Tuesday, June 10, 2025
Tuesday, June 10, 2025
Homeসিনেমাসভ্যতার সংকট ও সত্যজিতের চলচিত্রায়ন

সভ্যতার সংকট ও সত্যজিতের চলচিত্রায়ন

সুব্রত রায়

জিনিয়াস এর আধুনিকতম সংজ্ঞা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে যে, তাঁকে হতে হবে যেকোনো একটি বা দুটি বিষয়ে প্রশ্নাতীত রূপে পারদর্শী এবং সেই সঙ্গে একাধিক বিষয়ে গবেষকের মতো কৌতূহলী। অর্থাৎ তাঁকে হতে হবে দ্য ভিঞ্চি, মাইকেলাঞ্জলো, গ্যেটে, আইজেন্সটাইন, রবীন্দ্রনাথ, পিকাসো, ককতো প্রমুখের বংশধর। সত্যজিৎ রায় নিঃসন্দেহে তাই।

‘পথের পাঁচালী’তে যখন অপু পাঠশালা যাওয়ার জন্য চোখ মেললো আমাদের সিনেমা দেখার চোখ ফুটলো। তিনিই পথপ্রদর্শক। তিনিই প্রথম প্রতীক শস্যে, রৌদ্রে, সিন্ধুর উৎসবে চলচিত্রের অধিকার বর্ণনা করে গেলেন। ছবিতে সুন্দর অসুন্দরের টানাপোড়েনের ফলেই জীবনের বাস্তব রূপ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সুন্দরকে আরো সুন্দর লাগে। জন্মের আনন্দ মনে আরো দোলা দেয়। মৃত্যুর বেদনা মর্মান্তিক হয়ে বাজে। ইন্দির ঠাকুরনের গালভাঙ্গা হাসি সমস্ত মানুষকে মুহূর্তে আপন করে নেয়। পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক বলেন, “ইন্দির ঠাকুরন এই ছবিতে গ্রাম বাংলার আত্মার প্রতিমা। এখনো ভাবলে এক একটি দৃশ্য আমাকে তাড়া করে ফেরে”। সে সব তো আমাদের চলচিত্রের গতিপথ আমূল বদলে দেয় এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যে বিষয়টি ভাবতে গেলে আজও আমি বিস্মিত হই যখন দেখি এই ছবিতে কোনোরকম শ্রমিক–মালিক বা জমিদার—চাষির সংঘর্ষ

দেখানো হয় না। তাও কি এমন ঘটে যে রায় পরিবার গ্রাম থেকে শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়। এভাবেই তাঁর ছবিতে রাজনীতি এসেছে, তা কখনো অন্যভাবে আবার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ বা “সীমাবদ্ধ”তে সরাসরি।

‘পথের পাঁচালী’ দেখানোর তৎকালীন ভারত সরকারের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে বিষয়ে উৎপল দত্ত তার “সত্যজিৎ রায় ভারতীয় রেনেসাঁসের ফসল” এই নিবন্ধে তাঁর অসামান্য বক্তব্য আমাদের মুগ্ধ করবেই। “ভারত সরকারের সর্বপ্রধান ব্যাক্তিটি কলকাতায় ছবিটি দেখেছিলেন এবং দেখেই তাঁর মুখ আরক্তিম হয়ে যায়। কিছুটা উত্তেজিত স্বরে তিনি সত্যজিৎ রায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, সেলুলয়েডে এভাবে দারিদ্র দেখালে কি বিশ্বের কাছে ভারতের দুর্নাম হবে না?এ হলো এক প্রকৃষ্ট ভারতীয় প্রশ্নের নমুনা যা সব ভারতীয় শাসকই বিশ্বাস করেন। সত্যজিৎ রায়ের উত্তর তৎক্ষণাৎ সেই সর্বপ্রধান ব্যক্তিটির মাথা নিচু করে দিয়েছিল। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন দারিদ্রকে বজায় রাখা যদি আপনার পক্ষে দুর্ণামের না হয়, তবে আমি দেখলে দুর্নামের হবে কেন?” একইভাবে সত্যজিৎ তাঁর একাধিক ছবিতে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য রেখেছেন চলচ্চিত্রের ভাষায়, যা কখনো শ্লোগান হয়ে যায়নি। কাহিনীর মধ্যে দিয়েই তা তিনি ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও সমাজের প্রান্তিক মানুষের কথাও তিনি তাঁর ছবিতে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বলেছেন। প্রখ্যাত চলচিত্র তাত্বিক আন্দ্রে বাঁজার চলচিত্র তত্বের বইয়ের নাম ছিল, “what is cinema”. সেখানে তিনি চলচিত্র সম্পর্কে কিছু বেসিক প্রশ্নের অবতারণা করেন। সত্যজিৎ রায়ও তাঁর ছবির মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আর প্রান্তিক মানুষের সমাজে কি অবস্থান সে বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন, যা আমাদের আজও ভাবাচ্ছে।

   “সদগতি” ছবিটি তৈরী করা হয়েছিল কেবলমাত্র টেলিভিশনের জন্যই। ভারতীয় টেলিভিশনকে যারা নিয়ন্ত্রন করে সেই দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীর হাস্যকর আচরণের সঙ্গে আমরা সকলেই ভালোভাবে পরিচিত। যেহেতু তাঁদের কর্তাব্যক্তিরা অনেক দেরিতে বুঝলেন যে সত্যজিৎ রায় হলেন, “ভারতীয় রেনেসাঁসের শেষ প্রতিনিধি” সেহেতু তাদের নিজেদেরও টনক নড়লো। এঁরা “সদগতি” ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, কারন এই ছবিতে “চামার” শব্দটি বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে। লক্ষ্য করুন “সদগতি” ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল কেবলমাত্র টেলিভিশনের জন্যই। সুতরাং সংলাপকে চ্যালেঞ্জ করায় সত্যজিৎ রায় ও লেখক মুন্সি প্রেমচন্দ দুজনের ওপরেই আক্রমন করা।

সদগতি দেখার সময় মনেই পড়ে না যে এর মধ্যে সিনেমা শিল্পের কোনো কৌশল আছে। অত্যন্ত সহজ সরল বর্ণনাভঙ্গিতে শুরু হয় কাহিনী। একটি সাধারণ গ্রীষ্মের সকাল, আলো তখনও প্রখর হয়নি। এ সময় মানুষের গলার আওয়াজ নরম থাকে এবং ভুরু কুঁচকে যায় না। দুখী চামারের কিশোরী মেয়ে ধনিয়া উঠোনে ঝাঁট দিচ্ছে। আজ তার জীবনের বিশেষ একটি দিন। আজ পন্ডিতমশাই তাদের বাড়িতে আসবেন, তিনি ধনিয়ার বিয়ের শুভদিন ঠিক করে দেবেন। তাঁর মা ঝুরিয়ার মুখেও খুশি মাখা ব্যস্ততা। পন্ডিতমশাই এর মতন একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে আসা হবে, সেজন্য আলাদা ব্যাবস্থা করতে হবে তো। একটি নিষ্পাপ লাবণ্যময়ী কিশোরী মেয়ের বিবাহের প্রস্তাবনা দিয়ে শুরু। এর চেয়ে চমৎকার বিষয় আর কি হতে পারে। যতই গরীব হোক বা ছোটজাতের হোক, সেই মুহুর্তে ওরা একটি সুখী পরিবার।

প্রথম সমস্যা দেখা দেয় পন্ডিত এলে বসবেন কোথায়? ওরা তো অস্পৃশ্য। ওদের বাড়ির কোনো জিনিসে তো তিনি বসবেন না। একমাত্র কৈশোরের সারল্য এর উত্তরটি জানে। কেন, মোড়লের কাছ থেকে তাঁর খাটিয়াটি ধার করে আনলে হয় না? তখন এই কিশোরী মেয়েটিকে এই কঠোর সত্য শিক্ষা দেওয়া হয় যে খাটিয়া তো দূরের কথা মোড়ল তাদের একটুকরো জ্বলন্ত কয়লাও ধার দেবেন না। বরং মহুয়া গাছের পাতা ছিঁড়ে এনে টাটকা আসন বানানো হোক। পন্ডিত এলে তাঁকে উপঢৌকন দিতে হবে নিয়মমতো। এক সের আটা, আধ সের চাল, এক পোয়া ডাল, আধ পোয়া ঘি আর নুন হলুদ। এসব জোগাড় করে রাখতে হবে। তবে ঝুরিয়া যেন ওসব না ছোঁয়। কোনো জলচল মহিলাকে অনুরোধ করে তাকে দিয়ে আনিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে। আর রাখতে হবে চার আনা পয়সা। একমাত্র হরিজনদের পয়সাটাই পন্ডিতদের কাছে অস্পৃশ্য নয়।

