নাটিকা ‘অমৃতের সন্ধানে’

- Advertisement -

অনুপ চক্রবর্তী

যাজ্ঞবল্ক্যঃ মৈত্রেয়ী, আমার বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময় হল। গার্হস্থ্য আশ্রম ত্যাগ করার আগে আমি আমার যা কিছু সম্পদ ও বিত্ত তোমার ও কাত্যায়নীর মধ্যে বন্টন করে দিতে চাই। একথা আমি অস্বীকার করতে পারি না আর তুমিও তা জানো যে আমার দুই সহধর্মিণীর মধ্যে তুমি প্রিয়তর।

তাই তোমার কাছে আমার জিজ্ঞাস্য তুমি আমার সমস্ত সম্পদের মধ্যে কোনগুলো কামনা করো। আমি তোমাকে সেগুলো দিয়ে যাব। আর অবশিষ্ট সম্পদ দিয়ে যাব কাত্যায়নীকে। বলো তোমার কী প্রার্থনা। কী বাসনা। কী আকাঙক্ষা। আমি সব পূরণ করে যাব গৃহত্যাগের আগে। অরণ্যে গমনের আগে৷

মৈত্রেয়ীঃ প্রিয়তম, আমরা দুজন আপনার সহধর্মিণী। আমাদের দুজনের সমান অধিকার আপনার সম্পদে। আমি আমার সপত্নীকে বঞ্চিত করে অধিকতর সম্পদ পেতে চাই না।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ জানি তুমি ন্যায়পরায়ণা। বেশ। তাহলে আমার সমস্ত ঐশ্বর্য, ধন, সম্পদ, সমস্ত বিত্ত তোমাদের দুজনের মধ্যে সমভাবে বন্টন করে যাব।

মৈত্রেয়ীঃ না, প্রিয়। তারও কোন প্রয়োজন নেই ।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ তার অর্থ? কি বলতে চাও তুমি? তোমার কোন প্রয়োজন নেই কোন সম্পদের?

 মৈত্রেয়ীঃ  না, প্রিয়।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ কেন?

মৈত্রেয়ীঃ অমৃত জ্ঞানের চেয়ে কি বিত্ত শ্রেয়, প্রিয়?

যাজ্ঞবল্ক্যঃ না। অমৃত জ্ঞানের চেয়ে বিত্ত শ্রেয় নয় ৷

মৈত্রেয়ীঃ আমি অমৃত জ্ঞানের পিয়াসী, প্রিয়। বিত্ত নয়। যে জ্ঞানের আকাঙ্খার বীজ আপনি আমার মধ্যে রোপণ করেছেন, যে জ্ঞানের আলোকরশ্মির সন্ধান আমি পেয়েছি আপনার কাছে, তাই শ্রেয় আমার কাছে। আমি সেই পূর্ণ অমৃতজ্ঞানের পিয়াসী। বিত্ত, সম্পদ, ধন, ঐশ্বর্য আমাকে সেই অমৃত জ্ঞানের অন্বেষণের পথ থেকে বিচ্যুত করে ভোগের পথে নিয়ে যাবে। আমি তাই হাঁটতে চাই না ভোগের পথে। আমি জ্ঞান চাই, প্রিয়। জ্ঞান। চাই পরম বোধ। উন্মীলিত হোক আমার জ্ঞানচক্ষু। সম্পদ নয়, জাগতিক ঐশ্বর্য নয়,আমাকে আপনি জ্ঞানের ঐশ্বর্য দান করুন প্রিয় আপনার বাণপ্রস্থে যাওয়ার আগে।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ প্রিয়ে, তুমি জ্ঞানের অন্বেষক। তুমি সত্যের পিয়াসী। বেশ। তাহলে শোনো প্রিয়ে। সত্য বড় কঠিন। বড় নির্মম। জ্ঞান আবেগহীন। সত্যসন্ধানী তুমি। তাই সত্যের সপক্ষে থাকতে হলে তোমাকে তা সহ্য করতে হবে।

মৈত্রেয়ীঃ কি সেই নিৰ্মম সত্য

যাজ্ঞবল্ক্যঃ প্রিয়ে, মানুষের সমস্ত কিছুর প্রতি প্রীতির কারণ হলো আত্মপ্রীতি।

মৈত্রেয়ীঃ কী বলছেন আপনি প্রিয়?

যাজ্ঞবল্ক্যঃ হ্যাঁ। প্রিয়ে। পতির প্রতি প্রীতিবশত পতি প্রিয় হয় না। জায়ার প্রতি প্রীতিবশত জায়া প্রিয় হয় না। বিত্তের প্রতি প্রীতিবশত বিত্ত প্রিয় হয় না। দেবতার প্রতি প্রীতিবশত দেবতা প্রিয় হয় না। কোন কিছুরই প্রতি প্রীতিবশত তা প্রিয় হয় না। সমস্ত প্রীতির মূলে আছে আত্মপ্রীতি। আত্মপ্রেম ৷

মৈত্রেয়ীঃ আপনি যাওয়ার আগে এসব কি বললেন, প্রিয়? আমার হৃদয় চূর্ণ হয়ে গেল। মানুষ কি শুধুই আত্মপ্রেমী? মানুষ কি শুধুই আত্মকেন্দ্রিক? এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছি আমরা। আজন্ম ঋণবদ্ধ আমরা পৃথিবীর কাছে। প্রকৃতির কাছে। সমাজের কাছে। মানুষের কাছে। কী করে সেই ঋণ অস্বীকার করতে পারি, প্রিয়? এই জীবনের যাপন শুধুই তো নিজেকে নিয়ে নয়। সকলকে নিয়ে। সারা পৃথিবীকে নিয়ে। সারা প্রকৃতিকে নিয়ে। সমাজকে নিয়ে।মানুষকে নিয়ে। সব কিছুর প্রতি ভালোবাসায় ডুবে আছে নিজের প্রতি ভালোবাসা। এই আত্মপ্রেম আর বিশ্বপ্রেমকে কি করে পৃথক করব, প্রিয়? কী করে পৃথক করব?

না, প্রিয়। আমি দ্বিমত পোষণ করছি এই প্রথম আপনার সঙ্গে। আপনার শিষ্যা হয়েও। সহধর্মিণী হয়েও। আপনার এই শিক্ষা, এই জ্ঞান, এই দর্শন আমি গ্রহণ করতে পারছি না। আমি বিশ্বাস করি না সমস্ত কিছুর মূলে আছে শুধুই আত্মপ্রেম। এ যদি আমাকে বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে তো আমাকে ভোগের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। না, প্রিয়। আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও এই মুহূর্ত থেকে আমার পথ হয়ে গেল ভিন্ন। আমি অমৃত জ্ঞানের সন্ধান করব পৃথিবীর পথে। সমাজের মধ্যে। মানুষের মধ্যে। মানুষকে ভালবেসে। রূপ রস গন্ধে ভরা এই পৃথিবীকে ভালবেসে। আমাকে ক্ষমা করুন, প্রিয়৷ আপনার এই দর্শন আমি গ্রহণ করতে পারলাম না। আপনার এই শিক্ষা আমি প্রত্যাখ্যান করছি।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ এতদূর? আমাকে অস্বীকার করছ তুমি? আমার শিষ্যা হয়ে আমার জ্ঞানকে, উপলব্ধিকে,শিক্ষাকে অস্বীকার করছ তুমি? বেশ। তোমার উপলব্ধির পথেই তুমি থাকো।

মৈত্রেয়ীঃ হ্যাঁ, প্রিয়। আমি তাই থাকব। আমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে, আমার উপলব্ধির বিরুদ্ধে যাব না আমি। আত্মসমর্পণ করব না আপনার ভোগবাদী দর্শনের কাছে। আপনার কোন সম্পদ আমি গ্ৰহণ করব না। কৃচ্ছ্রসাধন করে আমার জীবন নির্বাহ করব। আমি বিশ্বাস করি মানুষের প্রতি ভালোবাসায়। বিশ্বাস করি না ভোগবাদী দর্শনে। বিশ্বাস করি না আত্মসর্বস্বতায়। আপনি আত্মসর্বস্বতায় আর ভোগের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সারাটা জীবন কাটিয়েছেন। আমি তা করব না।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ স্তব্ধ হও।এত স্পর্ধা তোমার? আমাকে আক্রমণ করছ? অভিশাপ দেব তোমাকে।

মৈত্রেয়ীঃ ঋষিবর যাজ্ঞবল্ক্য, , অভিশাপের ভয় আমাকে দেখাবেন না। আমি যা বলেছি তা যে মিথ্যা নয়, তা শুধু আপনি নন, সবাই জানে।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ স্তব্ধ হও,মৈত্রেয়ী। আমি অভিশাপ দিচ্ছি আর একটুও তুমি আমাকে আক্রমণ করলে তোমার স্কন্ধ থেকে শির খসে পড়বে।

মৈত্রেয়ীঃ পড়বে না। ঋষিবর যাজ্ঞবল্ক্য, আমি গার্গী নই। আমি এই অভিশাপে নিরস্ত হব না। গার্গী প্রগাঢ় জ্ঞানী ও বিদূষী হওয়া সত্ত্বেও তার জ্ঞান বা আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ছিল। তাই সে আপনার অভিশাপের ভয়ে সেই তর্কসভায় সাময়িকভাবে নিরস্ত হয়েছিল। যদিও সেই সাময়িক দুর্বলতাকে জয় করে সে আবার আপনাকে প্রশ্ন করেছিল।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ শেষাবধি যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে গার্গী নতি স্বীকারও করেছিল।

মৈত্রেয়ীঃ যুক্তিতে নাকি ভয়ে তা বিচারসাপেক্ষ। আমিও উপস্থিত ছিলাম সেই তর্কসভায়।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ কী বলতে চাইছ তুমি? আবার আমাকে আক্রমণ করছ?

মৈত্রেয়ীঃ না। আপনাকে আক্রমণ করছি না। আমি শুধু ইঙ্গিত করেছি আপনার বিশাল প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতাকে। আপনি ইচ্ছে করলে কারোর মুন্ডু খসিয়ে দেওয়ার জন্যে লোকের অভাব হবে না। কিন্তু আমি মুন্ডু খসার ভয় করি না গার্গীর মতো।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ স্তব্ধ হও,মৈত্রেয়ী। বন্ধ করো পতিনিন্দা। তুমি ভুল অর্থ করেছ আমার বাক্যের। গার্গীকে শির স্কন্ধচ্যুত হওয়ার কথা বলতে আমি বুঝিয়েছিলাম পরাজয়ের লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়া। কোন প্রাণহননের ভয় আমি দেখাইনি গার্গীকে। তোমাকেও একইকথা বলতে চেয়েছিলাম। উত্তেজনার ফলে রূঢ়ভাষণ হয়ে গেছে। অভিশাপের কথাও বলিনি।এটাও রূঢ় বাক্য প্রয়োগ। এটাও আমার উত্তেজনার ফল। আমি দুঃখিত। আমাকে তুমি হেয় কোরো না। আমিতো চলেই যাচ্ছি সন্ন্যাসী হয়ে সবকিছু ছেড়ে। যাওয়ার আগে কেন তোমার এই ফিরে দেখা আর আমাকে সমালোচনা করা?

মৈত্রেয়ীঃ আপনার সমালোচনা করছি না, প্রিয়। শুধু তুল্যমূল্য বিচার করছি। বিস্মিত হচ্ছি। ভোগের তৃপ্তি হয়তো আপনার ঘটে গেছে। তাই বাণপ্রস্থে গমন করছেন। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল যে এখনও আপনি ভোগবাদী দর্শনের প্রচ্ছন্ন সমর্থক। তাই আজো বিশ্বাসী আপনি আত্মপ্রেমের দর্শনে। আমি তা নয়। ক্ষমা করুন, প্ৰিয়।

যাজ্ঞবল্ক্যঃ ঠিক আছে। বিদায় মৈত্রেয়ী। যদি কখনো ভবিষ্যতে আবার আমাদের দেখা হয়, তাহলে মিলিয়ে নেওয়া যাবে কে ঠিক আর কে ভুল। বিদায়।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -