দুলাল চক্রবর্ত্তী
এক উঠোন (বিভিন্ন দলের এক সমন্বিত সংস্থা) আয়োজিত মানিক নাট্যমেলায়, সম্প্রতি নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে, সমগ্রের মধ্যে, চতুর্থ মঞ্চায়নে অভিনীত হয়েছিল নব বারাকপুর ছন্দনীড় সংস্থা প্রযোজিত “উপায়” নাটকটি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা মূল গল্পের নামও উপায়। সংস্থা দিশা নাম দিয়ে ।
গল্পেটির নাট্যরূপ আরোপ করেছেন, দলেরই নাটককার কানাইলাল চক্রবর্তী। তিনি এই গল্পটিকে এক ঘন্টার ছোট নাটকের আকারে লিখেছিলেন। তাতে এই নাটকের নাম ছিল দিশা। ছন্দনীড় সংস্থা, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উৎসবে, এই দিশা নাটকের পূর্ণ পরিসরকে কাজে লাগিয়ে, এক ঘন্টা সময় কালে বেশ কিছু সফল মঞ্চায়নও করে ফেলেছে। এই উৎসবে যেহেতু অভিনীতব্য যে কোন নাটকের নির্ধারিত সময় সীমা ছিল ৩০ মিনিট। তাই সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে এদিনের এই মঞ্চায়নটি ছিল, মূল নাটকের সম্পাদিত এবং সংক্ষিপ্ত করণ করে আনা খন্ডিত চেহারায় পূর্ণ গল্পের অনুপুঙ্খ নাট্যাভিনয়। এখানে এই নাটকের নাম দেওয়া হয়েছিল “উপায়’।
নাটকের মঞ্চভাষা আবিস্কার ও অভিনয় সঞ্চালনা করেছেন দলের নির্দেশক কমল দত্ত। তিনি নব বারাকপুরের স্থানীয় নাট্যজন। ছন্দনীড় সংস্থার বিশিষ্ট নাট্য মনস্ক ব্যক্তি।
এই উপায় নাটকে উঠে এসেছিল, আসাম থেকে ছিন্নমূল হয়ে কলকাতায় ছিটকে পড়া এক হতভাগা পরিবারের কথা। নগর সভ্যতার জটিল আবর্তে ঢুকে পড়া, সন্তান সহ ভূষণ-মল্লিকা এই উদ্বাস্তু পরিবারের দুর্দশার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত অমানবিক ছলনা বৃতান্ত কাহিনী। দেশ স্বাধীন হবার পরে, যারা নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্যতামূলক চাপে নতি স্বীকার করে, ভিন্ শহরে এসে, বিপত্তির মধ্যেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, এই গল্প তাদেরই জীবনে ঘটে চলা মর্মান্তিক কাহিনী বলে গেছিল। নাটকটি যথেষ্ট প্রাঞ্জল প্রকাশে এবং উপযুক্ত উপাচারে মঞ্চায়িত হয়েছিল। এটি একটি ঘটনা প্রধান উপস্থাপনা।
রাষ্ট্র নির্ধারিত অমানবিক অভিসন্ধিতে এবং রাজনৈতিক স্বার্থে চালিত এমন অনেক ঘটনাই, তাঁর সমসাময়িক কালে মানিক বন্দোপাধ্যায় যেমন চাক্ষুষ করেছিলেন। আজ আমরাও, এই ধর্মীয় মৌলবাদের আগ্রাসনে আক্রান্ত বাস্তবতায়, তেমনটাই দেখতে শুনতেই এগিয়ে চলেছি। এখন সকলেই আতঙ্কিত আছি, আগামীতে কে কোথায় কোন বিতর্কিত আদেশে দেশে থাকবে না ভিনদেশী আখ্যায়িত হয়ে ডিটেকশন ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নেবে। তা নিয়ে কোন সদর্থক কথা বলা যাচ্ছে না। সামনের দিনে রাষ্ট্র বিবেচিত নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ কোন পরিবার, কবে দেশ মাটি বিচ্ছিন্ন হয়, তাও কেউ বলতে পারছি না। এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতির চরম শঙ্কিত প্রহরে এই সময় দাঁড়িয়ে আছে বলেই, গল্পটির নাট্য অভিনয় অবশ্যই প্রাসঙ্গিক এবং জরুরী একটি গল্পের নির্বাচন। এই গল্পের গঠন বৃতান্ত থেকে খুঁজে খুঁড়ে ঈঙ্গিতগুলিকে, গল্পের চলন গতি প্রকৃতি অনুসারে নাটককার, নিজের কল্পনা ও নাট্য জ্ঞানকে মিশিয়ে একটি সুনাট্য রচনার নিরিখেই তুলে ধরেছেন। তাই গল্পে তীব্র ভাবে প্রকটিত নয়, এমন গুন্ডা, পুলিশ, পাগল এবং ধান্দাবাজ কিছু মানুষ শিয়ালদহ ষ্টেশন চত্বরে এসে ভূষণ ও মল্লিকার মুখোমুখি হয়েছে। তারা আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দ্বান্দ্বিকতায় দেশের আভ্যন্তরীণ কাঠামোকে নাটকের প্রয়োজনেই চিনিয়েছে। কারণ সকলেই এই দম্পতির কাছে বিড়ম্বনার কারণ। সকলেরই গোপন স্বার্থ তাগিদে এদের সহানুভূতি দেখিয়ে, প্রকারান্তরে কিছু হাতাতে চেয়েছে। যার মধ্যে মল্লিকার রূপ যৌবন ঘিরে উন্মাদনা গভীর চক্রান্তের অবতারণা করেছে। অতএব নারী লোলুপ এক সমষ্টিগত শক্তির নেগেটিভ আ্যপ্রোচের বিরুদ্ধেই নাটকের প্রতিপাদ্যের কহতব্য বিষয় উঠে এসেছে। সেখানে আত্ম সম্মান, ইজ্জত ইত্যাদির রক্ষার্থে, জাগরিত আত্মশক্তিতে প্রতিকীরূপে নারী জয়ের সংকল্প নিয়োজিত ছিল। তাই সিনেমাটিক এই গল্প, কিছুটা মেলোড্রামাটিক হলেও নাট্যায়নের উদ্দ্যেশ্যে মহৎকর্ম বলেই বিবেচিত হয়েছিল। উপস্থিত দর্শকদের অভিনন্দনও পেয়েছিল। কারণ নাটকের সবটুকুই ভাবনা ও প্রকাশে উজ্জ্বলতা পূর্ণ ছিল।
শিয়ালদহ ষ্টেশন চত্বরের সাময়িক আশ্রয়ে ভূষণ ও মল্লিকা আড়ষ্টভাবে হতবাক দশায় ছিল। তারা আপামর মানুষের সহায়তা চেয়েছিল। তাদের কপর্দকশূণ এই করুণ অবস্থার আন্দাজের মধ্যে ঠকবাজির চূড়ান্ত বাস্তবতা ক্রমান্বয়ে আসতে শুরু করেছিল। দরদ দেখিয়ে উপকারের নামে ভয়ানক ক্ষতির সম্ভাবনা নাটকের এগিয়ে চলার ক্লাইম্যাক্স তুলে ধরেছিল। কিছুই নেই এমন অসহায় এক ছিন্নমূল পরিবারের প্রতি মানুষের উপস্থিতি ন্যায় অন্যায়ের টানাপোড়েনে ঘটনার ঔৎসুক্য তীব্রতর ঘাত প্রতিঘাতে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিল। যাতে, মমতা দেখানো ভরসার পাত্র হয়ে ঘনিষ্ঠতায় আসা মানুষদের ভীড়, আমাদের চার পাশের নির্জনতাই দেখিয়েছিল।
কপট নারী কল্যাণ সমিতির প্রধান কর্তা প্রমথ এবং তার সঙ্গী সাথীদের চলা নানা দ্বান্দ্বিক আলাপে বিলাপে মঞ্চে কলুষিত সমাজের চেহারা উঠে এসেছিল। বিশেষত সেবিকা মানদা ও গব্বর চরিত্র দু’টি নিজের ন্যায় অন্যায় বোধের দ্বান্দ্বিক তারতম্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেই এক অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল। যা প্রমথের ছলা কলা দর্শিয়েছে। মল্লিকার রূপ লাবণ্যে কাতর হয়ে প্রমথ তাকে নষ্ট ভ্রষ্ট করে নারী দেহ ব্যবসায় লাগাতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু আংশিক পারিপার্শ্বিক সহায়তায়, মল্লিকা নিজেই চরম মুহুর্তে তাকে খুন করে নিজেকে এবং নারী সমাজকে, শক্তিময়ী হবার সংবাদ দিয়ে গেছে। যদিও মুহুর্তের মুখোমুখি মোকাবিলা। তবুও নিরুপায়ের আত্ম প্রতিষ্ঠার, আত্ম সম্মান রক্ষার এক অনন্য উপায়। কানাইলাল চক্রবর্তী গল্প থেকে নাটকের চলার প্রতিপাদ্য পথটিকে নারী অবমাননার প্রসঙ্গে যেমন ধরেছেন। যা নারীর সম্মান প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার এনআরসি, বা সিএএ প্রসঙ্গে উত্থাপিত বক্তব্যে দলকেও সমসাময়িক চর্চায় সম্মানিত করেছে।
নব বারাকপুর ছন্দনীড় সংস্থার উপায় নাটকের শিল্পী কলাকুশলীদের অভিনয় নৈপুণ্য মন্দ নয়। যদিও সংক্ষিপ্ত করণে ভূষণ চরিত্রটি বেশ আড়ষ্ট লাগে। তবুও নির্দেশক কমল দত্ত স্বয়ং সফলভাবে চরিত্রটির অসহায়ত্ব তুলে ধরেছেন। দর্শক মনকে বেশ টেনে ধরেছিল মানদা চরিত্রে পম্পি ভট্টাচার্যের সাবলীল ও চাপা বিরোধিতায় আক্রান্ত অভিনয়। গব্বর অপরাধের হাতিয়ার। সে চাকর হয়েই মুখ বুজে হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। তবুও সব শয়ে যেতে গিয়েও তার অন্তর ধিক্কার তাকে প্রমথ বিরোধী করে তোলে। অজয় ঘোষের দাপুটে অভিনয়ে এসব দ্যোতক অর্থবহ লেগেছিল। প্রমথের মিষ্টিমুখ সর্বস্ব ছলনা প্রতারণার আদলে গড়ে তোলা, অসীম সমাদ্দার অভিনীত মাফিয়া চরিত্রটির একহারা গঠন, এই নাটকের শক্তি। এরইমধ্যে খ্যাপা চরিত্রে সুব্রত চক্রবর্তী ও রামলোচনের ভূমিকায় জয়ন্ত বিকাশ দেবনাথ স্বচ্ছন্দ ও স্বচ্ছতায় ভরা ছিল। এদের কেন্দ্রে নানান ছন্দে, তরঙ্গে দোলায়িত মল্লিকার সামগ্রিক ব্যঞ্জনা প্রকাশে সুতপা সরকারের সক্ষমতা, নজর কেড়ে নিতে পেরেছিল। নাটকের কেন্দ্রীয় শক্তিতে তিনি অনবদ্য উপস্থিতি। সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতির মধ্যেই টোটাল টিম ওয়ার্ক নাটকের জন্যে ভাল। প্রায় সকলেই বয়স্ক এবং প্রবীণ শিল্পী। নাটকের পরিবর্তনশীল মঞ্চ ব্যবস্থার নিদেন সাজেশন গুলি নাটকের সম্পূরক কল্পনা বলেই মনে হয়েছিল। সাথে আবহ সংযোজনও সেই মোতাবেক সুন্দর।
মানিক নাট্যমেলায় নব বারাকপুর ছন্দনীড় সংস্থার এই উপায় নাটক নিয়ে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গটি, অবশ্যই ইতিবাচকতা প্রাপ্ত আলোচনা। যা প্রকারান্তরে উঠোন সমন্বয়ের অন্যতম শক্তি।