পারিবারিক ভালবাসায় উদ্বেলিত নাটক উত্তরপাড়া উত্তরায়ণের ‘ফল্গুধারা’

- Advertisement -

দুলাল চক্রবর্ত্তী

বেশ কিছুদিন আগে বহরমপুর রবীন্দ্র সদনে, সৈদাবাদ নবীন নাট্যদলের উৎসবে দেখলাম উত্তরপাড়া উত্তরায়ণ দলের নাটক ‘ফল্গুধারা’। আবার সম্প্রতি দেখলাম ফিনিকের ৯ম সাংস্কৃতিক মিলন উৎসবে, নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে। নাটকের রচয়িতা শঙ্কর বসু ঠাকুর। নির্দেশনা রাণা কুন্ডু। নাটকের আলো করেছেন অনয় মৈত্র, আবহ বিমল দে, মঞ্চ আশিস দাস, প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ জয়ন্ত দাশগুপ্ত। বক্তব্য প্রেমিসে আছে, পারিবারিক বিতন্ডা বিবাদের মধ্যেই মিলনে উদ্ভাসিত “মধুরেণ সমাপয়েৎ” বার্তা। শান্তি দিল এই উদ্ভিন্ন বাস্তবের বিচ্ছিন্নতায় সামান্যতম মিলেমিশে থাকার নাট্য নমুনার আলোকপাত।    

রচনায় অনবদ্য একটি নাটক। টেক্সট হ্যান্ডলিং এবং স্কুলিং অফ এ্যাক্টিং সব ভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কাহিনীর বাঁক গুলি নাটকীয়তায় যেমন উজ্জ্বল। সকলের সম্মিলিত অভিনয় তেমনই প্রাণবন্ত। সুন্দর সরল সাজেশনের মঞ্চ। তেমন আবহের সরলতা। বানানো সাজানোর চেষ্টায় গজিয়ে ওঠা  নাটুকেপনা নেই। আলোতেও উল্লেখযোগ্য কিছু কারুকাজ নেই। আছে চমৎকার সংলাপ। ক্ষুরধার সংলাপ, কথার পীঠে উৎপন্ন বাচনিক মুডের ফুড হয়েছে থোতা মুখ ভোতা করার উদ্যমে। সারাক্ষণই টানটান বিতন্ডা, খুবই বিপজ্জনক। ঘরের মধ্যে ঠোকাঠুকি….এই লাগে সেই লাগে চুলোচুলি, এমনই তীক্ষ্ণ ও তীব্র পরস্পরের ঠেলাঠেলি……উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। এই  যায় তো সেই যায়….কথায় কথা বাড়া বিবাদের মধ্যেই, ভেঙ্গে পড়ার প্রাক্কাল ও ছিল সমাগত…। যখন চন্ডাল মুহুর্ত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দিয়েসকলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করছে… হ্যাঁ যেমনই তা করছে,….ঠিক তার সাথেই, আবারো ভিন্ন কথার প্রশান্তি বোঝাপড়া কথা (মজা তামাসার) জল ঢালা আরামে আহ্হ  বলে জেগে উঠছে….. আসছে নতুন ভেসে আসা উদ্ভুত সমন্বয় পরিস্থিতির আরেক মুহুর্ত। এভাবেই ভাবে স্বভাবে উৎপন্ন হয় আসছে সাংসারিক সমৃদ্ধি সাপেক্ষের রাসায়নিক মজা। খুব অল্প সময়েই মুহুর্তের বদল এবং সেই মোতাবেক ঠান্ডা লড়াইয়ের ধরন রপ্তটাই এই নাটকের মঞ্চ সাফল্যের কেন্দ্রে আছে।

কথা আছে। মুখের কথা হয়েই। মনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে যায় নি মন কিম্বা মনান্তর। এতেই সাজছে সম্পর্ক….একটার পর একটা পোশাক খুলছে। আর পড়ছে। ভূপতিত পোশাকেরা লুটিয়ে পড়ে হাহাকার কলরব কোলাহল করছে।পাশেই চুড়ির নিক্কনে ঝনঝন শব্দেও বাজছে, কিন্তু তা বড্ড সুরেলা… বিচিত্র বিবিধ স্বর বৈচিত্রে। এভাবেই শশুর জয়শঙ্কর, স্বামী দয়াশঙ্কর, পুত্রবধূ অঞ্জনা এবং নাতনী শ্রীময়ী নিজেরাই মিলেছে আপন দায়িত্বে। তাই সংসারে বিবাদ বিসম্বাদ বলে যে কিছু হয় না। হবার কথা নয়। এ নাটকে তা প্রমাণ করে তবেই ছেড়েছে। সামান্য আরোপন এসেছে নাতনীর পাত্র খুঁজতে বেড়িয়ে যখন জয়শংকর যে বাড়িতে যাচ্ছে। তখনই আবার নাতনী শ্রীময়ীর প্রতি অনুরক্ত প্রবাসী, সেই বাড়ির ছেলে প্রেম কাতর অনিন্দ্য এ বাড়িতে প্রপোজ করতে এসেছে। গল্পের এটুকু মাত্র গড়ে তুলতে নিতে হয়েছে। নাটকের সৃষ্টিতে খুবই চমৎকার এক হৃদয় জয়শঙ্কর ন্যাওটা ভুতনাথ কল্পনা। মা শীতলা সমিতি ক্লাবের মস্তান সে। কিন্তু সে জানে সম্পর্কের দাম।  সংসারের আপাত গোলমালে মুখরা পুত্রবধূ অঞ্জনার কটকটিতে রাগ নয় শ্রদ্ধা অনুরাগ অবিকল ছিল। মনের অবয়ব পাল্টাচ্ছে না। পাল্টে চলেছে বোকামির জিভ কেটে শুধরে চলা ফল্গু নদীর ছলাৎ হাসি। তাই নাটকে আত্মার বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য আছে সংসার বৈচিত্রে। মুখগুলি পাল্টে যেমন গেল না, মুখরা বৃত্তিও বিন্দুমাত্র কমল না। কিন্তু মরে ভুত হয়ে গেল যুক্তিহীন কব্জি জোরের অনুমানগুলি। অন্যথায় ধ্বংস অনিবার্য হতে পারতো।

হেরে যাওয়া মুখ নিজেকে নিজেই যদি লুকিয়ে ফেলে, তখনই স্বীকার আছে তার। তাই এ নাটকের নানান বৈপরীত্যেও পেছন থেকে গাল পেরে বা ছুরি ধরে গলা কাটতে এল না কেউ। সংসারে সমাজে রাজনৈতিক দলে এই মিলন যদি অবিচল অবিকল থাকতো। তবে কী শান্তিটাই না হতো। এই ক্ষমতা প্রমাণ করার গদি যুদ্ধে মানুষ উলুখাগড়া সমান হতো না। ইত্যাদি নানা ভাবনতেই ভাবাল নাটক ফল্গুধারা। শঙ্কর বসু ঠাকুরের অনেক ভাল নাটকের মধ্যে এটি সেরা নাটক। সত্যি বলতে পরিবার এখন কই? পারিবারিক খুনসুটি এখন কী আর আছে? টুকরো হয়েছে তো সংসার, এ’মতে সে’মতে,…মনান্তরে। পথের বিভেদে,.. অশিক্ষিত কার্তিকেয় চালে… অহংকারের আল্হাদে। রাজনৈতিক সহমত নেই বলেই ফল্গুধারার পরিচয় সমাজে সংসারে দেশে কোথাও নেই।

সব কথার আড়ালে এমন নজর পড়েছে, যেখানে মরছে না বিচারবোধ। এক-ই ছাদের তলে মুক্ত করছে সবার মনকে। ঝরঝর করে ঝর্ণার মতো বয়ে চলেছে তাই নাটক, শান্তির পারিবারিক সম্মিলনে। চলতি নাজারে আজ সম্পর্কগুলি ক্রমেই ব্যারিকেডেড হচ্ছে। মনের ভেতরে ইগোর দাপট তীব্র। সমাজে সংসারে কেউই দু কথা ব’লে মুখোমুখি হয় না। লুকিয়ে ফেলে মনোভাব। হারিয়ে যায় কথা। মোবাইলে গিয়ে মেশে আত্মা। সামাজিক সাংসারিক কমিউনিকেশন অবরুদ্ধ হয়ে, চেপে যায় সবার ঠোঁটে উজিয়ে আসা বলতে চাওয়া বক্তব্য। তাই পরস্পরের কাছে খোলামেলা হচ্ছে না কেউ। ঝগড়া, বিতন্ডা, বিবাদ, বিতর্ক কিছুই এখন উন্মুক্ত মনের স্পেসে নিজেদের জন্যেই তৃপ্তিদায়ক নয়। অনাবিল শান্তি একতাবদ্ধ, এগুলির দিকে ফিরে তাকাতে আর প্রেক্ষাগৃহে বসে আনন্দিত হতে উত্তরপাড়া উত্তরায়ণ দলের ফল্গুধারার তুলনায় আর নাটতো খুঁজে পাচ্ছি না।

অবশ্যই গল্প বলবো না। বলবো শুধু এই নাটকের পুত্রবধূ অঞ্জনা’র চরিত্রে অত্যন্ত মাত্রা বোধে সজাগ, নাটকের প্রেমিসে মাথা খাটিয়ে কাজ কিরা শিল্পী মহুয়া চ্যাটার্জীর কথা। তিনি নাটকের জয়ের শক্তি। ভুতনাথ চরিত্রে রাণা কুন্ডুর কমেডি তালে তালবাদ্য হবার প্রাণ প্রাচুর্যও মধ্যবর্তী সময়ে একঘেয়েমি আসার বিরুদ্ধে অন্যতম নাট্য তৎপরতা। অবসরপ্রাপ্ত, মা শীতলা সমিতির সভাপতি জয়শঙ্করের উদাত্ত কন্ঠস্বরের (দীপঙ্কর ভট্টাচার্য) চরিত্রায়নটি নাটকের প্রশান্ত মেরু। কিন্তু হৃদয় হয়েছে শ্রীময়ীর বুদ্ধিমত্তায়। অন্যদিকে বোকা হাঁদারাম স্বামী দয়াশঙ্করের (প্রণব ভট্টাচার্য) ভিজে বেড়াল সাজেই রয়েছে নাটকে ধরা অধরা প্রাণের, প্রতিমা প্রাণ বিন্দু। মিষ্টি অনিন্দকে (সায়ণদীপ ধর) ভুলিনি। তবুও চমৎকার এই চরিত্রে এদিন জয়ন্ত দাশগুপ্ত। শ্রীময়ীর দুই শিল্পী বহরমপুর ও নৈহাটিতে যথাক্রমে শতরুপা চ্যাটার্জী ও অদ্রীজা বন্দোপাধ্যায় দু’জনেই একইরকম সাবলীল ও স্বাভাবিক। শ্রদ্ধা জানাই অদ্রীজাকে মাত্র ২৪ ঘন্টায় এক চরিত্র হয়ে ওঠার সামর্থ্যে। সবাই মিলেই বিভিন্ন স্বর বৈচিত্রে এবং বিহেভ প্যাটার্ন এ অনিন্দ্য নিরুপম নাটক গড়েছেন। জয় হোক উত্তরপাড়া উত্তরায়ণ দলের।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -