Tuesday, June 10, 2025
Tuesday, June 10, 2025
Homeনাটকথিয়েটার করে বলে গর্ব বোধ করে লিলুয়ার গর্বিতা

থিয়েটার করে বলে গর্ব বোধ করে লিলুয়ার গর্বিতা

বিজয়কুমার দাস

থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ২১

এই মুহূর্তে বাংলা থিয়েটারে যে নতুন প্রজন্ম দাপিয়ে অভিনয় করে চলেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম লিলুয়ার গর্বিতা ঘোষ। গৌতম ঘোষ ও নীতা ঘোষের একমাত্র সন্তান গর্বিতা লেখাপড়ার পাশাপাশি থিয়েটারকে জড়িয়ে নিয়েছে জীবনের সঙ্গে। ২০২০ সাল থেকে থিয়েটারে যুক্ত হয়ে বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ের সূত্রে থিয়েটারের দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। আসলে ছোটবেলায় দূরদর্শনের পর্দায় এবং চলচ্চিত্রের পর্দায় অভিনেতা -অভিনেত্রীদের অভিনয় দেখতে দেখতেই অভিনয় করার ইচ্ছেটা পেয়ে বসে। স্কুলে নাচ,গান,নাটকে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা তাকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এবং বন্ধু বান্ধবদের প্রশংসা তাকে বাড়তি সাহস জুগিয়েছিল এ ব্যাপারে। বিদ্যালয়ে আন্ত: বিদ্যালয় নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা তখন তার ঝুলিতে। অবশেষে থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই নেয় গর্বিতা।

এরপর মা- বাবার সঙ্গে জীবনে প্রথমবার থিয়েটার দেখতে যাওয়ার পর তার মনে হয়, যেমন করেই হোক থিয়েটারে সে যুক্ত হবেই।মা- বাবা খুব একটা আপত্তি না করায় কাজটা সহজ হয়েছিল। কিন্তু তার মনে হয়েছিল,থিয়েটার করতে হলে অভিনয়টা শিখতে হবে।আর এজন্য নিজেকে যুক্ত করতে হবে কোন থিয়েটারের দলের সঙ্গে।

লিলুয়ার প্রগতি লিলুয়া নাট্যদলের কথা সে জানতে পারে যখন আই এস সি পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে। প্রগতির সঙ্গে যুক্ত সেই দাদার সূত্রেই তার প্রগতি নাট্যদলে যুক্ত হওয়া। সেই প্রগতি লিলুয়া দলের থিয়েটার বিষয়ক এক কর্মশালায় অংশ নিয়ে অভিনয় শেখার সুযোগ মিলে যায় প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব প্রবীর গুহ ও ঊহিনী কলকাতার নির্দেশক অভিনেত্রী অদ্রিজা দাশগুপ্ত এবং কোরিওগ্রাফার ও অভিনেত্রী কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। এর ফলে থিয়েটার করার শিক্ষা,মনোভাব এবং ধারণাটা তৈরি হয় গর্বিতার। আর পিছন ফিরে তাকায়নি সে।থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।

প্রগতি লিলুয়া দলেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয় গর্বিতা। এই দলেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে মৈনাক সেনগুপ্ত নাট্যরূপায়িত “সাঁকো” নাটকে তার থিয়েটারের দলের অভিনেত্রী হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই নাটকে “রিণি” চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা জুটে যায় তার ভাগ্যে। আবির ঘোষ এবং রাকেশ দুগার এর নির্দেশনায় এই “সাঁকো” নাটকে অভিনয় করেই গর্বিতা থিয়েটারের সাঁকোয় পা রাখে কোন নাট্যদলের অভিনেত্রী হিসাবে।

কিন্তু এখানেই আটকে থাকেনি গর্বিতার থিয়েটার জীবন। এ পর্যন্ত (২০২৫) মাত্র পাঁচ বছরেই প্রগতি লিলুয়া ছাড়াও কালিন্দী নাট্যসৃজন, খড়দহ দ্বিসাত্তিক,হাতিবাগান কাব্যকলা মনন ও দেবান্তরা আর্টস এবং অঙ্গণ বেলঘরিয়া নাট্যদলে অভিনয় করেছে গর্বিতা।

এ পর্যন্ত তার অভিনীত নাটকগুলির মধ্যে কোন চরিত্রটা তার প্রিয়, এ কথা জানতে চাইলে গর্বিতা জানিয়েছে , একজন অভিনেত্রী হিসাবে তার কাছে সব চরিত্রই চ্যালেঞ্জিং, এবং অবশ্যই প্রিয়। তবু তারই মধ্যে  প্রগতি লিলুয়া দলে র প্রযোজনায় “সন্দীপনী” নাটকের “অ্যালাইদা মার্চ” (এনের্তো চে গেভারার স্ত্রী) তার একটি অন্যতম প্রিয়তম চরিত্র। নির্দেশক যখন এই চরিত্রের জন্য তাকে নির্বাচন করে বা তাকে বিকল্প হিসাবে ভেবে রাখে তখন দলের অন্যদের তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এই পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে দর্শকদের প্রশংসা আদায় করে নেয় সে। তার বয়স এবং মেধার চেয়ে অন্তত ১০ বছরের বড় এই চরিত্রে অভিনয় করতে তার মনেও সংশয় ছিল। তবু অভিনয়ের পরে দর্শক প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে  থিয়েটার করার  সাহসটা তার আরও বেড়ে যায়। নির্দেশক আবির ঘোষের নির্দেশনায় তার বয়সের থেকে অন্তত ১০ বছর বেশি বয়সের এই চরিত্রে অভিনয় করতে গর্বিতা প্রথমে সংশয়ে থাকলেও মঞ্চে উত্তীর্ণ হয়ে থিয়েটার করার সাহসটা তার আরো বেড়ে যায়। গর্বিতা জানিয়েছে,এই চরিত্রে মঞ্চে নামার আগে Remembaring Che : My life with the  Guevara বইটা তাকে সাহায্য করে চরিত্রটা বোঝার জন্য। এই চরিত্রে অভিনয়ের পর জেদ এবং একাগ্রতার মধ্যে সে যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল।

থিয়েটার জগৎ সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত সে ভাল ধারণাই পোষণ করে বলে জানিয়েছে। দলের নির্দেশক কর্ণধার, সদস্যরা তাকে প্রতি মুহূর্তে উৎসাহ দিয়েছে, পাশে থেকেছে এবং অভিনয় শিখিয়েছে। তাই থিয়েটার জগৎটাকে ভালবেসেছে গর্বিতা। অভিনয় করলে জীবনের নিশ্চয়তা নেই, ভবিষ্যৎ নেই এসব নানা কথা শোনার পরেও এখনও পর্যন্ত এই জগৎটা তার ভালবাসার জগৎ হয়ে উঠেছে। অথচ সে জানে, এখানে কাজ করা কঠিন। এই জগতেও অন্ধকার আছে, অসৎ সঙ্গের হাতছানি আছে, তবু তার ধারণা, নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেই সব ঠিক।

গর্বিতার এই থিয়েটারের পথে  যাঁরা প্রেরণার মশাল জ্বালিয়েছেন তাঁদের মধ্যে তার প্রথম নাট্যশিক্ষক আবির ঘোষ ছাড়াও কালিন্দী নাট্যসৃজন এর অভিনেতা নির্দেশক বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়, অভিনেত্রী নৃত্যশিল্পী নির্দেশক মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়, বেলঘড়িয়া অঙ্গন এর নির্দেশক অভি সেনগুপ্ত, খড়দহ দ্বিসাত্তিক দলের নির্দেশক প্রসূন ব্যানার্জী তথা নির্দেশক কোরিওগ্রাফার কুশলী অভিনেতা সুমিত কুমার রায় এর ভূমিকা তার অভিনয় জীবনে উল্লেখযোগ্য।

থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়?… এই প্রশ্নের উত্তরে গর্বিতা জানিয়েছে, Wheather you think you can,or you think you can not – you are right – হেনরি ফোর্ডের এই উক্তি পড়ে তার মনে হয়েছে, যারা মনে করে থিয়েটার করে বাঁচা যায়, তারা বাঁচে, বেঁচে আছে থিয়েটার করেই।এর জন্য একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে তার শখ, সৌখিনতা, বিলাসিতা, বস্তুবাদী লালসাকে বিসর্জন দিয়ে সাধারণ জীবন যাপন করলে বাঁচা যায় বলে তার বিশ্বাস। তাই থিয়েটার করতে চাইলে মা সম্মতি দিলেও বাবা এসব ভেবেই সংশয়ে ছিলেন। বাইরে থিয়েটার করতে যাওয়া নিয়ে বাড়িতে সমস্যা থাকলেও গর্বিতা প্রমাণ করেছে : নিজে ঠিক থাকলে সব ঠিক। এখন মা এবং বাবা তার থিয়েটারের একনিষ্ঠ দর্শক।

তাকানো যাক এ পর্যন্ত গর্বিতা অভিনীত থিয়েটারের দিকে। “সাঁকো”য় পা রেখে তার যাত্রা শুরু হলেও পরে প্রগতি লিলুয়ার ” সন্দীপনী”,”অনপত্য”,কালিন্দী নাট্যসৃজন এর ” পটের বিবি” ( নির্দেশক: বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়), বিজাতীয় (নির্দেশক: মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়), “সম্পর্ক” (নির্দেশক : বিল্বদল চট্টোপাধ্যায়), হাতিবাগান কাব্যকলা মনন ও দেবান্তরা আর্টস এর “দ্য কাইট রানার” (নির্দেশক প্রসেনজিৎ বর্ধন, সুমিত কুমার রায়),খড়দহ দ্বিসাত্তিক এর “প্রোজেক্ট ভালোবাসা” ( নির্দেশক-সুমিত কুমার রায়),  এবং অঙ্গন বেলঘরিয়ার “মৌন বাঁশরী” (নির্দেশক : অভি সেনগুপ্ত) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এভাবেই নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা, প্রতি মুহূর্তে থিয়েটার শেখা, জীবনের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সম্মানের সঙ্গে থিয়েটার করেই গর্বিত থাকতে চায় বর্তমানে জীববিদ্যার স্নাতকোত্তর পড়ুয়া অভিনেত্রী গর্বিতা ঘোষ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular