নিজস্ব প্রতিনিধি
কিছুদিন আগে জয় পাগল মাল্টিমিডিয়ার আয়োজনে আমন্ত্রিত মোশারফ করিম সাংবাদিকদের মুখোমুখী হয়ে বেশ কিছু দরকারী প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিয়েছিলেন। অতি সম্প্রতি একটি ইউটিউব চ্যানেলে সেটা আপলোড হয়। যেখানে অভিনয় বিষয়ে বাংলাদেশ ও এই বঙ্গের সকলের প্রিয় অভিনেতা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উত্থাপন করেছেন। যা নবাগত অভিনেতাদের কাছে দুর্দান্ত টিপস হয়ে পারে।
প্রশ্ন।। বর্তমানে বাংলাদেশে নাটকের অবস্থানটা কোথায়? আপনার কাছে কি মনে হয়? আপনারা যখন শুরু করেছিলেন, তখন যে সময়টা ছিল, একটা পরিবারের মত, এখন কি এরকমটা দেখতে পান?
মোশারফ করিম।। এটা খুব গাণিতিক প্রশ্ন বলে মনে হচ্ছে, যে আমি বলবো এর অবস্থান এখন নবম পর্যায়ে আছে। হা হা- অবস্থানটা নির্ণয় করা তো মুশকিল আসলে। শিল্পের ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে একে কোনো সংজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। এবং সেই কারণেই এই কাজের ক্ষেত্রে, অনেক কাজই আছে যেগুলো, মানুষের মন জয় করে, অনেক কাজ আছে মানুষের মন জয় করতে পারে না। কাজগুলো অনেকসময় নিন্দিতও হয়, আবার কালের বিচারে সেই নিন্দিত কাজ নন্দিত হয়ে যায়। তাই অবস্থানতা কোথায় আছে? সেটা বলা সম্ভব নয়, এবং বলা উচিতও না।
প্রশ্ন।। শিল্পীদের কি রাজনীতিতে আসা উচিত নাকি এই অঙ্গনের বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত যদি কিছু বলে-
মোশারফ করিম।। বাইরেও নিয়ে যাবো না, ভেতরেও রাখবো না। এটা শিল্পীর ব্যক্তি স্বাধীনতা। তার রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে পারে। আর তাতে সে সম্পৃক্ত হতে পারে। আবার কারোর ক্ষেত্রে, এমনও হতে পারে, না আমি আসলে এই বিষয়টা বুঝি না বা এর মধ্যে আমি আগ্রহ কম পাই। কিন্তু সব কিছুর পরেও, রাজনীতির বাইরেতো আসলে মানুষ না। যেহেতু দেশ বলে একটা কথা আছে। সেটা আমার কাছে মনে হয়, খুবই ব্যক্তিগত।
প্রশ্ন।। অনেকেই অভিনয়ে আসে তারা বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না, এর রহস্য বা কারণটা কি? বলে মনে হয় আপনার?
মোশারফ করিম।। যারা ঝরে পড়ে যায়, তাদের ঝরে পড়ার কারন আমি জানিনা আসলে। আর প্রশ্নটা এরকম না হয়ে, প্রশ্নটা এরকম হওয়া উচিত, যে বা যারা এখানে আসেন তাদের আসলে কি নিয়ে আসা উচিত? শিল্পের ক্ষেত্রে তো একটা ব্যপার থাকে, একে কোনো সংজ্ঞা দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। আগেই বললাম। এটা অসীম ব্যাপার। আর সে কারণে এখানে অনেককিছু ঢুকে পড়ে। যেহেতু জায়গাটা অসীম, কিন্তু ব্যপার হচ্ছে যে ঐ- প্রথম দরকার সততা। সেটা হচ্ছে, আমার নিজের মনের মধ্যেই। আমি জানি, আমি কি এটা পারি? নাকি পারি না? অবশ্যি এখানে একটা লোভ, মোহের ব্যাপারও আছে। যে আমি পারি না, তবুও আমার মনে, এখানে একটু বেরোলে মানুষ ছবি তুলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক ব্যাপার’তো এখানে আছে। আসলে বিষয়টা হচ্ছে যে আমি যদি ডাক্তারি করতে যাই তাহলে, ডাক্তারিটা পড়ে, জেনে-শুনেই আমার করা উচিত, একতা বিল্ডিং বানাতে গেলেও আমাকে ইঞ্জিনীয়ার হতে হয় আর অভিনয়ের ক্ষেত্রেও আমার মনে হয় যে, যারা অভিনয় করতে আসেন, তাদের সেটা জেনেশুনে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটা ট্রেনিং বলি, বা একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা বলি। আর শিল্পের ক্ষেত্রে তো টোটাল যাত্রাতে, মানে টিল ডেথ, যত দিন যায় তত অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়, আর সেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আমাদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে কাজেও লাগে।
প্রশ্ন।। আপনি তো বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করছেন। থিয়েটারে এরকম বিচিত্র চরিত্র পেয়েছেন কি না, আর যারা এখানে নতুন আসতে চাইছে, আপনার মতো কাজ করতে চাইছে, তাদের জন্য কি কি গুণ থাকা লাগবে? যদি বলে-
মোশারফ করিম।। আসলে হচ্ছে কি, এই যে আমার মতো কথাটাতেই আমার প্রথম আপত্তি। আমার মতো কেন হতে হবে? কারণ শিল্পের ব্যাপারটাই তো সৃষ্টি করা, সৃষ্টি মানে নতুন, তা সেখানে ফটোকপি করার তো কোনও মানেই হয় না, সেটা ঠিকঠাক না, সেটা আসলে শিল্প বিরোধী কাজ। এবং যে এই কপি করাটা শুরু করেন, তার নিজের ভিতরের সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা, লকড হয়ে যায়। এটা আমার বিশ্বাস। কারণ আমার মতোই যদি আর একজন চেষ্টা করতে থাকে, তাহলে আমরা নতুন কি করে পাবো? আপনি থিয়েটারের বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, হ্যা থিয়েটার বাঙ্গাল দেশে একটা বড় ভুমিকা তো অবশ্যই পালন করেছে। বিশেষ করে নামকরা শিল্পী যারা আছেন তাদের অধিকাংশই থিয়েটার থেকে আসা।
প্রশ্ন।। বিচিত্র সব চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কি কি করতে হবে?
মোশারফ করিম।। আসলে অভিনয় শিল্পীর বিচিত্র চরিত্রেই অভিনয় করা দরকার। সে কেন একটা চরিত্রে অভিনয় করবে? সে তো অভিনয়ই করবে, সে বিচিত্র চরিত্রেই অভিনয় করবে, এবং ঠিকঠাক ভাবেই করবে। এটাই তো হওয়া উচিত। এখন কি করা দরকার? অভিনয়টা শেখা দরকার। সেই শেখাটা তো আসলে অংকের মত না, যে একজন শিক্ষক রেখে, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার সুত্রের মধ্য দিয়ে শিখে গেলাম। চেষ্টা করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মেথোড আবিস্কার করাও হয়েছে। কিন্তু আসলেই এটা বসবাসের ব্যাপার। এটা চর্চার বিষয়। এবং চর্চার মধ্য দিয়ে বসবাসের বিষয়। বসবাস করতে করতে, মানে একটা বাচ্চা যেমন ভাষা শেখে আরকি, প্রথমে সে কিছু জানে না, তারপরে সে তো আর গ্রামার দিয়ে ভাষা শিখছে না, কিন্তু তার ভাষা শেখাটা হয়ে যাচ্ছে। কেমন করে করছে সে? এই ভাষার মধ্যে বসবাস করতে করতে। তাই আমার কাছে এইটাই মনে হয়, এই বসবাসটা খুব জরুরী।
প্রশ্ন।। আপনি অসংখ চরিত্রে অভিনয় করেছেন, কিন্তু এখন সেইভাবে গল্প পাওয়া যাচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে কি আমাদের স্ক্রিপ্ট রাইটারদের সংকট আছে? কি বলেন?
মোশারফ করিম।। আমরা যে নাটকগুলো করি, সেগুলোর তো বাজেট খুব বেশী থাকে না। এখন নাটক লেখাটাই যদি পেশা হয়, এটাকে পেশাগতভাবে নেওয়া কথা একটা মানুষ চিন্তা করে। যখন দেখবে সেখানে তার উপার্জনটা যথেষ্ট, তখন তার আগ্রহও তৈরি হবে। অনেকেই আছেন, অনেকেই ভালো লেখেন, আবার অনেকেই লেখার জায়গা থেকে সরেও গেছেন। কারণ ঐ টা। আর যখন ঐ জায়গাটা ঠিকঠাক থাকে, তখন আরও একজন কিন্তু উৎসাহিত হয়, না আমাকে লিখতে হবে, এবং লেখার জন্য পরিশ্রম করতে হবে। এবং কেমন করে ভালো গল্প লেখা যায়, কেমন করে ভালো নাটক লেখা যায়, সেগুলো নিয়ে ভাববে।
প্রশ্ন।। আগে অনেক ভালো ভালো নাটক হত, কিন্তু এখন সেইভাবে পাচ্ছি না, এটা কি ডিরেক্টরসদের সমস্যা নাকি স্ক্রিপ্ট রাইটারদের অধঃপতন, নাকি বাজেট, কোনটা মনে হয় আপনার।
মোশারফ করিম।। অবশ্যই বাজেট। তখন বাজেট হয়তো বেশী ছিল, তখনকার বাজেতের ব্যাপারটা জানিনা, কিন্তু যে নিষ্ঠা, সেই সময়ের অনেকেই কিন্তু সরেও গেছেন। কারণ তারা যে নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন, যেগুলোর সাথে আমি সম্পৃক্তও ছিলাম, এবং যে সময় নিয়ে কাজটা করতে পেরেছি, সেই সময় নিয়ে কাজতা করা যাচ্ছে না। সেটা জরুরী। সময় নিয়ে কাজ অরতে পারলেই আবার হবে। না হবার কিচ্ছু নেই। তাই সময় আর বাজেট দুটোই ফ্যাক্টর।