মা দুর্গা যখন বাংলা রঙ্গমঞ্চে চরিত্ররূপে

- Advertisement -

দেবা রায় 

 ‘রাবণবধ-এ আরও কয়েকটি (নিকষা, কালী, ত্রিজটা) ভূমিকার সঙ্গে ক্ষেত্রমণিকে দূর্গা চরিত্রে অভিনয় করতে হত ধর্মদাস সুর দূর্গা প্রতিমা বাস্তবানুরূপ করার জন্য আটটি মাটির হাত ক্ষেত্রমণির দেহে দৃঢ়ভাবে লাগিয়ে দিতেন এবং হরিতাল, ও গর্জন তেল দিয়ে মুখমণ্ডল অনুলেপিত করে নানা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তাঁকে সজ্জিত করতেন। দুর্গা প্রতিমার রূপ ধারণ করে ক্ষেত্রমণিকে আধ ঘন্টা ধরে মঞ্চে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে  হত। অসহ্য গুরুভারে অবসন্ন এবং নানা অনুলেপনের বিষাক্ত ক্রিয়ায় জর্জরিত ক্ষেত্রমণি ঠিক মূর্তির মতোই অচল, অনড় অবস্থায় থাকতেন কিন্তু অভিনয় শেষে একবার মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন’

-বাংলা নাট্যভিনয়ের ইতিহাস, ডঃ অজিত কুমার ঘোষ।

প্রাককথা

বাংলাদেশে মঞ্চাভিনয় শুরু হয়েছিল ইংরেজ আমলে কলকাতা শহরে। অভিজাত সমাজে নাট্যাভিনয়ে সাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না বলেই অনুমিত হয়। খুব স্বাবাবিক ভাবেই জনসাধারণের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল লোকাভিনয় বা ফোক ড্রামা। হোলিকা উৎসব, শারদোৎসব, অন্যান্য দেবদেবীর পূজার্চনা, শুভযাত্রা ইত্যাদি উপলক্ষে এই সমস্ত লোকাভিনয় অনুষ্ঠিত হত। পরবর্তীকালে এই ধারাররূপ হিসেবে যাত্রাকে ধরা যেতে পারে। একসময় মুসলমান শাসনকালে মুসলিম রাষ্ট্রশক্তির বাধাদানের জন্য অভিজাত সমাজ থেকে অভিনয় কলা লোপ পেয়েছিল। আমোদ-প্রমোদ সেখানে কঠোর হাতে দমন করা হতো।

বাংলায় অভিনয়ের উল্লেখ কোথায় পাই  

বাংলায় চর্যাপদে অভিনয়ের উল্লেখ আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যা লোকাভিনয় ঝুমুর ঢঙে রচিত। অর্থাৎ ঝুমুর, তরজা, যাত্রা, পাঁচালি প্রভৃতি বাংলার লোকাভিনয় আবহমানের। শেকড়ের। চৈতন্যদেবের নাট্যাভিনয়ের প্রতি অনুরক্তি আমরা বুঝতে পারি তাঁর একাধিকবার কৃষ্ণলীলার মধ্য দিয়ে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে যাত্রাভিনয় একটি সর্বজনবিদিত লোকপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। বিষয় সেই কৃষ্ণযাত্রার ‘কালীয়দমন পালা’। আবার দেখা যাচ্ছে চন্ডী ও মনসা লীলা ও পূজা অভিনীত হত। কালীয়দমন যাত্রাপালার পরিচালকরা ছিলেন শিশুরাম অধিকারী, পরমানন্দ, শ্রীদাম, সুবল, বদন অধিকারী, লোচন অধিকারী প্রমুখ। যারা সুখ্যাত ছিলেন।

কৃষ্ণকমল গোস্বামীর ভক্তিরস ঈ গীতিরসের সংমিশ্রণে মার্জিত রুচির যাত্রাগান (যেমন ‘রাই উন্মাদিনী’, ‘স্বপ্নবিলাস’) বা পালাগান রচনা ক’রে যাত্রাশিল্পের মান ও প্রভাব বৃদ্ধি করছিলেন। এরপর পাই বিদ্যাসুন্দরের রুচি  বিগর্হিত প্রভাব। গোপাল উড়ে টপ্পার ঢঙে ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা গেয়ে নাগরিক সমাজকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক ভাবধারায় যাত্রাপালায় মঞ্চাভিনয়ের ধারা অনুসৃত হয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলকাতার অনেক সজ্জন ব্যক্তি যাত্রার দল খুলে যাত্রার গ্রামীণতাকে নাগরিক চর্চায় রূপান্তরিত করেছিলেন। যার ফলে এক্সযাত্রায় প্রাচীন বিশুদ্ধতা ক্ষয় হল বা রক্ষা করা গেল না। এবং তার একটা নামকরণও হয়ে গেল। অপেরা। ঐ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকেই সুশিক্ষিত যুবসমাজ ইংরেজ প্রতিষ্ঠিত নাট্যমঞ্চে ইংরেজি নাট্যাভিনয় দেখে তাঁদের অভিনয় শৈলীর প্রতি আকৃষ্ট হন। যার প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখতে পেলাম লোকাভিনয়কে অপেরার ছাঁচে ঢেলে সাজাবার আয়োজন। হয়তো এই কারণেই বাংলা নাটক ইংরেজি নাট্যকলা ও নাট্যসাহিত্য অনুকরণ করে আজও যাত্রা বা অপেরার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

ভক্তিমূলক কাহিনীর সূত্রপাত

ভক্তিমূলক কাহিনী বা ধর্মীয় কাহিনী বা পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে রচিত ও নির্মিত নাট্যাভিনয়ের সমকালীন  সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকা উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র একের পর এক নাট্যরচনায় সমাজের ঘাত-অভিঘাত  চিত্রিত করে ফেলেছেন।

সেখানে আমরা লক্ষ করেছি  মনোমোহন বসু, গিরিশ ঘোষ, হরনাথ বসু, রাজকৃষ্ণ রায়, বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্তর মতো নাটককাররা সুলভ উচ্ছাস, অতিনাটকীয়তা, অনৈসর্গিকতার ওপর ভিত্তি করে অসংগত ধর্ম-বিজড়িত ঐতিহাসিক নাটক একের  পর এক রচনা ও নির্মান করে গেছেন। এসব করে তাঁরা হয়তো যুগের বা সমাজের বিশ্বাসের দাবী নিঃসন্দেহে মিটিয়েছিলেন কিন্তু নাট্যসাহিত্যের দাবী মেটাতে পারেননি।  

কালের কষ্ঠিপাথরে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে হলে অবশ্যি  নাটকের রচনা-কৌশল উচ্চতর সাহিত্যবোধে উন্নীত হতে হবে। মধুসূদন দত্ত বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসের কাহিনীকে গ্রহণ করে নিজের প্রতিভা ও কাব্যিক প্রয়োজনানুসারে সেই চিরকালীন মহাকাব্যের আখ্যানকে ভেঙেছেন আবার পুনর্গঠন করেছেন, যা বাংলা নাট্য-সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছে। তিনি নাট্যবিন্যাসে দেখিয়েছেন চরিত্র ও ভাবাদর্শের দিক দিয়ে ভারতীয় ঐতিহ্য স্বীকার করেও সুনিপুণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব। যেমন রামচন্দ্র দেবতার সাহায্যে জয়ী হয়েছিলেন বা লক্ষণ চন্ডীর বরে অন্যায়ভাবে মেঘনাদকে বধ করেছিলেন।

ঐতিহাসিক এইসকল চরিত্র অবতারণার কারণ কি 

এসবই মানুষের নৈতিক বোধকে জাগ্রত করতে পারে। কালের গহ্বরে এই সকল নাট্যপ্রয়াস তলিয়ে যায় না। কিন্তু শুধুমাত্র কাহিনীর অনুকরণ ও সামাজিক চাহিদাপূরণের লক্ষে যদি শিল্পের চর্চা হয়ে থাকে তবে তা সত্যিই অতলে তলিয়ে যায়। যদিও ইতিহাস তাকে চিরকাল বহন করে। আর সে ইতিহাসও জনমানসের কাছে পুনরুত্থাপিত করার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না।

আর সেই তাগিদ থেকেই উঠে আসে, নাট্যসাহিত্যে এই সকল নাট্যাভিনয়ের তৎকালীন নাট্যশিল্পীদের চরিত্র ও নাটকের প্রতি তাদের ভালোবাসা বা দায়বদ্ধতার কথা। আমরা জানতে পারি সে সময়ের নাট্যচর্চার নানান কথা। আর সেই নানান কথামালার মধ্য থেকে বাঙালী সমাজের এক দৈব চরিত্র ‘দুর্গা’ কে তুলে এনে সেই চরিত্র নির্মানের ইতিহাস বা প্রেক্ষাপটের অন্বেষণেই এই রচনা।

নাট্যমঞ্চে ‘মা দুর্গা’ উপস্থাপনার কারণ    

দুর্গা বাঙালির শুধুমাত্র ধর্মীয় আবেগের চরিত্র নয়। দুর্গা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও। কখনো মাতৃরুপে, কখনও জায়া কখনও কন্যা। এই ‘দুর্গা’ চরিত্র যখন মঞ্চে উপস্থাপিত হয়, তখন বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেই অভিনয় দেখতে ভিড় উপচে পড়বে। নাট্যশিল্পে সে সময় যারা অর্থ বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের  লাভ-লোকসানের হিসেবের প্রতি নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতাদেরও দৃষ্টি রাখতে হতো।

তাহলে কি ব্যাবসার কারণেই দুর্গা চরিত্রের অবতারণা

সমকালীন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির নিরিখে এইসব নাট্যচর্চা এককথায় বিলাসিতারই নামান্তর। এ দেশের আপামর মানুষ, শিক্ষিত সমাজ যেখানে বর্বর  ইংরেজদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন, ইংরেজ দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছেন সেখানে ভক্তিরসে নিমজ্জিত প্রাণসমূহের প্রতি ইতিহাস ভ্রু-কুঁচকে তাকাবে এটাই স্বাভাবিক।  

কোন সামাজিক পটভূমিকায় এই নাট্যচর্চা   

শিক্ষার অভাব ও পরাধীনতার জন্য আমাদের সমাজব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। নানা অন্ধ-কুসংস্কার আমাদের সমাজ মানসকে গ্রাস করে ফেলেছিল। সতীদাহ তার একটা অন্যতম উদাহরণ। রামমোহনের বিশেষ প্রচেষ্টার ফলে ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়ম বেন্টিংক আইন প্রণয়ন করে এই নিষ্ঠুর প্রথা বন্ধ করলেন। অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশনের ছাত্ররা ডিরোজিওর নেতৃত্বে সমাজের কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন। হিন্দুসমাজের চিরাচরিত প্রথা ও নৈতিক আচার সমূহকে ব্যঙ্গ করবার জন্য ‘ইয়ং বেঙ্গল’রা মদ্যপান ও গোমাংস ভোজনাদির সাহায্যে বাহাদুরি দেখাতে আরম্ভ করলেন।

‘তখনকার সময় গুণে ডিরোজিওর যুবক শিষ্যদিগের এমনি সংস্কার হইয়াছিল যে, মদ খাওয়া ও খানা খাওয়া সুসংস্কৃত ও জ্ঞানালোকসম্পন্ন মনের কার্য তাহাঁরা মনে করিতেন, এক গ্লাস মদ খাওয়া কুসংস্কারের ওপর জয়লাভ করা

—সেকাল আর একাল, রাজনারায়ণ বসু

মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’(১৮৬০) এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’(১৮৬৬) নাটকে এই নব্য সম্প্রদায়ের পরিচয় মেলে।

১৮৩৭ সালে হিন্দু-বিধবার পুনর্বিবাহের উদ্দেশ্যে কলকাতা ও মুম্বাইয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে ও প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালে ‘হিন্দু বিবাহ আইন’(হিন্দু উইডো রি-ম্যারেজ অ্যাক্ট) পাশ হয়। পশ্চিমভারতের বিষ্ণুশাস্ত্রী ও বাংলার বিদ্যাসাগর আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কুলীণ ব্রাহ্মণদের বহু-বিবাহ বন্ধ করতে শিক্ষিত কিছু ব্যাক্তি এই আইন প্রণয়ন করার চেষ্টা করেছিলেন। অসবর্ণ বিবাহ প্রচলন আন্দোলন ও বাল্যবিবাহ বিরোধী আন্দোলনের ফলে যথাক্রমে সিভিল ম্যারেজ বিল(১৮৭২) ‘এজ অভ কনসেন্ট’ বিল পাশ হয়।

কোন অর্থনৈতিক পটভূমিকায় এই নাট্যচর্চা

ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক নীতি বলতে কিছুই ছিল না। কোম্পানির আমলে সাম্রাজ্য বিস্তার, প্রশাসনিক ব্যয় প্রভৃতি খাতে একটা বিরাট অঙ্কের টাকা যোগাতে হয়েছিল ভারতবাসীকে। নীলকর সাহেবদের জটিল ও ক্রুর ব্যবস্থায় চাষীরা কখনোই ঋণ মুক্ত হতে পারতো না। কল-কারখানা সম্বলিত পাটশিল্পের প্রসারের ফলে হস্তচালিত তাঁতজাত  পাট-দ্রব্য উৎপাদনে ভাঁটা পড়ল। শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে বয়ন ও হস্তশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রশিল্পের আলোকোজ্জ্বল পর্ব শুরু হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতে যন্ত্রশিল্পের বিকাশের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন অনুভব করেনি।

কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের কৃষি, বাণিজ্য, শিল্পজাত দ্রব্য ও আর্থিক বন্টনের সুব্যবস্থার উপর। ব্রিটেনে ‘হোমচার্জ’ হিসেবে একটা বিরাট অংশের টাকা পাঠানো হত। তার মধ্যে মেল সার্ভিস, মেরিন চার্জ ইত্যাদি। ১৮৭৭ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে ঋণের পরিমাণ ১৩৯ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ২২৪ মিলিয়ন পাউন্ডে দাঁড়ায়।

কোন রাজনৈতিক পটভূমিকায় এই নাট্যচর্চা

পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও সংস্কৃতি  ফোলে উনবিংশ শতাব্দীর পর থেকেই ভারতবাসী, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ে চেতনার প্রতিভাস লক্ষ্য করা যায়। ফরাসি বিপ্লব, আমারিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, গ্রীসে স্বাধীনতা লাভ প্রভৃতি ঘটনা পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত ভারতবাসীর মন দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটায়। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৫৯-৬০ নীল বিদ্রোহ বিদেশী সরকারকে উচ্ছেদ করার সুতীব্র প্রয়াস। ধীরে ধীরে তীব্র অত্যাচারকে প্রতিহত করতে বিপ্লবী মতাদর্শে প্রাণিত ভারতের তরুণরা প্রাণ বিসর্জন দিতে এগিয়ে এলেন। গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে ইংরেজ নিধনের কর্মযজ্ঞে মেতে উঠলেন বাংলা তথা ভারতের মানুষ। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে বিপ্লবী আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।  

সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এই অস্থিরতার মধ্যেও ভক্তিরসাশ্রিত নাট্যচর্চার উৎসস্থল কি

  • ১) রামায়ণ-মহাভারত ও অষ্টাদশ পুরাণ
  • ২) মঙ্গলকাব্য
  • ৩) ধর্মগুরু ও বিশিষ্ট ধার্মিক মানুষের জীবনকথা

নানাবিধ চরিত্র থেকে ‘দুর্গা’ চরিত্রের প্রতি আলোকপাত

উত্তর সিপাহী বিদ্রোহ এবং প্রাক গণনাট্য আন্দোলন এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে রচিত ও অভিনীত ভক্তিরসাস্রয়ী নাটকের সংখ্যা ও তার ইতিহাস কম নয়। কিন্তু এই লেখায় বাংলা নাটকে ‘দুর্গা’ চরিত্রের চরিত্রাভিনয় ও তার ইতিহাসের প্রতি আলোকপাত হল।

দুর্গার কোন রূপগুলি মঞ্চে উপস্থাপীত হয়েছে  

দুর্গার নানান রূপ, কখনও কালী, কখনও বা গৌরী, কখনও উমা, ভগবতী, সতী…। আর এই চরিত্রটির বিশ্লেষণ নাট্যকাররা নানাভাবে করেছেন।

কেন এই অন্বেষণ  

দুর্গার নানারূপের বিশ্লেষণের সেই দিকটি আলোকপাত হলে উঠে আসবে সেই সময়ের নাট্যসংলাপের বয়ানে নাট্যকার,  নির্দেশক ও অভিনেতাদের কর্মপদ্ধতি-চিন্তন-দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়।

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘সতী’

সতী

নাটক-সতী

নাট্যকার– মনোমোহন বসু

প্রথম অভিনয়– ১৭ জানুয়ারী ১৮৭৪

স্থান– বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়

নাট্য সিদ্ধান্ত- সতী নারী স্বামী নিন্দা শোনা অপেক্ষা জীবন ত্যাগকেই শ্রেয় মনে করেন- এই নীতিকে কেন্দ্র করেই নয়টি দৃশ্য সম্বলিত পাঁচ অঙ্কের এই নাটক।   

এই নাটকের প্রধান চরিত্র ‘সতী’। সতীর পাতিব্রত-মহিমা প্রতিষ্ঠা করাই এ নাটকের মূল উদ্দেশ্য। পুরাণের কাহিনী অবলম্বন করলেও সতী চরিত্রটিকে নাট্যকার রক্তমাংসের মানুষ করে তুলেছেন। মনোমোহনের ‘সতী’ পিতা ও পতির মর্যাদার দ্বন্দে ক্ষতবিক্ষত এক মানবী।

‘সতী’ নাটকের সংলাপ

সতী- (রোদন) হায়! আমি এ মর্মপীড়া কার কাছে কই? হায় অভাগিনী কোথায় যায়? সেদিগে জন্মদাতা পিতা, এদিগে যার বাড়া নাই পতি। তিনি ভাবলেন এঁর অপমর। তিনি কল্লেন রোষ, এঁরও দেখছি ঘোর অসন্তোষ। এ অভাগিনীর দুই দিগেই বিষম। অভাগিনীর ক্ষুদ্র জীবন-লতায় দুই দিগে দুই তরু, একটি জন্মতরু-যার হাতে উৎপত্তি আর একটি আশ্রয়তরু- যার আশ্রয় বই গতী নাই।… আমি কি করিব? জন্মতরু হতে ছিন্নহলে বাঁচি না, আর আশ্রয়তরুর একটি বাকলে যদি আঁচড় লাগে, তাতে প্রাণ রবে না।

এ নাটকের একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  ‘হরপার্বতী মিলন’ নামক ক্রোড়াঙ্ক  দৃশ্যটি নাট্যকার নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণে সংযোজিত করেছিলেন। কারণ সেকালের দর্শক বিয়োগান্তক নাটক দেখতে পছন্দ করতেন না। (আজও কি করেন?) তাই দর্শকের রুচির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নাটকের শেষ দৃশ্যে মিলনান্তক দেখানোর স্বার্থে হর-পার্বতীর মিলন দৃশ্য দেখিয়েছেন। এ সম্পর্কে নাট্যকারের ঘোষণা- ‘বিয়োগান্তক নাটক প্রিয় মহাশয়েরা সে অংশটি বর্জন করেন এবং পুনর্মিলনানুরাগী মহাশয়েরা গ্রহন করিতে পারেন।’

নাটক- দক্ষযজ্ঞ

নাট্যকার– গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

প্রথম অভিনয়- ২১ জুলাই ১৮৮৩

স্থান– স্টার, বিডন স্ট্রীট

সতী চরিত্রায়ণ- বিনোদিনী

দক্ষযজ্ঞ নাটকের বিজ্ঞাপন

GRAND OPENING NIGHT/ STAR THEATRE/ BEADON STREET/ PROPRIETOR… BABOO GOORMUK ROY/Saturday 21st july, 9p.m/BABOO G.C. GHOSE’S NEW DRAMA/ DAKSHYA YAJNA/ EVERYTHING GRAND & WONDERFUL/ G. C. GHOSE, Manager.

স্টারের প্রথম অভিনয় সম্পর্কে বিনোদিনীর লেখায় পাই- ‘আমি ‘সতী’, কাদম্বিনি ‘প্রসূতি’ এবং অন্যান্য সুযোগ্য  লোকসকল নানাবিধ অংশ অভিনয় করিয়াছিলেন। প্রথম দিনে তো লোকারণ্য, সেই খড়খড়ি দেওয়ালে লোক সব  ঝুলিয়া বসে থাকা দেখিয়া আমাদের বুকের ভিতর দুর-দুর করিয়া কম্পন-বর্ণনাতীত। আমাদেরই সব দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। কিন্তু যখন অভিনয় আরম্ভ হইল তখ দেবতার বরে যেন সত্যই দক্ষালয়ের কার্য আরম্ভ হইল। বঙ্গের গ্যারিক গিরিশবাবুর ( সেসময়ে ইংল্যান্ডের রঙ্গমঞ্চের এক গৌরবোজ্জ্বল নাম গ্যারিক। এখানকার অভিনেতারা সকল বিষয়ে গ্যারিকের কাছ থেকে নির্দেশ নিতেন এবং গ্যারিকের অভিনয়রীতি অনুসরণ করতেন। এই অভিনয়ের বৈশিষ্ট কন্ঠস্বরের উচ্চতা ও তরঙ্গায়িত স্বরক্ষেপণ) সেই গুরুগম্ভীর তেজঃপূর্ণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুর্তি যখ স্টেজে উপস্থিত হইল, তখন সকলেই চুপ।  তাহার পর অভিনয় উৎসাহ, সে কথা লিখিয়া বলা যায় না। গিরিশবাবুর ‘দক্ষ’ আর অমৃতবাবুর ‘মহাদেব’ যে একবার দেখিয়াছে, সে বোধহয় আর কখনই তা   ভুলিতে পারিবে না। ‘কে-রে, দে-রে, সতী দে আমায়’ বলিয়া যখন অমৃতমিত্র স্টেজে বাহির হইতেন তখন বোধহয় সকলেরই বুকের ভিতর কাঁপিয়া উঠিত।  দক্ষের মুখে পতি নিন্দা শুনিয়া যখন সতী প্রাণ ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হইয়া অভিনয় করিত তখন সে বোধহয় নিজেকেই ভুলিয়া যাইত। অভিনয়কালীন স্টেজের উপর যেন অগ্নি উত্তাপ বাহির হইত।’

– আমার কথা, বিনোদিনী।

এই নাটকটিতে কোন সামাজিক পটভূমিকা লক্ষ্য করা যায়

১) সেকালের বয়প্রাপ্তা কন্যাকে যথাসময়ে পাত্রস্থ করতে না পারার ব্যাপারটি সমাজে অপরাধ বলে গণ্য হত। অনেক সময় কঠোর সামাজিক বিধানের জন্য  কন্যার পিতা-মাতাকে জাতিচ্যুত করা হত। তাই কন্যার বয়স বারার সাথে সাথে    পিতা-মাতার দুশ্চিন্তাও বেরে যেত। তাই সতীর বিবাহ  বিষয়ে চিন্তাগ্রস্থ পিতা  দক্ষের সংলাপ- ‘অকলঙ্ক শশীকলা সম/ কন্যা বাড়ে দিন দিন/ ভাবি মনে পাছে হয় জাতি-নাশ।’

২) শৈব ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দ্বন্দের প্রতি আকর্ষণ

গিরিশচন্দ্র তাঁর দক্ষযজ্ঞ নাটকে ‘সতী’কে মানবীরূপে নির্মান করেননি, তাকে শিবের আদ্যাশক্তি হিসেবে দেখিয়েছেন। যেখানে সতী জীবন দার্শনিক তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত। এ নাটকে সতী নানা অলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে আদ্যাশক্তি মহামায়ারূপে মর্যাদা লাভ করেছেন। গিরিশচন্দ্র সতীকে শিবেরও উঁচুতে জায়গা করে দিয়েছেন। সতী যেন ত্রিকালদর্শী- ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান তিনি একসাথে দেখতে পান।

নাটক– সতী

নাট্যকা– মন্মথ রায়

প্রথম অভিনয় ২৮ এপ্রিল, ১৯৩৭

স্থান– নাট্যনিকেতন  

সতী চরিত্রায়ন রাণীবালা

মন্মথ রায়ের ‘সতী’-র প্রেক্ষাপট

বিংশ শতাব্দীর প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কালে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার প্রভাবে দেশীয় নারীদের মধ্যে ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবাদের উন্মেষ ঘটে। ব্যাক্তিগত ও অন্যান্য ব্যাপারে তার নিজের মতামত ও ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে দ্বিধা করে না। এই নাটকে ‘সতী’ চরিত্রে সে যুগের শিক্ষিত রমণীসুলভ ব্যাক্তিত্বের বিকাশ দেখা যায়। যে পিতা দক্ষের মতের বিরুদ্ধে শিবকে পতি হিসেবে নির্বাচন করে। তার উক্তিতে স্বাধীন স্বামী-ভক্তি ও ব্যাক্তিত্বের পরিচয় মেলে।

মন্মথ রায়ের সতী নাটকের সংলাপ

সতী।। কন্যার বিবাহে পিতার তৃপ্তিই কি সব? কন্যার তৃপ্তি কি কিছুই নয়? তবে কী প্রয়োজন ছিল স্বয়ম্বরের আয়োজনের?

মন্মথ রায়ের সতী ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র ও প্রতিবাদী সত্তার স্ফুরণ। সতী একদিকে পূর্ন পরম্পরা না অন্যদিকে তেমনি প্রতিবাদী চরিত্র। সে নন্দীর কাছে বিনা নিমন্ত্রনে পিত্রালয়ে যাবার কারণটি ব্যাখ্যা করে।

সতী।। স্বামীর নিমন্ত্রন নাই বলেই তো আমি যাচ্ছি, জানতে যাচ্ছি কেন তাঁর নিমন্ত্রণ নাই? দেখতে যাচ্ছি কি করে শিবহীন যজ্ঞ হয়, এবং বলতে যাচ্ছি ত্রিলোকের শ্রেষ্ঠ বধু আমি- আমার স্বামী ত্রিলোকের স্বামী

এ নারী আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী। কোন কোমলতা বা অশ্রু বিসর্জন নেই। সে কঠোর ও রুদ্ররূপা। সে যেমন পিতার কাছে জানতে চায় কেন তাঁর স্বামীকে আমন্ত্রণ করা হয়নি, তেমনি এটাও চায় তার স্বামী যেন সেখানে যায়। স্বামীকে বলে-

সতী।। হ্যাঁ তুমি রবাহুতের ন্যায় নয়, ক্ষমাসুন্দর চোখেও নয়, যাবে রণসাজে- রুদ্ররূপে- সংহার মুর্তিতে প্রভু! প্রভু! তারা ভুলে গেছ যে তুমি মহারুদ্র-মহাকাল তারা শুধু মনে রেখেছে তুমি শুধু শুভঙ্কর, ক্ষেমঙ্কর, শঙ্কর তারা ভুলে   গেছে যে মেঘ শুধু করুণার বৃষ্টিধারা বর্ষন করে না- বজ্রও ক্ষেপণ করে হে ভৈরব! হে মহাকাল! হে মহারুদ্র! জাগৃহী! জাগৃহী! জাগৃহী!

মনোমোহন- গিরিশ-মন্মথের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

মনোমোহনের ‘সতী’ চরিত্রে যেমন গিরিশের ‘সতী’র মতো দার্শনিক তত্ত্বের অবতারণ নেই। কিন্তু ‘সতী’কে লৌকিক চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মনোমোহন ও মন্মথ দুজনেই। গিরিশের ‘দক্ষযজ্ঞ’তে ‘সতী’ প্রধান চরিত্রের বিরোধী কিন্তু মন্মথ রায়ের ‘সতী’ নাটকে ‘সতী’ প্রধান চরিত্রের সহযোগী।

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘উমা’  

উমা।।

নাটক– আগমনী

নাট্যকার– গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

প্রথম অভিনয় ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৭

স্থান– গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার

উমা চরিত্রায়ন বিনোদিনী

এটা গিরীশ চন্দ্র ঘোষের প্রথম গীতিনাট্য। ‘মুকুট চরণ মিত্র’ ছদ্মনামে এই নাটক প্রকাশিত হয়। ১৮৭২ সালের ৭ই ডিসেম্বর ন্যাশানাল থিয়েটার নাম দিয়ে সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। গিরিশচন্দ্র ন্যাশানাল শব্দটিকে ব্যাবহারের আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন- ‘দৃশ্যপট, রূপসজ্জা, সাজসজ্জা, আলো প্রক্ষেপণের উপযুক্ত সাজ সরঞ্জামের অভাব নিয়েও টিকিট বিক্রি করে অভিনয় করা ঠিক হবে না। একেইতো বাঙ্গালীর নাম দিয়ে থিয়েটার করলে তারা কী বলবে?’

পাঁচ বছর পর ‘গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার’ হাতে নিয়ে তিনি সর্বাগ্রে ‘গ্রেট’ কথাটা বাদ। রঙ্গালয় পরিচালনার ভার গ্রহন করে তিনি সবার আগে মৌলিক রচনা লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর নাট্য জীবনের জয়যাত্রা শুরু, ‘আগমনী’  নামক এই ছোট্ট গীতিনাট্য দিয়ে । তিন দৃশ্যের এই গীতিনাট্য।

তৃতীয় দৃশ্যে গিরিরাজপুরীতে উমার আগমন-

মেনকা।। মহারাজ, উমা আমাত কৈ? উমা আর তো দশভূজা নয়! তবে কি আমার স্বপ্ন সত্যি হল?

উমা।। মা মা, আমি তো দশভূজা নই, আমিই তোমার উমা

মেনকা।। (রাগিনীঃসাহানা, তাল- যৎ)

ওমা কেমন করে পরের ঘরে ছিলি

উমা বল মা তাই

কত লোকে কত বলে শুনে ভেবে

’রে যাই

মার প্রাণে কি ধৈর্য ধরে, জামাই

নাকি ভিক্ষা করে,

এবার নিয়ে এলে বলব হরে, উমা

আমার ঘরে নাই।।

গৌরী।। (রাগিনীঃসাহানা, তাল- যৎ)

তুমি তো মা ছিলে ভুলে,

আমি পাগল নিয়ে সারা হই

হাসে কাঁদে সদাই ভোলা,

জানে না মা আমা বই।।

ভাং খেয়ে মা সদাই আছে,

থাকতে হয় মা কাছে কাছে,

ভালো মন্দ হয় গো পাছে,

সদাই মনে ভাবি ওই।।

দিতে হয় মা মুখে তুলে,

নয়তো খেতে যায়গো ভুলে,

খেপার দশা ভাবতে গেলে,

আমাতে আর আমি নাই

ভুলিয়ে যখন এলেম ছলে

ও মা ভেসে গেল নয়নজলে,

একলা পাছে যায়গো চলে,

আপন হারা এমন কই?

এই নাটক মঞ্চস্থ হবার চারদিন পরে গিরিশ্চন্দ্রের দ্বিতীয় গীতিনাট্য ‘অকাল-বোধন’ অভিনীত হয়।

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘ভগবতী’ 

ভগবতী

নাটক – অকালবোধন

নাট্যকার– গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

প্রথম অভিনয়৩ অক্টোবর, ১৮৭৭

স্থান গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার

মূল চরিত্র রাম গিরিশ ঘোষ ও ইন্দ্র মহেন্দ্রলাল বসু

মাত্র দুটি দৃশ্যের ছোট্ট গীতিনাট্য এটি। এ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার তিনদিন পর ৬ অক্টোবর দুর্গাপূজার পাঁচ রঙা আগমনি গান ও ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর অনুষ্ঠানই ছিল ‘দি গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটার’-এর ওয়েলফেয়ার নাইট অর্থাৎ শেষ রজনী। এই তারিখ থেকে ভুবনমোহন নিয়োগী গিরিশ ঘোষ কে গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের ইজারা দেন। যদিও এই লেসির ভূমিকা তিনি বেশীদিন ধরে রাখেননি। ভাই কলকাতা হাউকর্টের উকিল অতুল কৃষ্ণ ঘোষের পরামর্শ এবং নির্দেশে শ্যালক দ্বারকানাথ দেবকে হস্তান্তরিত করেছিলেন। এরপর থেকে ভাইয়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকায় আজীবন বেতনভোগী নাট্য-কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন।

দ্বিতীয় দৃশ্যে শ্রীরামের শিবির। দেবীঘট স্থাপীত হয়েছে। মঞ্চে উপস্থিত চরিত্রেরা শ্রীরাম, লক্ষণ, বিভীষণ, সুগ্রীব ও কপিগণ। এরপর হনুমান ‘অষ্টোত্তর-শত নীল পদ্ম’ নিয়ে প্রবেশ। সেই নীলোৎপলাঞ্জলি দিয়ে রামের দেবীবন্দনা, বর লাভের আকাঙ্ক্ষায়। এদিকে পূজাকালে একটি নীলোৎপল কম পড়েছে। হনুমান বলে, গণনায় তার ভুল হয়নি। রামের সন্দেহ হয়।

রাম ।। তবে কী দেবী আমায় প্রতারণা করছেন। মা, অভাগা সন্তানকে আর বিড়ম্বনা করো না। মা গো-

অনেক প্রার্থনার পর অবশেষে ভগবতীর আবির্ভাব।

ভগবতী ।। (হাত ধরে) রঘুনাথ! এত আত্মবিস্মৃত কে? রামচন্দ্র! লক্ষীরূপা জনকনন্দিনীর দুঃখে কে না দুঃখিত? রাক্ষসকুলশেখর দশানন আমার পরম ভক্ত। তথাপি আজ অবধি আজ আমি তাকে পরিত্যাগ করলেম। ঘোর যুদ্ধে দশাননকে পরাজয় করে জানকী সতীকে উদ্ধার করো।

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘কালী’

কালী

নাটক- রাবণ বধ

নাট্যকার- গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

প্রথম অভিনয়- ৩০ জুলাই, ১৮৮১

স্থান- ন্যাশানাল থিয়েটার

কালী চরিত্রায়ন- ক্ষেত্রমণি

নাট্য সিদ্ধান্ত- প্রকৃতবীর মহৎ শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করলেও শেষে অশেষ শান্তিলাভ করেন।

রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিরত হওয়ার জন্য নিকষা ও মন্দোদরীর অনুরোধ অগ্রাহ্য করে রাবণের অবিচল যুদ্ধ সঙ্কল্পের ঘটনা নাট্যায়নের মধ্য দিয়ে এ নাটকের সূত্রপাত। কাহিনীর প্রারম্ভ থেকে পরিণতি পর্যন্ত পাঁচটি অঙ্কের গতিরেখাটি বিশ্লেষণ করলে পর্যায়ক্রমে পাঁচটি সন্ধি লক্ষ্য করা যায়। তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে রাবণের কালীপূজার মাধ্যমে কালীর প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভ নাট্যমুহুর্ত তৈরি করে।

কালীর সহিত যোগিনীগণের গান গাইতে গাইতে প্রবেশ।

(গীত, রাগিণী পাহাড়ী পিলু, তাল খেমটা)

রাঙা জবা কে দিল তোর পায়ে মুঠো মুঠো-

দে না মা সাধ হয়েছে,

পরিয়ে দে না মাথায় দুটো ।।

মা বলে ডাকবো তোরে,

হাততালি দে নাচবো ঘুরে,

দেখে মা নাচবি কত,

আবার বেঁধে দিবি ঝুটো ।।

কালী ।। মাভৈ মাভৈ !

হও রণজয়ী, কি ভয় তোমার আর,

এ তিন ভুবনে আর কার প্রাণে

হবে আগুয়ান রণে তোর,

রক্ষিব সমরে আমি তোরে,

হবে মৃত্যুঞ্জয়ী রণে ক্ষয় আজি-

যদি শূলে পশেন সংগ্রামে;

ত্রৈলোক্য উপর হবি রাজেশ্বর,

পুনঃ রে ভকত মম;

সুখে সীতা লয়ে কর কেলী চিরদিন-

আছি বহুদিন রণরঙ্গ ভুলে, হবে বিশ্বক্ষয়

দিনু বরাভয় তোরে।

পুনঃ রণমাঝে দৈত্য বিনাশিনী সাজে

নাচিব রে তোমারে লইয়া কোলে।

কৃত্তিবাসী সপ্তকাণ্ড রামায়ণে, লঙ্কাকাণ্ড পর্বে ‘রাবণের স্তবে অভয়ার অভয় দান’ শীর্ষক অংশের উল্লেখ এখানে বিশেষভাবে প্রয়োজন।

‘স্তবে তুষ্টা হয়ে মাতা দিল দরশন।

বসিলেন রথে কোলে করিয়া রাবণ।।

আশ্বাস করিয়া কন না করি রোদন।

ভয় নাই ভয় নাই রাজা দশানন।।

আসিয়াছি আমি আর কারে কর ডর?

আপনি যুঝিব যদি আসেন শঙ্কর।।

অমিতবরণা কালী কোলে দশানন।

রূপের ছটায় ঘটা তিমির নাশন।।‘

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘দুর্গা’

দুর্গা

নাটক – রাবণ বধ

নাট্যকার– গিরিশ চন্দ্র ঘোষ

প্রথম অভিনয়- ৩০ জুলাই, ১৮৮১

স্থান-ন্যাশানাল থিয়েটার

দূর্গা চরিত্রায়ণ ক্ষেত্রমণি

‘রাবণ বধ’ নাটকের বিজ্ঞাপন

– ইংলিশম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত

National Theatre

Saturday, 30th july at 9pm

A new play written by

Baboo Girish Chandra Ghosh’s

RABANBADHA & Sitar Agni Poriksha

DOORGAPUJA ON STAGE

স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রথম রজনীর সমালোচনার অংশবিশেষ। -…Much credit is due to the sinic artist Baboo D.D. Soor for Doorga Poojah Scene

একদিকে রাবণের কালী পূজা ও কালীর প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভ, অপর দিকে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজো ও তার কৃপালাভের আশায় রামের দূর্গা বন্দনায় তুষ্ট দেবী বলেন-

দূর্গা ।। ‘কি কর কি কর দয়াময়!

ও হে গোলকবিহারী,

দেখ স্মরি পূর্বের বারতা তব দ্বার

উদ্ধারিতে নিজ দাসে,

অবতীর্ণ হ’য়েছ ভূতলে;

কা পূজা কর তুমি,

কি প্রভেদ তোমায় আমায়

তবে যে পূজা মোরে,

সে কেবল করিতে প্রচার,

আপন মহিমাভাব

প্রমা প্রকৃতি তোমার জানকি;

হেন সাধ্য কিবা ধরে দশানন,

হরিতে তাহারে, রঘুবীর?

অন্নপূর্ণারূপে, নিত্য নিশিযোগে,

ঘুমাইলে চেড়ীদল,

পশিয়া অশোকবনে,

পরমান্নে ভুঞ্জাই সীতায়

ছাড়িনু লঙ্কা, ছাড়িনু রাবণে;

মম বরে নাশ তারে, হে রাবণ-অরি!

দুষ্ট চেড়ীগণে যত মেরেছে সীতায়

হের সে সকল চিহ্ন মম কায়,

আর আমি না পারি সহিতে সে তাড়না

এইভাবে কৃত্তিবাসী সপ্তকাণ্ড রামায়ণে, লঙ্কাকান্ড পর্বে রামের স্তবে ‘রাবণ বধের জন্য দেবীর আদেশ’ শীর্ষক অংশের উল্লেখ এখানে বিশেষভাবে প্রয়োজন

…রামের বচন শুনি বিষাদ হরিষ গণি,

স্তুতিবাক্য কাত্যায়নি কন;-

শুন প্রভু দয়াময়, অখিল ব্রহ্মাণ্ডচয়,

পতি তুমি ব্রহ্ম সনাতন।।

তুমি আদি ভগবান, অখণ্ড কাল সমান

বিশ্ব রহে তব লোমকূপে

তুমি চরাচর গতি, অচ্যুত অব্যয় অতি,

ব্যাপকতা পরমাণু রূপে।।

মায়ার মনুষ্য তুমি, চতুর্ব্বাহু আসি ভুমি,

নাসিতে রাক্ষস দুরাচার

ভব ভাব্য প্রভু হও, কভু কোন ভাবে রও,

শুদ্ধ তত্ব কে জানে তোমার?

তোমার জানকী যিনি, পরম প্রকৃতি তিনি,

রাবণের কি সাধ্য হরিতে?

অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি দশভুজা,

বিধিমতে করিলা বিন্যাস

লোকে জানবার জন্য, আমারে করিতে ধন্য,

অবনীতে করিলা প্রকাশ।।

রাবণে ছারিনু আমি, বিনাশ করহ তুমি, এত বলি হইল অন্তর্ধান

তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনায় ‘শ্রীদুর্গা’

শ্রীদুর্গা

বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত বিরচিত ‘শ্রীদুর্গা’ নাটকটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ-নাটকের নাট্যসিদ্ধান্ত হল ‘তমোগুণে পূর্ণ মানুষের বিনাশ অবশ্যম্ভাবী’। নাটকটিতে চারটি অঙ্ক চোদ্দটি দৃশ্য। চতুর্থ অঙ্কের উপস্থাপিত বিষয়বস্তু হল- দেবতাদের ডাকে সমুদ্ভুতা দশভুজা মহামায়ার অবাধ্য সন্তান ভক্ত মহিষাসুরকে শূল দিয়ে আক্রমণ করে নিজের পদতলে স্থান দেন। এবং পুনর্জন্ম না হওয়ার ও দেবীর সাথে পূজা পাবার বর দেন। গদ্য-পদ্য ও দীর্ঘ ছোট সংলাপ এ নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯২৬ সালের ১ডিসেম্বর মিত্র থিয়েটারে এ নাটকের প্রথম অভিনয়।

পৌরাণিক ভক্তি রসে আশ্রিত নাটকের দর্শক প্রসঙ্গে  

‘পৌরাণিক নাটকের অভিনয় দেখতে যারা যান তাঁদের চিত্তের মধ্যে সাধারণত লৌকিক রসপিপাসা ও অলৌকিক মহিমা উপলব্ধি- এই প্রকার আকাঙ্ক্ষাই বিরাজ করে থাকে। মনে রাখতে হবে নাট্যকার শুধু স্রষ্ঠা নন, তিনি  দর্শকসমাজেরও অন্তর্ভুক্ত বটে। দর্শকদের সংস্কার ও প্রবণতা তার নাটকের রূপায়ণে অনেকখানি সক্রিয় থাকে। ভারতীয় ধর্মাবেগের দিকে লক্ষ্য রেখে অনেক সময় তিনি নিখুঁত নাট্যাদর্শ অপেক্ষা তরল ভক্তি প্রবাহ সৃষ্টির দিকেই অধিকতর মনোযোগ দিয়েছেন। … যেখানে ধর্ম মহিমা পরিস্ফুট সেখানেই তাদের মত পরিতুষ্ট, নাটকের দোষ-ত্রুটি, অসঙ্গতি ও অনৌচিত্য তখন তাদের চোখে আর ধরা পড়ে না’।

–অজিত কুমার ঘোষ

পৌরাণিক রসের স্বরূপ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে

‘রামায়ন-মহাভারতের মধ্যে জীবনের যে মহান, গম্ভীর ও উদাত্ত সুর সমুদ্র তরঙ্গের মতো প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত, যে বিপুল প্রসার, যে বর্বর বীরত্ব সুক্ষ্ম-বুদ্ধিসম্পন্ন-রোমান্টিক জিজ্ঞাসা-নিরপেক্ষ এক উল্লাস ও আর্তনাদ-সঙ্কুল ছন্দে নিত্য তরঙ্গিত তার জটিল আস্বাদকে পৌরানিক রস নামে অভিহিত করা যায়’।

– ডঃ ক্ষেত্র গুপ্ত।

অর্থাৎ এই দুই ব্যাখ্যা থেকে আমরা পৌরাণিক রসের অস্তিত্ব বা গুরুত্ব অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু এই রসাস্বাদনের সাথে ব্যক্তির ধর্মের প্রতি আসক্তি বা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস যুক্ত হয়ে আছে। আর এই লৌকিক আচারের মধ্য দিয়ে অলৌকিক চর্চার দিকটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে, এটা কখনোই অস্বীকার করতে পারিনা।

এই সুত্র ধরে আবার যদি ইতিহাস চর্চায় যাই আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের দিকটিও বুঝে নি। ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে জৈমিনিসুত্রে সেরকম কিছুই প্রকাশ পায়নি। মহর্ষি ব্যাসদেব, মহর্ষি জৈমিনির গুরু ছিলেন। গুরু শিষ্য একস্থানে অবস্থান করে একই সময়ে দুজনে ব্রহ্মসূত্র ও মীমাংসাসূত্র রচনা করেছেন। উভয় সূত্রগ্রন্থ পাঠ করলে উভয়ের অভিমত পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে তাঁদের যুক্তি-প্রতিযুক্তির বিশ্লেষণ ধরা পড়ে।

জৈমিনির বক্তব্যে-

‘ঈশ্বর যদি অবিকারীই হন, তবে তিনি অবশ্যই বিচিত্র জগত-রূপ কার্যার কারণ হতে পারেন না। জগতের সৃষ্টির মধ্যে বৈষম্য দেখা যায় বলে তাকে পক্ষপাতীও বলতে হয়। কাউকে সুখী ও কাইকে দুঃখী দেখতে পাই বলে তাকে নির্দয় বলতে হয়। তিনি কখনোই বৈষম্য ও নৈঘৃণ্য দোষ থেকে মুক্ত থেক্তে পারবেন না। সুতরাং ঈশ্বর কল্পনা অনাবশ্যক।’

যদিও ব্যাসদেব জৈমিমিকে নিরীশ্বরবাদী বলে মানতেন না।

ধর্ম-দর্শন এ-সকলের বাদানুবাদ যতই থাকুক- তাকে কল্পনা করার অভিলাষ মানুষের মূলস্থ। এবং সেই ভাবাবেগের সলিলে নিমজ্জিত হয়ে ভারত তথা বাংলার সংস্কৃতি আজও ইতিহাস আর তার লোকায়ত পরম্পরাকে বহন করে আসছে।

অতএব ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভক্তিমিশ্রিত অর্ঘ ও পূজা নৈবেদ্য অর্পণ করার রীতি-রেওয়াজ আবহমানের। তৎকালীন এরূপ মানষ-কল্পনা ও বিশ্বাস পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের বিজয়রথের দুর্জয় অভিযানে দুলেছে মাত্র অবলুপ্তি হয়নি।

একালের দর্শকের ভক্তিপ্রবণতা

আজও মানুষ দৈব নির্ভর। বাংলার মানুষ এ ব্যাপারে আরো ভাবপ্রবণ। ধর্মবিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার বাতাসে শ্বাসগ্রহণ করে। আর এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই ভারতীয় তথা বাংলার নাট্যচর্চায় পৌরাণিক ধর্মীয় কাহিনীর প্রবেশ বলে যেতে পারে।

অতএব এই চর্চার ধারাবাহিকতা আজও বজায় আছে। পেশাদার নাট্যমঞ্চে যখন এই দূর্গা, কালী, ভগবতী, সতী প্রমুখ দূর্গার নানান রূপের চরিত্রায়ণ হয়েছে এবং বারংবার ক্ষেত্রমণি-বিনোদিনী-রানীবালা প্রমুখের  নাম নাট্য ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে।

এই সকল চরিত্রের অভিনেত্রীদের সামাজিক অবস্থান

তৎকালীন বঙ্গসমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে তাঁদের, থিয়েটারে অভিনয় করে যাওয়ার লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। মেয়েদের নাটকে অভিনয় করা সে-সময় সমাজগ্রাহ্য ছিল না। অবশ্য আজও যে মেয়েদের থিয়েটারে অভিনয় খুব সহজ হয়েছে তা নয়। নিয়তিবাদ, পরলোক  বিশ্বাস, ভবিষ্যৎবাণীর সাফল্য, অভিশাপের অনিবার্যতা, নীতিবোধ প্রভৃতি বিষয় অবলম্বন করে যে নাট্য ইতিহাস গড়ে উঠেছে তা বাংলার নাট্যচর্চায় আগামী প্রজন্মের কাছে এক অপরিহার্য দলিল।

সেদিনের শুরু হওয়া পথচলা আজও বহমান। সময়ের সাথে সাথে নাট্যক্রিয়ার বিবর্তন, সুস্থ সমাজ গঠনে এক স্বাভাবিক ঘটনা। সমসময়ের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের ছায়া না থাকা কাম্য নয়। তাই তুলনামূলক বিশ্লেষণে ঠিক ধরা পড়ে যাবে একজন নাট্যকর্মীর ব্যাক্তিগত অভ্যাস আর তার সংস্কৃতি। জীবনবোধের দিক থেকে ধরা পড়বে তাঁদের মানসিক গঠন ও বৌদ্ধিক চর্চা কি ছিল। আর সেই  অভ্যাসের বহমানতা আমরা আজও বজায় রেখে চলছি, তবে নাট্যের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে প্রায় উপেক্ষা  করেই। এবং যার ফলে সামাজিকভাবে অন্ধ বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে আছি। অথচ নাটকের প্রভাবে সমগ্র জাতির মেরুদণ্ডটা সোজা হয়ে শক্ত হয়ে থাকতে পারতো।

শেষকথা

দূর্গা সংহার করে অন্যায়কারীকে। দূর্গা সহায় হয় দুর্গতদের। দূর্গার স্নেহধন্য আপামর হিন্দু সমাজ। তবু কেন ইতিহাসে দেখতে পেলাম দূর্গারূপীদের অসহায়তা? কে ক্ষেত্রমণিকে প্রতিমার বাস্তবানুরূপ প্রকাশের স্বার্থে নিজেকে দেহের থেকে বেশী ওজনের কৃত্তিম অঙ্গ নিয়ে আধ ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়! অথচ আজও ক্ষেত্রমণিকে বাংলার নটী বলে ক’জন চিনি! ক্ষেত্রমণি আজও আছে। আজও তারা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সত্বেও সেভাবেই বেঁচে আছে। কেউ সেই দুর্গতি দূর করেনি। কেউ না।

তথ্য সুত্রের ঋণস্বীকার

বাংলা থিয়েটারে ভক্তিমূলক নাটক, ডঃ নবকুমার সরকার

নাট্য গ্রন্থাবলী, মন্মথ রায়, ষষ্ঠ খণ্ড

গিরীশ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড- সম্পাদনা দেবনারায়ণ গুপ্ত।

বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস। ডঃ অজিত কুমার ঘোষ

বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক, পুলিন দাস

বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদান, শঙ্কর ভট্টাচার্য

অথ নট-ঘটিত- সূত্রধার

নাটকের কথা, অজিত কুমার ঘোষ

কৃত্তিবাসী সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, সম্পাদনা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। 

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -