‘পোলিও খেয়ে দু’বছরের ছেলার হিসি বুকে পড়ে না’ – পথনাটকের আজব অভিজ্ঞতা

- Advertisement -

দেবা রায়

পথনাটকে অপরাধমূলক বিষয়ের উপস্থাপনা হয়ে থাকে। যেমন নারী ও শিশু পাচার, দেশী বা বিদেশী মদের অবৈধ ব্যবসা, গৃহহিংসা আইন, পণপ্রথা, শিশুশ্রম প্রভৃতি। যে কোন অপরাধমূলক কার্যকলাপ যার সাথে কমিনিউটির মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ আছে – সেই বিষয়গুলি নিয়ে নাটক করতে গেলে বাধার সম্মুখিন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যে কোনও অঞ্চলের মানুষই সেই এলাকায় অপরাধমূলক কাজে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে তাদের আপাত দৃষ্টিতে দেখে কেউ বুঝতেই পারবেন না। এমনও হতে পারে এই সব ব্যক্তিরা সমাজের কোন সরকারি বা বেসরকারি পদে বহাল রয়েছেন। যেখানে মানুষ তাকে ভালো মানুষ বলেই জানেন। সেই ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে তারা এই সব অপরাধমূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকে।

পথনাটকের পথের বাধা

আর এধরনের কমিউনিটিতে গিয়ে যখন সামাজিক অপরাধমূলক নাটক করে অঞ্চলের মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা চলে, তখন এই ছদ্মবেশী মানুষগুলো নানাভাবে নাটক করতে বাঁধা দিয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে প্রতিটি পরিবারের মধ্যে যেমন নির্যাতিত মানুষ আছে, তেমনই নির্যাতনকারীরাও থাকাটা অস্বাভাবাবিক নয়।

এই অপরাধীরা আপনার আমার মত পরিবারেরই একজন। অনেক সময় দেখা যায় পরিবারের একজন বলে তাকে আড়াল করার চেষ্টাও করে থাকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। সেখানে নিজেদের ভালো কোনটা – সে বিষয়টাকে আমরা যখন নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরি তখন প্রত্যাঘাত আসাটা অনিবার্য।

পথনাটকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা

অর্থাৎ নিজেদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে নাট্যকর্মীদের কাজে নামতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনিক সমস্ত যোগাযোগ সঙ্গে রাখতে হবে। বা যে সংস্থা নাট্যকর্মীদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে, তাদের উচিত উপযুক্ত প্রশাসনিক সাহায্য নিয়ে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।

উপযুক্ত ব্যাবস্থা না নিয়ে কোনও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কাজ করতে যাওয়া উচিত নয়। কারণ যেখানে নারী ও শিশু পাচার নিয়ে কাজ হবে সেই জায়গাটায় ওই ধরনের কাজের সূত্র পাওয়া গেছে বলেই সেখানকার মানুষের জ্ঞাতার্থেই এই নাটক করতে পাঠানো হয়ে থাকে।

যেখানে অবৈধ ভাটিখানা সেই সংলগ্ন জায়গায় নেশা বিরোধী প্রচার করতে হবে। এখন ধরুন একটি কমিউনিটি যেখানে আপনারা নাটক করতে গেছেন শিশু ও নারী পাচার নিয়ে কাজ করতে। একটা কথা জানতে হবে এই পাচারের কাজে মূলত মহিলাদের বেশী ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। সেই মহিলা স্বভাবিকভাবেই আপনার দর্শক হবে।

নাটক চলাকালীন সে কিন্তু নানাভাবে নাটকটা করতে না দেবার জন্যে আপনাদের বিরক্ত করবে। অঞ্চলের মানুষকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখতে হবে যাতে কেউ যদি নাটকে ব্যাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তারাই যাতে তাঁকে বাধা দেন। অর্থাৎ অসম্ভব ধৈর্য না থাকলে এ কাজ করা যাবে না।

স্বার্থপর মানুষের নিজের স্বার্থ নিয়ে উদাসিনতা

তারপর যে অঞ্চলে আপনারা কাজ করতে যাবেন সেখানকার মানুষ তাদের কিসে ভাল হয় সে ব্যপারে মারাত্মক উদাসীন। আমরা যে তাদের ভালোর জন্যে গিয়েছি সে ব্যাপারটা অধিকাংশ সময় তাঁরা মানতে চান না। এবং সেই ব্যাপারটা প্রকাশের জন্য তারা নানা মন্তব্য করে থাকেন।

সেই মন্তব্য শুনে নাট্যকর্মীদের কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়া যাবে না। বরং পাশের অপর মানুষের সাথে কথা বলে তার বক্তব্য খণ্ডন করে দিতে হবে। মেনে নেওয়া যাবে না। অঞ্চলের মানুষকেই প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসার সাহস দিতে হবে। এছাড়া কাজকে ব্যাঘাত ঘটাতে সেই স্থানীয় চক্রান্তকারীরা সব সময় গল্প ফাঁদে। যা শুনে অন্যান্যরা কাছে আসতে ভয় পায়। এরকম একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

পথনাটকে পোলিও সচেতনতা

একবার পালস পোলিও নেওয়ার জন্য পথনাটকের মাধ্যমে আবেদন জানাতে গেছি। যে এলাকায় গেছি সেই এলাকার চক্রান্তকারীদের কেউ একজন আগেই বলে রেখেছে, পালস পোলিও খাওয়ালে জন্ম দেবার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ চক্রান্তকারীরা বলতে চাইছে যে সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্যেই এই ঔষধ দিয়ে তাদের কাছে পাঠাচ্ছে।

প্রসঙ্গত এই অঞ্চল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। এবং তাই আমরা কাজ না করতে গেলে এই তথ্য পেতাম না। একজন মদ্যপ ব্যক্তি নাটকের মাঝে এসে আমাকে প্রশ্ন করতে চাইল, আমি বললাম নাটক শেষে আমরা তার কথা শুনব। সে অপেক্ষা করে রইল। নাটক শেষে তার কাছে জানতে চাইলাম সে কি বলতে চাইছে। সে বলল – ‘আমার দু বছরের ছেলা, পোলিও খেয়েছিল, তারপর থে তার হিসি আর বুকে পড়ে না।’ চারপাশে নিমেষে হাসির রোল উঠল।

আমি হাসি থামার পর বললাম- ‘এই যে ভাই আপনি কি রকম বাপ? যে একটা দু-বছরের শিশুর যৌনাঙ্গ দাঁড়ায় কি না তা লক্ষ্য রাখছেন?’ হাসি আগের চেয়ে আরো বাড়ল। আমি বুঝলাম মানুষ আমার কথাটা নিয়েছে। বা আমি তাদের ভাষায় কথা বলতে পেরেছি। আমি সাথে সাথে অন্য একজনকে ডাকলাম এরেনাতে।

আগত ব্যক্তিকে শুধালাম, আচ্ছা ভাই আপনি বলুন এ কি ঠিক কথা বলছেন? সে বলল – বলল ‘না’ – ‘তবে পোলিও খেয়ে আমার ভাইয়ের জ্বর এসেছিল।’ আমি বললাম- ‘তুমি জানলে কি করে পোলিও খেয়ে তার জ্বর এসেছে? এমনও হতে পারে তার আগে থেকেই জ্বর ছিল। তুমি আমি তো ডাক্তার না। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’ সে বলল- সে গিয়েছিল, ডাক্তার নাকি বলেছে যে পোলিও খেয়েই হয়েছে। ‘আমি বললাম যে ডাক্তার এরকম বলেছেন তার নাম ও রেজিস্ট্রেশন নং দিন, আমরা ওর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

তার কাছে থেকে জানতে পারলাম সে অঞ্চলের হাতুড়ে ডাক্তার। বুঝে নিতে অসুবিধা হল না সুতোটা কোথায় বাঁধা আছে। তাদের ধর্মীয় গুরু বলে দিয়েছেন এই পোলিও আসলে সরকারী চক্রান্ত। তাদের বংশের জন্ম নিয়ন্ত্রণের লক্ষেই এই উদ্যোগ।

পথনাটকে মনে রাখার জিনিস

আমরা নাট্যকর্মীরা কিন্তু মেনে নিই না। আমরা নানান উপমা সহযোগে নাটক দীর্ঘায়িত করি। এরকম ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই যে হিন্দু পরিবারে একাধিক সন্তানের জন্ম হয় না। আর একাধিক সন্তান জন্ম দিয়ে আপনি যদি সেই সন্তানদের ভালো করে দেখভাল করেন, তাহলে দিন না যত খুশি সন্তানের জন্ম।

কিন্তু একটা শিশু পালন করতে যে খরচ আপনাকে করতে হয় সেখানে ৭টা সন্তানকে দেখভাল করতে ৭গুণ খরচ বাড়বে। অথচ আপনি একটু ভেবে দেখবেন সেই ৭জনকে পালন করার ক্ষমতা যদি আপনার সত্যি থেকে থাকে তাহলে সেই টাকায় আপনি ১জনের দেখভাল করলে সে শিশুর প্রতি আপনি বেশি নজর রাখতে পারবেন। আর সেই শিশুও সুস্বাস্থের অধিকারী হবে। ভালো করে লেখাপড়া শিখতে পারবে। ভবিষ্যতে আপনার কষ্ট কিছুটা কমবে। মানুষ শোনে। কেউ কেউ বোঝে। আবার অনেকেই বোঝে না।

এরপরই শুরু হয় সেই সকল সমাজকর্মীর কাজ, যাঁরা আমাদের থেকেও বেশি ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে একটার পর একটা মিটিংয়ের মাধ্যমে অবুধ মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করে থাকেন। অর্থাৎ শুধু নাটক করে দিয়েই আমরা রাতারাতি সব কিছু পাল্টে দিতে পারি না। নাটক দেখার পর তারা কিছুটা আশ্বস্ত হন। কিছুটা ভরসা পান। এভাবেই এই নাট্য প্রক্রিয়া সমাজসংস্কারের কাজ করে চলেছে। নিঃশব্দে। নীরবে।

(চলবে)

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -