সুব্রত কাঞ্জিলাল
অ্যাক্টিভ থিয়েটার আয়োজিত নাট্য উৎসবে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ পানিহাটি লোকসংস্কৃতি মঞ্চে (নজরুল প্রেক্ষা গৃহ) অপরিসর পাটাতনে রাজ দেউল-এর অভিনয় দেখার সুযোগ হয়েছিল।
ঐকতান দক্ষিণেশ্বর দীর্ঘ বছর ধরে থিয়েটারের জগতে বিরাজমান থেকে নিজেদের বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করতে পেরেছে। আরও ভালো করে বললে বলতে হবে, নিজেদের জাত চেনাতে পেরেছে। এই দলটির প্রযোজনা দেখলেই বুঝতে পারা যায় এঁদের স্বতন্ত্র রুচিবোধ রয়েছে। এঁরা ঝাকের কৈ নয়।
রবীন্দ্র গল্প কবিতা সংগীতের প্রতি এঁদের আকর্ষণ বেশ গভীর। সেই ধারাবাহিকতায় রাজ দেউল নাটকটি বর্তমান যুগ এবং সময়ের প্রেক্ষিতে অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। মন্দিরে দেবতা নেই। দেবতার আসন রয়েছে মন্দিরের বাইরে শ্রমজীবী জনতার মধ্যে। রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে।
রাজামশাই প্রভুত অর্থ ব্যয় করে মন্দির তৈরি করেছেন। তাঁর দরকার একজন পূজারীর। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখার অনুসারী বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব এবং আরও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে মন্দিরের পূজারীর চাকরিপ্রার্থীদের আনাগোনা চলতে থাকলেও মহারাজার কাউকেই তেমন পছন্দ নয়।
অবশেষে অসাম্প্রদায়িক মনের সমস্ত রকম জাতি-ধর্ম বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে থাকা একজন গায়ক বাউলের আবির্ভাব ঘটল। রাজার তাকে পছন্দ হলো। এই গায়ক নির্বাচিত হলেন রাজ দেউলের প্রধান পুরোহিতের আসনে। সংকট বাঁধলো বাউল গায়কের কন্যাসম এক নারীকে কেন্দ্র করে। জানা গেল, এই মেয়েটি আসলে শূদ্র সম্প্রদায়ের। এই মেয়েটির জায়গা হতে পারে না দেবতার মন্দিরে।
তাকে বার করে দিতে হবে রাস্তায়। অন্যদিকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে মন্দির নির্মাণ করা হলেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপদের সীমা অতিক্রম করে গেছে। কৃষক-মজুরদের হাতে কোন কাজ নেই। তারা রাজপ্রাসাদের বাইরে কাজের সন্ধানে জমা হয়েছে। এ যেন বর্তমান ভারতবর্ষের রাজ্য শাসন এবং শাসকদের প্রতিচ্ছবি। সংগঠিত ধর্মের জাতাকলে পড়ে দেশের মানুষ আজ বিপন্ন। সামাজিক ন্যায় নীতি, নিরন্ন মানুষের আর্তনাদ মাথা কুরে কুরে মরছে দেব-দেউলের চৌকাঠে।
এই দলের প্রায় প্রতিটি অভিনেতা দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। প্রযোজনায় সংগীতের ভূমিকা বেশ উজ্জ্বল। প্রথম থেকেই তীব্র গতিতে অভিনয় এগিয়ে যায়। দর্শক আসনে আমরা নিবিষ্ট হয়ে বসে থাকি পরের দৃশ্যের কৌতুহল নিয়ে। নাটকের সংলাপের মধ্যে আপাত কোন জটিলতা নেই। অথচ জীবন্ত হয়ে উঠেছে চরিত্রের মুখের কথা। এই নাটকের শত শত রজনী অভিনীত হওয়া দরকার। আমি বলব বর্তমান বাংলা থিয়েটারের অধিকাংশ প্রযোজনা বসে দেখা যায় না। সময়কে ওইসব নাটক কোনও ভাবেই স্পর্শ করে না। সেই তালিকায় ঐকতান দক্ষিণেশ্বরের রাজ দেউল নাটকটি ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবে।