বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ১৭
অভিনয়ের নেশা যাকে আঁকড়ে ধরে, তাকে সহজে ছাড়ে না। এমনই দৃষ্টান্ত জলপাইগুড়ি পান্দাপাড়ার ১২ নম্বর লেনের ঈশানী দত্ত। অবশ্য অভিনয়ের একটা বিশেষ ধারাকে সে বেছে নিয়েছে এজন্য। শুধু বেছে নিয়েছে বলার চেয়ে বলা ভাল, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে। সেই ধারাটি হল মূকাভিনয়। সে মনে করে, অভিনয়ের এই ধারাটি অবশ্যই নাট্যকলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিছু না বলেও যে অনেক কথা বলা যায়, তা একমাত্র মূকাভিনয়েই সম্ভব বলে তার ধারণা। মূক হয়েও মুখর – এই শিল্পের এটাই মন্ত্র তার কাছে।
আর পাঁচজনের মতই ভাল লাগার শিল্প হিসাবে সে অভিনয়ে এসেছিল। ক্রমে তা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতে এখন পেশা হিসাবে নেওয়ার ইচ্ছাও লালন করে চলেছে ঈশানী।
ঈশানীর বাবা সব্যসাচী দত্ত এবং মা রুমা দত্ত ঈশানীকে এক্ষেত্রে সবসময় যথেষ্ট অনুপ্রেরণা ও উৎসাহ দিয়ে থাকে। এটাই ঈশানীর কাছে সবচেয়ে সহায়ক। আসলে ঈশানীর ঘরেই তো মূকাভিনয়ের সূতিকাগৃহ। ঈশানীর বাবা সব্যসাচী দত্ত জলপাইগুড়ি সৃষ্টি মাইম থিয়েটারের পরিচালক, প্রশিক্ষক। বলা বাহুল্য, সৃষ্টি মাইম থিয়েটার দীর্ঘকাল জলপাইগুড়ি সহ উত্তরবঙ্গে মূকাভিনয় চর্চায় উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছে। তাই মূকাভিনয় থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি ঈশানী।বাবার উৎসাহেই সৃষ্টি মাইম থিয়েটারের হয়ে তার প্রথম মঞ্চাবতরণ। ঈশানীর অভিনীত প্রথম পরিবেশনা : গোসানী মঙ্গল। যা আশা জাগিয়েছিল দর্শকদের মনে। তারপর থেকে আর থমকে দাঁড়ায়নি সে। লেখাপড়ার পাশাপাশি চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। আপাতত সৃষ্টি মাইম থিয়েটার এবং দমদম মাইম এমবডির সঙ্গে চর্চায় নিযুক্ত।
সুনীতিবালা সদর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সীমানা ডিঙিয়ে এখন ঈশানী কলেজ পড়ুয়া। কিন্তু পাশাপাশি অভিনয়চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। কারণ, এখন তার মনে হয়, এই অভিনয়কলার সঙ্গেই সে নিজেকে জড়িয়ে রাখবে।প্রয়োজনে পেশা হিসাবে ঝুঁকি নিতেও নিজেকে প্রস্তুত করছে। এ পর্যন্ত এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকার সূত্রে যে (কয়েকটি কাজ করেছে, তার মধ্যে “বিপন্ন পৃথিবী” তার অন্যতম প্রিয় ও প্রশংসিত পরিবেশনা। এক সাক্ষাৎকারে ঈশানী জানিয়েছে, বিপন্ন পৃথিবীতে মূলত পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কথা ব্যক্ত হয়েছে। আর সেটাতে সে কেন্দ্রীয় চরিত্র “প্রকৃতি” হয়ে মঞ্চে অবতরণ করে। এই প্রকৃতি চরিত্রটিই তার এ পর্যন্ত প্রিয় চরিত্র। কারণ হিসাবে সে জানিয়েছে, এই চরিত্রের মাধ্যমে এক শিক্ষামূলক বার্তা সে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে। প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে পারছে। এছাড়াও নিজের স্কুল সুনীতিবালা বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা মৌসুমী মজুমদারের পরিচালনায় “বিবেকানন্দ” নাটকে চামার চরিত্রটিও তার কাছে অন্যতম স্মরণীয় চরিত্র।
বেশ কিছু বছর অভিনয়কলার সাথে যুক্ত থাকলেও থিয়েটার জগৎটা তার পুরোপুরি চেনা হয়ে ওঠেনি বলে সে জানিয়েছে। তবে এটা অনুভব করেছে যে, থিয়েটার করতে হলে লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করে সততার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। কারণ থিয়েটার করা খুব সহজ মনে হলেও ততটা সহজ নয়। নিত্যদিনের অভ্যাস, চর্চা, অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করতে হয়। আর এর মধ্যে দিয়েই ভাল – মন্দ চেনা যায়। মন্দকে এড়িয়ে ভালর সাথে হাত মেলাতে পারলেই থিয়েটার জগতে ভালভাবে থাকা যায় বলে সে মনে করে। তার মা- বাবা তাকে প্রতি মুহূর্তে সাহস দিয়ে থাকেন।সচেতনও করেন।
অভিনয়ের সাথে যুক্ত থাকতে থাকতে অভিনয়কে পেশা হিসাবে নিতে চাইলেও থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়?… এ প্রশ্নের উত্তরে ঈশানী জানিয়েছে, শুধু থিয়েটার করে বাঁচা অবশ্যই একটি কঠিন লড়াই। তবু অনেকেই এ লড়াইটা লড়ছে। কিন্তু কখনো কখনো তার মনে হয়, থিয়েটার করে বাঁচা যদিও কঠিন তবু এই শিল্প মন ও মগজকে পুষ্ট করে। শুধুমাত্র সেইজন্য থিয়েটারকে আজীবন জড়িয়ে রাখা যায় বেঁচে থাকার জন্য। ঈশানী আশাবাদী। তাই সে বিশ্বাস করে, থিয়েটারশিল্প একদিন নিশ্চয়ই থিয়েটারশিল্পীদের কাছে ভালভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো দিতে পারবে।
এ পর্যন্ত ঈশানী দত্তরায় পরিবেশিত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলি হল : গোসানি মঙ্গল, কাকতাড়ুয়া, বিপন্ন পৃথিবী, The peace, The stone, Oh! Corona, ফাঁদ, বিবেকানন্দ
উত্তরবঙ্গ থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র অবশ্যই। আর সেখানেই বহু ছেলেমেয়ে থিয়েটারচর্চার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তাই ঈশানীও আশাবাদী, অভিনয়কলার সাথে সে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না।