চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক শঙ্খ ঘোষের মুখোমুখি

- Advertisement -

বাংলা নাটক ডট ইন এর পক্ষ থেকে সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন দেবা রায়

(এবারের সাক্ষাৎকার পর্বে আমাদের সাথে আছেন চলচিত্র ও নাট্য পরিচালক শঙ্খ ঘোষ। যিনি বলা যেতে পারে নিভৃতে এক বিকল্প খোঁজের সন্ধানে নাটকের সাথে যাপন করে চলেছেন। তাঁর সাথে মুখোমুখি আলাপচারিতায় উঠে এসেছে প্রায় পাঁচ দশকের অতীন ও কয়েক দশক এগিয়ে থাকার এক পরিকল্পনা। ভাবনায় ও যাপনে অত্যন্ত স্বাভাবিক ছন্দে যিনি মাথা গুঁজে কাজের মধ্যে ডুবে আছেন। এমনই মানুষের মুখোমুখি আমি।)

দেবা রায় – শঙ্খ দা, প্রথমেই যে কথাটায় আমি আসতে চাইছি, সেটা হল ফিল্মের মতো এতো বড় একটা ক্যানভাস ছেঁড়ে কেন এই অন্তরঙ্গ নাটকের প্রতি আপনার চলাচল শুরু করেছেন?  

শঙ্খ ঘোষ – দেখো প্রথমেই ভালোলাগা জানাই যে তুমি আমাকে এমনভাবে পাকড়াও করেছো তারজন্য খুব ভাল্লাগছে। শুভ ইচ্ছা নিয়েই কথাগুলো বলি, এবং আড্ডার ছলেই বলছি।

দেবা রায় – অবশ্যই

শঙ্খ ঘোষ – দেখ ঠিক শিফটিং নয়, প্রতি মুহুর্তে শিফটিং কথাটা বললে, দাঁড়ায় অন্যরকম। আসলে কি হয়, আমার যেটা মনে হয়, যে আমিও মনে করি, মানুষ হিসেবে চলচ্চিত্র তৈরী করা আমার শুরু হয়, যখন আমার ২৭ বছর বয়েস। সেই সময় থেকে আমি বহু রকমের ছবি দেখতে থাকি, কিন্তু আমায় প্রথম নাড়া দেয়, বার্গম্যান ও তারকোভস্কি, এই দুজন। নাড়া দেয় কারণ হচ্ছে, আমি তারও আগে থিয়েটারও করতাম। চার্বাক গ্রুপে থিয়েটার করতাম। তখন আমি অভিনয় করতাম এবং তার আগে করতাম সবিতাব্রত দত্তের সঙ্গে। এগুলো সবই মঞ্চের কাজ। এবং করতাম মানে বেশ জোরকদমে মাস্তানি করেই করতাম। অভিনয় করতাম, বিভিন্ন চরিত্রেই করতাম, ভালো লাগতো, খুব ভালো লাগতো। তারপর চলে গেলাম অঞ্জন দত্তের সঙ্গে কিছু থিয়েটারের কাজ করতে, এই থিয়েটার করতে করতে আমার মনে হল, এটা শুধু ফিজিক্যাল থিয়েটার নয়, শারিরীক থিয়েটার নয়, এটার সঙ্গে একটা পড়াশুনা এবং কঠিন পড়াশুনা জড়িত। এবং সেটা কিন্তু আমার শুধুমাত্র ইংরাজী নাটক বা বিদেশী নাটক, উনি  বেশীরভাগ বিদেশী নাটকই করতেন, কিন্তু অঞ্জন দত্তের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার যেটা মনে হয়েছিল যে পড়াশুনাটা কন্টিনিউয়াস করা, এবং তার সাথে চলচ্চিত্র দেখা, ‘এটা কর,’ এবং আমাদের দেখাত, এবং আমার বাবা যেহেতু একজন চিত্র পরিচালক ছিলেন, এবং আমার বাড়ীতে ঋত্বিক ঘটক আসতেন, এবং আমি নিজের চোখে মৃণাল সেনকে বাবার সঙ্গে আড্ডা মারতে দেখেছি, আমাদের রাসবিহারীতে একটা পুরোনো বাড়ি, সেই বাড়িতে দেখেছি। ঐখানে ঐ একই, কোথায় একটা মনে হয়েছে, এনাদের সকলেরই কিন্তু থিয়েটার একটা প্রাথমিক ভালোবাসা। এনাদের মধ্যে ছিল, কেন ছিল? কি জন্য ছিল?

তার একটাই কারণ, সেটা রাজনৈতিক কারণ। এবং যে রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং আদর্শে এনারা হাঁটাচলা করেছেন, বিশেষ করে আমি ঋত্বিক ঘটকের কথা বলবো, এবং দেখেছি আমি, যে সরাসরি ইনি কিভাবে ওনার প্রতিবাদী ভাবনা থেকে, সমানে কাজ করে গেছেন, এবং যখন তখন বলছেন যে, আমার যেটা মাধ্যম সেগুলো আমার মাধ্যম বলে কিছু নেই, আমার যেটা মনে হবে, যে এক্ষুনি এটা বলিষ্ঠ, তখন আগের মাধ্যমটা ছেড়ে আমি চলে যাব। একথাটা সবাই আমরা জানি, এবং ঋত্বিক ঘটক বহু থিয়েটার করেছেন, মৃণাল সেনও ছিলেন, কিন্তু ডিরেক্ট মৃণাল সেন নাটকে জড়িত ছিলেন না। এইখান থেকে দেখতে দেখতে আমি, একটি বিদেশী চলচ্চিত্রকারদের সাথে পরিচিত হলাম, তাদের ছবি দেখতে শুরু করলাম, তারপর দেখলাম যে তারকোভস্কি বার্গম্যান, তারও আগে যদি আমি ধরি আইজেনস্টাইন, এরাও কিন্তু ভীষণভাবে থিয়েটারকে আকড়ে ধরেই এগিয়েছে। কেন? তার কারণ আমার মনে হয়, আমি পুঁথিগত জায়গা থেকেই বলছি, পুরোটাই কিন্তু একটা বিশ্বাস অর্থাৎ যা অবশ্যই রাজনৈতিক বিশ্বাস। যে রাজনীতি চলছে সরাসরি তার এগেন্টস্টে কিছু বলতে গেলে আমার একটা মাধ্যম চাই, যেটা হয়তো সিনেমাতে হচ্ছে না, কোথাও মানুষের সঙ্গে টাচ করা যাচ্ছে না। হয়তো সেই মুহুর্তে এক, দু নম্বর হচ্ছে পয়সা হয়তো নেই তখন, একটা সিনেমা করার জন্যে, প্রযোজক আসছে চলে যাচ্ছে, দাঁড়াচ্ছে না, তাহলে তখন কি করবো? অথচ আমার ভেতরে সমানে একটা বিষয় আমাকে পাগল করে দিচ্ছে, এবং তখন রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা থেকে, সেই মুহুর্তে সেই কথাগুলি যদি না বলি, তাহলে আমার বিশ্বাসটা কোথায় যেন ফিকে হয়ে যাবে। তা এটা বলতে গেলে আমার একটা জায়গা চাই তো, একটা প্ল্যাটফর্ম চাই তো, তা সেই প্ল্যাটফর্মের জন্য একটা থিয়েটার। যেটা একটা মাধ্যম।

দেবা রায় – হ্যাঁ থিয়েটারেও বলা যায়, সিনেমাতেও বলা যায়, আমরা একটা সময় জেনেছি যে আমাদের থিয়েটারের পূর্বজরা, তাঁরা বলছেন যে, আমাদের বহু মানুষের কাছে পৌছোতে গেলে আমাকে সিনেমায় যেতে হবে, তা আমার প্রশ্ন যে আপনি তো সেই সিনেমা শিল্পেই আছেন, সেখানে বলতে পারছেন, কিন্তু সেই কাজকে আপাতত বন্ধ রেখে তার অল্টারনেটিভ হিসেবে বা যে ভাবেই হোক থিয়েটারে আসছেন, কেন? যেখানে দর্শক হিসেবে কখনই সেই রেঞ্জটায় পৌছাতে পারবেন না।


শঙ্খ ঘোষ – হ্যাঁ

দেবা রায় – তাহলে এর কারণটা কোথায়?

শঙ্খ ঘোষ – না আমি একটা কথা বলি। দর্শকের কাছে পৌঁছোতে পারবো না, সিনেমা করলেই পৌঁছোতে পারবো, এটা কিন্তু আমার মনে হয় না।

দেবা রায় – স্কোপ-টা বেশী!

শঙ্খ ঘোষ – না এখানেও আমার একটা প্রশ্ন আছে, অর্থাৎ তুমি কি ধরনের সিনেমা তৈরী করছো? ধরো আমি ঋত্বিক ঘটকের কথা বলি, অযান্ত্রিক যখন হল, তখন উনি গাড়ী তুলে দিলেন বসুশ্রী সিনেমা হলের ওপরে। পাগলামো? অবশ্য পাগলামো তো নয়, ওটা হচ্ছে মানুষকে টানা।  মানুষকে বোঝানো। কিন্তু তারপরেও মানুষ ঢুকলো না। সাতাশটা লোক, বত্রিশটা লোক, তাহলে সিনেমা করলেই যে লোক হবে, আর নাটক করলে লোক হবে না, এটা মনে হয় ‘না’, এই ধারনাটা অন্তত আমার নেই। দু নম্বর হচ্ছে, সিনেমা করতে গেলে যদি দশ টাকা লাগে, সেই মোমেন্টে আমার মনে হয় থিয়েটার করতে গেলে সাত টাকা লাগে। তা এটাও একটা  ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে তোমার একটা চিন্তা তুমি প্রকাশ করবে, ইকোনমিক্যাল জায়গাটা, সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে যে থিয়েটার করতে গেলে, সেই ইকনমিক্স যেন কোথায় আমায় চাপ দেবে না। আমি আমার মতো কাজটা করতে পারবো। তবে তুমি যদি বলো এটা কি অলাটারনেট, হচ্ছে না ব্যাপারটা? যে সিনেমা হল না বলে থিয়েটার, আমার তা মনে হয়নি, আমি বলি, আমি একসময় টিউশন করতাম, তখন আমি এতো ছবি বানাই নি, একটা মাত্র, ডকুমেন্টারি করেছি, তখন ভীষণ অবস্থা খারাপ কি করবো? তখন আমি ডকুমেন্টারি প্রথম করি,  সাকিলা বলে একজন কোলাজ আর্টিস্ট, তাকে নিয়ে একটা ছবি করলাম, করতে গিয়ে আমার বহু পেইন্টারের সঙ্গে আলাপ হল। সে বিকাশ ভট্টাচার্য বলো, গণেশ পাইন বলো, গনেশ হালুই বলো, সবার সাথে আলাপ হল, আলাপ হতে গিয়ে যেটা হল, তখন আমি ভীষণ খুঁজছি কি করবো, টাকা পয়সা খুব দরকার, চাকরীও করবো না, তখন এই পেইন্টাররা আমায় বললেন, যে তুমি আমার রঙ সাপ্লাই করো। আমি তখন ওই এক্রেলিক রঙ ওদেরকে সাপ্লাই করতে আরম্ভ করলাম। এবং সেটা আমার কাছে একটা ব্যাবসা হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু ব্যাবসা হলেও আমি কিন্তু এঞ্জয় করছি। যখন বিকাশ ভট্টাচার্য আকঁছেন, আমি তাঁর কাছে রঙ নিয়ে গেছি, এবং উনি বলছেন বোস, একটু চা খা। আমি চা খাচ্ছি আর দেখছি। 

দেবা রায় – সেই সঙ্গটা।

শঙ্খ ঘোষ – হ্যাঁ সঙ্গটা।  যাপন টা। যাপন থেকে সরলাম না আমি। অর্থাৎ আমি যদি ব্যাবসাটাও করি, সেটা যদি যাপনের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমার মনে হয়, ত্থিয়েটার সিনেমা পেইন্টিং, যে কোন একটি মাধ্যম, যে মাধ্যমটা তোমার শিল্পকলা। সেটার সাথে একেবারে তুমি যদি শুয়ে পড়তে পারো, ঘুমিয়ে পড়তে পারো, তার সাথে যদি উলঙ্গ হতে পারো, তাহলে আমার মনে হয়, তোমার কাজ তুমি কিন্তু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। এটা আমার একটা বিশ্বাস এবং দৃঢ় বিশ্বাস। তখন একটা বিষয়, তখন দাঙ্গা লেগেছে, ডিসেম্বর মাস, সিক্সথ ডিসেম্বর, আমি করলাম কি তখন, সমস্ত পেইন্টারদের বললাম, আমি আপনাদের ছটা সাতটা ছবি নিয়ে, আমি একটা এলবাম তৈরী করবো, আমি কিন্তু পয়সা দিতে পারবো না। সবাই আমায়, গণেশ হালুই, বি আর পানিসর, আরও বেশ কিছু অমিতাভ দা, শ্যমল দত্ত রায়, এরা সব আমাকে ছবি দিলেন। এবং আমি কিন্তু তখন একটা এলবাম তৈরী করলাম এবং বিক্রি করলাম, সেই পেইন্টিং এর এলবামের বিষয় ছিল দাঙ্গা বিরোধী ছবি। ছোট্ট একটা এলবাম, এ-ফোর কাগজে ওনারা সকলে দিয়েছিলেন। সেটা আমি তখন বিক্রি করেছিলাম, ওনারা ওনাদের নিজেদের বন্ধুদের বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এইভাবে চলতে চলতে আমি  আবার একটা সিনেমার মধ্যে ঢুকলাম। তখন ঐ মুহুর্তে ছ’মাস কিন্তু আমি বেঁচে ছিলাম ওটার মধ্যে। আমি দেখেছি আমি কিন্তু ওটা যন্ত্রণা থেকেই করেছিলাম। আপমি পারছি না, আবার আমি কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে সেলসম্যান হতে পারছি না। আমি কিন্তু ওষুধ বিক্রি করতে পারছি না। আমি একটা চায়ের দোকান দিতে পারছি না। আমার কোথাও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু চায়ের দোকানের মানুষগুলোর সঙ্গে আমি আড্ডা মারতে পারি, তাদের সাথে শুতে পারবো, কিন্তু আমি চায়ের দোকানের মালিক হতে পারছি না। কিন্তু সেলসম্যান হিসেবে আমি পেইন্টিং বিক্রি করতে পারি। আমার মনে হচ্ছে আমি কোথাও যেন এঁদের সাথে জড়িত রয়েছি। শুধু পেইন্টারদের সাথে জড়িত নয়, আমি এমন একটা শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছি, যেটা আমারই।

দেবা রায় – ট্রেডের সিগনিফিকেন্স টা।

শঙ্খ ঘোষ – একদম। এইটাই আমার মূল জায়গা। তুমি এটাকে শিফটিং বল যাই বল, সেটা তোমার মতো করে বুঝে নাও।

দেবা রায় – আচ্ছা যাইহোক এবার আমাদের বাংলার থিয়েটার চর্চায় যদি চলে আসি, বাংলা থিয়েটারের অবস্থা আপনি ভালোভাবেই জানেন। আপনি কি মনে করেন, আজকের যে বাংলা থিয়েটার, যেভাবে চর্চা চলছে, যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আপনি কাজটা করতেন বা করেন, সেই রাজনৈতিক চর্চা চরিতার্থ করার জন্য এই থিয়েটারের চর্চা চলছে?

শঙ্খ ঘোষ – হুম। চলছে না।
 
দেবা রায় – তাহলে এখানে একটা ক্রাইসিস আছে!

শঙ্খ ঘোষ – হুম।

দেবা রায় – তাহলে কি আপনার এই ক্রাইসিসটা মেটাতে ইচ্ছে করে না?

শঙ্খ ঘোষ – না আমি ক্রাইসিস মেটাতে পারবো না।

দেবা রায় – কেন মেটাচ্ছেন তো। আপনি যেটা বলতে চাইছেন, সেটা বলছেন তো। আপনার শিল্প যাপনের মধ্য দিয়েই। আচ্ছা এই রাজনীতি বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? কোন রাজনৈতিক কথাগুলি আপনি বোঝাতে বা বলতে চাইছেন?


শঙ্খ ঘোষ – থিয়েটারে বলতে চাইছি না। আমি তো আমার যদি সিনেমা তুমি দেখ, সেখানে বলছি।

দেবা রায় – না থিয়েটারেও তো আপনি বলতে চাইছেন, বলেছেনও।

শঙ্খ ঘোষ – তা হয়তো চাইছি।

দেবা রায় – আমি জানতে চাইছি, রাজনৈতিক পারপাসটা, যার জন্য আপনি ফিল্ম করেন বা নাটক করেন। কোন রাজনৈতিক বিষয়টিকে আপনি উত্থাপণ করতে চাইছেন? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে।

শঙ্খ ঘোষ – যদি বলো যে, বামপন্থী রাজনীতি, তাহলে এক কথায়, বামপন্থী রাজনীতি। কিন্তু আমি যে বামপন্থী রাজনীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি, অর্থাৎ আমি যা দেখে এসেছি, সেই বামপন্থী রাজনীতিটার, আজকে আমার কাছে খুব ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু আমি যে বামপন্থী রাজনীতির কথা বলছি, সেটা, আবার পাল্টে যাওয়াটার মধ্যে দিয়ে আরেকটা নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ চাইছি। এবং সেটার মধ্যে যদি উগ্রতা থাকে, থাকুক।

দেবা রায় – বাঃ! বেশ

শঙ্খ ঘোষ – মানে আমার মনে হচ্ছে কোথাও একটা ধ্বংসের দরকার আছে।

দেবা রায় – প্রতিরোধ তো একটা দরকারই।

শঙ্খ ঘোষ – হ্যাঁ। সেই ধ্বংসটা মানে একটা দাঙ্গা নিশ্চই আমি চাই না। একটা মানুষকে খুন করতে চাই না। কিন্তু একটা মানূষের আদর্শ, যে আদর্শে এখন মানুষকে রোজ উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, সেটা  আমার কাছে আদর্শ বলে মনে হচ্ছে না। আমি যে রাজনৈতিক কথা বলতে চাইছি, সেটা একেবারেই একটা উগ্র বামপন্থা। এবং যেটা আমি এখন পর্যন্ত বিশ্বাস করে আছি, এবং সেটা কতদূর টেকা না টেকা সেটাও আমি জানি না। কিন্তু আমি সেই উগ্র রাজনীতির কথা আমি মনে প্রাণে চাই বা বিশ্বাস করি।

দেবা রায় – এবার প্রশ্ন হচ্ছে। আমরা কি তাহলে বিপ্লব চাইছি?

শঙ্খ ঘোষ – এটা বড় কঠিন কথা। যাইহোক।

দেবা রায় – আপনি কি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা বলছেন? তাহলে তার দ্বারা কি আজকের বাজার সংস্কৃতি যা আমাদের ওপর আঘাত হেনেছে। সেটাকে কি আমরা প্রতিহত করা সম্ভব?

শঙ্খ ঘোষ – কিছুটা ঠকানো যাবেই। পুরোটা আমি জানি না।


দেবা রায় – সেই ক্ষেত্রে নাটকের ভুমিকা কি হবে?

শঙ্খ ঘোষ – নাটককেও সশস্ত্র হতে হবে।

দেবা রায় – সেটা কীভাবে?

শঙ্খ ঘোষ – কীভাবে আমি কি করে বলবো? সেটাই তো আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। অর্থাৎ আমি যে নাটকটা লিখলাম, আমি যে নাটকটা দেখালাম, তুমি দেখলে আরও চারটে লোক দেখলো। তাঁরা দেখার পর বললেন যে,  এটা আপনি যে কারণে একটা জায়গায় করতে চাইছেন, পার্টিকুলার একটা জায়গায়। কি দুটো জায়গায়। এবং আমি পরবর্তী থিয়েটার। আমিও নতুন করে ডেভেলপ করার চেষ্টা করছি, পার্টিকুলার একটা থিয়েটার ওখানেই হবে।৷ সবাই জানবে ওটাই শঙখর থিয়েটার হয়। আর কোথাও হচ্ছে না। অর্থাৎ ওখানে যে পনেরটা লোক আসবে, তাঁদের মধ্যে পাঁচটা বা ছ’টা লোককে আমি কিন্তু বিশ্বাস করাতে পারবো যে, আমি যে কোন রাজনীততে বিলং করি। চলুন।  আমার সঙ্গে হাটুন। আপনারাও হাটুন, কিংবা আমিও আপনাদের সঙ্গে আছি।

দেবা রায় – এখানে একটু আটকাচ্ছি। যদি আমার সঙ্গে হাটুন বলি, তাহলে সেই ব্যাক্তি বিশ্বাস চলে আসছে নাকি?

শঙ্খ ঘোষ – না না না। ব্যাক্তি বিশ্বাস থেকে বলছি না। আবার তুমি বলতেও পারো, আমার দেখে মনে হোল যে আপনি আমাদের সঙ্গে হাটুন আমি হাটবো।

দেবা রায় – তাহলে কি ভাব এক্সচেঞ্জের কথা বলছেন?

শঙ্খ ঘোষ – হ্যাঁ এক্সচেঞ্জ। অবশ্যই। আমি ধরো ঐ যে পনেরোটা লোক জড়ো করছি, পনেরোজনের মধ্যে সেদিন একজন আমাকে দরুন বলেছে, আমাকে বলেনি আরেকজনকে বলেছে। যে শঙখ যেটা বলতে চাইছে, সেটার জন্যে,  শঙখর জীবিত অবস্থায় হয়ে ওঠা সম্ভব কি না আমি জানি না। তবে মৃত্যুর পরে হয়তো হতে পারে। এটা কোন বেসিস এ বলেছে, কি বেসিসে বলেছে আমি জানি না। কিন্তু আমি সেটা বিশ্বাস্ করি আর না করি, আমার কিন্তু কোথাও মনে হয়েছে, এবং উনি এটা বলেছেন যে স্পেশাল জায়গা দরকার যে শঙখর এই কথাগুলো মানুষজড়ো করার জন্যে। এটা কি একেবারে হৈ হৈ করে একেবারে রাস্তায় দাড়িয়ে বললে হবেনা। 

দেবা রায় – একজন মানুষকে ট্রানস্ফর্ম করতে গেলে সেই মানুষটাকে তো আগে তার পরিবেশ থেকে আলাদা হতে হবে। একক ভাবেই তাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আজ চারপাশে যখন আমি রাজনীতিটা দেখছি যে আমাকে একা করে দেবার রাজনীতি চলছে, সেটাও তো একটা চক্রান্ত। বাজার সংস্কৃতি তোমাকে ভালো থাকতে বলছে। তোমার ভালো ত্থাকাটা এসিওর করছে না।

শঙ্খ ঘোষ – হ্যাঁ

দেবা রায় – তুমি আগে নিজেরটা বোঝো, তারপর অন্যেরটা বুঝবে।

শঙ্খ ঘোষ – নষ্ট করছে।

দেবা রায় – হ্যাঁ। তাহলে এই যে আত্মাটাকে নষ্ট করার চেষ্টা চলছে, সেই আত্মাকেই পুনরুজ্জীবিত করার কথাই বলছেন কি?   

শঙ্খ ঘোষ – আত্মা পুনরুজ্জীবিত করতে আমি পারি না, কিন্তু তুমি চেষ্টা করো। আগুনটা তো ভিজে গেছে। দেখো না ভেজার মধ্যেও তো একটা আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে। বারুদ টা তো ভিজেই গেছে। এটা তো সত্য, কিন্তু সম্পূর্ণটা কি ভিজে রয়েছে, এটা তো হতে পারে না।  মানে আমি অন্তত বিশ্বাসি করি না। এবং এটার জন্য না তোমার ভেতরে লড়াই চলে, যার জন্য উগ্রতা দরকার। প্রকাশ ভঙ্গি কি হবে আমি জানি না। কিন্তু একটা উগ্রতা থাকা খুব দরকার। এই ডেস্পারেট অবস্থানটা যদি আমাকে তৈরী করতে না পার…

দেবা রায় – মানে নমনীয়তা দিয়ে সম্ভব না।

শঙ্খ ঘোষ – না কিছুতেই সম্ভব নয়া।

দেবা রায় – তাহলে নমনীয়তা মানে আপনি আবার আন্ডাস্ট্যান্ডিং রাস্তায় যাচ্ছেন তাইতো?

শঙ্খ ঘোষ – একদম। এটাই রাজনীতির মূল কথা।

দেবা রায় আচ্ছা এই উগ্রতাবাদ যদি আমি ধরি বা ধর্মীয় উগ্রতাবাদ যা ক্রমশ গ্রাস করে যাচ্ছে, সকালে থেকে সন্ধ্যে অবধি, আপনি সোশ্যাল সাইট খুলুন বা মিডিয়ায় আসুন, সর্বত্রই তাদেরই জয়গান চলছে, পাড়ায় পাড়ায় উৎসব বেড়েই চলেছে। ধর্মাচরণ বেড়েই চলেছে।   

শঙ্খ ঘোষ – হুম আরও বাড়বে। এটাও ধরে নেয়া যেতে পারে।

দেবা রায় – তাহলে আমরা তো ক্রমশ সংখ্যা লঘু হয়ে পড়ছি। 

শঙ্খ ঘোষ – না হচ্ছি না, তার কারণ হচ্ছে, তুমি যদি বারবার একটা মানুষকে হ্যামার করো না, যে- তুমি এসো না! এসো, আমার কথাটা শোনো না প্লিজ, সেখানে তোমাকে মাথা নত হয়ে কথাগুলো বলতে হবে। এই নত হতেও কিন্তু আমরা পারছি না, এটাও ঘটনা। এই যে আমি এখন যে কথাটা বলছি, বারবার আমার কথার মধ্যে কিন্তু আমি এসে যাচ্ছে। এইটাকেও ভাঙ্গতে হবে, মানে এই জায়গাটা কিন্তু আমাদের অনেকের মধ্যে আছে। এইটা যদি তুমি না ভাঙ্গতে পারো তাহলে কিন্তু, কিছুতেই তোমার কথা কেউ শুনবে না। এটা কিন্তু এই ২০২৩ এসে খুব মনে হয়। যে এত বেশি আমরা থেকে আমিতে পরিণত হয়েছি না, চেঞ্জ হয়েছি, আমি করবো, আচ্ছা আমার এই কাজটা কিরকম? আচ্ছা আমি না এটা করছি কেন? মানে শুধুই আমি। কিন্তু যে রাজিনীতিতে আমরা বিশ্বাস করছি, সেটাতো ঠিক আমি-র রাজনীতি নয়। আমি বলছি ভাবতে, একটু ভাবি না, একটু ভাবি! ব্যাস এইটুকু, ভাবলেই যথেষ্ট।   

দেবা রায় – এক্ষেত্রে একটি ইউনিট যদি ১৫ জনকে ভাবায়, তাহলে এই ভাবনা কতদিনে ছড়াবে?

শঙ্খ ঘোষ – এটা তো খুব বড় প্রশ্ন। এটা আমি জানি না। এইজন্যই জানি না বলছি, আমি তো দেখো- এক্ষুনি তুমি যদি বলো, চলো পতাকা নিয়ে নামি, আমি হয়তো পতাকা নিয়ে নামতে পারবো না, কিন্তু আমি পতাকাটায় বিশ্বাস করি। ধরো সবাই জড়ো হয়ে আছে, আমি নিশ্চই তার তলায়, আছি, কিন্তু আমরাই তো একজন ওভার অল লেখা অভিনয় করা বা পরিচালনা করা, তা সে সিনেমাতেই বলো বা নাতকেই বলো, আমি তো শুধুই রাজনীতি করতে  আসিনি, আমি তো কিছু একটা সৃষ্টি করতেও এসেছি, যেটার মধ্যে একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস রয়েছে, শুধুই রাজনীতি করতে এসেছি, তা তো নয়!

দেবা রায় – বেশ। এবার আমার প্রশ্ন, শিল্প চর্চার তো বিভিন্ন মাধ্যম আছে, আমরা যখন এই ইন্টিমেট স্পেস টাকে ভেবে নিচ্ছি, আগামী দিনে কি এটাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখতে চলেছে?   

শঙ্খ ঘোষ – আমি তো সবসময় সেটাই মনে করি, তার কারণ, শোনো- বেসিক্যালি আমরা ভীষণ বদমাইশ হয়ে গেছি, ‘আমরা’ বলছি কারন আমিও তার মধ্যেই হয়তো আছি, কিন্তু সেখান থেকে যদি জনা পনেরো লোক নিয়ে, জরো করে, একটু যদি, বোঝানো যায়, যে আমরা আছি, খুব কাছ থেকে, ভালোবেসে, আন্তরিক হয়ে, তার জন্য আমি মাইক নিয়ে দেড়শ লোককে তো বলতে পারবো না, যে চলুন না আমরা একসাথে গান গাই। কিন্তু ১৫ জনকে আমার বলার মানে সাহস আছে, যে আমি এইটা চাইছি, আপনারা কি এইটা চাইছেন? একটা প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। ১৫ টা লোকের মধ্যে যদি আমি ছ’টা লোককে মনে করাতে পারি, আমার বুকে   জরিয়ে তারা যদি থাকতে পারে, একসাথে চা খেতে পারে, তাহলেই তো যথেষ্ট বলে মনে করি। আমার কাজ সেখানে হাসিল। ও ৬টা থেকে তো আবার ১২ টা হবে। হ্যাঁ ধৈর্য তো রাখতেই হবে। এখন সেই ধৈর্য, তুমি যদি বলো আমাকে, যে সেই ধৈর্য কি আপনার আছে? আমি বলব, অবশ্যই আছে। না হলে এত তামঝাম থিয়েটার হচ্ছে, এতো তামঝাম সিনেমা হচ্ছে, সেখানে আমি মাথা না ঢুকিয়ে, সেখান থেকে বাইরে বেড়িয়ে কাজগুলো করছি কেন? 

দেবা রায় হ্যাঁ মানে  

শঙ্খ ঘোষ – আমি তো ওটাকে বিশ্বাসই করছি না।   

দেবা রায় – প্রসেনিয়াম যে কাজ অনবরত হয়ে চলেছে, আপনি কি মনে করে এই প্রসেনিয়াম থিয়েটারেও যে চর্চা আজ চলছে, সেটাও কি আন্তর্জাতিক স্তরের বা মানের যে থিয়েটার প্র্যাক্টিস চলছে, তার সাথে তুলনা করা যায়? আমাদের বাংলা থিয়েটার? 

শঙ্খ ঘোষ – না করা যায় না, একেবারে বলবো না, দু একটা হয়তো, চলতে পারে, মানে দু-একটা। মানে সেটাও খুব কঠিন জায়গা, যেমন ধরো, যখন উষা গাঙ্গুলি বেঁচে ছিলেন, তখন একটা দুটো নাটক, আমার কোথাও মনে হয়েছিল, যে কোনো জায়গায় দেখানো যায়, যেরকম ক্যালিফোর্নিয়াতে বসেও আমরা দেখতে পারি আবার আমি কলামন্দিরেও বসে দেখতে পারি, আর এখন যেটা মনে হয়, সব থিয়েটার বলবো না, আমার এই মুহুর্তে মনে পড়ছে, আমি একদম প্রসেনিয়াম থিয়েটারের কথা বলছি, যে খুব স্টাইলে এক্টিংটা করে, বা নাটকটা তৈরি হয়েছে। মেঘনাদ বধ কাব্য। কোথাও মনে হয় মেঘনাদ বধ কাব্য বধ কাব্য কিন্তু বিদেশে দেখানো যেতেই পারে, এবং গ্রহণযোগ্য সেটা হতেই পারে। এছাড়া আমার খুব একটা, কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না, যেটা তুমি প্রশ্ন করলে, যে ইন্টারন্যাশানালি যে এটা যায় কি যায় না।  

দেবা রায় আপনি তো এ বিষয়ে অনেক বেশি পরিচিত, যেটা আপনি, সিনেমার সুত্র ধরে, আন্তর্জাতিক স্তরের কাজ আপনি জানেন, সেই জন্যই আমি প্রশ্নটা করলাম, যে আজকে আমাদের বাংলা থিয়েটারে, মান যে জায়গায় যাচ্ছে, সেই ভাবনা বা মন, তাদের চিন্তন, তাঁরা কি তথাকথিত সেই গড্ডলিকা প্রবাহে মধ্যেই ঢুকে? নাকি তাঁরা এগিয়ে থাকা, নাট্য চর্চার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন?   

শঙ্খ ঘোষ – না, আমি কি বলছি, আমার পাশে যে বন্ধুটি, থিয়েটার করেন, সেও কিন্তু, ঐ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টাই করছেন।   

দেবা রায়জেনে করছেন নাকি না জেনে করছেন?  

শঙ্খ ঘোষ – সেটা তো মুশকিল, আমি জানবো কি করে, আমি যা দেখছি তা বলছি, ধরো আমি তোমায় বলি কৌশিক সেনের যে নাটকটা, সম্ভবত হ্যামলেট, আমি দেখেছিলাম, জ্ঞান মঞ্চে, আমার কিন্তু মনে হয়েছে ও ভীষণভাবে ইনফ্লুয়েন্সড বিদেশী নাটকের দ্বারা, ওর স্ট্রাকচার, যেভাবে, কম্পোজিসন করে বা টোট্যালটা।

দেবা রায় এখানে একটু কন্ট্রাডিক্ট করছি, আপনি যেহেতু অঞ্জন দত্তের সাথে কাজ করেছেন, তাঁর থিয়েটারের আশপাশ দিয়ে কি এই থিয়েটার যেতে পারে?    

শঙ্খ ঘোষ – না সেটা তো অন্য কারণ, অঞ্জন দত্তের থিয়েটারের মধ্যে একটা বিদেশী ঘরানা থাকতো, আষ্ঠেপৃষ্ঠে থাকতো, সেই জন্য অঞ্জন দত্তের সাথে এনাদের তুলনাটা করছি না, কারণ ওনাকে তখনই ভীষণশভাবে হেয় করতো সবাই, কারণ হচ্ছে বাংলা, এই যেমন আমাদের ম্যাক্সমুলারে অরুণদা এসে দেখলেন, বিভাস দা এসে দেখলেন, কি যে করছিস অঞ্জন? একদিন বিভাস দা এই কথা বলেছেন, কিন্তু যখন ধরুণ ঐ সময় দাঁড়িয়ে যেহেতু জার্মান, ওখান থেকে লোকজন আসতো, তাঁরা থিয়েটার দেখতেন, তারপর আমাদেরকে বিদেশে এপ্রোচ করলো, অঞ্জন দা  গেল, আমি যাইনি, যাই হোক, সেটা অন্য কারণে যাইনি, এবং সেটা ওরা এক্সেপ্ট করলো কেন? কোথাও ওদের মনে হয়েছে যে, ব্রেসটের যে নাটকটা হচ্ছে এই নাটকটা ওখানে হয়তো, সহজভাবেই নেবে। জার্মানীতে, আমি জানি না যে কেন এটা এক্সেপ্ট হল, কিন্তু আমার কোথাও মনে হোত, অঞ্জন দা সবার থেকে আলাদা। প্রোডাকশন করার ক্ষেত্রে বলছি, এবার ধরো তোমার ভালো লাগা বা না লাগা বা আর একজন ছেলের ভালো লাগা, সেটা তো একেবারেই আপেক্ষিক, সেটা তো ওইভাবে বলা যায় না, এবং আমার যেটা মনে হয়েছে ধরো, শাওলি মিত্রের যে, নাথবতী অনাথবতৎ, আমার তো অসম্ভব ভালো লাগা একটা প্রোডাকশন, কাজেই এইরকম বিক্ষিপ্ত ভাবে কিন্তু অনেক প্রোডাকসনে যেগুলোকে বিদেশে সহজ ভাবে মানুষ গ্রহণ করবে বলে আমার মনে হয়।    

দেবা রায়করেওছে।

শঙ্খ ঘোষ – হ্যা করেওছে। কাজেই ওইভাবে কিন্তু একেবারে দুরছাই বলা যাচ্ছে না, যে বাংলাতে এমন কোনও থিয়েটার হচ্ছে না, যেটা বিদেশে যেতে পারে না। এটা বলাই যাবে না। বর্তমানে আমার মনে হয়েছে মেঘনাদ বধ কাব্য এটা ইন্টারন্যাশানালি এক্সেপ্টেড। 

দেবা রায়সেও তো অনেকদিন হয়েগেছে, আমি হালের নাটকের কথা বলছি।

শঙ্খ ঘোষ – তাহলে আর একটা কাজ হতে পারে সুমনের একটা কাজ তিস্তাপারের বৃত্তান্ত।

দেবা রায়সেও তো অনেকদিন হোল।

শঙ্খ ঘোষ – না আর তো কিছু মনে পড়ছে না। নেই। নেই কেন জানো তো? আমার কোথাও যেন মনে হয়, প্রকাশদার একটা কথা বারবার আমার মনে হয়, যার জন্য তাকোভস্কিকে ভালো লাগা, ধর ছাত্ররা জিজ্ঞেস করলো, স্যার হোয়াট ইজ ফিল্ম? উনি বলেন যে অনেস্টি। একটাই উত্তর।  

দেবা রায়ঋত্বিকও তাই বলেছেন।  

শঙ্খ ঘোষ – একদম, প্রকাশদার মুখেও তাই শুনলাম। এটা আমার সবসময় মনে হয়, তুমি যদি সৎ হও না, মানে সৎ হওয়াটা ভীষণ কঠিন, কারণ আমরা তো অসম্ভব জটিলতার মধ্যে দিয়ে যাই, সারাদিন, সেটা ফ্যামিলিগত কারণে বল, তোমার নিজের জগতে বল সবটাই এবং আমরা আর্টিফিসিয়াল হয়ে যাই। কি করবে তুমি, এই জায়গা থেকে তুমি যদি সৎ না হয়ে কাজ কর, তাহলে ধরা পরবে। এবং সেটা টাচ করবেই না মানুষকে, তোমাকে আলটিমেট অনেস্ট হতে হবে।      

দেবা রায়আর তখনই কি আমাকে হ্যামলেট ধরতে হবে বা শেক্সপীয়র?

শঙ্খ ঘোষ – না না ধরতেই হবে তা নয়, তুমি তো, নিজেও একটা নাটক লিখতে পারো।

দেবা রায়হ্যা নিজের মৌলিকভাবনা থাকতে হবে, তা না হলে আমার দেউলিয়াপনামো কাজ করবে?  

শঙ্খ ঘোষ – একদম,  

দেবা রায়তাহলে এবার আমরা আসতে পারি, প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা আমাদের থার্ড থিয়েটার ফর্ম, সেই থার্ড থিয়েটার ফর্মকে কীভাবেও দেখেন?  

শঙ্খ ঘোষ – বাদল সরকার আমার প্রিয় মানুষ। তাঁর থিয়েটার আমাকে নাড়ায় না।  

দেবা রায় কেন?

শঙ্খ ঘোষ – কারণ বাদল সরকারের যে কাজ, সেখানে এক্সপ্রেশন, মানুষের ধমনির মধ্যে মানুষকে টান দেয়া, শিরা উপশিরা টেনে বার করা, ভাবনাটাকে। সেটা কিন্তু বাদল সরকারের নাটকের মধ্যে পাইনি।

দেবা রায় আচ্ছা!   

শঙ্খ ঘোষ -বাদল সরকারের নাটক এতো বেশী শারীরিক, মানসিক জায়গাটা বড় অল্প বলে আমার মনে হয়। আজকে ধরো বাদল সরকারের পরে যারা কাজ করছেন, বাদল সরকারের ঘরানার মধ্যে যারা আছেন, তাঁরাও এটা একটু যদি ভাবেন, যেটা প্রবীর গুহর মধ্যেও আমি দেখেছি, ভীষণভাবে উনি শরীর চর্চা, শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা থিয়েটার, এইটাকে প্রাধান্য দেন প্রথমে, তারপর উনি ঢোকেন অন্তরে, কিন্তু আমি তো বিশ্বাস করি যে, অন্তর যদি তোমার না কেঁদে ওঠে, তাহলে তুমি শরীর চালনা করবে কি করে, এটা তো অন্তর থেকেই উঠে আসে, তোমার ভেতর যদি কাঁদে তাহলে তোমার আঙুলও কাঁপবে। তোমার পায়ের কেরে আঙুলটাও  কাঁপবে। এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু এঁদেরকে আমি ভীষণভাবে বিশ্বাস করি, কারণ এঁরা তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে এতো বেশী সৎ, বাদল সরকারের কথা বলছি, যে নিজের জীবনকে টোটাল ভেঙ্গে চুড়ে, তছনছ করে দিয়েছেন, কাজটা করার জন্য, এইবার ধরো উনি তিনটে প্রেম করছেন, কথার কথা বলছি, উনি ছটা বিয়ে করেছেন, এগুলো তো আলোচনা বিষয় হতে পারে না,

দেবা রায়একদমই তাই, তবে অন্তর না কাঁদলে শরীর সঞ্চালন হবে না, এটা বাদলবাবুও মনে করতেন এবং অভ্যাস করাতেন। এখানে আপনার কথা থেকে একটা বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি, এই যে মাঠে, ময়দানে, জন-অরণ্যের মাঝে নাটক করা আর আপনার কথামতো ১৫ জন দর্শকের সামনে কাজ করার মধ্যে একটা বড় ফারাক লক্ষ্য করছি। দুটোরই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। আমি সে বিষয়ে যাচ্ছি না, এবার উপসংহারে আসতে হবে। আমরা এরকম একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যে ইন্টিমেট থিয়েটার, বা ব্ল্যাকবক্সটা ভবিষ্যতের জন্য একটা জায়গা হতে চাইছে।

শঙ্খ ঘোষ – এখনই হয়ে গেছে। কারণ প্রচুর বেড়ে গেছে ইন্টিমেট স্পেস। আমাকে সেদিন একজন অভিনেত্রী এই স্পেসে অভিনয়ের পরে বললেন, দাদা এই যে এই স্পেসে কাজটা করলাম না, কিরকম একটা অন্যরকম ফিলিং হল, কিন্তু সেটা স্টেজে করলে এরকম ফিলিং হয় না। ব্যাস এইটুকুই তো যথেষ্ট, শিক্ষা। আর তো দরকার নেই, তোমাকে তো জোর করে বলার নেই, এই মঞ্চে করিস না, এই মঞ্চ ছেড়ে এখানে কেন করছিস? পয়সা নেই আর প্রশ্ন নেই কিন্তু ওর কাছে। ও আগে ভাবতো, ও মঞ্চে যেতে পারছি না, পয়সা নেই, চলো, আজকে একটু মুক্তাঙ্গনের সামনে গিয়ে রাস্তায় করে আসি, কিন্তু এখন ধরো ধীরে ধীরে কিন্তু এই ছোট ছোট হলগুলো হওয়াতে, একটা ভাবনা চিন্তা ডেভেলপ করছে, এটাই তো যথেষ্ট।

দেবা রায় এটা আবার অন্যদিকে চলে যাচ্ছে না তো, ব্যাক্তি বা আলাদা হয়ে যাবার প্রবণতা? 

শঙ্খ ঘোষ – সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। সেটা তো আমি আলাদা করে বলে দেবার কেউ নই না! বা তুমিও কেউ নও। আসলে আলাদা তো, তুমি যদি হও, তুমি এমনিতেই হতে পারবে। তুমি যদি মনে কর, যে তোমার বউকে তুমি ডিভোর্স দেবে, বা তার সাথে আমি আজকে দেখা করবোই না আমি বা আরেকটা বান্ধবী এসে গেছে, তা তুমি তো সহজভাবে একা হয়ে, পুট করে একা হয়েও তার সাথে চলে যেতে পারো। ইট ডিপেন্ডস যে তুমি নিজেকে কীভাবে ভাবছ। ওই সেদিন আমি বলছিলাম না, বারবার নিজেকে ফিল্টার করো, ফিল্টারটা আমরা যদি করতে থাকি, কন্টিনিউয়াস, তাহলে তুমি কখন যে উলঙ্গ হয়ে যাবে, তোমার রঙবেরঙের পোষকটা ছেঁড়ে তুমি সহজ হবে, তুমি সেটা নিজেই হয়ে যাবে। এটা জন্য কাউকে তৈরি করতে হবে না। ওই সেই ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে সততার প্রশ্ন আরকি।

দেবা রায়আমার শেষ প্রশ্ন, আপনার অনেক মূল্যবান সময় নিয়ে নিলাম।

শঙ্খ ঘোষ – আমার ভালোই লাগলো।

দেবা রায়আচ্ছা। ধন্যবাদ। আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কি?

শঙ্খ ঘোষ – আমি যেটা সব সময় বলি, আবারও বলছি, কালকে আমি প্রবীরদাকে এই কথাটাই বলেছি, সেটা হচ্ছে যে আমরা উলঙ্গ হতে পারছি না, আমরা যদি একটু উলঙ্গ হই, তার মানে আমরা সহজ হই। তাহলে আমার মনে হয় যে সমস্ত কিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা আমার কাজটা। অর্থার আমার কাজের সাথে কিন্তু অর্থনীতি সমাজনীতি, রাজনীতি, সবটাই জড়িয়ে পড়ে, অর্থাৎ আমরা উলঙ্গ হয়ে বলা মানে, তোমাকে প্রকাশ্যে সকলে চিনবে, তুমি করছ।

দেবা রায়এক্সপোসড!

শঙ্খ ঘোষ – এক্সপোসড হতে হবে তোমায়, নিজেকে। তুমি লুকিয়ে থেকো না। তুমি নিজেকে প্রকাশ করো, উলঙ্গ হও। ব্যাস!

দেবা রায়বাংলা নাটক ডট ইনের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনি যে আপনার মূল্যবান সময় বাঁচিয়ে আমাদের এতক্ষণ সময় দিলেন, তার জন্য। আর আমাদের বাংলা নাটক ডট ইনের নাটক ও সিনেমার এই ম্যাগাজিন সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

শঙ্খ ঘোষ – খুব ভালো কাজ। আমি আপনাদের সাথে আছি।

দেবা রায় – ধন্যবাদ  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -