ক নানাভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, মোড়ক দেখে ক্রেতা জিনিষ কেনে। এবার আসে সেই দ্রব্যের বিজ্ঞাপন। যেমন খাবার বা দ্রব্যের  উতকর্ষতা  প্রতিষ্ঠা  করবার জন্য তাদের বিজ্ঞাপণ ক্রেতাকে আকর্ষিত করতে বদ্ধপরিকর ও প্রয়োজনে মিথ্যাচারে দুষ্ট থাকে।

আর তেমনই এই নাটকের ক্ষেত্রে  এই ক্রেতাই কিন্তু আজ দর্শকরূপে বিরাজমান। দর্শক ভগবান। দর্শকই শেষ কথা   বলে। এইসব তেলমাখানো প্রলেপ আমাদের খুব স্বাভাবিক অভ্যেস।

দর্শক কি চায়?

দর্শক কিভাবে বাঁচে, দর্শকের অভ্যেস এই নিয়ে আমাদের নাট্যকর্মীদের কোন সার্ভে আছে? নাট্যকর্মীরা কি সমাজে বেড়িয়ে মানুষের সাথে মিশে মানুষের মনের কথা বুঝতে চেয়েছেন কখনো? মানুষের দিনযাপনের সাথী হয়ে   থেকেছেন কখনও? নাট্যশিল্পে দর্শক নির্মানের জন্য কোন ভূমিকা আছে আদৌ বা তা নিয়ে আন্দোলন? আমাদের দেশে আর্ট বা সিনেমা অ্যাপ্রিসিয়েসন কোর্স আছে। 

নাটকের ক্ষেত্রে? নেই। কেন নেই? সে প্রশ্ন নিয়ে দাবী উঠেছে কখনও? অতএব আমরা ধরেই নিচ্ছি আমাদের নাটকের দর্শকের চোখ বা মেধা এতোটাই উচ্চমানের যে আমরা যারা নাট্যচর্চা করি তাঁরা, তাঁদের কাছে কেউ না।

ওই ব্যবসায়ে লক্ষ্মী বন্দনার মত। দর্শক নিলে তবেই ধন্য? এই ধন্য হয়ে যাওয়ার পশ্চাতে কিন্তু ঐ নৈতিকতাকে পাশ কাটিয়ে যাবার একটা ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে। আমরা মানুষকে বা দর্শককে কেন যেন নিজের মতো করে নিরপেক্ষ করে রাখতে ভালোবাসি। এবং সাথে নিজেকেও।

যদিও নিরপেক্ষতার ধারণা স্বচ্ছ নয়। যারা মনে করেন আমি বিজ্ঞানের কাছে ঋণী, বিজ্ঞান আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে তারাই যদি নিজেদের ব্যাক্তিগত চর্চায় অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাস বহন করেন তাহলে তা দ্বিচারিতার নামান্তর। যে হৃদয়ে লালনের ঠাই দিয়েছি সেখানে শিব- মহম্মদের বা যীশুবন্দনায় বিশ্বাস কিভাবে সম্ভব? ভেবে দেখেছি কখনো?

লালনকে ভালো লাগা মানে আমি আধুনিকতাকে স্বীকার করছি, সুস্থ সামাজিক ব্যাবস্থাকে মেনে নিচ্ছি আবার পরমুহুর্তে ছুটে যাচ্ছি আমার এতদিনের সংস্কারের গভীর অন্ধকারে। সেখান থেকে কে বের করে আনবে আমাকে?  কার আছে সে দায়? নাট্যকর্মির আছে। শিল্পীর আছে। আছে স্রষ্টার।

কিন্তু সে  দায় পালন করতে চাইলে বাজারের কেউ যদি আমাকে না মেনে নেয়! বাজারের কেউ যদি আমাকে তিরস্কার করে! বাজারে যদি আমি গৌন হয়ে যাই! এই আত্ম সংকট উপেক্ষা করি কি করে? অতএব এসো বাবারা তোমরা আমাদের  নাটক দেখিয়া আমাদের ধন্য কর। প্রশংসা কর। বাহবা দাও। করতালিতে আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে দাও। টিকিট কাউন্টারে হাউসফুল ঝুলিয়ে দাও।

পারলে টিকিট কাউন্টারে নিয়মিত ধূপ ধুনো দিয়ে, একটা গনেশ এনে পূজো কর। দেখ সেল কেমন বাড়ে। এমনও শোনা যায় নতুন নাটক মঞ্চে নামার আগে তার সফল কামনায় কালীঘাটে পূজা দেওয়া হয়।

নাট্যচর্চার ভবিষ্যৎ

অতএব নাট্যচর্চার অভ্যন্তরে যে সংস্কার লুকিয়ে আছে সেই একই অভ্যাস বা বিশ্বাস সাধারণ বা দর্শকের মাঝেও নিহিত আছে। এরই মাঝে অতি নগণ্য একটা সংখ্যা আছে যেখানে এসব বিশ্বাস লালিত হয় না। তারা তাই থিয়েটারের অমুক দাদা তমুক জ্যাঠা হয়ে উঠতে পারেন না। আর যেহেতু পারেন না সেইহেতু এই শ্রেণী  তথাকথিত দর্শককূলের সমাদর থেকে বঞ্চিত থাকেন। যদিও সেই  নগণ্যেরা সে প্রত্যাশা করেন না বরং তাদের চিন্তনের উন্মেষ ঘটাতে লাগাতার কাজ করে যেতে থাকেন। সেটা কিন্তু চোখে দেখা যায় না।

অর্থাৎ আমরা এ  ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারি যে নাট্যচর্চা প্রকান্তরে ব্যবসামুখী। এতক্ষণ আমি যা বললাম তা শহর বা কলকাতা কেন্দ্রিক অভ্যাসের কথা। আর এই নাট্যাভাসের উপর মুখিয়ে থাকে জেলার কিছু নাট্যদল।

যার ফলে এই অভ্যাসেরই অনুসারী হয়ে ওঠে তাদের থিয়েটার। জেলার দল কলকাতায় আসবে নাটক দেখাবে এই যে তাঁদের উন্নীত হবার বাসনা সেই আকাঙ্খাই কখন কীভাবে সেই বাজারের মধ্যে ঢুকে পরে তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না। এখানে একটি কথা বলা ভীষন প্রয়োজন কলকাতার নাট্যচর্চা কিন্তু জেলার উপর সম্পুর্ণ নির্ভরশীল গত চার-পাঁচ দশক ধরেই। আগেও ছিল এখনও আছে।

 যদিও দুটোই আলাদা সময়ের থাকা। তাই সমস্যাও আলাদা। আগে জেলার ছেলে-মেয়েরা যেমন করত তার সাথে তাল মিলিয়ে শহরের ছেলেমেয়েরাও করত। একটা বড় অংশের সরকারী চাকুরীজীবী এই তথাকথিত ‘গ্রুপ থিয়েটার’ আন্দোলনের সাথে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায়, আবেগে-অনাবেগে, বাধ্যে-অবাধ্যে জড়িয়ে ছিলেন। সবটাই ছিল নির্দেশক মুখী যা ‘গ্রুপ থিয়েটার’ কনসেপ্টের সাথে বিরোধিতা করে। দল নাকি দলের অধিকর্তা  এই লড়াই শুরু হয়ে যায়। দলগুলো ভাঙ্গতে থাকে। আর একটা একটা করে দল খুলে বসে যাওয়া,   শুরু হয়ে যায়।

যা আজকের শাখাপ্রশাখা বাড়তে বাড়তে একটা বিরাট সংখ্যায় এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সেই দলের নির্দেশক দেহ রাখলে দলটিও শুয়ে পড়তে থাকে, কারন সেই দলের নাট্যনির্মান নির্ভর করতো সেই নির্দেশকের ওপর। সেই দলটা ভেঙ্গে গিয়ে তিন বা চার টুকরো হয়ে গেল। ঠিক যেমনভাবে আমাদের যৌথ পরিবার গুলো ভেঙ্গে যেতে থাকল।

প্রত্যাশা ও উপসংহার

আমরা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে একে একে নিজের মতো করে একেকটা দ্বীপে বাস করতে শুরু করলাম। অতএব সেই দ্বীপকে ঝলমল করে না সাজালে সে দ্বীপের রাজা সমাদৃত হবে কীভাবে? আমরা আজ বিচ্ছিন্ন। একেক দ্বীপের রাজা। কার কত এলেম সেটা নির্মানের প্রশ্নে নাটকের গুণাবলী বিশ্লেষণ করা মূখ্য উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য টিকে থাকা। আর টিকে থাকতে প্রয়োজন সাহায্য।

এখানেই এগিয়ে আসে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তাকে পুষ্ট করতে অনুদানের ডালি এনে সামনে দাঁড়ায়। কারণ রাষ্ট্র জানে এঁরা প্রতিবাদী হতে পারে। জনতার স্বরকে উচ্চকণ্ঠে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ফলে ভোট প্রক্রিয়ায় তার প্রভাব পড়তে পারে। তাই মুখ বন্ধ করে দাও। তাহলে কী দাঁড়ালো একদিকে নাট্যবিপ্লবীরা দর্শককে জনতা জনার্দন ভাবে। আর একদিকে সেই কৌশলী নাট্যকর্মিকে পকেটে পোড়ে রাষ্ট্র।

এভাবেই সেই তথাকথিত ‘গ্রুপ থিয়েটার’ বেশ সুখে, নিশ্চন্তে, এক সৌখিন বলয়ে নিজেকে আবৃত করে রাখেন আর নাট্যজগতের পীঠস্থানে চমক-গমক-ঠমক দিয়ে জড়ত্বপ্রাপ্ত দর্শককূলের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন।

এ হেন নাট্যচর্চা কখনও একটা সমাজের উন্নতিকল্পে কখনোই এগিয়ে আসতে পারে না। যে নাটক সময়ের কথা বলে না, সময়ের সংকটকে তুলে আনতে পারে না, তাদের নাটক ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে না। পঠিত হবে না।

এখানে ব্রেশটের উক্তি প্রাসঙ্গিক- ‘শিল্পকে যদি রাজনীতিবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়, তবে সে শিল্প শাসকশ্রেণীর হাতিয়ারে পরিণত হয়’। অর্থাৎ সমসময়ের উৎপীড়ন, অরাজকতা, সন্ত্রাস যদি আমাদের নাট্য চর্চায় স্থান পায় তাতে করে রাষ্ট্রের মুখোশ খুলে যাবে। কথায় কথায় একটা উচ্চারণে আমরা খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করি, ‘আমরা নাটকে রাজনীতির কথা বলি না’। আমরা কি তাহলে ইতিহাসকে অস্বীকার করতে পারি, বাংলা নাটকের  ইতিহাসের বিবর্তনে মাইলস্টোন ‘নীলদর্পন’ ও ‘নবান্ন’ তাহলে কিসের নাটক ছিল? 

উৎপল বলছেন- ‘যে থিয়েটার আমাদের কাঁদায় না ভাবায়। মোহাচ্ছন্ন করে না চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে সাহায্য করে। তন্দ্রাতুর করে না সজাগ করে। আর থিয়েটারকে চিন্তার রাজ্য করে তোলার পশ্চাতে যে যুক্তি থাকে তা রাজনৈতিক চেতনাকে ঘিরে নয়। অ্যারিস্টটল আবেগভিত্তিক নাটককে মান্যতা দিয়েও আরেক ধরনের নাটককেও মান্যতা দেন, যা দর্শককে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোকে উন্নীত করবে। যেমন কাথার্সিস হল আবেগভিত্তিক নাটকের উদ্দেশ্য যা ট্র্যাজেডি নির্মান করে, আনাগনোরিসিস হল বিজ্ঞান ভিত্তিক নাটকের উদ্দেশ্য যা এপিকের ধারণা তৈরি করে।’

ব্রেশট বিশ্বাস করতেন বিশুদ্ধ শিল্পীরা আদতে ফ্যাসিবাদের সহায়তা করেন বা আবেগ তাড়িত থিয়েটার নাৎতসীদের দাস। এ তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ ছাড়া  কিছুই বুঝতে চাইতেন না তিনি। তিনি শুধু অবক্ষয়ী বর্তমানকে দেখতেন না বর্তমান তার কাছে ভবিষ্যতের অর্ধেক সূচনা।

আবারো উৎপল দত্তের(Utpal Dutta) কথায়- ‘আমাদের দেশের দর্শক কখনও থিয়েটারে স্টার সিস্টেমের শিকার হবে না। অন্তত থিয়েটারে হবেন না। চলচ্চিত্রে হয়েছেন। কারণ থিয়েটারে সেভাবে বৃহৎ পুঁজিপতিদের আবির্ভাব ঘটেনি চলচ্চিত্রের মতো। কারণ বৃহৎ পুঁজিপতিরা স্টার সিস্টেম করে তাদের মুনাফার জন্য। এখানে স্টার সিস্টেম কোথা থেকে আসবে। এই স্টার সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যই তো গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।’  মহান নাট্যকর্মীর এই কথাগুলো আজ চোখের কোলে জল এনে দেয়। তিনি আজ থাকলে দেখতে পেতেন পূঁজির আগ্রাসন আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বে কিভাবে আমাদের এই নাট্য চর্চায় ঘুণপোকারদল বাসা বেঁধেছে। কোটী কোটী টাকা খরচ করে সরকার নাট্যচর্চার দেখভাল করছে, আর তার সাথে সাথে আমাদের মননে গেঁথে দিয়েছে সেই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার মন্ত্র। এ থেকে মুক্তি পেতে সংগঠিত হওয়াই একমাত্র পথ। আমাদের চেতনায় শাণিত হাত ঐক্যবদ্ধ করতে পারলেই আমাদের জয় ওদের পরাজয়। অর্থগৃধ্নের দল একদিন পরাহত হবেই। 

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -