Gambhira Gan: গম্ভীরা গানের উৎপত্তি কোথায়/গম্ভীরা গান কী/ গম্ভীরা গানের ইতিহাস  

- Advertisement -

দেবা রায়

গম্ভীরা গান (Gambhira Gan) পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা এবং বাংলাদেশের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের বিশিষ্ট লোকসংগীত হচ্ছে গম্ভীরা গান (Gambhira Gan)। হিন্দু ধর্মের একটি বিশেষ সময় অর্থাৎ চৈত্র-বৈশাখ মাসে একটি বিশেষ লোক উৎসবকে কেন্দ্র করে এই নৃত্য-গান পরিবেশনার মাধ্যমে অঞ্চলের মানুষ মেতে ওঠেন। গম্ভীরা গান (Gambhira Gan) স্থানীয় মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় লোকগান। আজও নানা উৎসবের সাথে মিশে রয়েছে এই শতাব্দীপ্রাচীন একটি শিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

গম্ভীরা কি?

বাংলা লোকসঙ্গীত শিল্পের একটি অন্যতম ধারা। প্রাচীন বাংলার মালদা শহরের জামতলি, কালীতলা ও বর্মনপাড়ায় প্রতিবছর ১৬ই বৈশাখ গম্ভীরা উৎসবের আয়োজন দেখা যায়। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত এই উৎসব চলে যতক্ষণ না পর্যন্ত নতুন ফসলের কাজ আরম্ভ হয়। এই উৎসবের শুভ সূচনা হয়ে গম্ভীরা পূজার মধ্যে দিয়ে।

কি এই গম্ভীরা পূজা?   

নিষ্ঠা, আচার-বিচার মেনে পূজার বিধিকে বজায় রেখে শিবের আবাহনই গম্ভীরা পূজার প্রাথমিক পর্ব। এরপর সারা শহর জুরে নানান গম্ভীরা তলায় তারা এই সময় ধরে গম্ভীরা শিল্পের প্রদর্শন করে যান। আর এই শিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের অনুরাগ বা আকর্ষণ চোখে পড়ার মতো। এই পূজার নানাবিধ পর্যায় বা স্তর।  প্রত্যেকটি স্তরে রয়েছে উৎসবের আঙ্গিক। শেষ পর্বে গম্ভীরা গান  পরিবেশিত হয়। এই গানের মধ্য দিয়েই সমকালীন জীবনের ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। গম্ভীরা উৎসব মালদহ জেলার প্রধানত চার দিনের উৎসব। গম্ভীরা পুজোকে কেন্দ্র করে গম্ভীরা মণ্ডপ বা প্রচলিত নামে গম্ভীরা তলা তৈরি করা হয়। প্রথম দিনের  উৎসবের নাম ‘ঘর ভরা’।

সেই দিন শিব ঠাকুরের উদ্দেশে  ঢাকঢোল বাজিয়ে নদী থেকে ঘটে জল নিয়ে সেই ঘট স্থাপন করা হয় মণ্ডপে। দ্বিতীয় দিনের উৎসব ‘ছোট তামাশা’। এই দিনে শিব ও পার্বতীর পুজো হয়। পুজোর অনুষ্ঠান রং, তামাশা, আনন্দ, রসিকতার মধ্যে দিয়ে গম্ভীরা প্রদর্শিত। তৃতীয় দিনের উৎসব ‘বড় তামাশা’। সে দিন হয় মুখোশনৃত্য উৎসব। চামুণ্ডা, নরসিংহী, কালীর মুখোশ পড়ে ঢাকের তালে তালে নৃত্য হয়। মুখোশ পড়ে উদ্দাম নৃত্যের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। আর, চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম ‘আহারা’। সে দিন দুপুরে/ বিকেলে সঙ বেরোয়।

বিভিন্ন সাজে সেজে সঙ গ্রাম-শহর পরিক্রমা করে। এই সঙ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম রীতিতে গান গেয়ে অভিনয় করা হয়। নাটকীয় গুণ সব রকম ভাবে প্রকাশ পায় এখানে। এই রীতিটিই গম্ভীরা লোকনাট্য। গম্ভীরা গানের শুরুতে দেবাদিদেব শিবকে বন্দনা করার রেওয়াজ আছে। শিবরূপী অভিনেতাকে মঞ্চে নিয়ে এসে তাঁকে সমস্ত বিষয়ে জানানো হয়। সমাজের মঙ্গলের জন্য কী করণীয় বা কোনও সমস্যা থাকলে কী ভাবে তার সমাধান করা যেতে পারে, তার প্রতিকারের নিদান দেন শিব। দর্শকের সামনে শিবকে উপস্তিত করে সমস্যার সমাধান করার মধ্যে দিয়ে সমাজ সচেতন হয়।

গম্ভীরা নাচের নানাবিধ নাম কি?

বুড়াবুড়ির নাচ, টাপা নাচ, সারস নাচ, মুখা নাচ, মশান নাচ, কালী নাচ প্রভৃতি।  

গম্ভীরার প্রকারভেদ  

বাংলা গম্ভীরা সাধারণত দুইপ্রকার — আদ্যের গম্ভীরা এবং পালা-গম্ভীরা। প্রথমত দেবদেবীকে সম্বোধন করে মানুষ যখন তার সুখ-দুঃখ পরিবেশন করবে তখন তাকে আদ্যের গম্ভীরা বলা হবে।  আর দ্বিতীয়ত পালা-গম্ভীরায় নানা-নাতির ভূমিকায় দুজন ব্যক্তির অভিনয়ের মাধ্যমে সমাজের এক একটা সমস্যা তুলে ধরবে আর মাঝে মাঝে গানের সুরে তা মানুষের অন্তর মজিয়ে দেবে।

গম্ভীরা গানের মূল বৈশিষ্ট কি?

দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামে সংঘটিত নানা ঘটনা সঙ্গীত ও নৃত্যের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপনা ও পর্যালোচনা করাই হচ্ছে গম্ভীরা গানের মূল বৈশিষ্ট্য। সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষামূলক, এমনকি সাম্প্রতিকতম নানা রাজনৈতিক হালচালও যা গম্ভীরা শিল্পের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপীত হয়। এবং অবশ্যই উপস্থাপনা উপভোগ্য হয়।  এমনকি অনেক গম্ভীরায় বার্ষিক চাওয়া-পাওয়ার হিসাবও দেখতে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে যা উপস্থাপন হয় তা মানুষের জীবনের কথা, মানুষের কষ্টের কথা, অত্যাচারীর অত্যাচারের কথা।

গম্ভীরাকে আকর্ষনীয় করতে কি করা হয়?

গম্ভীরাকে আরো বেশি মানুষের নিয়ে যেতে, তাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে নৃত্যে শিল্পীদের ছৌ-এর ঢঙে দেব-দেবীদের মুখোশ  ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছে।

এই গম্ভীরা কারা গায়?

এই গান সাধারণত পোলিয়া, রাজবংশী, নাগর, কোচ প্রভৃতি আদিবাসী শিল্পীদের কণ্ঠে বেশি শোনা যায়। অর্থাৎ উপরে উল্লিখিত অঞ্চলে নিম্নবর্গীয় হিন্দু, নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নাচের প্রচলন রয়েছে।


গম্ভীরা গানের জনক কে?

আধুনিক গম্ভীরা গানের প্রবর্তক-জনক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গম্ভীরা শিল্পী ওস্তাদ শেখ সফিউর রহমান ওরফে ‘সুফি মাস্টার’। ১৮৯৪ সালে তৎকালীন মালদহ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ভারতের কিছু অংশ) জেলার ইংরেজ বাজার থানার ফুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

গম্ভীরা কার উদ্যোগে সর্বভারতীয় স্তরে খ্যাতি পায়?

বিংশ শতাব্দীর বাঙালি বৌদ্ধিক মননের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি বিনয়কুমার সরকার যিনি ১৯০৭ সাথে ‘জাতীয় শিক্ষা সমিতি’ গঠনের মধ্য দিয়ে গম্ভীরা  আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এই আন্দোলনের সোনার ফসল হরিদাস পালিতের লেখা ‘আদ্যের গম্ভীরা’ যা সারা ভারতবর্ষকে লোকসংস্কৃতির এই বিশেষ ধারার পরিচয় করায়। ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ বইয়ে তিনি অকপটে বলেছেন- ‘… এ কালে গণতন্ত্র কপচাই। সেই গণতন্ত্রই জীবনে প্রথম দেখেছি জামতল্লীর গম্ভীরার শাসন কায়দায়। আজকাল সমাজতন্ত্র কপচাই। সেই সমাজতন্ত্রের দম্ভও জীবনে প্রবেশ করেছিল চুনিয়া-নুনিয়া-পাঁজরা-কাঁসারি জাতীয় ভাইদের সঙ্গে নাচানাচি আর লাফালাফির আবেষ্টনে।’  

এই নিম্নগর্গের লোক সংস্কৃতির উদ্দ্যেশ্য কি?  

বাঙ্গালি নিম্নবর্গের সেই জনসংস্কৃতি যা প্রতিমূহুর্তে ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী স্বর হয়ে উঠতে চায়, তার শৈল্পিক প্রকাশ হিসেবে গম্ভীরা একটি অববদ্য মাধ্যম। এই শিল্পে ব্যবহৃত গান, নাচ, অভিনয় সবই মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নেয়। অনেক বিতর্কিত সত্য যা আপাত দৃষ্টিতে উস্কানিমূলক মনে হলেও মানুষের উপকারে আসে। সেই সকল কথা শ্রবণে তারা শিক্ষিত হয়, সচেতন হয়, অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিতও হয়। অর্থাৎ বিনদের পাশাপাশি সমগ্র জাতিকে এক সচেতনতামূলক বার্তা দান করে এই গম্ভীরা।

গম্ভীরায় মুখোশের ব্যবহার

মালদহের গম্ভীরার বিশেষত্ব হল মুখোশের ব্যবহার৷ স্থানীয় সূত্রধর সম্প্রদায় নিম এবং ডুমুর গাছের অংশবিশেষের সাহায্যে মুখোশগুলি তৈরি করে। যে মুখোশগুলি সব সম্প্রদায়ের বাধ্যতামুলক নয়, সেখানে তারা স্বাভাবিকভাবেই মুখোশ না পড়ে গম্ভীরা গান বা নাচেন। সাথে গানের দল বা বাদকের সঙ্গত করে।

গম্ভীরা এখন 

গম্ভীরার ঐতিহাসিক সাবেকিয়ানা কাটিয়ে, সমসাময়িক জীবনের প্রত্যেকটি ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গম্ভীরা আজ  অনেকাংশেই বদলে গিয়েছে। আধুনিকতার দিকে অনেকটাই  এগিয়েছে বাংলার এই লোকশিল্প। গম্ভীরার গান , নাচ ও স্ক্রিপ্ট সবই বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে প্রভাবিত করেছে। আবার  সময়ের তালে আধুনিক যাত্রা ও নাটকের ভাবধারাও কখনও  কখনও গম্ভীরা লোকনাট্যকে প্রভাবিত করেছে।

এই পরিবর্তন শুধু লোকনাট্যের ক্ষেত্রেই নয়, সমস্ত লোকসংস্কৃতির মধ্যেই এর প্রভাব পড়ে।। সেই সুত্রে বিষয়ভাবনাতেও আমূল পরিবর্তন  ঘটেছে  গম্ভীরার। স্মরণাতীত কাল থেকে গম্ভীরা মানুষের মন জয় করে আসছে। আশা করা যায়, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের হাত ধরে গম্ভীরা এগিয়ে যাবে আপন গতিতে তাদেরই শিল্পের ক্যারিসমায়।

অতএব এই শিল্পকে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আর  এইখানেই সাধারণ মানুষের এই শিল্প রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতা এসে যায়। যদি হারিয়ে যায় তা হবে আমাদেরই জন্য, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা বর্তমানে লোক সংস্কৃতির ঢাল ব্যবহার করে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অনেকেই এই শিল্পের প্রয়োগে যথেচ্ছ পরীক্ষানিরীক্ষা করছি, যা অনেকসময় এই শিল্পের মাধুর্য বিনষ্ট করছে।  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -