Anil Dey: নাট্যশিক্ষক ও নির্দেশক অনিল দে’র মুখোমুখি

- Advertisement -

সাক্ষাৎকার – দেবা রায়

আজ আর অনিলবাবু (Anil Dey) আমাদের মধ্যে নেই। রয়ে গেছে তাঁর মূল্যবান কথাগুলি। বছর ছয়েক আগে তাঁর গলফগ্রীনের বাসভবনে বসে তাঁর মুখোমুখি হয়ে তাঁকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। সেই সকল প্রশ্নের সাবলীল জবাব আগামীদিনের বা আজকের নাট্যকর্মীদের অবশ্য পঠিতব্য এক সাক্ষাতকার বলেই মনে করি।

অনিল দে (Anil Dey) থিয়েটার ও দুরদর্শনের জগতে একটা উজ্জ্বল নাম, এই জগতে আপনার কাজের ইতিহাসের স্মৃতিচারণা দিয়ে শুরু করি।  

অনিল- অনেক ঝাপসা হয়ে গেছে সব, তবু বলি- আমি যে অভিনয় জগতে এসেছি, সেটা আকস্মিকভাবে আসিনি। আমার বাড়িতে অভিনয়ের একটা ভালো পরিবেশ ছিল। আমি জীবনে প্রথম যাত্রাতে অভিনয় করি। আমার বাবার একটি যাত্রার দল  ছিল, সেই যাত্রার দলে আমি অভিনয় করি। তার আগে অবশ্য একটা হয়েছিল, সেটা হচ্ছে টালিগঞ্জ নাট্যসমাজ বলে একটা অপেশাদার যাত্রার দলে, আমার বড়দা সেখানে ফিমেল সাজতো। তখন ফিমেলরা সেভাবে যাত্রা বা নাটকে কাজ করতো  না। এটা ৫২ সাল। এবং আমি তখন থেকেই অভিনয় করি। তারপর বাবা দল  খুলল, আর টালিগঞ্জ নাট্যসমাজের যতগুলো নাটকে বালক অভিনেতার দরকার পড়েছে, আমি তাতে অভিনয় করেছি। আমার বাবা অক্ষয়কুমার দে। উনি কিন্তু নিজে যাত্রা করতেন না। কিন্তু উনি ফাইনান্সার ছিলেন। ওনার নিজের নামে দলটা, অর্থাৎ ওনাকে কেউ নামিয়েছিল। আমাদের খুব ভালো পয়সা ছিল, কারণ আমার বাবার একটা কারখানা ছিল, সেখানে ধানকলের মেশিন তৈরী হত। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট ছিল, বাবার একটা অফিস ছিল, ছোটবেলায় আমি সেখানে গেছি, নববর্ষের দিন, পূজোটুজো হত। আমরা তিন ভাই, তার মধ্যে আমার বড় বোন যে আমার পরে, সে গ্রামাফোন কোম্পানীতে রেকর্ড করা আর্টিস্ট ছিল। আমার বড়দাও খুব ভালো গান গাইতেন। মেজদাও গান গাইতে পারতেন। মেজবোন আমার ইমিডিয়েট পরে, আর আমার ইমিডিয়েট ওপরে হচ্ছে বড় বোন। সেও গান গাইতে পাড়তো।

অর্থাৎ আমাদের অ্যাটমসফেয়ারটা এরকম ছিল। সকালবেলা। ঘুম থেকে উঠলে, সব বিছানায় পর পর শুয়ে আছি, বাবা একাই  ব্যাবসা করতেন, তখন আমরা সকলেই ছোট। আমার তখন দশ বছর। তিনি  এইসব পছন্দ করতেন। ওনার লাইফটাও খুব স্ট্রাগলের লাইফ। সেটাও শুরু হয়েছিল অভিনয় দিয়ে। কলকাতা শহরে এসেছিলেন গ্রামে একটা যাত্রার দল গিয়েছিল, কৃষ্ণযাত্রার, সেখানে, আমার বাবা গায়ের রঙ কিন্তু কালো, সেখানে যাত্রা দেখতে গিয়ে তার মনে হল যে কৃষ্ণ করেছে আমি তো তার চাইতে ভালো করতে পারবো, তখনি ম্যানেজারের কাছে গিয়ে বল্ল, আমি আমাকে কৃষ্ণ চরিত্র দিন আমি গানও গাইতে পারি, অভিনয়ও পারি। তিনি বললেন, তুমি কোথায়  থাকো? বলল আমি কাছেই থাকি, আমাদের বাড়ি ছিল যশোরে। নহাটা গ্রামে। বলল – ঠিকাছে গাও দেখি গান, বাবা গান গাইল, তাকে সঙ্গে সঙ্গে পছন্দ হোল, আমার ঠাকুরদাদা মারা গেছেন, বাবার চৌদ্দ বছর বয়সে। বাবার অবস্থা খুব  ভালো ছিল না। বাবার মামার কাছে বড় হয়েছেন। সেখানে মাও ছিল। পিসিরা ছিল। তারপর বাবা কলকাতায় চলে এল, সেই যাত্রা নিয়েও চলে এল। এই আমরাও কলকাতায় এসে গেলাম।

মায়ের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারতাম না। কিন্তু পছন্দ নিশ্চই ছিল, সবকটা ছেলে, বাবা খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। মা হয়তো সেই জন্যে কিছু বলতেন না। এই আমি এদিকে চলে এলাম, ওই নাট্যসমাজে। প্রথম যাত্রা পালা হচ্ছে, ব্রজেন্দ্রকুমার দে এমএবিটি, এই এম,এ,বি,টি উনি লিখতেন। ওর যাত্রা লীলাবসানে আমি করতাম কৃষ্ণের ভক্ত মুকুল। আমার প্রথম চরিত্র অভিনয়ে। সেটা এই দশ-এগারো বছর বয়েসে। স্কুলে  তখন অনেক নীচের দিকে পড়ি। আমি একটু বেশী বয়সে ভর্তি হয়েছিলাম। ৭  বছর বয়সে। আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম। আমার একবার পড়লেই সব মনে  থাকতো। আর আমার পড়তে বসতে হোত না। আমি খুব কম পড়েছি। পড়াশুনা যা করেছি, বড় হয়ে করেছি। যাইহোক এই করতে করতে অভিনয়ের একটা নেশা  চেপে গেল, সকলেই কিন্তু অভিনয় ছেড়ে দিল, আমার কিন্তু চাগাড় দিল। আমি স্কুলে অভিনয় করতাম। যেখানেই যেতাম অভিনয়ের জন্য ডাক পেতাম। ডাকঘর  করেছি আমি চোদ্দবার। অমলের চরিত্রে, বহু মেডেল পেয়েছি। সে মেডেল আবার নিজেই দিয়ে দিয়েছি অন্য লোকেদের ভালো অভিনয় দেখে।

এইভাবে লাইফটা শুরু হয়েছে, স্কুলে পড়তাম, দেশপ্রান বিদ্যায়তনে, তারপরে আমার খুব চড়া গলায় ডি সার্পে গান গাইতাম বলে, আমি যে বয়েসে ডি সার্পে গান গেয়েছি, ঐ বয়েসে কচি  গলা তো, ঐভাবে গান গাওয়া উচিত হয়নি, এখন বুঝি। কিন্তু ওদের প্রয়োজন  ছিল, গাইয়ে নিয়েছে, চোটের পর থেকে আমার গলাটা ভাঙ্গা হয়ে গেল। মাঝখানে আমার বড়দা চিদপুরে যাত্রার দলে গেল। চন্ডী অপেরা। বড়দার খুব সুখ্যাতি ছিল। গোপাল রানি বড়দার নাম। গতবছর মারা গেছেন। মেজদাও তার বিশাল দশাসই চেহারা নিয়ে লক্ষী করতেন, আমি ছোটবেলায় দেখতাম অতবড় লক্ষী।  এইভাবে শুরু হোল, স্কুল থেকে নাটক করলাম, নিজে নাটক লেখার ঝোঁক তৈরি হল। রবীন্দ্রনাথের সব নাটক করলাম, একটা দল তৈরি করলাম যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে করলাম তোতাকাহিনী। দলটার নাম ছিল  সাথী সংস্থা। আমি সমস্ত তোতাকাহিনীর সমস্ত নাটকটা লিখেছিলাম ছড়ায়। কবিতা লেখা ছড়া লেখা এগুলো আমার ছোটবেলা থেকেই অভ্যেস ছিল। আজও সেটা আছে। যদিও এখন আর আমি সক্রিয় নই। নিস্ক্রিয় হয়েও আমি আছি, যেমন তুমি এলে, এরকম অনেকেই আসে আমার কাছে। তারপর কলেজে গেলাম, এম এ পাশ করলাম। এম এ পড়বার সময় বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়লাম, বাবা আমাকে  আশুতোষ কলেজে ভর্তি করতে নিয়ে গেলেন। কিন্তু আমি বাংলা পরবো শুনে বাবা রাজী হচ্ছে না। সাইন্স পড়তে হবে। আমি কিছুতেই পরতে চাইলাম না। আমার অঙ্কে ভীষণ ভয় ছিল। স্কুল ফাইনালে অঙ্কে আমি ৩৪ পেয়েছিলাম।

তখন  বাবা নিয়ে গেলেন প্রিন্সিপালের কাছে। খগেন সেন। বাবা বললেন দেখুন ওকে আমি  বলছি সাইন্স পড়তে, ও বলছে বাংলা পড়বে, রেজাল্ট দেখে খগেনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি কবিতা লেখ? বললাম হ্যাঁ। তিনি শুনতে চাইলেন আমার লেখা  একটা কবিতা। আমি বলে দিলাম। খগেনবাবু বললেন বাহ, এতো খুব ভালো, কেন ওকে আপত্তি করছেন? এটা করলেই ও যেখানে পৌঁছোবার ঠিক পৌঁছবে। বাবা তা মেনে নিয়ে বাংলাইয় ভর্তি করালেন। আশুতোষ ছেড়ে আমি চারুচন্দ্রে  এলাম প্রানের বন্ধু গনেশ বসুর জন্য। সেও আমার সাথে থেকে থেকে কবিতা লিখতে শুরু করলো। পরবর্তিকালে সেও কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। ও অমৃত  পত্রিকায় চাকরি করতো। মনীন্দ্র রায়ের অমৃত পত্রিকা। এইভাবে চলতে থাকে। আমি একটা নাটক লিখেছিলাম চেক বিপ্লবের ওপরে। আমাদের সময়টা  ছিল একদল বিপ্লবের সময়। নাটকটার নাম কম্পন। সেই নাটকটা পাশের পাড়ার জয়ী  বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন নাটকটা আমাকে দিয়ে দাও, আমি করবো। সে তখন নতুন দল নিয়ে কাজ করছে নাম পঞ্চপ্রদীপ। আমাকে বলল তুমি আসবে না আমার দলে? আমি তখন ওই ভাঙ্গাচোরা একটা দল, যেখানে নাটক ও হয় না, কি করি? আমি গেলাম করলাম, তারপর সেই দলটাও ভেঙ্গে গেল। তখন পাশের   পাড়ায়  আমার অন্য বন্ধুরা , তখন নকশাল মুভমেন্ট খুব তীব্র। তখন আমি এম   এ করছি।

তার আগে কমিউনিস্ট পার্টি একটাই ছিল। সিপিআই। সেই পার্টি  করতাম আমি। আমি সদস্য ছিলাম। ডাইরেক্ট আমি পার্টি করতাম, যেখানে মিটিং হোত সেখানে আমি গান গাইতাম, আমি অনেকগুলো গণসংগীত লিখেওছিলাম। সুর করেছিলাম। সেই হারমোনিয়ামটা আজো আমার কাছে আছে। এর পরে নাট্যায়নে ঢুকলাম। সেখানে বিজন চ্যাটার্জী ছিলেন ডিরেক্টর। তারা একটা শো করে সকলে মিলে আর আসছে না। তখন পার্মিসন নিতে হত। রবীন্দ্রভারতী থেকে দিত, কিন্তু পার্মিশন নিতে হত?? সেটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, নামটা মনে পরছে না। যাইহোক সেখান থেকে পার্মিশন নিলাম, ছমাসে জন্য। সার্টিফিকেট আমার হাতে অথচ শো নেই। তখ আমি ছেলে খুজতে লাগলাম। যাকে পাই তাকেই বলি আয়। পাড়ার দোকানে তিন চারটে ছেলে আড্ডা দিত, তাদের ধরে আনলাম, তার মধ্যে একজন সুব্রত ঘোষ। সে আজীবন আমার সাথেই থেকেছে। সম্পাদক ছিল। এই আমার দল নাট্যায়ন হয়ে গেল। নাট্যায়ন নিয়ে আমি প্রচুর ভাবনা চিন্তা করেছি। সেখান থেকে কত নাটক পুরস্কার পেল। আমার জীবনে একবারই একদম শুরুটা ব্যারাকপুরে, কম্পিটিশনে আমরা সেকেন্ড হলাম। তার ফলে সকলে উতসাহ পেয়ে গেল। কিছু আমি লিখলাম, কিছু নাট্যরূপ দিলাম, পর পর কাজ করে গেলাম।

আমি সবসময় মঞ্চ নাটক এবং আমার নাটক করেছি। সমরেশ বসুর ‘মানুষ রতন’ করেছি। সুনীল গাঙ্গুলির ‘গরম ভাত’। ওদের কাছেও গিয়েছি আমি পার্মিশনের জন্যে।  সমরেশদা তো বললেন, মানুষ রতন স্টেজে হবে? আমি বললাম কেন হবে না? সে বললে না ও তো রিক্সাওয়ালেদের নিয়ে ব্যাপার, মঞ্চে কি রিকসা তুলবে তুমি?  আমি বললাম আমি কীভাবে করবো আমি জানিনা, আপনি গল্পটা পার্মিশন দিলে তাহলে গিয়ে লিখবো। বলল তুমি গুপী গাইন বাঘা বাইন করেছো তো, আর ভরসা পারছি না যে তুমি করতে পারবে না। গুপী গাইন বাঘা বাইন যে মঞ্চে করতে পারে, সে সবকিছুই করতে পারে। আমি লিখলাম, শো করলাম, সমরেশদাকে ডাকলাম , উনি শো দেখলো, দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, বলল আমি ভাবতে পারিনি, গল্পটা আরো অনেকে ওপরে উঠে গেছে। সুনীলদা গরম ভাত দেখে প্রথমে ইম্প্রেসড হন নি। আমি গল্পটা চেঞ্জ করেছিলাম। দারিদ্র আর  সেক্স এই দুটো পাশাপাশি থাকে, এটা সুনীলদা বলতেন। গল্পেও তাই করেছিলেন। শ্বশুর বৌমাকে সিডিউস করছে। আমি তো গ্রুপ থিয়েটার করনেওয়ালা ছেলে, আমার পক্ষে ওটা করা অসম্ভব, অথচ গরম ভাত দারুণ সাবজেক্ট। আমি ওটা করলাম, কুসংস্কার আর দারিদ্র পাশাপাশি। তা দেখে তো তার পছন্দও হোল না। আমাকে বলল, খুব ভদ্রলোক, আমি বললাম কিরকম দেখলেন? আমার ত মুখ  স্টাডি করা খুব সহজ কাজ, বুঝে গেলাম। তার ভালো লাগেনি। আমারও কিছু করার নেই, তখন গরম ভাত জমে গেছে। ধরো থিয়েটার দেখে কেউ যদি বলে মন্দ না, তাহলে বুঝবে ভালো লাগেনি।

আবার যদি কেউ বলে উফ কী ভালো, তাহলে বুঝবে তার ভালো লেগেছে। যদি জড়িয়ে ধরে এসে তাহলে বুঝবে রা খুবই ভালো লেগেছে। ওটা ছিল ৯৫ বছরের বৃদ্ধের চরিত্র। পবন। তার সংলাপটা ছিল  এরকম – বৌ ও বৌ কি খাচ্ছিস রে বৌ! আমার একটা বই আছে। ‘কিভাবে অভিনয় করতে হয়।’ আমার একটা ইন্টারভিউ করেছিল রুদ্র প্রসাদ সেনগুপ্ত। তাতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, থিয়েটারে তোমার কন্ট্রিবিউশান কি? আমি বললাম- আমার কন্ট্রিবিউশন? সেতো বিরাট শব্দ। কিচ্ছু নেই আমার কন্ট্রিবিউশন। তা রুদ্র বলল- গুপী গাইন তোমার কন্ট্রিবিউশন নয়? তুমি ৯২৯  নাইট শো করেছো। আমি বাঘা করতাম, স্টেজের অপর ঢোল বাজাতাম। গুপী  তিন জন করেছে। প্রথম করতো গোরা রায়। দ্বিতীয় করতো শক্তি ঠাকুর। তাকে তখন কেউ চেনে না। মুক্তাঙ্গনে আমাকে একদিন বলল- অনিল বাবু আমার  একখান কথা শুনবেন? আমাকে আপনার দলে নিবেন? আমি বললাম তুমি গান   জান? বলল হ আমি হাইতে পারি। আমি তখন গুপী খুঁজছি। আমি ভাবছি গান গাইতে পারে অথচ তোতলা? গান গাইল। ‘মানবোনা বন্ধনে…’ মান্না দের গান। দারুণ গাইলো। আমি নির্বাচন করলাম, যা থাকে কপালে, শক্তিই করবে গুপী। আমি অনেক ডায়লগ ছেটে বাঘাতে নিয়ে এলাম।

তারপরে শুরু করলাম, কি করে শক্তিকে তোতলামো সারানো যায়। বললাম শক্তি তুমি একটা কাজ করো, ধর তুমি মহারাজ বললে, তুমি আগে বলতে যেও না। তুমি কথাটাকে আগে মুখের মধ্যে তৈরী করে নাও। তারপর দুরদর্শনে আমাকে ডাকল। সেখানে বুদ্ধু ভুতুমের কড়চা শুরু করলাম, আমারই লেখা। ৭৬ সাল হবে। সেখানে একটার পর একটা  প্রোডাকশন করতে লাগলাম। একদিন বিভাস আমাকে বলল। উনি প্রোডিউসার ছিলেন। সে একদিন আমাকে বলল কী অনিল শুধু অনন্যার প্রোগ্রামই করবে আমার কিছু করবে না? তুমি নাটকের লোক তুমি নাটক করবে না? আমি বললাম হ্যাঁ নিশ্চই করবো। আমাকে লিখতে বলল। আমি রাত্রিবেলা বাড়িতে এলাম, স্ক্রিপ্ট লিখলাম, ৬-৭ঘন্টা। তার পরদিনই অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বিভাসে ওখানে চলে গেলাম। বিভাস আমাকে দেখেই বলল – কী? হয়ে গেল নাকি? বললাম হ্যাঁ, শুনবে তুমি? বলল নানা শুনতে চাই না। আমি বললাম   বিভাস তুমি প্রডিউসার, আমি শুনেছি তারা তাদের ইন্সট্রাকশন মত ডিরেক্টরদের কাজ করায়, তুমি কি আমার ওপর ইন্সট্রকশন দেবে? সে বললে- পাগল নাকি? তোমাকে কে ইন্সট্রকশন দেবে? কোনদিনের জন্যও বলেনি এটা কর অনিল। এটা বাদ দিয়ে দাও। সে স্বাধীনতা দেয়, এবং সে নিজেও স্বাধীনভাবে কাজ করে।  আমাকে খুবই পছন্দ করতো।

আপনি কি চাকরি করতে করতেই এসব করতেন?

অনিল- হ্যাঁ। আমার অফিস ছিল হেড অফিস, ব্যাঙ্কে। সেই সময় রিজিয়নাল অফিস হওয়াতে আমাদের কাজগুলো সব সরে যেতে লাগলো। আমার কোন কাজ নেই সকাল দশটায় গিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকি। ডালহৌসি। সেখানে ছেলে মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে ধরতো। আমার কথা শুনতে ওরা পছন্দ করতো। আমি যেহেতু   টেলিভিশনে করি সেই জন্য আমার একটা জনপ্রিয়তা ছিল। আমি সেখানে অনেক স্বাধীনতা পেয়েছি। তারপর রেডিও ডাকল। সেখানেও স্ক্রীপ্ট করতে লাগলাম। অনেক নাটক করেছি। শ্রাবন্তীর সাথেও কাজ করেছি। কী ভুতের নাটকে। আমার  একটা নাটক হবে এর মধ্যে। আপনপর। করছে কুমার রায় একাডমী।

বহুদিন আপনি নাটক দেখছেন না। থিয়েটারের সাথে রাজনীতির তো একটা সম্পর্ক থাকে, আজকের থিয়েটারে কিন্তু বর্তমান সময়কে সেভাবে পাচ্ছি না। তার   মূল কারণটা কি?

অনিল- কারণ, হচ্ছে ভয়। নাট্যকাররা তো বিপ্লবী নয়। তারা সাহসীও নয়। এদেশটা সেভাবে তৈরিও নয়। এখানে কেই কাউকে কিছু বলবে না, বললে মার খাবে। ক্ষমতা ব্যবহার করে আজ সকলেই কম বেশী দেশ চালাচ্ছেন। একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি কখন কি কথা বলছে, সেটার যে কী অর্থ হতে পারে তাও তারা জানে না, তাদের কুৎসিত সব মন্তব্য আদতে আমাদের সংস্কৃতিকে নষ্ট করে। এসব  করেও তারা শাস্তি পায় না। সবটাই টাকার খেলা, তখন বলছিলে না, এত টাকা  কোথা থেকে আসছে? এইখান থেকে আসছে। ভয় থেকে টাকা আসছে। আর পাইয়ে দিয়ে টাকা আসছে। ব্যাবসায়ীরা এখানে ব্যাবসা করতে পারলো না। চাইল না। ব্যঙ্কের টাকা লোন নিয়ে কোটী কোটী, কাউকে টাকা ফেরত দিতে হয় নি। আমরা কিছু বলছি না, কারণ হচ্ছে, প্রথমত এখন যারা নেতা তারা সেই মানসিক শক্তির অধিকারী নয় যে তারা আদর্শের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে। কোন কমিটমেন্ট নেই। নিজের জন্য কমিটমেন্ট আছে, এত এত টাকা স্যালারী বাড়িয়ে নিল, আপত্তি করেছে কোন পার্টি?

কেউ করেনি।

অনিল- না করেছে। সিপিএম করেছে। তারা টাকাটা নেয়নি। পার্লামেন্টে যে টাকাটা বাড়লো সেইটা একমাত্র সিপিএম ছাড়া আর সবাই নিয়েছে। এই যে সস্তায় ক্যন্টিনে খাবার  খায়, এটা আদর্শ? এরা দেশকে গড়বে? সাধারণ মানুষ তো পারবেই না, তাদের ভয় হবে। যে আমার কথা বলতে যেয়ে আমার গলা কেটে নেবে। খবরের কাগজ  খুললেই দেখবে হয় ধর্ষন, নাহয় চুরি, নাহয় খুন। সর্বত্র হচ্ছে। কারন সব জায়গাতেই এরা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া তারা টাকা  তুলছে, কোটী কোটী টাকা তুলছে, সেই টাকাটা কে পাচ্ছে? শুধু মাফিয়ারা  পাচ্ছে? না দেখো গিয়ে সবাই ভাগ পাচ্ছে। ওপর থেকে নীচু তলায়। আর তাই চারপাশে এত আনন্দের আয়োজন দেখতে পাও।    

তাহলে কি আমাদের যে কালচারাল রিসোর্স ছিল, সেখানে কি ঘাটতি হচ্ছে?

অনিল- কালচারাল রিসোর্স যা ছিল, সেটা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কারণ ঐরকম নাটক আর কেউ করবে না। মানুষের চেতনাকে জাগাবার নাটক আর কেউ করবে না। আমাকে যদি কেউ বলে করতে আমি বলবো মাপ করো আমি এই বয়সে আর মারদাঙ্গা করতে পারবো না। নকশাল মুভমেন্টের সময়, পুলিশ আমাকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করলো, এই যাদবপুর থানায়, কী যেন লোকটার নাম, মোহান্তি , তখন আমি ব্যাঙ্কে চাকরি করি, ব্যাঙ্কে তখন আমার খুব পপুলারিটি। ছমাস হয়েছে সবে চাকরি। পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, সে একটা ঘরের মধ্যে, পায়খানা পেচ্ছাপ চারিদিকে, দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমাকে নকশাল বলা হল। কিন্তু পুলিশ তো জানেনা আমি নকশাল বিরোধী। তো মহান্তি এসে বলল স্পেসিফিক কোন চার্জ না থাকলে ছেড়ে দিন ব্যঙ্ক বন্ধ হয়ে গেছে। স্ট্রাইক হয়ে গেছে। ইউনিয়ন দারূন স্ট্রং। আমাকে পুলিশ বলল যে তুমি কি খুব বড় নেতা? আমি বললাম কিসের নেতা? আমি ব্যাঙ্কে ঢুকেছি ছয় মাস, ছয় মাসে কেউ নেতা হয়? তা হলে ব্যঙ্ক বন্ধ করলে কি করে? আমি বললাম, আমি করেছি নাকি? বনধ হয়েছে? তাইতো আমি জানিনা।

ওরা স্ট্রাইক ডেকে দিয়েছে। আজ কি সেটা হবে? ব্যঙ্কে গেলাম থানা থেকে বেড়িয়ে, চেয়ারম্যান ডাকল আমাকে। আমি গিয়ে দেখলাম আমার সামনে সার্ভিস ফোল্ডারটা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন- আপনার চাকরি তো থাকবে না। আমাকে বললেন আপনি কি পার্টি করেন? আমি বললাম না। যদি বলেন তাহলে আমি সিপিআই-এর সাথে আজও আছি। তখন বললেন তাহলে তো আপনার চাকরি থাকবে না। না থাকলে কিছু করার নেই। আপনি বললে আমি চলে যাব। তখন উনি বললেন তাহলে কী করবেন বাইরে গিয়ে? আপনার তো এত কোয়ালিটি রয়েছে, তার ওপরে এমএ। আপনি এই অভিনয় করেন, আপনি ম্যজিকও জানেন? এসব লেখাছিল কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস-এ, উনি সব  পড়লেন, আমি  বললাম  এসব দিয়ে রাস্তায় ডুগডুগি বাজাবো। তখন উনি বললেন আপনাকে ডুগডুগি বাজাতে হবে না, আইনের একটা ফাঁক আছে। হোলনাইট থাকলে  তার সম্পর্কে স্টেপ নেয়া হয়। আর তাই বুঝলাম সেই জন্যেই পুলিশও ছেড়ে দিয়েছে। আজ এটা হলে কেউ যাবেই না। থিয়েটারেও এরকমটা তাই দেখতে পাবে না, এ দলের লোক ওদলে, ওদলের লোক এদলে। টাকা নিয়ে কাজ করছে। তাদের নামে টিকিট বিক্রি হচ্ছে আর সেই অনুপাতে টাকাও পাচ্ছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। আমি একটা ছেলেকে তৈরি করলাম দশ বছর পরিশ্রম করে, তারপর তাকে আমি যখনই আমি বলি যে অমুক তারিখে রিহার্সাল, আছে সে বলে আমার তো শো আছে অন্যদলে, আমি কোনদিন এইটা করতে দিই নি কাউকে।  যেতে গেলে ঐ দলে যাও, সেই দলও উপকৃত হবে, আমিও উপকৃত হবো। আসলে থিয়েটারে দলটা করার জন্য থাকে পাগল দুতিনটা লোক।

আপনার প্রিয় অভিনেতা কে?

অনিল- ইদানীং তো দেখি না, শুনেছি সুরজিত ভালো অভিনয় করে। পুরনোদের মধ্যে সর্বত্রই মনোজ। ভানুদা যেমন সর্বত্র ভানুদা।

ডিরেক্টর বা নাট্যকার হিসেবে আপনি কার কথা বলবেন?

অনিল- ডিরেক্টর হিসেবে আমাদের সময় সব চাইতে বড় ও ভালো ডিরেক্টর বিভাস চক্রবর্তী। শম্ভুদা, উৎপলদা, অজিতেশদা এই তিন জনকে বাদ রেখেই বলছি। একবার মৃনালদা আমার অফিসের ছাদে শুটিং করতে এসে আমাকে নিয়ে গেল। কেকে মহাজন ছিল ক্যামেরাম্যান। আমাকে নিয়ে গিয়ে সারাদিন আমার সাথে নানা গল্প, মৃনালদা আমার সব নাটক দেখেছে। আমি ঋত্বিক ঘটকের অভিনয় পত্রিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ছিলাম। আমার সিরিয়াল ‘যদি এমন হত’, সেটাতে উৎপল  দাকে একটা রোল দিয়েছিলাম। অজিতেশের সাথে আমি একসাথে নাটকের কম্পিটিশনে বিচারক হয়ে গিয়েছিলাম। দেবনারায়ন গুপ্ত তার সাথেও সম্পর্ক ছিল।   

তখন তাহলে ছোট-বড় এই প্যারামিটারটা ছিল না, নাটক করছে মানে সকলেই  সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতো।

অনিল- হ্যাঁ। আমি একবার অজিতেশবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি মৌলিক নাটক  করেন না কেন? এত বিদেশী অনুবাদ করেন কেন? উনি বললেন মৌলিক? কাকে বলে মৌলিক? আপনি মৌলিক? আপনি কোত্থেকে এসেছেন? এই গ্রহটা কি মৌলিক? মৌলিক বলে কিছু হয় না। তারপর থেকে এই কথাটা আমি আর ব্যাবহার করি না। অনুপদার সাথে খুব ভালো পরিচয় ছিল। অনুপদা আমাকে  একদিন রবীন্দ্রসদনে বলেছিল- অনিল আমাকে একটা কাজ দে না রে। আমি কিছু করতে পারিনি। অনুপদার স্ত্রী বিথী গাঙ্গুলী আমাদের দলে অভিনয় করতো।

আগামী প্রজন্মের কাছে আপনার বার্তা কি? 

অনিল- যেন সকলে সৎ হয়। থিয়েটার করতে হলে সৎ হতে হবে। কারণ চরিত্রের সততাটা প্রকাশ করা দর্শকের সামনে সেটাই মূল কথা আর নিজে সৎ না হলে সেটা সম্ভব না।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -