সুব্রত কাঞ্জিলাল
অনেকেই আমার কাছে আবদার করেন, দাদা একটা হাসির নাটক লিখে দেবেন?
আমি বলি, চারিদিকে যা চলছে, এসবের মধ্যে হাসি পায়? আমি তো দেখছি অসংখ্য মানুষ রাগে ফুসছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। কোটি কোটি বেকার এদেশে এই রাজ্যে জন্মগ্রহণ করার জন্য অনুশোচনা করছে। ন্যায় বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কান্নাকাটি করছে। শত শত কৃষক প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে। এর মধ্যে হাসির খবর কোথায়?
শাসকদের ভন্ডামি, ডিগবাজ বিশেষজ্ঞ নেতা মন্ত্রী, কর্পোরেট মিডিয়ার সার্কাস এইসবের মধ্যে প্রহসনের উপাদান আছে। যা থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক প্রহসন মূলক নাটক রচনা করা যায়।
আমাদের কতিপয় নাট্য বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, না না না ওসব চলবে না। কোনরকম রাজনৈতিক বিষয় নাটকে থাকবে না। নির্মল হাসির নাটক দরকার। যে নাটক হবে সম্পূর্ণভাবে অরাজ নৈতিক।
আমি বলি, তাহলে আমাকে জীবন বিরোধী, সমাজবিরোধী নাটক লিখতে হবে। কারণ সমাজের জন্য, জীবনের জন্য লেখক শিল্পী রা দায়বদ্ধ। সুস্থ সুন্দর সমাজের জন্য, জীবনের জন্য কবি শিল্পী সাহিত্যিকরা কাজ করেন। জীবনে এবং সমাজে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নানারকম অসঙ্গতি থাকে। অনাচার, ব্যভিচার, দুর্নীতি, অমানবিকতা আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করি। শিল্পীর মন ঠিক তখনই বিদ্রোহ করে ওঠে। প্রতিবাদ করতে চায়। অসংগতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়। শিল্পী তখন তার নিজের অস্ত্র অর্থাৎ কালি কলম, তুলি রং, ক্যামেরা, থিয়েটারের ভাষা হাতে তুলে নেয়।
রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হবার সূত্রপাত ঘটেছিল এক ব্যাধের হাতে মিথুনরত পক্ষী দম্পতির মৃত্যুর ঘটনা দেখার পর। অকারণ রক্তপাত দেখে কবি মন রক্তাক্ত হয়েছিল। আর ঠিক তখনই তার মুখ থেকে যে শ্লোক উচ্চারিত হয়েছিল তার অর্থ, বন্ধ হোক হিংসা। রক্তপাত।
পৃথিবীর প্রতিটি মহাকাব্য রামায়ণ মহাভারত ইলিয়াস ওডিসি কিংবা ডিভাইন কমেডি কেন লেখা হয়েছিল বলতে পারেন? এগুলো কি নিছক অরাজনৈতিক?
আমাদের দেশের সংস্কৃত নাটক থেক শুরু করে, শেক্সপিয়ার এর নাটক, ইবসেন, মলিয়ের, ম্যাক্সিম গোর্কি, চেখভ, রবীন্দ্রনাথ, এদের নাটক গুলো কি অরাজনৈতিক?
আমার মনে হয় রাজনৈতিক বিষয় সম্পর্কে আমাদের অনেকের মধ্যে স্বচ্ছ ধারণা নেই। রাজনীতি যে সমাজবিজ্ঞান এইটা আমরা স্কুল কলেজের পরীক্ষা পাশের বই থেকে জানতে পারি। পরীক্ষা পাশের জন্য ওইসব বই মুখস্ত করে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জন করি। বাস্তব জীবনে এসে বিষয়টা নিয়ে চর্চা করি না। আমরা বুঝতে চাই না যে, একটা সমাজের
ভিত্তিমূল যেমন অর্থনীতি, সেই ভিতের উপর যে স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে থাকে সেটাই হলো রাজনীতি, ও সমাজ নীতির অন্যান্য দিক গুলো। যেমন শিল্প-সংস্কৃতি, মানুষের মূল্যবোধ ইত্যাদি। সুতরাং রাজনীতি বিবর্জিত শিল্প সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ সোনার পাথর বাটির মতো।
জনৈক সমাজ বিজ্ঞানী বলছেন, যেখানে দুজন মানুষ এক জায়গায় অবস্থান করে সেখান থেকে শুরু হয় রাজনীতি। যেখানে একাধিক মানুষ, সমাজবদ্ধ জীবন, গ্রাম গ্রামান্তর শহর নগর কেন্দ্রিক অসংখ্য মানুষের যে জীবন সেইখানে থাকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতির ভূমিকা।
শ্রেণী সমাজে যেদিন থেকে হুজুর মজুর, রাজা প্রজা ভাগ হয়ে গেল, সেই দিন থেকে হুজুর শ্রেণী বলা শুরু করলো, মজুরের কাজ অনন্ত শ্রমের মধ্যে ডুবে থাকা। হুজুরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করা। প্রজাদের কর্তব্য রাজ পরিবার এবং বংশের সেবা করা। এটাই তাদের মূল ধর্ম। রাজনীতি আসলে রাজার নীতি। এখানে প্রজাদের অনুপ্রবেশ চলতে পারে না।
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে হুজুর শ্রেণি শ্রেণী শোষণের মধ্যে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। দাস যুগে পশুর মত মানুষকে দাসত্ব স্বীকার করতে হয়েছিল। দাস ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যে অর্থনীতি বিকশিত হয়ে উঠেছিল তারই প্রভাবে রোম সাম্রাজ্যের মতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ধনী বণিক রাজন্যবর্গের বিলাসী জীবন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। রাজন্যা বর্গ পুরোহিত শ্রেণীকে দিয়ে প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলা ন হতো, রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি। সুতরাং রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা র অর্থ ভগবানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। প্রজাদের কাজ রাজ আনুগত্য স্বীকার করে ভবিতব্যের ফল ভোগ করা। রাজনীতি একটি ভয়ংকর অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুর পর নরকবাস।
গ্রিক মহাকাব্য ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল।
ইসকা ইলাসের লেখনিতে আমরা পেলাম জনগণের জন্য বিদ্রোহের আহ্বান। যীশু খ্রীষ্ট রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ এবং যুদ্ধ ঘোষণা করল। স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ ছিল রোম সম্রাট ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দাস জনতার শ্রেণী সংগ্রাম।
ভারতীয় সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুরু বৃহস্পতির অনুগত চার্বাক বাহিনীর বিদ্রোহ ছিল রাজা ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম।
আমরা কি বলতে পারি না যে মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সাহিত্য? বাংলা আধুনিক থিয়েটারের জন্ম হয়েছিল যে নীলদর্পণ নাটক দিয়ে সেই নাটকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নাটক এবং সাহিত্য?
পরাধীন ভারতবর্ষে অসংখ্য নাটক রচিত হয়েছিল যা ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নাটক। আমাদের ঐতিহ্যশালী যাত্রা সেখানে ও দিনের পর দিন মাসের পর মাস রাজনৈতিক পালা শুনতে হাজার হাজার মানুষ ছুটে যেত। মুকুন্দ দাসের স্বদেশী যাত্রা এই ধারার উল্লেখযোগ্য অংশ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ও রাজনৈতিক নাটকের প্রবল চাহিদা ছিল। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, গ্রুপ থিয়েটার এইসব নাটকের অসামান্য মঞ্চায়ন ঘটিয়েছিলেন। সেইসব শত শত নাটক উপভোগ করতে হাজার হাজার দর্শক রাতের পর রাত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতে ন।
তাহলে রাজনৈতিক নাটকের বিষয়বস্তু কি হওয়া উচিত? অন্যদিকে অরাজনৈতিক নাটক বলতে যেগুলো প্রচলিত, সেই সব নাটকে আমরা শেষ পর্যন্ত কি পাই? কলকাতার ব্যবসায়িক মঞ্চে অর্থাৎ একদা স্টার থিয়েটার, রংমহল, বিশ্বরূপা, সরকারিনা তে যেসব নাটক হতো, সেইসব নাটকে আমরা যে গল্প পেতাম, সেই গল্পের চরিত্রগুলো ড্রয়িং রুমের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো।
অর্থাৎ ড্রয়িং রুমের বাইরের যে জগত যাকে আমরা বৃহত্তর সমাজ জীবন বলি, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা বলি, তার সঙ্গে ড্রয়িং রুমের খাঁচায় আবদ্ধ মানুষগুলোর কোন যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যেত না। মনে হতো ড্রয়িং রুম যেন এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এখানকার মানুষগুলোর খিদে পায় না, রোজগার করে না, আকাশ দেখেনা, প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন এক একটি নর কঙ্কাল। এরা নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি করে। হিংসা প্রতি হিংসায় জর্জরিত হয়। এদের জীবনে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত ঋতু গুলোর কোন প্রভাব নেই।
সিনেমার অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে এইসব নাটক মঞ্চস্থ হত। দর্শকদের বেশিরভাগ অংশ সিনেমার তারকাদের দেখতে টিকিট কাটতো।
কিরণ মৈত্রের নাটক যা বিধায়ক ভট্টাচার্য মহাশয়ের নামে সেতু নাটকটি মঞ্চস্থ হত স্টার থিয়েটারে। এক নারীর মা হতে না পারার যন্ত্রণার নাটক। এই নাটকটি মূলত তাপস সেনের আলোর জাদু দেখার জন্য জনপ্রিয় হয়েছিল। মঞ্চের মধ্যে একটি চলন্ত ট্রেনকে দেখানো হয়েছিল। এই নাটকের কোন সামাজিক আবেদন ছিল না। এই ধরনের অসংখ্য নাটক মঞ্চস্থ হতে হতে একটা সময় ব্যবসা আর জমছিল না। তখন ব্যবসায়িক কারণে রঙ্গমঞ্চে নাইট ক্লাবের ক্যাবারে ডান্সারদের আমদানি করা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো ব্লো হট নাটক। সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। নিষিদ্ধ জগতের নাটক। ইত্যাদি।
পরিহাসের কথা এই যে, এতসব করেও ওই থিয়েটার ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়লো। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক এগিয়ে চলল। কারণ গ্রুপ থিয়েটারের নাটকে আর্থ সমাজ রাজনৈতিক জীবনের চিত্র স্পষ্ট ছিল। সমসাময়িক সময়ের ভাষা উচ্চারিত হচ্ছিল। সাধারণ মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো দর্শকরা প্রত্যক্ষ কর ছিল। রাষ্ট্রের অমানবিক ভয়ংকর স্বৈরাচারী ভূমিকা গ্রুপ থিয়েটার নাটক সাহসের সঙ্গে মানুষের কাছে পরিবেশিত হচ্ছিল।
আমরা দেখলাম উৎপল দত্তের নাটক থেকে শুরু করে
আরো অসংখ্য ছোট বড় নাটকের দলগুলোর প্রযোজনা মঞ্চ সফলতা অর্জন করছিল।
রাজনৈতিক নাটকের ডেফিনেশন কি হওয়া উচিত এই নিয়ে বামপন্থী মহলে অনন্ত তর্ক বিতর্ক চলে আসছে।
এরই মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বললেন, আমাদের দেশে প্রকৃত রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ করা অসম্ভব। কারণ আমাদের দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ইউরোপ আমেরিকা তে গণতন্ত্রের যে রূপ দেখতে পাওয়া যায় সেই রকম মুক্ত বাক স্বাধীনতা এদেশে নেই। পরাধীন ভারতবর্ষ যেমন ভাবে অসংখ্য নাটক উপন্যাস সরকার ব্যান্ড করে দিয়েছিল, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ও শাসকগোষ্ঠী বারবার অসংখ্য নাটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দেশদ্রোহিতার অজুহাতে শিল্পীদের জেলে যেতে হয়েছে। সরকারের মনপসন্ত না হলে বারবার অনেক সিনেমা, সাহিত্য গ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
গণনাট্য সংঘের একাংশ এবং বামপন্থী মহলের একাংশ, মনে করতে ন, প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং দলীয় রাজনীতির প্রচারমূলক নাটক আসলে রাজনৈতিক নাটক। এই ভ্রান্ত ধারণা গ্রুপথিয়েটারের অধিকাংশ নাট্যকর্মীদের মধ্যে আজও বদ্ধমূল হয়ে আছে।
তারা কিছুতেই বুঝতে চান না যে, রাজনীতি কোন সংকীর্ণ বিষয় নয়। শিল্পসাহিত্যে কোনভাবেই সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রচার চলতে পারে না। বৃহত্তর অর্থে রাজনীতির ভূমিকা বিজ্ঞান চর্চার মতো গুরুত্বপূর্ণ।
ভোট প্রচারের জন্য যেসব এজি ট প্রপ নাটক রচনা করা হয়, তার সীমানা এবং প্রাসঙ্গিকতা ক্ষণকালের জন্য। শিল্পের সাধনা চিরায়ত সাধনা। শিল্পের আবেদন কালাতীত।
বিগত ৭০ এর দশক থেকে ছোট নাটক প্রতিযোগিতার মঞ্চে মঞ্চে আমরা রাজনৈতিক নাটকের নামে যত জো তদার জমিদার খতম হতে দেখেছি, তত জো তদার জমিদার এই বাংলায় ছিল না। শ্রেণী শত্রু খতম বা শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে বক্তৃতার পর বক্তৃতা আমরা নাটকের মঞ্চে শুনেছি। বাংলার দর্শক ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। একটা সময় এমন হলো যে, রাজনৈতিক নাটকের দর্শক সংখ্যা কমতে কমতে ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল।
এইসব নাটকে জীবনের অনুরণন খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিপ্লবী চরিত্র গুলো পাথরের মত চেহারা নিয়ে কথা বলে। তাদের মুখে হাসি নেই। কান্না নেই। তারা প্রেম করে না। তাদের গায়ে কোন কলঙ্ক নেই।
গিরিশ ঘোষ বলতেন, নায়ক যদি ভুল না করে, কলঙ্কের দাগ তার গায়ে না দেখা যায়, তাহলে নাট ক লেখা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
আমরা আজও বুঝতে পারি না যে নাটকে কোন গল্প কিভাবে সাজিয়ে তোলা হবে। আমাদের অধিকাংশ নাটকের পাত্র-পাত্রীরা মঞ্চে আসা-যাওয়া করে। তারা চরিত্র হয়ে ওঠে না। কারণ নাট্যকার চরিত্র নির্মাণ করতে পারেননি।। নাট্যকার তার বলবার কথা গোল গোল করে পাত্র পাত্রীর মুখে গুঁজে দেয়। দর্শকের চোখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে বোঝাতে চায় তিনি আসলে কি বলতে চান।
উৎপল দত্তের ভাষায় বলতে গেলে, নাটক হল সেই জিনিস যার মধ্যে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত এবং সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক চিত্র আমরা দেখব। ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের, ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের এক জটিল বিন্যাস হলো নাটক।
কার্ল মার্কস একবার শ্রমিক শ্রেণীর বিষয়বস্তু নিয়ে শ্রেণী সংগ্রামের নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। তারপর নাট্যকার এর উদ্দেশ্যে বলছেন, আমরা ওই বিপ্লবী শ্রমিকদের লিঙ্গ খুঁজে পেলাম না।
অর্থাৎ নাটকের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম ছিল। বিপ্লবী কথাবার্তা ছিল। জীবন্ত মানুষ ছিল না। যেমন আমাদের এখানকার বেশিরভাগ নাটকে রক্তমাংসের মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার রাজনৈতিক নাটকের লেখকরা তাদের অন্যতম শত্রুকেও খুঁজে পান না। না পাওয়ার কারণ অভিজ্ঞতার অভাব। জীবন বোধের অভাব। কোন একটা বিষয় নিয়ে যদি কেউ উপন্যাস কিংবা নাটক লিখতে চান তাহলে অবশ্যই তাকে সেই বিষয় সম্পর্কে যতদূর জানা যায় জানতে হবে। অবজারভেশন এবং ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হবে। এইখানেই আমাদের দুর্বলতা।
যদি প্রশ্ন ওঠে, যৌনকর্মীদের বঞ্চনা শোষণ বিষয় কেন আমাদের নাটকে উঠে আসছে না? ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, বিজ্ঞানের নামে অপ বিজ্ঞানের প্রচার, জনসাস্থ্যের বিষয় নিয়ে ভয়ংকর একটা অসুস্থ সমাজ তৈরি করার বাণিজ্য। আমাদের নাটকের বিষয় হতে পারে নাকি? নর নারীর প্রেমের গল্পের মধ্যেও যে শ্রেণী শোষণ, শ্রেণী সংগ্রাম ঢুকে পড়েছে, এ ব্যাপারে আমরা কতটুকু সচেতন?
যারা হাসির নাটক খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তাদের কি মনে হয় না হাসির জন্য হাসি হয় না। আমরা সব সময় হাসি না। ক্ষুধার্ত মানুষ হাসতে ভুলে যায়। সাড়ে পাঁচশ দি ন ধরে অনশন ধরনা দিয়ে বসে থাকা চাকরি প্রার্থীদের জীবনে হাসির মজার কোন স্থান নেই। চার্লি চ্যাপলিনের থিয়েটার এবং সিনেমা হাসি হাসি তামাশা নয়। ক্ষুধার্ত বঞ্চিত মানুষের কান্না। মিথুন রত একটি দম্পতি পাখি যখন তীর বিদ্ধ হয়, রক্তাক্ত হয়, সেই দৃশ্য দেখে বাল্মিকীর মধ্যে হাসির সঞ্চার হয়নি।
তবে হ্যাঁ পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষায় এমন অনেক হাসির নাটক আছে যা পাঠ করার পর, কিংবা মঞ্চস্থ হওয়ার পর দর্শকের বা পাঠকের পিঠে সপাং সপাং চাবুক পরে। নাটকের মর্ম বস্তু উপলব্ধি করার পর হাসি হারিয়ে যায়। জার্মান নাট্যকার ব্রেষট সাহেব এর এইরকম অনেক নাটক রয়েছে। আদতে ওই নাটকগুলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নাটক। শেক্সপিয়ারের কমেডি গুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, সমাজের কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত চেহারাটা।
একটা রাজনৈতিক নাটক তখনই আদর্শ নাটক হয়ে উঠতে পারে, যখন সেই নাটকের মধ্যে আমরা দেশ সমাজ ও মানুষের হতাশা, প্রত্যাশা, জীবন যন্ত্রণা, এবং স্বপ্নের বিশ্বস্ত চিত্র দেখতে পাই। চরিত্রগুলো বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশে।
ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার উপন্যাসের অনেকগুলো নাট্যরূপ বাংলায় দেখা যায়। উপন্যাসটা সমগ্র পৃথিবীতে বহু পঠিত। সোভিয়েত রাশিয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। সিনেমাটা বেশ উঁচু দরের কাজ বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে বাংলায় যে নাটক গুলো আমরা দেখেছি, তার কোনোটা ই উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। ওই উপন্যাসে জারিও রাশিয়ার গরীব মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের যে বিশ্বাসযোগ্য দলিল পাওয়া যায়, সেই অংশগুলো বাংলা নাটকে বর্জন করা হয়েছে। ফলতো, মা নামক বাংলা নাটক গুলো রক্তমাংস হীন কতগুলো কঙ্কালের স্লোগান সর্বস্ব জীবনের উত্তাপ হীন নির স আখ্যান হয়ে থেকেছে। এই কারণেই এই নাটক বামপন্থী পরিমণ্ডলের বাইরে অন্য কোন দর্শককে আকর্ষণ করতে পারেনা।
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমা কাল জয়ী রাজনৈতিক সিনেমা। এই সিনেমার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। একই রকম ভাবে উৎপল দত্তের নাটক টিনের তরোয়াল কালজয়ী রাজনৈতিক নাটক। সত্যজিৎ রায় এই নাটক সম্পর্কে বলেছিলেন, এটাই হলো বাংলা থিয়েটারের উচ্চতা।
একটা আদর্শ রাজনৈতিক নাটকের মধ্যে আমরা একটা দেশ, সময়, মানুষ ও সমাজের ইতিহাস কে জানতে পারি। যেমন জীবনানন্দ দাশের কাব্যের মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসকে দেখতে পাওয়া যায়।
বিগত কুড়ি বছর ধরে বাংলা থিয়েটারের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক নাটক দূরের কথা, বাংলার সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনের কোনরকম ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই অবক্ষয়ের কারণ বাজার অর্থনীতি। নাটক এবং সিনেমার লোকজন থেকে শুরু করে সংস্কৃতি জগতের অনেকেই নিজেকে বাজারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। শ্রমজীবী মানুষরা দিশাহীন। মানুষের মুক্তির আন্দোলনের কথা যারা বলতেন, তারাও বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের চোরাবালিতে ডুবতে বসেছেন ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, বিদুর। তবে নতুন প্রজন্মের একদল তরুণ-তরুণী লড়াইয়ের ময়দানে এসে দাঁড়িয়েছে। এরাই লিখবেন নতুন ইতিহাস। না লেখা একটি কালজয়ী রাজনৈতিক নাটক এরাই রচনা করবে।