puppetry: পুতুল নাটকের সাতকাহন

- Advertisement -

ড: শুভ জোয়ারদার

খেলনা হিসাবে যেহেতু সেই আদ্যিকাল থেকেই, যীশুখ্রীষ্টের জন্মের আগে, সেই মহেঞ্জোদারোকাল (Mohenjo Daro) থেকেই পুতুলের ব্যবহার প্রচলিত। আর পুতুল (puppetry) মানেই সেটা ছোটদের ব্যাপার- এমনটাই মনে করা হয়। এই ধারনা থেকেই পুতুলনাচ বা Puppetry শিশু বিষয়ক উপকরণ বলে মনে করা হয়। কিন্তু বস্তুত ব্যাপারটা কি তাই? এই বিষয়ে সঠিক তথ্য জানবার জন্য চলো আমরা একটু ইতিহাসের পাতায় নজর রাখি।  

ইতিহাসে পুতুল নাটকের কথা

ইতিহাসবিদদের অনুমান, পুতুল আসলে কৃষি সভ্যতার বাই প্রডাক্ট। পৃথিবীতে চাষবাসে আবিস্কার যেহেতু কম করে দশ হাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন আর মূলত মেয়েদের আবিস্কার, তাই তাঁরা মনে করেন, প্রাচীনকালে মানে কৃষির আবিস্কারের কালে কৃষির অনিবার্য উপকরণ জল ও মাটি নিয়ে খেলতে খেলতেই নারীরা আবিস্কার করেন মাটির পুতুল।

হতেপারে কৃষি কর্মে ব্যাস্ত মায়েরা আপন সন্তানদের ভুলিয়ে রাখতেই একদা খেলনা হিসাবে পুতুল আবিস্কার করেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁদের স্বামী বা পুত্রদের হাতে উঠে হয়তো সেই পুতুল সচল হয়।

পুতুলনাচ বা নাটক কেন সৃষ্টি হয়েছিল?

শুরুতে পুতুল নাচ বা নাটক নয়, শুধুমাত্র শরীর নাড়াচাড়া করেই খেলা দেখাতো, যা ‘পোতলা বাজি’ বলেই বিখ্যাত ছিল। আর শুরুর দিকে পুতুল কিন্তু বালখিল্য বা শিশুদের খেলার উপকরণ ছিল না। ছিল বয়স্কদের বিনোদনের বিষয়।

পরে অবশ্য তা শিশুযোগ্য বিনোদনে পরিণত হয়। কারন সকলেই জানে যে শিশু আর পুতুলরা জন্মসূত্রেই প্রায় এক সূত্রে বাঁধা। তবে আজকে শুধু ছোটদের মনোরঞ্জন নয়, পুতুল আজ বিজ্ঞানে , বিপননে, বিনোদনে সর্বত্র। বিদেশে শিশুশিক্ষায়, প্রচার বিপননে, মহাকাশ বিজ্ঞানে, চিকিৎসা শাস্ত্রে, কম্পিউটার চালিত রোবটপুতুলদের নিয়মিত কাজে লাগানো হয়। যার মানে হলো, পুতুল.শিল্পটি আর শুধুমাত্র বিনোদনে আটকে নেই, মনকে আনন্দ দেওয়া ছাড়াও সে মানুষের আরও অনেক দরকারী কাজে সার্ভিস দিতে শুরু করেছে। তবে এটা ঠিক, এই সব বহুবিধ ব্যতিক্রমী কাজে তাঁদের  সাধারণত দেখতে পা|ওয়া যাচ্ছে এদেশে না, মূলত বিদেশে বা ইউরোপে। চলো বিদেশের পুতুলনাচ ও পাপেট নিয়ে অতঃপর তোমাদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করি।

বিদেশে পুতুল নাচ চর্চার শুরু কবে ও কীভাবে?   

ইউরোপে পুতুলনাচের শুরুয়াত হয় আজ থেকে কমবেশী পাঁচ হাজার বছর আগে গ্রিস দেশে। প্রথমে মনে করা হত, মিশর বা ইজিপ্ট থেকেই তা গ্রিসে রপ্তানী হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে মিশরীয় পন্ডিতরা স্বীকার করেন যে তারা এই পুতুল শিল্পটিকে আরো নানা বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার সঙ্গে পূর্ব ভারত থেকেই পেয়েছিলেন।

পুতুলনাচের ইতিহাস মূল নাট্যকলার ইতিহাসের সমকালীন। খ্রীষ্ট্রপুর্ব পঞ্চম শতাব্দীর ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (Herodotas) বলেছেন, মিশরে তৎকালে ধর্মীয় মিছিলগুলিতে দেবতার ডামি হিসাবে পুতুল ব্যবহার করা হত।

রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীরাও তাদের কৃষি উৎসবে কাজে লাগাতো এই পুতুলকে। পূর্ব এশিয়াতে ব্যবহৃত হয় ছায়াপুতুল ধর্মীয় পালা পার্বনে। ইউরোপ আর ইজিপ্টের পন্ডিতরা বলেছেন যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস জাগানোর জন্য, দেবতার বিকল্পে পুতুলদের নাড়াচাড়া বা ম্যানিপুলেশন করানো হত।

অনুরূপভাবে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর জন্য বহুবার দেশে বিদেশে পুতুলদের কাজে লাগানো হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে। ইউরোপের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে সে দেশে পঞ্চম শতকের আগে থেকেই পুতুল নাচের প্রচলন ছিল। ক্ল্যাসিকাল সময়ের শেষভাগে এথেন্সে ‘ডায়োনিসাস’ (Dionisius) নামে ছিল বিখ্যাত এক সুতো পুতুলনাচের বাজিগর।

কিধরনের পুতুল নাচের ভাবনা ছিল সেই সময়ে?
জার্মানীর প্রাচীন পুঁথি ঘেটে জানা যায় ১১৭৫ সালেই সে দেশে পুতুল নাচের প্রচলন ছিল। তবে সেই পুতুলগুলি ছিল ‘দস্তানা’ বা হাতপুতুল (Glove Puppet)

পরবর্তীকালে যুদ্ধের পরে শুরু হয় সুতোপুতুল বা (marionette) পুতুলদের আনাগোনা। একটি নথি থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে জার্মানীর বড় বড় শহরগুলিতে পুতুল নাচ দেখানোর জন্য প্রায় চার হাজারের মতো দল ছিল।

আরও বেশ কিছু পেশাদারী গোষ্ঠী ছিল যারা অনুমতি পেয়েছিল অপেক্ষাকৃত ছোট শহর বা গ্রামাঞ্চলে অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য।

জার্মানীদের পুতুলনাচ বরাবরই ধ্রুপদী ঘরাণার। ফলে সেটা অচিরেই সীমান্ত পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী মুরাভিয়া বা সুইডেনে প্রসারলাভ করেছিল। জার্মানদের পুতুলনাচের বিখ্যাত চরিত্র হেমারলেইন ডেনমার্কে গিয়ে অবলীলায় মি: ম্যাক্স হয়ে গেল। জার্মান পুতুলনাচের প্রভাব পড়েছিল রাশিয়াতেও।

রাশিয়ান পুতুলনাচের প্রেত্রঙ্গ চরিত্রটি অনিবার্যভাবে জার্মান প্রভাবিত। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে আরোও বড় সত্যি রাশিয়ার পুতুল নাচের আদি উৎস টি কিন্তু এসেছিল বাইজেনস্টাইন দেশ থেকে।

পুতুল শিল্পের প্রকারভেদ ও জনপ্রিয়তার কারণ 
ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশেই পুতুলনাচ বা পাপেট্রি শিল্পের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে শিল্পটি। নানা ফর্মে আর নানান আঙ্গিকে। কখনও সুতোপুতুল, কখনও লাঠিপুতুল, তো কখনও বা দস্তানা পুতুলের ছন্দে।

 মধ্যযুগে ইতালীতে রেঁনেসা যুগে প্রচলিত হয় ‘পুলসিনেলো’ (Pulcinella) নামে এক ধরনের সুতো চালিত পুতুলের। সেই সুতো পুতুল বা ম্যারিওনেট যখন ফ্রান্সে এলো তখন তার নাম হয়ে গেল ‘পলসিনেশ’।   

এভাবেই একদিন তা চলে আসে ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ভাঁড় বা মজার চরিত্র ‘পাঞ্চ’কে (Punch) কে না চেনে। আর এই জনপ্রিয়তম চরত্রটিকে পাওয়া যায় পৃথিবীর প্রায় সব দেশে। অবশ্যি নানান নামে।  

জার্মানী আর সুইডেনে তাকে ডাকা হয় ‘কাসপার’

(Casper)।  ইংল্যান্ডে সে বিখ্যাত ‘ইয়ান ক্লাসেন’ নামে। রোমানিয়া ও হাঙ্গেরীতে তাকে ডাকা হয় ‘ ‘ভাসিলচে’ নামে।
চীন দেশে পুতুলনাচের উদ্ভব হয় হানযুগে বা খ্রীষ্টপূর্ব ২০৬ থেকে ২২০ সালে ছায়া পুতুলের মাধ্যমে। জাপানে পুতুলনাচ শুরু হয় মোটামুটিভাবে পাঁচ হাজার বছর আগে ‘জোমোন’ সময়কালে।

 পাপেট নিয়ে জাপানের কর্মকান্ডটি মূলত নবান্ন উৎসবের হাত ধরে, যা কি না ছিল কৃষি নির্ভর।

আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও পুতুল নাট্যের ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। আমাদের দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাদা বা সুন্দরবন অঞ্চলে কাঠিপুতুল বা দণ্ড ঘরানাটি খুবই প্রাচীন। স্থানীয় কথ্য ভাষায় একে বলা হয় ‘ডাং’ এর পুতুল।

পন্ডিতরা মনে করেন যে সম্রাট অশোকের কালে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারের মাধ্যমে সাম্রাজ্য প্রসারকালে এই ডাং পুতুল পালতোলা জাহাজে একদা তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে সুদূর ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলংকা হয়ে মিশর ও গ্রীসে পাড়ি দিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার ‘ওয়াং গোলাক’ আর দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডাং পুতুল যে একই ঘরানার অভিন্ন পুতুল নাচ তাতে পন্ডিতদের মধ্যে কোনও দ্বিধা নেই।

নানা দেশের পুতুল নাটকের তুলনামূলক পর্যালোচনা
দেশ বিদেশের পুতুলনাচের উৎস  ইতিহাস, ঘরানা তাদের কালক্রম নিয়ে এইসব সত্যি কথা ও গল্পগুজুব শুনে বেশ কিছু কথা অন্তত তোমাদের পরিস্কার হয়েছে। সেটা হল পুতুল নাচ কিন্তু এক রকমের নয়, তার নানান ধরন, তৈরি আর চালানোর নানা পদ্ধতি। আর পৃথিবীর নানা দেশে তাদের নানান নাম।

তবে নাম যাই হোক না কেন, কাজে তারা এক এবং অভিন্ন। নাচে গানে সংলাপে, চেতনে-অবচেতনে মানুষকে অনুক্ষণ অনাবিল আনন্দ দিয়ে চলেছে। সেই প্রায় প্রাগৈতিহাসিক জন্ম মুহুর্ত থেকে।

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জানা গেছে যে, এশিয়াতে ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাঢ়বঙ্গদেশে আর্যরা এদেশে অভিযান চালাবার আরো আগে প্রায় মহেঞ্জোদাড়োকালীন যুগে প্রাচীন পুতুলবাজির জন্ম হলেও আজ নাম নিজ জন্মভূমিতেই নানা ধরণের পুতুলনাচ যথেষ্ট উপেক্ষিত, সংস্কৃতির মূল স্রোত থেকে বেশ খানিকটা অপসারিত।

 বিশেষজ্ঞরা হয়ত এর পিছনে বৈজ্ঞানিক কারণগুলি খুঁজে, তার প্রতিকারের উপায় বাতলাবেন কোনোও একদিন। ততক্ষণে চলো আমরা একটু চোখ বুলিয়ে নিই যেখানে পুতুলনাচ শিল্পটা বেশ মহা সমারোহে লালিতপালিত হচ্ছে সেই ইউরোপে ও সমৃদ্ধশালী দেশগুলিতে।

পুতুলনাটকের জনপ্রিয়তা ও ভারতের সাথে অন্যান্য দেশের তুলনামূলক বিচার
তোমাদের যেমন নানারকম  মুখরোচক খাবারের দিকে দারুন চাহিদা সেই রকম সব দেশের মানুষও তাদের মনের খিদে মেটায় নানা মনোমুগদ্ধকর সংস্কৃতি আস্বাদন করে।

সেইকারণের পুতুল না পৃথিবীর সব দেশে সব কালে সমান জনপ্রিয়। তোমরা জিজ্ঞাসা করতেই পারো তাহলে শিল্পটা এদেশে কেনইবা উপেক্ষিত আর কেনইবা বিদেশে জনপ্রিয়?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পুতুলনাচ এদেশে অদ্যাবধি লোকসংস্কৃতির একটা শাখা ও ধারা মাত্র। অন্যদিকে বিদেশে তা মূল শিল্পধারার অনিবার্য অংশ।

একটু নজর করে দেখলেই বেরুবে আমাদের দেশে পুতুলনাচ দেখেন ও চর্চা করেন যারা তারা আসলে গ্রামীন, স্বল্প শিক্ষিত অনুন্নত মানুষজন।

অন্যদিকে বিদেশে শিক্ষিত অভিজাত বা সব ধরণের মানুষরাই পুতুলনাচের পৃষ্ঠপোষনকারী। বিদেশে প্রতিটি স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুতুলনাট্যের পাঠ্যক্রমে শিক্ষা দেওয়া হয়। একটা পুতুল নাট্যের দলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন অসংখ শিক্ষিত মানুষ ও গবেষকরা।

সে দেশের পেশাদারী জগতেও জনপ্রিয় এই শিল্পটি। লক্ষ্য কোটী ডলার প্রতিদিন লগ্নী করা হয় পুতুলনাচের বাণিজ্যকরণে। আমরা যেখানে শিল্পটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সংকটের সাথে লড়াই করছি সেখানে বিদেশে শিল্প আর শিল্পীরা তো বহাল তবিয়তে আছেনই সেই সঙ্গে তাদের সহযোগিতায় নিত্য নতুন উপায়ে বিকাশ ঘটানো হচ্ছে মানব সভ্যতার। জাপান থেকে জার্মানী, সুইডেন,  রাশিয়া, ফ্রান্স, মার্কিনদেশে সর্বত্র একই ছবি। ঐ সব দেশের প্রতিটি ছোটবড় শহরেই একাধিক পুতুলনাটক বা পাপেট থিয়েটারের মঞ্চ। যদিও আমাদের ভারতবর্ষে কোনো শহরেই অদ্যাবধি পুতুলনাটকের সব রকম আঙ্গিকের অভিনয়যোগ্য একটি হলও নেই। 

 বিদেশের এক একটি পাশাদারী পুতুল নাচের দলগুলির নেপথ্যে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলে, তা এদেশের যে কোনও একটা  ছোটখাটো কারখানার থেকেও বিশাল। স্টুডিও, সেট, রেকর্ডিং, কম্পিউটার আর দিনরাতের মহলায় সেই সব স্থানের, সেই সব দেশে সততই চলে সংস্কৃতি নির্মানের হাতেকলমে প্রয়োগচর্চা।

যার নির্যাসে তৈরি  হয় বড় বর স্টেজ প্রোডাকশন কিংবা থ্রি-ডি এনিমেশন ফিল্ম। অনেকে মনে করেন সিনেমা টেলিভিশন স্মার্টফোন ইন্টারনেটের ফলে পুতুলশিল্পটি ক্রমশ মুমুর্ষ হচ্ছে।

 আপাতদৃষ্টিতে কথাটির মধ্যে সত্য থাকলেও প্রকৃত সত্য উঠে এসেছে সমাজ বিজ্ঞানীদের গভীর নজরদারিতে। তারা বলেন, নতুন প্রযুক্তির ফলে সনাতন শিল্প আপাতভাবে একটু বিব্রত হলেও, সেই প্রযুক্তির সহযোগিতাতেই সনাতন সিল্প ফের ঘুরে দাঁড়াতে সমর্থ।

উদাহরণে তারা বলেন মুদ্রণ বা ছাপাই শিল্পের কথা। ডিটিপি আবিস্কারের ফলে প্রাচীন ধাতু নির্মিত অক্ষর শিল্প উঠে গেলেও, বাজারে সফট কপির বাড়বাড়ন্ত যুগেও, কাগজে ছাপা বা হার্ডকপি কিন্তু অব্যাহত।  

ঠিক তেমনি যে পরম্পরা বা ট্রাডিশনাল দলগুলির পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের আপডেট করেছে। তারাই কিন্তু শেষ অবধি বাজারে থিতু বা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং পুতুলনাচ উঠে যাচ্ছে বলে যারা হা হুতাশ করছেন, তার শিল্পটির কল্যানকামী হলেও আগামী দিনের সবটা হয়তো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন না।

যার ফলে এটা সত্যি প্রাচীন পুতুলনাচ শিল্পটি আজ নব্য প্রযুক্তির প্রয়োগে বিজ্ঞানের যাদু ছোঁয়াতে নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে মানুষের সামনে। এত রকমের যে পুতুলনাচ, তার মধ্যে যেমন মিল আছে, তেমনি অমিলও প্রচুর।

তবে পৃথিবীর সর্বত্র সব পুতুলের সৃষ্টি কিন্তু শিল্পীদের হাতেই। শিল্পী মানে এখানে ছবি আঁকিয়ে বা চিত্রকরদের কথা বলছি। দেশে বিদেশে যত পুতুলনাট্য পরিচালক হয়েছেন, প্রত্যেকেই বড় বড় সব সফল চিত্রশিল্পী।

বাংলার পুতুল নাট্যের মহান কারিগর।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত পুতুল পরিচালক মোস্তাফা মনয়ার বা কলকাতার পাপেট ডিরেক্টর পদ্মশ্রী সুরেশ দত্ত- দুজনেই বিখ্যাত পেইন্টার। তোমরা যারা পুতুল নাচে আগ্রহী, তাদের বলি, শুধু ছবি নয় পুতুল বানাতে লাগে প্রায় সমস্ত শিল্পশাখার নানা কলাকৌশল।

 সাহিত্য, সঙ্গীত, অভিনয়, চারুকলা, কারুকলা, আলো, সেট, পরিচালনা সব মিশিয়ে সে একটা জবরদস্ত প্যাকেজ। এই সব প্রত্যেক শিল্পচর্চাকে আলাদা আলাদাভাবে জেনে বুঝে মিলিয়ে তবেই সার্থক একটা পুতুলনাটক নির্মান সম্ভব।

অর্থাৎ একটা পুতুল যখন নেচে গেয়ে সংলাপে বা তলোয়ার ঘুরিয়ে আসর মাতায় , তখন তার পিছনে যে বহু মানুষের শ্রম নিষ্ঠা অনুশীলনের মেলবন্ধন একত্রিত হবে- এটা বঝা জরুরি।আর একটা লক্ষ্য করারা ব্যাপার আছে, বিশেষ করে পৃথিবীর প্রাচীন পুতুলনাচে।

সেটা হলো, একটু মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে পৃথিবীর সমুদ্রতটবর্তী দেশগুলিতেই বিশেষ করে তার বন্দর জনপদ ঘিরেই পুতুল চর্চার বিকাশ ঘটেছিল। বলো তো দেখি নিজ নিজ সাধারণ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ঠিক এমনটা কেন?

এর উত্তরে বলা যায়, যে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে, যখন বাষ্পীয় জাহাজেরা জলযান হিসাবে মহাসমুদ্রগুলিতে দাপাতে .শুরু করেনি, তার আগেই মূলত দক্ষিণ এশিয়ার বন্দরগুলি থেকে ইউরোপের প্রাচীন নগরগুলির সঙ্গে জলপথে, পাল তোলা জাহাজে বাণিজ্যা যোগাযোগ হতো।

মানুষের সঙ্গে তার সংস্কৃতিও দেশান্তরে যাতায়াত করে বলে, এইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার পুতুলনাচ প্রথমে গ্রীসে, পরে পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। আসলে জলপথই ছিল সে যুগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াতের একমাত্র পথ। কাজেই মহাদেশের বন্দর সংলগ্ন জনপদেই যে সেই সময়ের শিল্পকলা জনপ্রিয় হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

পুতুল নাটকে আগামীকে লেখকের আহবান।  

তোমরা যারা এতক্ষণ ধরে এই নিবন্ধটির সার সংক্ষেপ গ্রহণ করছো, তাদের জন্য অতঃপর সরাসরি কিছু ইতিবাচক কথা বলি। প্রশ্ন হল, সেই ঐতিহাসিক কালের জন্মমুহুর্ত থেকে পুতুলনাট্য শিল্পটি মানুষের এতো উপকার করলেও বাস্তব তথ্যটি হল, এদেশের মানুষ কিন্তু তার প্রতি বেশ কিছুটা অবিবেচনার কাজ  করেছে।

শিল্প ও বিনোদনের কথা পরে হবে। আগে হোক বিজ্ঞানের কথা।  বিজ্ঞানীরা বলছেন, পুতুলের এখনও অনেককিছু দেওয়ার মানুষকে।

তাই তাকে সমাজের কাজে ফিরিয়ে আনাটা জরুরী। আর তোমরা যারা এই যুগের বিজ্ঞান মনস্ক তরুণ তরুণী, তাদেরকে আমাদের অনুরোধ, এসো সময়ের প্রয়োজনে বিদেশের মতো সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে মানবকল্যানের স্বার্থে পুতুল নাট্যকলা অথবা পাপেট্রিকে পুনরাবিষ্কার করি।

বহুদিনের অনাদরের আর বিস্মৃতির ধুলো জমেছে আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপকরণের শরীরে। এসো সেই ধুলো আদর করে অপসারিত করে তাকে ফের ব্যবহারের উপযুক্ত করে তুলি।

তোমরা যদি পুতুলদের এইটুকু দাও , পুতুলও তোমাদের তার প্রতিদানে বেশ কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই কথাগুলিই একটু সতথ্যে তুলে ধরতে চাই।

ভবিষ্যৎ এ শিক্ষার্থীদের পেশা করার কিছু টিপস।

তোমাদের মতো ছাত্রাবস্থা থেকেই প্রয়োজনীয় বিষয়ে  কৌতুহলীদের জন্য ভারত সরকারের সংস্কৃতি দপ্তরের অধীনে আছে ‘সি সি আর টি’ বলে একটি সংস্থা। এরা স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের পুতুলনাচ শেখার জন্য পঞ্চম শ্রেণী থেকে বারো ক্লাস অবধি বৃত্তি দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তোমাদের একজন গুরুকে নির্বাচন করতে হবে, যিনি তোমাদের শিল্পকর্মটি শেখাতে সম্মত।তাকে রাজি করিয়ে কাগজপত্র পাঠালেই সি সি আর টি মাস প্রতি হিসাবে একটা টাকা বারো ক্লাস পাশ করা অবধি তোমাদের নিশ্চিতভাবে প্রতিবছরই পাঠাবে। এর পরে আছে জুনিয়র আর্টিষ্ট, ফেলোশিপ ইত্যাদি নানা স্কলারশিপ।

অর্থাৎ শুধুমাত্র মজা বিনোদন নয়, রুটিরুজি, পাঠক্রম, প্রশিক্ষণ- এইসব ব্যাপারেও অন্যান্য পেশার মতো পুতুলনাচের পেশাদারী শিক্ষার ব্যাবস্থা আছে। তোমরা আগ্রহী হলে অবলীলায় এইসব সুযোগ সুবিধাকে নিজেদের পরিকল্পনামতো জীবনে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবহার করতে পারো।

আর একটা প্রয়োজনীয় বিষয় হল ওয়ার্কশপ বা কর্মশালার প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করে তাতে অংশগ্রহণ করা। রাজ্যে বেশ কিছু উন্নত গুণমানের পুতুল নাট্য গোষ্ঠী আছে। তাদের দিয়ে স্কুলে, কলেজে বা সমাজ সংগঠনগুলোতে কর্মশালার ব্যবস্থা করে, সপ্তাহব্যাপী ঐসব কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষকদের কাছে পুতুলবানানো এবং চালান বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষার পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

এ সবেরই ব্যবস্থা আছে, তবে তার আগে জানতে হবে তোমরা কি চাও? শিল্প আর শিল্পীদের উদ্ধারের নামে এক নতুন বিজ্ঞানে নিজেদের লেখাপরা শেখার সঙ্গে সঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চাও? নাকি তোমাদের বা শিল্পটির মধ্যে নিখুত সম্ভাবনা থাকা সত্বেও বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চাও?

মনে রেখো, তোমাদের মত সম্ভাবনাময় তরুণ ছাত্রছাত্রীদের বলছি। তোমাদের হারাবার কিছুই নেই। অন্যদিকে জয় করার জন্য আছে বিপুল একটি বর্ণময় সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের মালিক বা পরিকল্পক এবং নিয়ন্ত্রক তোমরা নিজেরাই!     

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -