বিজয়কুমার দাস
থিয়েটারের নতুন প্রজন্ম : পর্ব ২২
সুভাষগ্রামের সোমা রায় ও পবিত্র রায়ের পুত্র রাহুল রায় এখন থিয়েটারের একনিষ্ঠ অভিনেতা। অথচ থিয়েটারে আসার কথা ছিল না তার। নাটক নিয়ে পড়াশুনো করেছে তাও নয়। কিন্তু সেই রাহুলের থিয়েটারের প্রতি একটা টান ছিলই। এই মুহূর্তে থিয়েটারের নতুন ধরণের কাজ করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তরুণ নির্দেশক শরণ্য দে-র নাট্যদল টেন্থ প্ল্যানেট প্রযোজিত “গ্যালিলিও” নাটক দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিল রাহুল।এই প্রযোজনাটি দেখে তার মনে হয়েছিল “এমনও থিয়েটার হয়!”….কিংবা “এভাবেও একটা থিয়েটার ডিজাইন করা যায়!”…
গ্যালিলিও নাটক দেখার অভিজ্ঞতা তাকে এতটাই অভিভূত করেছিল যে, থিয়েটার করার ইচ্ছেটা তাকে পেয়ে বসেছিল। এ প্রসঙ্গে রাহুল জানিয়েছে, গ্যালিলিও দেখার পর তার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এমনও থিয়েটার হয়?.. থিয়েটারে এই ইল্যুশনটা কীভাবে তৈরি হয়?… এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যেই থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিল রাহুল রায়। সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করেনি রাহুল। একদিন নিজেই গ্যালিলিও নাটকের নির্দেশক শরণ্যকে ম্যাসেঞ্জারে বার্তা দিয়ে লিখেছিল, সে থিয়েটার করতে চায়।..
টেন্থ প্ল্যানেট এর নির্দেশক শরণ্য তাকে চলে আসতে বলে একদিন। সে যুক্ত হয়ে পড়ে টেন্থ প্ল্যানেট এর সঙ্গে। অবশ্য তার আগে স্পন্দন পিপলস থিয়েটার নামে একটা নাট্যদলে সে যুক্ত ছিল থিয়েটারের সূত্রেই। যে গ্যালিলিও নাটক দেখে সে টেন্থ প্ল্যানেট নাট্যদলের সাথে যোগাযোগ করেছিল সেই দলের গ্যালিলিও নাটকেই তার অভিনয়ের সুযোগ ঘটে যায়। এ পর্যন্ত এই দলের ৮ টি প্রযোজনায় অভিনয় করে সে থিয়েটার দেখা দর্শকের প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে।এখন এই দলের একজন একনিষ্ঠ নাট্যকর্মী রাহুল।

অবশ্য স্কুলেও থিয়েটার করার অভিজ্ঞতা ছিল তার। তাই থিয়েটারের প্রতি একটা ভালবাসা ছিলই। স্কুলে ” হীরক রাজার দেশে ” নামে একটা নাটকে অভিনয় করে দর্শক এবং শিক্ষকদের প্রশংসা পেয়েছিল।স্বভাবতই থিয়েটার করার ইচ্ছেটা তার মনের মধ্যে ছিলই।রাহুল জানিয়েছে, টেন্থ প্ল্যানেট দলে নানা নাটকে অভিনয়ের সূত্রে সে যেন প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কার করে চলেছে। স্কুল কলেজের সীমানা ছাড়িয়ে স্পন্দন পিপলস থিয়েটার থেকে টেন্থ প্ল্যানেট দলে এসে সে একজন পরিপূর্ণ থিয়েটারকর্মী এবং থিয়েটারের অভিনেতা হয়ে ওঠার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।বারুইপুর হাই স্কুল ও মৌলানা আজাদ কলেজে তার লেখাপড়া।
এ পর্যন্ত যে কয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছে তার প্রায় সবগুলোই তার প্রিয়।কারণ সে বিশ্বাস করে, ভাল অভিনয় করতে হলে অভিনীত চরিত্রটিকে ভালবাসতে হয়।প্রতি মুহূর্তে নিজে ভেঙেচুরে চরিত্র উপযোগী হয়ে উঠতে হয়।তবু অভিনীত চরিত্রগুলির মধ্যে দুটো চরিত্র অবশ্যই তার প্রিয় চরিত্রের তালিকায়। “একটি সেলসম্যানের মৃত্যু ” নাটকের বনি চরিত্র এবং “ব্ল্যাক কফি ও সান্টাক্লজ” নাটকের সান্টাক্লজ চরিত্রদুটি তাকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছে বলেই এই চরিত্রদুটি তার প্রিয়তম চরিত্রের তালিকায় অবশ্যই তার কাছে উল্লেখযোগ্য। বনি চরিত্রটি তার অভিনীত চরিত্র হিসাবে বিশেষিত কারণ এই চরিত্রটি তাকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছিল। এজন্য তাকে শিখতে হয়েছে রিয়েলিস্টিক এক্টিং বা মডার্ণ এক্টিং। সে মনে করে, বনি চরিত্রটি তাকে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।অন্যদিকে স্যান্টাক্লজ চরিত্রটিও তার কাছে প্রিয় হওয়ার কারণ এই চরিত্রে অভিনয় করতে সে বিশেষ রকমের একটা মজা পায়। এছাড়াও ” ঠান্ডা গোস্ত” নাটকে ঈশ্বর সিং চরিত্রে ও “এপিটাফহীন মৃত্যু” নাটকে হেনরি চরিত্রটিও তাকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছে।
এই যে নিজেকে থিয়েটার জগতের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে তাতে তার কেমন লাগে?… এই প্রশ্নের উত্তরে রাহুল জানিয়েছে,জীবনের সব ক্ষেত্রের মতই থিয়েটার জগতেও ভাল এবং মন্দ আছে। কিন্তু সে বিশ্বাস করে, ভালটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কাজের সময় যার সাথে যতটুকু সম্পর্ক ততটুকু বজায় রাখতে শিখলেই নিজে ভাল থাকা যায়।
কিন্তু থিয়েটার করে কি বাঁচা যায়?… এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে, এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরটা সে খুঁজে চলেছে। তবে আপাতত থিয়েটারের জীবনটা তার কাছে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে আবিষ্কার করার একটা জীবন,সেটা মনে রেখেই হয়তো বাঁচা যায়। থিয়েটার করার ব্যাপারে বাড়িতে মা বাবার উৎসাহ সে পায়। তার মতে, তাঁদের উৎসাহ আছে বলেই সে থিয়েটার জগতে নিজেকে জড়াতে পেরেছে। তাঁদের উৎসাহ না থাকলে এইভাবে থিয়েটারের কাজ করে যাওয়া তার সম্ভব হত না বলেই সে মনে করে।
তাকানো যাক, রাহুল অভিনীত নাটকের তালিকার দিকে। স্পন্দন পিপলস থিয়েটারে সমুদ্র গুহর নির্দেশনায় সে অভিনয় করেছে “সম্রাট ও ভিক্ষুক ” এবং ” বর্ণ বিপর্যয়” নাটকে। টেন্থ প্ল্যানেট দলে এ পর্যন্ত তার অভিনীত নাটকগুলি হল: একটি সেলসম্যানের মৃত্যু, গ্যালিলিও, থ্রি পেনি অপেরা, একটি ব্ল্যাক কফি ও স্যান্টাক্লজ, ম্যাকবেথ, ঠান্ডা গোস্ত, এপিটাফহীন মৃত্যু, গাঙচিল। টেন্থ প্ল্যানেট এর সবগুলি নাটকেরই নির্দেশক শরণ্য দে।
হঠাৎ থিয়েটারে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে থিয়েটার করতে করতে তার এখন মনে হয়,এই জগৎটা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কারের একটা জগৎ। সেই বিশ্বাস নিয়েই থিয়েটার করে চলেছে রাহুল রায়।