সুব্রত রায়
আজ নির্ঘাত একটা ধুন্ধুমার কান্ড বাঁধবে। লোক ধরে এক হাজার, কিন্তু সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাল রিচেলিউ-এর হলঘর অনেকক্ষণ তাকে ছাড়িয়ে ফেঁপে উঠছে তো উটছেই। দেওয়ালের গা ঘেঁষে এমনকি মঞ্চের দুধারে দাঁড়িয়ে মানুষ অপেক্ষমান, অধীর। ভীড় আর ঠেলাঠেলির মধ্যে ঢুকছে অনেকেই, যারা মেহমানদারীর তোয়াক্কা করে না মোটেই। যেমন আঁতোয়া, মারিয়েন আর মিশেল এর মতো কচিকাঁচার। জনতার স্রোতের তোড়ে কোনরকমে ছেঁড়া প্যান্টটুল, স্কার্ট সামলাতে সামলাতে ওরা এক্কেবারে ভেতরে হাজির। দেরি না করে তিনজনেই লেপ্টে গেছে দেওয়ালে। বেশ বোঝা যাচ্ছে শহরের গন্যিমান্য প্রায় সবাই উপস্থিত, তবে সবারই চোখমুখ বেশ থমথমে, জড়োসড়ো হয়ে থাকে তিন পুঁচকে দম নিতে নিতেই মিশেল একবারটেরিয়ে দেখে নেয় যা শুনেছিল, সব সত্যি কিনা।
হ্যাঁ ওই তো! সটান খাড়া রয়েছে প্রজেক্টর। ওখান থেকেই আলো ঠিকরাবে আর আছড়ে পড়বে পিছনে টাঙানো সাদা পর্দায়। ব্যাস! তারপর অদ্ভুত খড়খড়ে আওয়াজ, সাদা কালো আলোছায়া খেলে বেড়ালো অন্ধকার জুড়ে। চৌকানো ফ্রেমের ভিতরে অপার পৃথিবী। ছায়াছবি নড়াচড়া করতেই হ্যাঁ হয় গেল ওরা। আঁতোয়াটা স্কুল পালন ছেলে, বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া আছে বলে মনে হয় না। মিশেল আর মারিয়েনের ঘরদোরের কথা বাপের জন্মে কেউ শোনেনি। প্যারিস শহরের অলিতে গলিতে চাইলে দেখা মিলবে ওদের। মাঝে মাঝে রুটির দোকানে টুকটাক হাতসাফাই করতে হয়। নেহাৎ প্যারিসে বিনা পয়সায় ফিল্ম দেখার হরেক মওকা, তাই বাঁচোয়া,যেমন আজকে। ফিল্মের নাম ইংরেজি তর্জমায় “ওল্ড এন্ড নিউ”(Old and New), সঙ্গে উপস্থিত ফিল্মের পরিচালক, এসেছেন রাশিয়া থেকে।
তিনি আর কেউ নন সের্গেই মিখালোভিচ আইজেনস্টাইন (Sergei Mikhailovich Eisenstein)। অনেকেই দেখেছে লোকটার দুনিয়া কাঁপানো ফিল্ম “যুদ্ধজাহাজ পটেমকিন” এবং “অক্টোবর’ (Battleship Potemkin and October)। তাঁর নিদ্রোহের এমন চনমনে ছবি যে, সকলের দিলখুশ করেছে এমনটা বলা যাবে না। অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে মানুষ। মাঝে মাঝে কানে আসছে কথা কাটাকাটি। হবার কথা।বলতে বলতে মঞ্চে হাজির লোকটা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মাঝারি গড়ন আর মাথাটা চেহারার তুলনায় বেশ বড়।সবচেয়ে নজরে পড়ে লোকটার ধারালো বাঁকা চাউনি। প্রতিনিয়ত মেপে চলেছে সবকিছু। পরিচয় পর্ব চুকতেই শুদ্ধ ফরাসি তে বলতে শুরু করে সের্গেই মিখালোভিচ আইজেনস্টাইন। দেখা যাচ্ছে লোকটা শুধু ফিল্ম করিয়ে নয়, তত্ব কথায়ও ওস্তাদ বটে। সিনেমার কাজ দৃশকে নিয়ে তা বলে দেখানোতেই থেমে থাকলে চলবে কেন তার? গল্পের নকশি কাঁথা ঢের বোনা হয়েছে, এবার আসুক নিখাদ চিন্তার ঢেউ। রূপসাগরে ডুব দিয়েই ভাবনার অরূপরতন খুঁজতে হবে সিনেমাকে।
ইউরোপ মহাদেশে কুড়ির দশক থেকেঅন্যরকম পরীক্ষা নিরীক্ষার ঢেউ বইতে থাকে সিনেমার পর্দায়। জার্মানিতে চলচ্চিত্রের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে অভিব্যক্তিবাদ। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে আজ দেখা যাচ্ছে,জার্মান পরিচালকের কাহিনী রচনার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন আবহরচনাকে। এমনকি তাদের আলো ব্যাবহারের রীতিটিও ওলন্দাজ চিত্রকলা, মূলত রেমব্রান্ট থেকে এসেছে।আর ফরাসিরা যেহেতু চিরকালই চিত্রকলার অভিজ্ঞতায় ধনী,তাঁদের চলচিত্রীয় বর্ননাও তাই অধিকতরভাবে প্রভাবিত ছিল ভিসুয়ালি সূক্ষ্মতায়। কিন্তু সিনেমার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে সবথেকে সাহসী এবং বৈপ্লবিক পদক্ষেপ বোধহয় নেওয়া হয়েছিল বলশেভিক সোভিয়েত ইয়নিয়নে। কুলেশভ কর্মশালায় অন্তত আইজেনস্টাইন ও পুদভকিন চলচ্চিত্রে দৃশ্য আর সংযোজনার যে পদ্ধতি গ্রহণ করলেন, তাতে সিনেমা দর্শনেন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে চিন্তাশ্রয়ী অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ করলো। এই রীতি এতই প্রভাবশালী ছিল যে, আজ যখনই আমরা সম্পাদনার ক্ষেত্রে “মন্তাজ” শব্দটির প্রয়োগ করি, তখনই তা বয়ে আনে সোভিয়েত, বিশেষত আইজেনস্টাইনের অনুষঙ্গ।
লেনিন ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে নব্য সোভিয়েত শিল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে সিনেমা। আইজেনস্টাইনের থেকে বছর খানেকর ছোট কুলেশভ অনেকদিন ধরেই নতুন সোভিয়েত সিনেমার চরিত্র কি হওয়া উচিত তা বোঝাতে গিয়ে ব্যাবহার করেছেন একটি শব্দ “মনতাজ” কুলেশভের মতে ফিল্মের যদি কোনো নিজস্বতা থাকে তা মোটেই ফ্রেম বাঁধা ছবিতে নেই, বরং রয়েছে শটে শটে সম্পর্ক তৈরি করার ঘটনা বা মানে তৈরির কারিকুরিতে।
“যুদ্ধজাহাজ পটেমকিন” যে সিনেমার ইতিহাসটাই আমূল বদলে দেবে তা ১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে ছবি মুক্তি পাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যায়। অচিরেই প্রায় গোটা পৃথিবীতে নয়া সোভিয়েত রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক দূত বনে যায় ১৯০৫ সালের রাশিয়ার নৌবিদ্রোহের ওপর তোলা ছবি। ছবির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য পর্দায় ওডেসা সিঁড়ির দৃশ্য পর্যায়। আইজেনস্টাইন বলবেন ছন্দ মনতাজ, আমাদের আক্রমন করতে থাকে দৃশ্যের ইতিহাসে গণহত্যার সবথেকে ভয়াল ছবি। সদ্য সাতাশ পেরোনো আইজেনস্টাইনকে যে সাদামাটা ঘটনাক্রম বিশেষ টানছে না বোঝাই যাচ্ছে। গনহত্যার দৃশ্যের পর পরই পটেমকিম থেকে কামান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে চার শটে পাথুরে সিংহ উঠে দাঁড়ায় বোঝা যায় তুলনার শিল্পকে আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তিনি। রূপের উপরিতল ছেচে ওঁর ফিল্ম আরো বেশি করে চাইছে বিমুর্ত যুক্তি তক্কো হাজির করতে। ফিল্ম বানানো ব্যাপারটা খুব ছোট করে ভাবতে পারতেন না আইজেনস্টাইন। বিশাল জায়গা জুড়ে একাধিক ক্যামেরা আর শয়ে শয়ে লোক নিয়ে শুটিং করতে ভসলবাসতেন তিনি। বিপ্লবের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যখন “অক্টোবর”বানাচ্ছেন তখন শেষের দিকে টানা তিরিশ থেকে চল্লিশ ঘন্টাও শুটিং করেছেন। উপায় ছিল না। ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি ছিল কর্তৃপক্ষের দেওয়া সময় সীমা।
১৯২৪ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর, খুব দ্রুত শেষ হলো “হরতাল”-এর কাজ একটি কারখানার ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে দেখানোর চেষ্টা হয় জার আমলের অত্যাচার আর তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত প্রতিরোধ। স্ট্রাইক এর কদিন পরেই একটি প্ৰবন্ধ লেখেন আইজেনস্টাইন “ফিল্ম এট্রাকশন মনতাজ” সেই প্রবন্ধের বক্তব্য বেশ বোঝা যায় ফিল্মটা দেখলে, মনতাজ হলো তুলনার শিল্প।ফিল্ম এট্রাকশন বা শট কোনো কিছুই স্বকীয় নয়। অনুষঙ্গের প্রবাহে একটি কনামাত্র। অনেকর সঙ্গে না মিললে এর অর্থ খুঁজে পাওয়ার জো নেই ফিল্মে। স্ট্রাইক-এ পুলিশ যখন ধর্মঘটিদের ধরতে ছোটে,কারখানার মালিক তখন লেবু নিংড়ানোর যন্ত্র ঘোরায়। শেষ দৃশ্যে শ্রমিকদের গনহত্যার পরের শটেই দেখানো হয় ষাঁড় জবাই-এর দৃশ্য। আর এখানেই কুলেশভ আর পুদভকিনের মতের থেকে আলাদা হয়ে যায় আইজেনস্টাইনের মনতাজ তত্ব।
বিপ্লবী ত্রয়ীর শেষে আইজেনস্টাইন জানাচ্ছেন, এর পরের ধাপ শ্লোগান থেকে ফিল্ম, যেখানে দৃশ্য সবসময় ছাড়িয়ে যেতে চাইবে, অনেকটা প্রবন্ধের মতো, শুধু চিন্তা দিয়ে গড়া শরীর। মার্ক্স এর পুঁজি বইটাকে ফিল্ম করবো আমি। এমন ঘোষণা করার বুকের পাটা হলো যাঁর, তিনি সত্যি ফিল্মটা করে উঠতে না পারলেও ঋণী করে রাখবেন ভবিষ্যতের সব ছবিকারদের, বিশেষ করে তাঁদের, যাঁরা ফিল্মে বুনতে চাইবেন চিন্তার নকশিকাঁথা।