কলকাতা – বাংলা নাট্য জগতে নক্ষত্রপতন। প্রয়াত হলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা তথা নাট্যকার মনোজ মিত্র। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। আজ, মঙ্গলবার সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। পরিবার সূত্রে খবর, বেশ কিছুদিন থেকেই তিনি বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁকে ভর্তি করানো হয়েছিল সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেই সময় পরিস্থিতি সংকটজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হার্টের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু সেই সময় দিন কয়েক মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে জয়ী হয়ে জীবন নাট্যমঞ্চে ফিরেও এসেছিলেন । কিন্তু মঙ্গলবার শেষ রক্ষা হল না। তাঁর মৃত্যুর খবরে শোকস্তব্ধ গোটা চলচ্চিত্র জগত্। সমাজমাধ্যমের পাতায় অভিনেতা অভিনেত্রীরা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রয়াত অভিনেতার উদ্দেশ্যে।
মনোজের তৈরি নাট্যদলের নাম ‘ঋতায়ন’। যেখানে তিনি নাট্যকার এবং নির্দেশক দুই ছিলেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ‘অবসন্ন প্রজাপতি’, ‘নীলা’, ‘মৃত্যুর চোখে জল’, ‘সিংহদ্বার’, ‘ফেরা’-সহ আরও অনেক নাটক। এছাড়াও বহু বহু বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। খলনায়ক হিসাবেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল। তাঁর অভিনীত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি হল ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘শত্রু’, ‘তিন মূর্তি’, ‘দামু’ প্রমুখ।
জীবনের নাট্যমঞ্চে মনোজ মিত্র
১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে মনোজের জন্ম। তিনি তাঁর বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান। বাবা অশোককুমার মিত্র প্রাথমিক জীবনে শিক্ষকতা করতেন। পরে ব্রিটিশ সরকারের ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক হিসেবে কাজ করেন।
বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলায় মনোজকে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। ফলে শৈশব থেকেই বিবিধ প্রকৃতির মানুষ, তাদের বিচিত্র সব পেশা আর তার পাশাপাশি প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্যকে যে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, সে কথাও বার বার উঠে এসেছে তাঁর বহু লেখায়, সাক্ষাৎকারে।
মনোজের শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের স্কুলেই। কিন্তু বাল্যকাল থেকে রুগ্ন মনোজকে ঘুরতে হয়েছে বাবার কর্মস্থল অনুযায়ী। ছোটবেলায় এক গৃহশিক্ষকের সাহচর্য তাঁকে পাঠ্য বিষয়ের বাইরের জগৎ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। সৃজনশীল লেখালিখির সলতে পাকানোর কাজ সম্ভবত সেই সময় থেকেই শুরু হয়।
স্বাধীনতার পর কলতায় চলে আসে মনোজ মিত্রর পরিবার। কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র ছিলেন মনোজ। একদিকে অধ্যাপনা এবং অন্য দিকে থিয়েটার দুদিকেই সমান আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই অভিনেতা চেয়েছিলেন কলকাতার কাছের এমন কোনও কলেজে যোগ দিতে যেখানে চাকরি করতে করতে তাঁর থিয়েটার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। যদিও তাঁর থিয়েটার করাতে একেবারেই মত ছিল না অভিনেতার বাবার। যদিও পরবর্তীকালে দুই দিকই সমান তালে সামলেছেন তিনি। বহু দিন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্য বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে পড়িয়েছেন। ২০০৩ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
জীবনই ছিল তাঁর রঙ্গমঞ্চের মশলা
মনোজ মিত্র পরে ঘণিষ্ঠমহলে জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতার লগ্নে তিনি জানতেন, তাঁর ‘দেশ’ খুলনা ভারতেই পড়বে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জানা গেল, সেই জেলা ‘বিভুঁই’ হয়ে গিয়েছে চুপিসারে। বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহ পড়েছে পাকিস্তানে আর তাঁর পৈতৃক নিবাস খুলনা জেলা পড়েছে ভারতে।
এর এক দিন পরেই আবার জানতে পারেন, খুলনাও পড়েছে পাকিস্তানে। মুহূর্তের মধ্যে নিজভূমিকে পরবাসে পরিণত হতে দেখেই কি জীবনের নিষ্ঠুর রসিকতার দিকটিকে চিনতে শুরু করেন মনোজ? সেই জীবনবোধই যেন ‘সাজানো বাগান’ থেকে ‘নরক গুলজার’-এর মতো নাটকগুলিতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মনোজ মিত্র। যেখানে প্রবল সঙ্কট-মুহূর্তেও চরিত্রেরা কিছুতেই রসবোধ হারায় না।
জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে নাট্যমঞ্চে
১৯৫০ নাগাদ মনোজ মিত্রর পরিবার চলে আসে এ পার বাংলায়। স্কুলজীবনেই থিয়েটারচর্চার সূত্রপাত। ১৯৫৪ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলে সহপাঠী হিসাবে পান বেশ কিছু সমমনস্ক মানুষকে। এই সময়েই মনোজ ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন। এই কলেজেই দর্শনে অনার্স নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়াশোনা চলাকালীন পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতো বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নাটকের দল ‘সুন্দরম’। এরপর জড়িয়ে পড়েন নাটকের সঙ্গে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালীনই দলের জন্য প্রথম নাটক লেখা। ২১ বছর বয়সে মনোজের প্রথম লেখা নাটক ‘মৃত্যুর চোখে জল’। সেটি লেখা হয়েছিল এক একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার জন্য। সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান লাভ হয়। এই সময় থেকেই গল্প লেখা ছেড়ে পুরোপুরিভাবে নাটক লেখাতে মনোনিবেশ করেন মনোজ মিত্র।
কলকাতায় সাজানো বাগান
মনোজ ছিলেন উত্তর কলকাতার বাসিন্দা। তবে বেশ কয়েক বার বাসাবদল ঘটেছে তাঁর জীবনে। পরবর্তী কালে পাকাপাকি ভাবে সল্টলেকে থিতু হয়েছিলেন। স্ত্রী আরতি মিত্র। তাঁদের একমাত্র কন্যা ময়ূরী।
১৯৭৭ সালে মনোজ লিখলেন ‘সাজানো বাগান’। প্রধান ভূমিকায় তিনি নিজে। বাংলা নাটকের দর্শক বুঝতে পারল বাংলার নাট্যজগতে আরেক নক্ষত্র জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে। আসলে ‘ডায়লগের’ ভারাক্রান্ততা থেকে নাটককে মুক্তি দিয়েছিল ‘সাজানো বাগান’। সেটাই জন্য নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু তাঁর নাটক ‘বক্তব্যহীন’ হয়ে যায়নি। শ্রেণি নয়, ব্যক্তিমানুষই তাঁর নাটকের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ‘চাক ভাঙা মধু’র জটা বা মাতলা, ‘সাজানো বাগান’-এর বাঞ্ছা, সকলেই একক।
‘সাজানো বাগান’-এ বাঞ্ছার ‘বক্তব্য’ একটা কোথাও থাকে বটে, কিন্তু সে তার সর্বস্বতা নিয়ে গ্রাস করে না একা মানুষের লড়াইকে। বেদনার সঙ্গে ফুলঝুরির আলোবিন্দুর মতো ঝলকায় কৌতুক। যা শত-সহস্র মারি আর মড়কের পরে আবার নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
নাট্যজগৎ থেকে রূপোলি পর্দায়
নাট্যকার-পরিচালক মনোজকে চলচ্চিত্র অভিনয়ে প্রথম পাওয়া গেল ১৯৮০ সালে তপন সিংহ পরিচালিত ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ। তাঁরই নাটক ‘সাজানো বাগান’-এর চলচ্চিত্রায়নে তিনিই হাজির বাঞ্ছারামের চরিত্রে। মঞ্চাভিনয় থেকে পরিণত বয়সে সিনেমার পর্দায় উঠে আসা খুব সহজ কাজ ছিল বলা যায় না। কিন্তু ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ সাড়া ফেলে দিলেন মনোজ। পর্দা এবং মঞ্চ— দুইয়েরই নিয়মিত অভিনেতা হয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
তপন সিংহ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকের পাশাপাশি অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, হরনাথ চক্রবর্তী, প্রভাত রায় বা অঞ্জন চৌধুরীর মতো মূলধারার পরিচালকদের ছবিতেও তাঁর অনায়াস উপস্থিতি। অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত ১৯৮৪-র ছবি ‘শত্রু’র খলনায়ক নিশিকান্ত সাহা বাংলা চলচ্চিত্রে সিরিও-কমিক ভিলেনের উদাহরণ হয়ে রইল।