সকাল থেকে কিছু খায়নি দুখী চামার। তাতে কি হয়েছে, এই তো এখুনি সে পন্ডিত কে নিয়ে আসবে। তারপর শুভ কাজটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে তারপর সে খাওয়ার অনেক সময় পাবে। ঘাসের বোঝাটি মাথায় করে সে টলমলে পায়ে এগিয়ে যায়। পুরো কাহিনীটি আর সবিস্তারে বলার প্রয়োজন নেই। সকালের এই নরম ভাবটা কেটে গিয়ে ক্রমশ কর্কশ দুপুর আসে, তারপর ম্লান সন্ধ্যা ও দমবন্ধকর রাত্রি। দুখী চামারের মৃত্যু, তার মৃতদেহ সরানোর সমস্যা ও সমাধান নিয়েই “সদগতি”। আপাতত মনে হয় চলচ্চিত্রকার একটি জীবনকাহিনী নির্লিপ্ত ভাবে বর্ণনা করে গেছেন। শুধু নির্লিপ্ত নয়, নির্মমও। সত্যজিৎ রায় তাঁর কোনো ছবিতে এমন হননি। প্রকৃতির কোনো স্থান নেই এখানে, জীবনের প্রবহমানতার কোনো চিহ্ন নেই এখানে। কেউ কেউ বলেন সত্যজিতের বাস্তবধর্মী ছবিতেও কবিত্বের ভাব বেশি থাকে। আমি মনে করি সেটাই মহৎ শিল্পীর প্রকৃত লক্ষণ, যেমন টলস্টয়ের উপন্যাস। কিন্তু সত্যজিৎ সেটাকে অভিযোগ মনে করে এবারে সদগতির ক্ষেত্রে বললেন দেখো কিভাবে রূঢ় বাস্তবকেই চলচিত্রের ভাষায় উপস্থাপিত করা যায়। অন্যান্য সব কাজ সেরে ফেলার পর পরিচালক যখন দুখী চামারকে বিশাল প্রাচীন গাছের গুড়িটার সামনে দাঁড় করান তখন আমরা আঁৎকে উঠি। পন্ডিতের বাড়ির সামনে রাবনের মূর্তি, কিন্তু ক্যামেরা দিয়ে তিনি কখনোই সেটার প্রতি বিশেষ মনোযোগ আরোপ করেন না। পন্ডিতের বাড়িতে সবকিছুই খুব ধীর গতিতে চলে। তার পাশেই দুখী কাঠ চেরাইয়ের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যায়। সে ঘাস কাটতে জানে, কিন্তু সে কাঠ কাটতে জানে না। সে যে কিছু খায়নি সেটা তীব্র মর্মান্তিক ভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয় পন্ডিত ও তার গৃহিণীর আলোচনায়: ওকে কিছু খেতে দিলে হয় না? কিন্তু ওরা চামার, অনেক না খেলে ওদের পেট ভরে না। একটা দুটো রুটির বেশি নেই। সুতরাং তা আর ওকে দিয়ে কি হবে? এই ভেবে পন্ডিত ও গৃহিণী বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে নিজেরা শুতে চলে যায়। একটা সময় দুখী চামারের কুড়োলে আলো ও ছায়ার সাংঘাতিক খেলা দেখে শিহরণ জাগে। বোঝা যায় চলচ্চিত্রের ভাষা কত কম সময়ে কত বেশি কথা প্রকাশ করতে পারে।

‘সদগতি’র কাহিনী রচিত হয়েছিল কুড়ির দশকের পটভূমিকায়। আজও যে এ ঘটনা কত সত্য তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছবিতে সত্যজিৎ রায় কোনো উচ্চারিত প্রতিবাদ কিংবা নিজস্ব বক্তব্য রাখেননি। কিন্তু তাঁর পরিষ্কার শিল্পভাষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের সংবিধান, গণতন্ত্র নিয়ে চেঁচামেচি এখনও কত অসার। মানুষই মানুষকে বাঁচতে দেয় না। এই হলো এ পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস, যা আজও অপরিবর্তনীয়।

সত্যজিৎ রায় নিজের সমসাময়িক জীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে রেনেসাঁসের মতাদর্শকেও ছাড়িয়ে গেছেন। যেমন “সদগতি”। সম্ভবত ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই প্রথম আমরা দেখতে পেলাম এক শ্রমজীবী মানুষের যন্ত্রনা জর্জর মুখচ্ছবি। আমরা এতদিন ভারতীয় সর্বহারাকে দেখতে পেয়েছি শ্লোগান দেওয়া ইউনিয়ন কর্মী হিসাবে। তারা সকলের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে অমিতাভ বচ্চনের আশায়, যে নিজের ঘুষির আঘাতে কুপোকাত করবে শোষকদের। মূলধারার ছবি বারবার শ্রমিকদের দেখিয়ে এসেছে মধ্যবিত্ত হিসাবে, যারা অপেক্ষা করছে এক পরিত্রতার জন্য। সেই পরিত্রাতা আসবে এবং তাদের মুক্ত করবে। “সদগতি”হলো প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র যা এক প্রকৃত ভারতীয় শ্রমিককে তুলে ধরলো। এই শ্রমিক দুভাবে শোষিত। প্রকৃত পক্ষে “সদগতি”হলো বর্তমান ভারতীয় সর্বহারা আন্দোলনের প্রাক ইতিহাস যা শুরু হয়েছিল ব্রাম্ভনদের ঘৃণা ও ঔদ্ধত্বের পরিবেশে। “সদগতি” ছবির সত্যজিৎ রায় অবশ্যই একজন রেনেসাঁস চিন্তাবিদ নন, বরং সমসাময়িক বিশ্ব যে শ্রেণী সংগ্রামের মুখোমুখি হচ্ছে তারই এক কবি সত্যজিৎ রায়।

পথের পাঁচালী ছবিতে সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন, তার ছবির চরিত্রগুলি কষ্টভোগ করেছে ভগবানের ইচ্ছায় নয়, বরং মানুষেরই সৃষ্ট দারিদ্রের কারনে। ভগবানের থেকেও ক্ষমতাশালী এক শক্তি তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছে—-এই শক্তি হলো এক সামাজিক ব্যাবস্থা যা শোষনকে ক্ষমা করে।

মনুষত্ব ধ্বংসকারী এই “ঈশ্বর” ধারণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের চিত্র সাফল্যের সঙ্গে ধরা পড়েছে “দেবী” চলচ্চিত্রে। সেখানে একটি মেয়েকে দেখানো হয়েছে, সে এক সাধারণ গৃহবধূ, ঘোষণা করা হয় সে দেবীর অবতার এবং সমস্ত অসুস্থ গ্রামবাসীকে সুস্থ করে তুলতে পারে। শেষে যে শিশুটিকে সে প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসে সে মুমূর্ষু হলে তার পায়ের সামনে হাজির করানো হয়, যদি সে সেই ছেলেটিকে সুস্থ করে তুলতে পারে। কিন্তু মেয়েটি শিশুটির জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে সাহস পেল না।এবং সে পালাতে চেষ্টা করে তার শাড়ি শতছিন্ন হয়ে যায় এবং কাজলের কালিতে মুখ আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

এ ছবি থেকে এদেশের সিনেমা মেশিন থেকে উদ্ভূত কয়েক ডজন ছবির তুলনা করা যেতে পারে। সেই সব ছবিতে দেখা যাবে একটি মুমূর্ষু শিশুকে দেবী মূর্তির সামনে রাখা আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান তাকে মরবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এবং এরপরেই অবশ্য দেবীর ভজনা করে এক লম্বা গান হবো সেই দেবী সন্তোষী মা হতে পারেন অথবা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো ভুলে যাওয়া দেবতা হতে পারেন। এরপর দেখা যাবে সেই পাথরের মূর্তি একটু হাসতে শুরু করলো, শিশুটির দেহের ওপর কয়েকটি ফুল ছড়িয়ে পড়লো। তারপর আহা সে কি দৃশ্যাসেরা ডাক্তাররা যা পারেননি, এক টুকরো পাথর তা করে দিল কয়েক সেকেন্ডে, শিশুটি চোখ মেলে চাইলো এবং উঠেও

বসলো। এরপর ভগবানকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরো একটি গান, যা শেষ হতে চায় না অথবা শিশুটির বাবা-মা আনন্দে কৃতজ্ঞতায় মেঝেতে গড়াগড়ি দিতে লাগলো।

এই ধরনের নির্লজ্জ কুসংস্কার প্রতি বছর একের পর এক ছবিতে দেখানো হয়। এগুলি কি ড্রাগসের থেকে কম বিপদজনক? যদি ড্রাগস আমাদের তরুণ প্রজন্মের শরীর নষ্ট করে থাকে তবে এইসব চলচ্চিত্র নষ্ট করে থাকে তাদের মনকে। এইসব বাজে ছবি তৈরি করা যদি অসম্ভব করে তোলা যায় এবং তার পরিবর্তে যদি সারা দেশে কম দামে “দেবী” দেখানোর ব্যাবস্থা করা যায় তবেই সত্যজিৎ রায়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা দেখানো হবে।

ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করলে “দেবী” একটি বিপ্লবী চলচিত্র।শত শত বছরে ভারতীয় গ্রামগুলির প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্মকে যেভাবে মেনে আসা হয়েছে, এই ছবিতে সেই ধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। এদেশে ধর্মশাস্ত্র বল কথিত সেই তন্ত্রমন্ত্রকে সরাসরি আঘাত এনেছে। রামায়ন ও মহাভারতের কদর্য প্রযোজনা না দেখিয়ে ভারতীয় টেলিভিশনের উচিত ছিল “দেবী’বারে বারে দেখানো। তাহলে হয়তো অযোধ্যায় হনুমান বাহিনীর কীর্তিকলাপ দেখতে হতো না।গোড়ায় সত্যজিৎ রায় ভেবেছিলেন মহাভারতের পাশা খেলার দৃশ্য নিয়ে একটি বড় বাজেটের ছবি করবেন।তাতে তোশিরে মিফুনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেতারা থাকবেন।তিনি এজন্য ভারত সরকারের কাছে অর্থ চেয়েছিলেন। আমলাতন্ত্র সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।কারন তখন তারা আটেনবরোর “গান্ধী”ছবির জন্য কোটি কোটি টাকা জলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন, যে ছবিতে তিনি ভারতে ইংরেজ শাসকদের সম্পর্কে অভিযোগগুলি স্খলন করতে দুঃসাহসী প্রয়াস নিয়েছিলেন।

আমরা তাঁর শেষ দিককার ছবিগুলি বিশ্লেষগ করে দেখতে পারি। তাহলে দেখবো তাঁর অসাধারণ সমসাময়িক মনে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া কাজ করেছে। ইবসেনের “এনিমি অফ দ্য পিপল” অবলম্বনে তৈরি “গণশত্রু” ছবিটি ইবসেনের নাটকের মতো শেষ হয়নি। সেখানে ড: স্টকম্যান সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছেন যে ব্যক্তি মানুষই সবসময় সঠিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সব সময়ই ভুল।

গণশত্রু একাধিক কারনে, একেবারে নতুন সত্যজিৎ। তিনি এর আগে কখনোই নাটক থেকে ছবি করেন নি। বিদেশি গল্প নিয়েও কাজ করেননি এর আগে। এবং এই ধরনের বিষয় বা চরিত্র তাঁর ছবিতে আগে কখনও আসেনি। এতগুলো নতুন চ্যালেঞ্জের ছবিতে তাঁর স্টাইল এতটাই পাল্টেছে যে আমাদের বিস্মিত হতে হয়। তাই গণশত্রু নতুন সত্যজিৎ তো বটেই।মহৎ শিল্পী বারে বারে নিজেকে ভাঙেন, এক অন্য মাত্রাতে নিয়ে যেতে চান। এক্ষত্রেও তাই। তার বিষয় নির্বাচন ও বলার ভঙ্গি দুটোই বেশ অভিনব। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে দীর্ঘ সংলাপ—প্রবন দৃশ্যের দাবিতে সত্যজিৎ এ ছবিতে এমনভাবে এত ক্লোজ আপ ব্যবহার করেছেন যা আগে তাঁর ছবিতে দেখেছি বলে মনে হয় না। ক্যামেরার শ্লথগতি, দৃশ্যের অন্তর্মুখীতা এবং দীর্ঘ ক্লোজ আপ —-এই ত্রিমাত্রা থেকে উঠে এসেছে “গনশত্রু”র নতুন শৈলী।

ইবসেনের নাটকে শুধু দূষিত পানীয় জলের কথা আছে।সেই দূষিত জল তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করেছে এমন একটি জায়গায় সেটিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিণত করে গড়ে উঠেছে একটি অসৎ, দায়িত্বজ্ঞানহীন বাণিজ্যচক্র এই বাণিজ্যচক্রের বিরুদ্ধে এক ডাক্তারের একক যুদ্ধ এবং অন্তিম পরাজয় নিয়েই ইবসেনের নাটক।সামাজিক মূল্যবোধ, অবক্ষয়, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিত—এইসব কিছু ইবসেনের নাটকের মধ্যে বহু পরতে জড়িয়ে ফেললেও ধর্মীয় সংস্কার, বিশ্বাসকে টেনে আনতে পারেননি। সত্যজিৎ সেই সাহস দেখিয়েছেন। তিনি এদেশের সামাজিক, মানবিক অবক্ষয়ের সঙ্গে যেভাবে প্রচ্ছন্ন ধর্মীয় সংস্কারকে বুনে দিয়েছেন, যেভাবে আমাদের বিজ্ঞান বিমুখ অজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন, এই অজ্ঞতার কারন হিসাবে, তাতে হিন্দু মনের অবগহন স্তরের ভূমিকাটি সাহসী

উচ্চারণ পেয়ে গেছে নিঃসন্দেহে। এবং এই উচ্চারণই সত্যজিতের ছবিটিকে নিয়ে গেছে এমন এক উত্তরণের বিন্দুতে যেখানে ইবসেন পৌঁছতে পারেননি তাঁর নাটকে।

এরপর আপনি যদি শাখাপ্রশাখার দিকে তাকান তাহলে সেখানে দেখতে পাবেন সত্যজিৎ সেখানে মধ্যবিত্ত অনৈতিকতাকে কশাঘাত করেছেন। এই মধ্যবিত্ত এখন পুঁজিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য ছুটছে। অথবা “আগন্তুক”এ দেখুন, সেখানে সত্যজিৎ রায় তথাকথিত সভ্যতাকে ভৎর্সনা করেছেন, যে সভ্যতা বোতাম টিপে একটা শহর ধ্বংস করে দিতে পারে এবং যে সভ্যতা আদিবাসীদের অবজ্ঞা ও ঘৃনা করে।কারন তারা খুন করার শিল্পটি আয়ত্ত করতে পারেনি।

মূল্যবোধের সংকট ঘুরে ফিরে সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবিতেই প্রধান বিষয় হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। “শাখাপ্রশাখা”তেও বিষয়টি ফিরে এলো। প্রতিতুলনায় বিশেষ করে মনে পড়ে “সীমাবদ্ধ” ছবির কথা এবং পিকু। “শাখাপ্রশাখা”র গল্প তাঁর নিজের।এতে একটি জিনিস স্বত:প্রমাণিত—-সমাজ, জীবন সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারনায়, অনুভবে প্রতিক্রিয়াগুলি তীব্রতর হয়ে উঠেছে। সমাজ মনস্ক শিল্পী সত্যজিৎ আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। এটাই স্বাভাবিক।

ছবির শেষ দিকে মানসিক ভারসাম্যহীন মেজোছেলে প্রশান্ত স্বগতোক্তির মতো বলে, “যত সহজ, তত ভালো”এই কথার লক্ষে সত্যজিৎ যেন এই ছবিটিকে পৌঁছে দিতে চান। সহজ অথচ গভীর, এ এমন এক সরলতা যা প্রজ্ঞার গভীরতা থেকে জন্ম নেয়।শাখাপ্রশাখায় সব কিছুর আয়োজন থাকলেও আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত অপূর্ন থেকে যায়।

সত্যজিৎ রায় তার সৃষ্টিপর্বের গোড়া থেকেই উদ্বুদ্ধ ছিলেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থায়। বিষয়বস্তু ও শিল্পরীতিতে সেই ভঙ্গি গোড়া থেকেই লক্ষনীয়।তার বিশ্বাস প্রথম চিড় ধরেছিল “জনঅরণ্য” তে। তারপর শাখাপ্রশাখা পর্যন্ত প্রায় সব ছবিতেই কাজ করেছে সত্যজিতের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি।সমাজের সমালোচনায় তিনি অনেক সময়ই সোচ্চার, কিছুটা সরলীকরনের ছাপও পড়েছে তাঁর এই ধরনের ছবিগুলিতে। কিন্তু তাঁর তীর্যক দৃষ্টি ও বিশ্লেষনের নিষ্ঠুরতা আমাদের চোখ এড়ায়নি।

সত্যজিতের শেষ ছবি “আগন্তুক”এ আমরা দেখি সেই মানবিক বিশ্বাসের প্রত্যাবর্তন।তীব্র শ্লেষ ও কশাঘাত এখানেও আছে, কিন্তু তারপরেই এক ক্ষমাসুন্দর প্রশান্তির প্রলেপ। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র মনমোহন যখন পঁয়ত্রিশ বছর পর ঘরে ফেরেন, তখন তাকে দেখে মনে হয় অন্য গ্রহের মানুষ। পৃথিবীতে এসে নানা অসঙ্গতি দেখে মজা পাচ্ছেন, ঠাট্টা করছেন। কিন্তু সমাপ্তিতে নতুন করে অনুভব করেছেন আত্মিক বন্ধন। কিংবা তিনি যেন সেই আলতামিরার গুহাচিত্রকর। তাঁর সারল্য আর আদিমতা নিয়ে উপস্থিত আজকের জগতে।ভঙ্গির এই বৈচিত্রে “আগন্তুক” যেন এক আধুনিক রূপকথার স্তরে উন্নীত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর শেষ জীবনে “সভ্যতার সংকট” লিখেছিলেন, সত্যজিতও তাঁর শেষ ছবিতে সভ্যতার প্রতি তাঁর অনাস্থাকেই দৃঢ় ভাবে ব্যক্ত করেছেন। কখনো কখনো এই ছবির মূল চরিত্র মনমোহনকে আমার সত্যজিৎ রায়েরই “অল্টার ইগো”বলে মনে হয়।ওই একই প্রজ্ঞা, বাগবৈদগ্ধ ও মেধার দ্যুতি। “আগন্তুক” ছবির মূল চরিত্র ছবিতে সভ্যতা, অসভ্য, বর্বর মানুষ, ধর্ম প্রভৃতি সম্বন্ধে যা বলেছেন তাতে একটা কথা পরিস্কার মনে হয় সত্যজিৎ জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের মতোই এই সভ্যতা, দৈনিক পত্রিকা, আদিবাসী সমাজ সংস্কৃতি, বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি সম্পর্কে একধরনের মন্তব্য করেছেন চলচ্চিত্রের ভাষায় যা আমাদের বিস্মিত করে, মুগ্ধ করে আর নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়। তাই একথা বলাই যায় রেনেসাঁস শব্দটি সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তিনি ছিলেন মানব জাতির বিবেকের একটি মুহূর্ত।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular