কানে এল- ‘এই শালা মালটা আমাদের ভয় পেয়েছে’, পথনাটকের অভিজ্ঞতার নির্যাস

- Advertisement -

দেবা রায়

থিয়েটার নিয়ে মানুষের খুব কাছাকাছি যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে পথনাটকের মতো জিনিস খুব কম আছে। মঞ্চের ওপর থেকে মানুষের মনের কথা বা জীবনের কথাটা তুলে আনা যায় না। মঞ্চ ছেড়ে যখন এই মাধ্যমের সাহায্যে আমরা মানুষের কাছে নাটক নিয়ে পৌঁছে যাই, তখন তারা যেভাবে আমাদের কাছে ছুটে আসেন তাতে আমাদের কাজের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। দর্শকের অনুভুতিগুলি সামনে থেকে দেখতে দেখতে বুঝতে বুঝতে নাটক করে যাবার আনন্দ আর কিছুতে নেই।

সবচেয়ে বড়  ব্যাপার একজন নবাগত অভিনেতার পক্ষে এইভাবে নাটকে অভিনয়ের সুযোগ তার অভিনয় জীবনের অনেক বড় ঘটনা এবং সাহায্যও বটে। কারণ অভিব্যক্তি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার এর থেকে বড় সুযোগ আর কিছুতে নেই। মঞ্চের প্রতি একটি অকারণ ভীতি সারাজীবন অনেক অভিনেতাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। তিনি যদি একবার এই নাটকের একটা শো করেন এবং এই সকল দর্শকের মুখোমুখি হন তাহলেই বুঝতে পারবেন তিনি কিভাবে অভিনয় করবেন, বা অভিনয় করতে তাঁর কি কি করা উচিত।

যে সকল সমস্যা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হয় তার গভীরে যেতে কোনও সাজানো স্ক্রিপ্ট বা সংলাপের সাহায্য নিতে হয় না। অভিনয় স্থল থেকেই যে কত সংলাপ উঠে আসে তার ইয়ত্তা নেই। আর উঠে আসে তথ্য। যে বিষয়ে কাজ করতে গিয়েছি তার কিছু তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই আমরা নাটকটাকে সাজিয়ে নিয়ে ওদের কাছে ছুটে যাই। যাওয়ার পর একের পর এক শো করার সাথে সাথে আমাদের নাটকের স্ক্রিপ্টেরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। যা বই বা নাটকে সবটা সাজিয়ে বলা যায় না। আর এখানেই নাটকের উত্তরণ ঘটে।

শহরের মানুষ প্রতিদিন বাইপাস দিয়ে কাজের জন্যে ছুটে চলেন আর চলার পথে একটা নির্দিষ্ট জায়গা এলেই নাকে রুমাল দেন। জায়গাটার নাম ধাপা। আমার সেখানে যাবার সুযোগ হয়েছিল। নাটক নিয়ে নয়। সেখানকার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কর্মশালার মাধ্যমে নাট্যনির্মাণের কাজ নিয়ে। সেই ছেলেমেয়েরা প্রায় অনেকেই স্কুলে যায় না। তারা ঐ আবর্জনার ঢিবি থেকে নানা জিনিস কুড়নোর কাজ করে থাকে। ৮ থেকে ১৮ বছরের ছেলেমেয়েরা এসেছে কাজ করতে। যাদের অধিকাংশই র‍্যাগপিকার। সকাল হলেই ময়লার গাড়ি ঢুকলে তারা ছুটে যায় ওই ময়লার পাহাড়ে। সেখানে নিজেদের মধ্যে চলে মারপিট। কে আগে পাবে তাদের কাঙ্খিত জিনিসের হদিশ।

তারা কুঁড়িয়ে সোনা পায়, রূপা পায়। দামী মোবাইল ও পায়। পায় ‘ডেটফেল’ মোড়কজাত খাদ্য দ্রব্য। সে সব খায় তারা। শিশুমনের ওইসব জিনিসের প্রতি আকর্ষণ তো আর শ্রেণিভেদে নিরুপম হয় না। সেটা শিশুর সহজাত। আর সেই অজ্ঞানতা থেকেই তারা বারোমাস ভোগে পেটের অসুখে। ময়লার সেই বোটকা দুর্গন্ধ তারা সয়ে নিয়েছে। আর অনেক তারা কিছু সয়ে নিয়েছে। সেই আবর্জনার পাহাড়ের পাশেই বেওয়ারিশ লাশ পোড়ায় সরকারি দপ্তর। সেই পচা ও পোড়া মাংসের গন্ধ নিয়েই তাদের বেঁচে থাকা। তার ওপর আবার নাটক শেখা।

একদম আলাদা একটা জগতের সাথে তাদের পরিচয় করানোর সময় তারা নিঃশব্দে শুনে যায় আমার কথা। তাদের সেই চোখের সরল অথচ অভিজ্ঞ চাহনি আমাকে বেদনাতুর করে। চোখের জলকে চেপে রেখে ওদের উপহার দিতে হবে হাসির কথা। দিতে হবে আনন্দ। ওদের নিষ্পাপ অথচ বেড়েপাকামো আচরণ আমাকে তাদের সাথে নানা থিয়েটারের খেলায় মাতিয়ে রাখে সারাদিন। আমাকেও যে তাদের সাথে মিশতে হবে। তিনদিন একসাথে কাটানোর পর তারা আবার ছুটে  যায় সেই যন্ত্রণাময় নরকের মধ্যে গান গাইতে গাইতে। নাটকের গান। সে গানে তাদেরই কথা। তাদের চোখের জল আজও আমার হৃদয়ে সযত্নে রাখা আছে। শুনেছি এখন তারা নিজে নিজে নাটক করে, কয়েকজন মাঝে মাঝে ফোন করে ডাকেও।

এমনি অনেক ঘটনা আছে যা শুনলে বা জানলে আমরা নিজেকে আরও শিক্ষিত করতে পারি। মানুষের মাঝে গিয়ে শেখার মত স্কুল আর কোথাও আছে নাকি! একজন থিয়েটার কর্মী হিসেবে এ আমার জীবনে পরম পাওয়া। এ জানায় কোনও অহংকার নেই, আছে শুধু বার বার দেখাতে চাওয়ার নেশা।

আরও একটি ঘটনার কথা বলব। একদল ছেলে ট্রেনে  ট্রেনে ড্রাগ বেচতো। একটি বেসরকারি সংস্থা তাদের ধরে দায়িত্ব নিল পুনর্বাসনের। কি সাহস। আমাকে ডাকা হল তাদের নারচারিং–এর জন্যে। তাদের কর্মশালার মাধ্যমে নাটক শেখাতে হবে। আমি ছুটে গেলাম সেই অভিজ্ঞতা লাভের তৃষ্ণায়। আপাত দৃষ্টিতে এরা পুলিশের খাতায় ক্রিমিনাল। এদের অভিজ্ঞতা অনেক আচ্ছা আচ্ছা বড়খোকাদের থেকে কম কিছু নয়। এদের বয়স- ১০ থেকে ১৫। এরা এসব করেই টাকা কামায়। প্রত্যেকের চোখে নেশার ছোঁয়া। ভদ্রসমাজ যাদের দেখামাত্র বলবেন লুম্ফেন। ছোটলোক। সে যাই ভাবুক আমি আপাতত সেসব ভাবতে পারছি না। আমার ভেতরে একটাই চিন্তা এদের কিভাবে বাগে আনব?

মূলত কথার সাহায্যেই আমার এই কাজ শুরু হয়। কিন্তু এরা কি আমার কথা শুনবে? কেন শুনবে? হাসি বা মজাও কি এরা নিতে পারবে? এইসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে আমার কানে একটা সংলাপ কানে এল- ‘এই শালা মালটা আমাদের ভয় পেয়েছে’। ভয়! তার মানে ওরা ভীতুকে দেখে সাহস পায়। আমি ভয়ানক এক হাসি হেসে উঠলাম। আমাকে ‘মাল’ বলা ছেলেরা নিমেষে চুপসে গেল। আমি তখনই বুঝে গেলাম, আমার অভিনয় কাজে এসেছে। আবার হাসলাম। ওরা ততক্ষণে স্তব্ধ।

আমার হাসি ক্রমে বাড়তে বাড়তে থিতিয়ে কান্নায় পরিণত হল। আমার কান্নায় ওদের সেই কঠিন হৃদয়টা যেন নিমেষে কেঁদে উঠল। ওরা আমাকে দেখছে। যাকে বলে চেটেপুটে দেখছে। আমি সংলাপের সাহায্যে একটা বেদনার স্ক্রিপ্ট বলতে শুরু করলাম। সেটা ইমপ্রোভাইসড। ওরা এতক্ষণে মাটিতে বসে পরেছে। আমার অভিনয় দেখছে। আমার কান্নার কারণ ছিল আমার জীবন। যে জীবনের সাথে ওদের জীবনের মিল আছে। আমি কি হতে পারতাম আর আমি কি হচ্ছি, আমাকে যারা এই পাকে নিয়ে চলেছে তাদের আমি ঘৃণা করি। আমি ভাল হতে চাই, এই জীবন থেকে বেরোতে চাই। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল- ‘আমার একটা কথা আছে’। হ্যাঁ বল- । সে বলল- ‘আপনি ভুল বলছেন, আপনি ভাল হতে চাইলেই আপনি ভাল হতে পারবেন না। ঘরে এসে যখন দেখি না বাপটা মাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে মাসিটাকে লাগাচ্ছে, তখন…’ বলে কাঁদতে শুরু করল।

আমি কাছে গেলাম। মাথায় হাত বোলালাম। ওকে জল দিলাম। অপর একজন বলে উঠল- ‘আচ্ছা আপনি যে হাসলেন সেটা কি সত্যি?’ –আর একজন তার কথার উত্তর দিয়ে বলল- ‘না না অ্যাক্টিং করছিল, তুই বুঝিস নি?’ আর একজন সাথে সাথে বলে উঠলো –‘মাইরি দারুণ দিলেন, পুরো বমকে গেছিলাম।’ আমি সরাসরি ওদের প্রশ্ন করলাম— ‘তোমরা শিখবে?’

তারপর থেকে ওরা আর থেমে থাকেনি, প্রতিদিন ক্লাসে ঠিক সময়ে চলে এসেছে। কাজ করেছে। ক্রমে তারা সেই পেশা থেকে সরে এসেছে। সেই পেশার পরিবর্তে তাদের শেখানো হল মধু সংগ্রহ। ওরা তাই করলো। তারপর স্টেশনে বা রেলে চানাচুর, লজেন্স বিক্রি করে সংসার চালাত। একবার এরা দুজন ড্রাগ পেডলার কে ধরে এনে সংস্থার কাছে এনে ফেলেছিল। এই তো সেদিন একজন আমাকে একটা ফোন করে আমার কুশলতা জানতে চাইল। সে এখন বাঙ্গালোরে একটা ফ্যাক্টরিতে খালাসির কাজ করে।

থিয়েটার আমাকে এভাবেই দিয়েছে বা থিয়েটারের সাহায্যে আমি এভাবেই মানুষের কাছে যেতে পেরেছি। জানিনা এই থিয়েটার কোনদিন আমাদের দেশে সদর্থে ব্যবহৃত হবে কিনা। তবে যতদিন দেহে থাকবে প্রাণ, করে যাব এভাবেই কাজ। কারণ আমার মাথার সৃষ্টিছাড়ারা এদের সাথেই খাপ খাওয়াতে পারে ভাল। আর আমিও নিজেকে খুঁজে পাই, আমার সমাজকে খুঁজে পাই।

সবশেষে বলি, আমি শুধুই থিয়েটারটা নিয়ে থাকতে পারি। শুধুই থিয়েটার। থিয়েটারে এভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরে আমি আসলে প্রতিদিন শিখে চলেছি। 

(সমাপ্ত)

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -