সুব্রত কাঞ্জিলাল
ধারাবাহিক- পর্ব- ১
অনেকে বলে দামাল যুবক। কেউ কেউ বলে একেবারে শিশুর মত মন। দুরন্ত আবেগপ্রবণ। আবার কেউ কেউ বলে রগচটা। একেবারে বেয়ারা ধরনের। তবে খুব কাছ থেকে দরদী মন নিয়ে বেশ কিছুদিন যারা লক্ষ্য করেছেন তাকে তারা বলেন, এই সব কিছু নিয়েই তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ।
মৃত্যুর পর থেকে তাকে নিয়ে যে খুব চর্চা হয়েছে তা নয়। যতদিন বেঁচে ছিলেন, সৃষ্টিশীল ছিলেন, বেশিরভাগ সমালোচক, এদেশের বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ডানপন্থী দক্ষিণপন্থী মধ্যপন্থী প্রায় সবাই এই মানুষটাকে তার কাজের জন্য সহানুভূতি দেখান নি। নানাভাবে আক্রমণ করেছেন। সমসাময়িক অন্য চলচ্চিত্রকারদের যতটা স্পেস দেওয়া হয়েছিল তার ১০ শতাংশও এই মানুষটার ভাগ্যে জোটে নি। তারপর অর্থাৎ দীর্ঘদিন কর্মহীন অবস্থায় থাকবার পর প্রায় অকালে চলে যাবার মুহূর্তেও তার প্রতি কোনো রকম মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়নি। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় একটা কুৎসিত কার্টুন বেরিয়েছিল। যেখানে দেখা যাচ্ছে তার শেষ ছবির পর্দায় যেমন তিনি মাতাল হয়ে ভূমিসজ্জা নিয়েছেন, সিনেমা হলের দর্শক আসনের নিচেও ওই একই ভাবে মানুষটিকে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
চরম বামপন্থীরা তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলতো, লোকটা কনফিউজড ইন্টেলেকচুয়াল। মধ্যপন্থী বামপন্থীদের একটা অংশ তাকে বলতেন, লোকটার শিল্পকর্মগুলো হলো যান্ত্রিক বস্তুবাদী। দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে কেউ লোকটাকে সহ্য করতে পারত না। তবে বোম্বের সিনেমা জগতে তার মর্যাদা ছিল। বিমল রায়ের ডাকে তিনি কিছুদিন মুম্বাইতে কাজ করতে পেরেছিলেন। কাজ মানে গল্প লেখা চিত্রনাট্য লেখা।
পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। তবে তিনি পুনার ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ব্যাপারে সরকারি পরিকল্পনা এবং কাজে অসন্তুষ্ট ছিলেন। ছাত্রদের নিয়ে সে সময় তাঁর দিনগুলো বেশ সুখের হয়েছিল। শোনা যায় পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের অন্য শিক্ষকদের মত তিনি প্রটোকল মেনে চলতেন না। বন্ধুর মতো ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন।
চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর মানুষটার বিরুদ্ধে মিহিন মধ্যবিত্ত বন্ধু না হলে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। তারা বলতেন, লোকটা আত্মঘাতী। ব্যক্তিগত জীবনে বিশৃংখল। অসম্ভব কল্পনা প্রবণ, অস্থির মানসিকতার স্বীকার। তার জন্মশতবর্ষে আমরা প্রশ্ন তুলতেই পারি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত তিনিও কি মধ্যবিত্ত সমাজের মডেল ছিলেন? ভ্যানগগ, গগা, পিকাসো এরাও তো সুস্থির মানসিকতার শিল্পী ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে এদের আচার-আচরণ উল্টাপাল্টা ছিল। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এদের প্রতিবাদ ব্যক্তিগত জীবনের পরতে পরতে আমরা লক্ষ্য করেছি। অধ্যাপকের জীবন বর্জন করে নিশ্চিন্ত আর্থিক জীবনের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন শিশির ভাদুরি। সমাজের প্রচলিত অনুশাসনের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য মশাইও। সারা জীবন ধরে তাকে আত্মনিগগ্রহ করতে দেখেছি। এই কারণেই হয়তো বিজন বাবু বলেছিলেন, মদ খাইলো ঋত্বিক, আমাদের হইল নেশা। আসলে ঋত্বিক ছিল মধ্যবিত্ত জীবন প্রবাহের কাপালিক।
এই বাজার অর্থনীতির সমাজে, ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিকোণ থেকে ঋত্বিক ঘটককে আমরা বোঝার চেষ্টা করলে অনেক অসংগতি বেরিয়ে আসবে। এই অসঙ্গতি ঋত্বিকের নয়। আমরা তাকে আমাদের মত করে ভাবতে গেলে ভুল হয়ে যাবে।
সে যাই হোক। আমরা দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের জন্য পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাবার পর বাংলার তরুণ প্রজন্মের একদল মানুষ তাঁর প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। আমরা এও দেখতে পাচ্ছি যে যারা আবেগের আতিশয্যে ভেসে যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগ অংশ ওই মানুষটার বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করছে না। বাতাসে ভেসে বেড়ানো চুটকি গল্প, লোকমুখে প্রচারিত যুক্তিহীন কথাবার্তার ওপর নির্ভর করে এই মানুষটাকে দেবতা বানিয়ে ফেলেছেন। এরা কিন্তু এই মানুষটার সৃষ্টিকর্মের প্রায় কিছুই দেখেননি অনেকে। এদের যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মানুষটা তাঁর জীবনে কটা ছবি নির্মাণ করেছেন আর সেই সব ছবিগুলো আপনি কি দেখেছেন, কিভাবে দেখেছেন, এইসব ছবিগুলোর প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? তাহলেই কিন্তু খোলসটা খুলে পড়বে।
ভারতীয় সিনেমা এবং বিশ্ব সিনেমার প্রেক্ষাপটে এই লোকটার কাজগুলোর কি মূল্যায়ন আপনারা করবেন? দেখা যাবে সযত্নে তারা এইসব প্রশ্ন এরিয়ে যাবে। পরবর্তী যুগের এবং এই সময় দেশের নাট্যকর্মীদের কজনই বা নাট্যকার, পরিচালক অভিনেতা ঋত্বিক বাবুর ভূমিকা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? তাঁর ‘জ্বালা’ নাটক ষাট কিংবা সত্তর দশকে কয়েকটি দল অভিনয় করলেও অন্য নাটকগুলো অবহেলিত থাকল কেন? এই মানুষটা যে একসময় বেশ কিছু গল্প লিখেছিলেন সে ব্যাপারেও আমাদের আগ্রহ নেই কেন?
সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন সব লেখা বেরোচ্ছে যা দেখলে চমকে উঠতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে খুল্লামখুল্লা যে যার খুশি উল্টাপাল্টা মন্তব্য করবার সুযোগ আছে বলে, আবেগের আতিসয্যে মানুষটাকে ব্রহ্মার আসনে বসিয়ে দিলাম, আর বাকিদেরকে বললাম সাধারণ চাকর বাকর!! আমি এই ভাবাবেগের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে কোনও হদিস খুঁজে পাচ্ছি না। তবে হ্যাঁ, সমাজ সংসারে কোন মানুষকে অনেকেই যেমন নিন্দা-মন্দ করতে শুরু করে তখন তাঁর প্রতি কোনও কোনও অংশের মানুষেরা সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। হয়তো এইরকমটাই হতে পারে। আমরা তো জানি যে আলোচ্য ব্যক্তির সৃষ্টিকর্ম সর্বত্রগামী হয়ে ওঠেনি। সরকারি এবং বেসরকারি কোনও স্তর থেকে তিনি তেমন কোনও পুরস্কার পান নি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের সুবাদে তিনি কখনো ইউরোপ আমেরিকা থেকে ডাক পাননি। এই মানুষটার প্রথম নির্মিত ছবিটা তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তিলাভ করেনি। তাঁর ১৩টির মত কাজ জীবিতকালে সম্পূর্ণ করে উঠতে পারেননি। বড় বড় আন্তর্জাতিক সিনেমার আসরে তাঁর জন্য কোনদিন আসন রাখা হয়নি। এক কথায় তিনি নানা দিক থেকে বঞ্চিত এবং অবহেলিত ছিলেন। এইসব কারণেই হয়তো তাঁর প্রতি এক ধরনের অনুকম্পা বেড়েই চলেছে।
তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের অনুকম্পা তিনি কি কখনো প্রত্যাশা করেছিলেন? তিনি কি বড় বড় পুরস্কার, নানাবিধ সম্মেলনে পৌরহিত্য করবার প্রত্যাশী ছিলেন? বরং দেখা গেছে তিনি এই সব কিছু এড়িয়ে চলেছিলেন। নাম যশ অর্থ প্রতিপত্তির কোন প্রত্যাশা তার ছিল না। তিনি যে মার্কসবাদী ছিলেন না, এইটা প্রমাণ করবার জন্য কয়েকজন বই লিখে ফেলেছেন। এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে তার ছবিগুলো ইয়ুঙ দর্শনের প্রভাবে আচ্ছন্ন। আমরা অবশ্য এটা বলতে চাই না যে মার্কসবাদী না হলে বড় বড় শিল্পকর্ম করা যায় না।
যদিও এই মানুষটা বলতেন, মার্কসবাদী না হলে, ডায়লেক্টটিকস না বুঝতে পারলে সিনেমা করবার অধিকার জন্মায় না। আমরা ঘরোয়া স্তরে অনেক ছোট ছোট সভাতে তার আলোচনা শুনে বুঝতে পারতাম যে , শ্রেণী দর্শনকে তিনি কিভাবে তার সৃষ্টিকর্মে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। শ্রেণী সংগ্রামের দর্শন তিনি ভালোভাবেই আত্মস্থ করেছিলেন। আবার বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যাদের লেখা এবং বক্তৃতা এতই দুর্বোধ্য , আলংকারিক ভাষা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে জটিলতা আগ্রহী পাঠকদের সমস্যায় ফেলে দেয়। এইসব বুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ করতে চান যে আমাদের আলোচ্য মানুষটির শিল্পকর্ম কতটা সমৃদ্ধ ছিল। তবে ওই যে বললাম, সাধারণ মানুষের মধ্যে এর কোন প্রভাব পড়ে না। যেমন রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র দর্শন নিয়ে ওপর তলার মস্তিষ্কজীবিরা এমন সব কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন, যা শুনলে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারেন না যে, রবীন্দ্রনাথ কি বাংলা ভাষায় সাহিত্যকর্ম করেছেন ! ? তারপর রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড যা কান্ড করেছিল সে সময়, দেবব্রত বিশ্বাসকে ব্যান্ড করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে দেবব্রত বিশ্বাস খুব সাধারণ ভাষায় মিউজিক বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিদের পাণ্ডিত্যের বেলুন ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, রবীন্দ্র সংগীত যাতে পপুলার না হয়, সাধারণ মানুষের সম্পদে পরিণত না হয় সেই চেষ্টাই মিউজিক বোর্ড করেছিল। সাহিত্য শিল্প সংগীত এগুলো তো জনগণের সম্পত্তি। এগুলো থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করবার পরিকল্পনা এবং ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। শতবর্ষ আগে রাজা মহারাজা জমিদাররা মনে করতেন যে সাহিত্য শিল্প সংগীতের একমাত্র সমঝদার তারাই। জনগণ নামক চাষাভূষা শ্রমজীবী মানুষের জন্য তো রয়েছে লোকগান। লোকনাট্য। লোকশিল্প। তাছাড়া সিনেমা এমন একটা সমৃদ্ধ মাধ্যম যার রসগ্রহণ করতে গেলে শিক্ষিত হতে হয়। তবে সিনেমা যেহেতু প্রথম থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দখলদারিতে চলে গিয়েছিল সেই হেতু পূজির মালিকরা অল্প কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পেরেছিল , সিনেমা নিয়ে বিপুল বাণিজ্য করবার অন্তহীন সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দেখা গেল সিনেমা শিল্প টাকে তারা তাদের বাণিজ্যের উপায় হিসেবে দেখতে শুরু করল। এই বাণিজ্যে পাহাড় প্রমাণ মুনাফা রয়েছে। অন্য দিক থেকে দেখা গেলে দেখা যাবে, চলচ্চিত্রের প্রভাব মানুষের শুধুমাত্র মনের ওপর বিস্তার করে না। চলচ্চিত্র মানব দেহের উপর এক ধরনের আফিমের মত কাজ করে।
চলচ্চিত্রের আদি যুগে আমাদের রবীন্দ্রনাথ তার শেষ বয়সে বুঝতে পেরেছিলেন, মানব সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে এই শিল্পের চূড়ান্ত ক্ষমতার দিকগুলো। লেলিন সাহেব বলতেন, আমাদের দেশের সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে চলচ্চিত্র শিল্পের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। ইউরোপের আরো একজন চলচ্চিত্রকার লুই বুনুয়েল বললেন, চলচ্চিত্রের সাদা পর্দা যদি সত্যি কথা বলতে পারতো, তাহলে পৃথিবীর দেশে দেশে অসমাপ্ত বিপ্লবের দামামা বেজে উঠতো। কিন্তু আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি এটা দেখে যে, চলচ্চিত্রের ক্যামেরাকে বেশ করে আফিম খাইয়ে রাখা হয়েছে। আর তাই সেকেন্ডে 24 টা ফ্রেম যখন সাদা পর্দায় প্রতিফলিত হয় তখন দেখা যায় সেকেন্ডে 24 বার করে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। তিরিশের দশকে চলচ্চিত্রের ক্যামেরা এবং টেলিভিশনের মাধ্যমে হিটলারের নাজিবাহিনী কিভাবে ফ্যাসিবাদের প্রচার করেছিল তা সিনেমা শিল্পের ইতিহাসে একটা অন্ধকার অধ্যায়। ক্যামেরা সত্যি কথা বলে। প্রিন্টিং প্রেস, মুদ্রণ যন্ত্র থেকে ছাপা হয়ে বেরোনো বইপত্র বিষয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা, যা ছাপা হয়ে বেরিয়েছে তার মধ্যে কোন মিথ্যে নেই।
ক্যামেরায় তোলা ছবিতে সত্যর অপলাপ করা হয় না। অন্যদিকে সিনেমা শিল্পকে সম্পূর্ণভাবে পুজির গ্রাসে বন্দী করে ফেলবার পর, পুজির মালিকেরা প্রচার করতে থাকলো , মনোরঞ্জন ছাড়া সিনেমার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এই জন্য হলিউড বলিউড নামক সিনেমা তৈরির স্টুডিওগুলোকে বলা হয় ড্রিম ল্যান্ড। রাজ কাপুরের মত পরিচালকরা প্রথম থেকেই বলে আসছেন, আমরা এই ড্রিমল্যান্ড থেকে মানুষের জন্য স্বপ্ন ফেরি করি। মুভি ক্যামেরা আবিষ্কার হওয়ার পর প্রথমে যখন এক রিল দুই রিলের নির্বাক ছবি তৈরি হতো সেগুলো ছিল নির্ভেজাল কমেডি। আমাদের দেশে নির্বাক ছবির কারিগররা ছোট ছোট কাহিনীচিত্র তৈরি করতেন। সেগুলো ছিল নির্মল হাসি মজার সিনেমা। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছিল ঠাকুর দেবতাদের নিয়ে ছবি করার ধুম। ছবিতে শব্দের প্রয়োগ যখন এসে গিয়েছিল তখন এই শিল্পের কর্ণধাররা বাণিজ্যের দিক থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তবে নির্বাক যুগের ছবি তৈরীর কারখানায় আমরা চার্লি চ্যাপলিনের মত যুগন্ধর প্রতিভাকে পেয়ে গেলাম। চ্যাপলিন নিছক হাসি মজার মধ্যে আটকে থাকলেন না। তার ছিল সামাজিক দায়বদ্ধতা। ছবির মধ্যে দিয়ে তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন। মালিক শ্রমিকের বিরোধ। বড়লোক গরিবের সংঘর্ষ। পচা গলা পুঁজিবাদের ক্যান্সার গ্রস্থ চেহারা। মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এর প্রয়োজনীয়তা। পৃথিবীর মানব সমাজের জন্য একটা সুন্দর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটাই ছিল তার ছবিগুলোর মর্ম কথা।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ঘটে গিয়েছিল দুনিয়া কাঁপানো এক বিপ্লবের ইতিহাস। শোষণ মূলক সমাজ ব্যবস্থার বাইরে একটা নতুন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলবার সময় রুশ দেশের শিল্পীরা কথাসাহিত্য, কাব্য, থিয়েটার নিয়ে নতুন ভাষ্য রচনা করছিলেন। এদের মধ্যে থেকে উঠে এলেন আইজেন স্টাইন, পুদভকিন এর মত বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহাগুরুরা। ওই দেশে সৃষ্টি হল অক্টোবর, মাদার, ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, ইত্যাদির মত ক্লাসিক সিনেমা। এইসব সিনেমার প্রভাব ভারতবর্ষে এসেও ঢেউ তুলেছিল। ওইসব সিনেমার আদর্শে তৈরি হয়েছিল পথের পাঁচালী, নাগরিক, ছিন্নমূল, দো বিঘা জমিন, তেরো নদীর পাড়ে ইত্যাদি ছবিগুলো। ৩০-৪০ এবং ৫০ এর দশকে কলকাতা এবং বোম্বেতে অনেক বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি হয়েছে সেইসব ছবির গল্পের মধ্যেও গরীব মানুষের সমস্যা উঠে এসেছিল। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ক্যান্সারের ক্ষত বহু ছবিতে দেখা যেত। পারিবারিক গল্পগুলোতে মূল্যবোধের সংঘাত ফুটে উঠত। গ্রামের পটভূমিকায় কত রকম ছবি তৈরি হতো। সেইসব ছবি থেকে ভারতীয় গ্রাম্য জীবনের কথা, লোকসংস্কৃতির পরিচয়, গ্রামের গরীব মানুষদের সামাজিক অবস্থান উঠে আসতো। ওই ছবিগুলো ব্যবসায়িক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিল।
নিচুতলার মানুষদের মধ্যে প্রেম প্রীতি ভালবাসা মূল্যবোধে্র যে তীব্রতা ছিল তার কনা মাত্র উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেত না এরকম গল্প নিয়েও অনেক ছবি হয়েছে। অর্থ সম্পদ মানুষকে যে অমানুষ তৈরি করে এই প্রতীতি বহু সিনেমার গল্পে দেখা গেছে। অনেক ছবিতে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। অবস্থাটা বদলাতে শুরু করলো, সত্তরের দশক থেকে। সিনেমার পর্দায় গরিব মানুষরা হারিয়ে গেল। গ্রামীণ গল্প আর খুঁজে পাওয়া গেল না তেমন করে। অলিখিত নির্দেশ যেন জারি হয়ে গেল সিনেমা শিল্পের কারিগরদের উপর —-দেশের মানুষের দারিদ্র্যের কথা সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা যাবে না।
এদেশে না খেতে পাওয়া মানুষের সমস্যাগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। অসহনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কাজ না পাওয়া শিক্ষিত বেকারদের যন্ত্রণা, একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকদের কি অসহনীয় অবস্থা, রাজনৈতিক নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি এইসব থেকে সিনেমা শিল্প মুখ ঘুরিয়ে নিল। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, অজয় কর, রাজেন তরফদার, তপন সিংহ এমন অনেক বাঙালি যেসব চিত্রপরিচালকদের জন্য বাংলা সিনেমা তথা ভারতের সিনেমা আন্তর্জাতিক সিনেমা মহলে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছিল , সেই পশ্চিমবঙ্গে ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেনো জল ঢুকে পড়ল।
মনোরঞ্জনের নামে, প্রেম কাহিনীর আখ্যানগুলো হয়ে উঠল বিকৃত মানসিকতার শিকার। টালিগঞ্জের সিনেমা শিল্পের সু উচ্চমান নামতে নামতে রসাতলের শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে। এবং অজুহাত খাড়া করা হচ্ছে যে, এইসব নাকি দর্শকদের চাহিদা। সুতরাং সিনেমা বাণিজ্যের লগ্নিকারীরা মুনাফার স্বার্থে অপসংস্কৃতির চোলাই মদ সরবরাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আসলে এটা মিথ্যা অজুহাত।
সিনেমা শিল্প নিয়ে এই যে আমাদের এতক্ষণের আলোচনা এসব ঋত্বিক কুমার ঘটক জানতেন। তিনি প্রথম থেকে রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ভারতের আত্মার খোঁজ করতেন। ভারতীয় সুপ্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস নিয়ে তার ছিল অগাধ পড়াশোনা। এদেশের কৃষ্টি, লোকসংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য, লোকশিল্পীদের
অর্থনৈতিক অবস্থা তিনি নিবিড় ভাবে অধ্যায়ন করে ছিলেন। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সব রকম খবরা-খবর তিনি রাখতেন। অনেকেই যা জানেন না সেটা হলো, ইংরেজি সাহিত্যে তার অগাধ পড়াশোনার কথা। সুদক্ষ সরোদিয়া ছিলেন। নিয়মিত সরোদ বাজনার চর্চা তার ছিল। ভারতীয় মার্কসঙ্গীতের পাশাপাশি বিদেশি সংগীত এবং আমাদের লোকসংগীতএর বিষয় তার যে দক্ষতা ছিল আজ আমরা কেউ তা ভাবতেও পারি না। তিনি ছবি আঁকতে পারতেন। ক্যামেরা এবং সম্পাদনা যাকে বলে গুলে খেয়ে ছিলেন। অসম্ভব ভালো অভিনেতা ছিলেন।
ঘটকবাবুর পরিবারটা ছিল বাংলা শিল্প সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। কাব্য কবিতা, কথাসাহিত্য, সংগীত চর্চায় পরিবারের প্রায় সকলেই দক্ষ ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী শিল্পসাহিত্যের যে সংগঠন গড়ে উঠেছিল সেখানে তিনি যুক্ত হন। তারপর গণনাট্য সংঘ তার কাজের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র স্বাধীনতা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাংবাদিকতাও কিছুদিন করে ছিলেন। গণনাট্যের প্লাটফর্মে এসে নাটক লেখা ,পরিচালনা করা এবং অভিনয় করা শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারলেন সীমাহীন অশিক্ষিতদের দেশে গল্প উপন্যাস লিখে বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছানো যাবে না। নিরক্ষর মানুষেরা থিয়েটার দেখতে আসে। থিয়েটারের রস গ্রহণ করতে পারে। এবং এক একটি মঞ্চে শত শত দর্শকের সামনে নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি তার কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। তিনি লিখে ফেললেন বেশ কয়েকটি নাটক। দলিল, সাঁকো, জ্বলন্ত, সেই মেয়েটা, জ্বালা এই পাঁচটি নাটক তিনি রচনা করেছিলেন। ব্রেখট সাহেবের গ্যালিলিও নাটক অনুবাদ করেছিলেন। একটি নাট্যপত্রিকা অভিনয় দর্পণ সম্পাদনা করেছেন। তবে গণনাট্যের মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের নাটক সহ আরো অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। পরিচালনাও করেছেন। মানসিক হাসপাতালে থাকার জ্বলন্ত নাটক ওখানকার চিকিৎসা রত মানুষদের নিয়ে অভিনয় করান। সম্ভবত এই নাটকটা বাংলায় প্রথম সাইকোলজিক্যাল ড্রামা।
সাঁকো নাটকের বিষয়বস্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের নাটক। কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি পত্রিকাতে সাংবাদিকতা করার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন কলকাতায় বেশ কয়েকটি আত্মহত্যার ঘটনা। তিনি লিখে ফেললেন জ্বালা নাটকটি। জীবন যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারা কয়েকটি চরিত্র আত্মহত্যার পরেও যন্ত্রণা মুক্ত হতে পারছে না। তারা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইছে। এইখানে ঋত্বিক বাবুর শিল্পীমন যে কথা বলতে চায় সেটা হলো পড়ে পড়ে মার খাওয়া নয়, জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া নয়। বাঁচার জন্য লড়াই করতে হবে। জীবন অনন্ত।
(প্রবন্ধের মতামত একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত)