Tuesday, December 17, 2024
Tuesday, December 17, 2024
Homeআলোচনাবরানগর দৃশ্যকাব্যের সেই বিদ্রোহী মানুষের মুখপত্র

বরানগর দৃশ্যকাব্যের সেই বিদ্রোহী মানুষের মুখপত্র

অবনী ভট্টাচার্য (শিলিগুড়ি)

উত্তরবঙ্গের মানুষ আমি। ৭০-৮০ দশকে নাট্যচর্চা নিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়েছে। তারপর নানা কারণে কোন নাটকের দলের সঙ্গে নিয়মিত যুক্ত থাকা আর হয় নি। কলেজে মাস্টারি করতে গিয়ে আসাম, ত্রিপুরা, সবশেষে শিলিগুড়িতে জীবনের অনেকটা সময় পার করে দিয়েছি।

তথাপি রাজ্যের কোথায় কোন নাটক, কোন দল, অভিনয় করছে, এসব খবরে উৎসাহ ছিল। শ্বশুরবাড়ি কলকাতায় মাঝেমধ্যে আসতে হয়। তখন কলকাতার নাটকের ঘর গৃহস্থালির খবরা-খবর রাখতে হয়। সম্প্রতি বিডন স্ট্রিটে আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ার ঐতিহ্যবাহী মিনার্ভা মঞ্চে ঢুকে পড়েছিলাম। অপরিচিত বরানগর দৃশ্যকাব্যের ‘সেই বিদ্রোহী’ নাটকটা দেখবার পর আমি সারারাত ঘুমোতে পারি নি। কেন ঘুমতে পারি নি এখানে সেই কথাই উল্লেখ করবো।

উত্তরবঙ্গের তরাই অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণের সুন্দরবন পর্যন্ত বাংলা সংস্কৃতির জগতে বেশ কিছু বছর ধরে মূলত আলোচনা হয়ে চলেছে, তবে কি বাঙালির সংস্কৃতি থমকে গেল? অন্যরকম হয়ে গেল? সৃষ্টিশীলতার মেজাজ হারিয়ে ফেলে বাঙালি সংস্কৃতি মেরুদন্ডহীন হয়ে পড়েছে?

এই আলোচনা বাংলার বাইরেও ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলার যে থিয়েটার শিল্প দেখে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ আলোড়িত হতো, এগিয়ে চলার নতুন দিশা দেখতে পেত, সেই থিয়েটার কোথায় গেল? ভারতের সংস্কৃতির রাজধানী কলকাতা শহরের অধঃপত ন বাঙালি হিসেবে আমাদের কি লজ্জা দেয় না?

কেউ কেউ বলছেন, থিয়েটারের দলের বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। যত দল হয়েছে, তত দর্শক নেই। এই কারণেই হয়তো বাংলা থিয়েটারের মান নাকি ক্রমাগত নিম্নগামী। তবে আমাকে সেদিন দৃশ্যকাব্যের সেই বিদ্রোহী আমাকে বসিয়ে রেখেছিল। আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। কেন? সেই কথাই বলতে বসেছি!

মহাভারতের এক উপেক্ষিত চরিত্র বিকর্ণ কে নিয়ে এই নাটক গড়ে উঠেছে। খুবই পরিচিত ঘটনা। বছরের পর বছর ধরে পাশা খালার দৃশ্য, দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্নভাবে আলোচিত হয়ে আসছে। নাটকে, সিনেমায়, কবিতায়, গল্পে, যাত্রায়। যা অন্তহীন এক বিতর্ক সভা। তবে সমস্ত আলোচনা একমুখী। দুর্যোধন দুঃশাসন এবং কৌরবদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা। পাঞ্চালির মানসিক স্তর নিয়ে তেমনভাবে কেউ ভাবে নি।

দূর্যোধনদের মত সমানভাবে দোষী, এবং অপদার্থ, মেরুদণ্ডহীন, পাণ্ডবদের প্রতি কেউ আঙুল তুলে প্রমাণ করে নি যে, যুধিষ্ঠির মশাই কে সাধু প্রতিপন্ন করা যায়। এই নাটকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, মাতা কুন্তী দেবী কে সেদিন পাঞ্চালীর পরিবর্তে যদি লাঞ্ছিত হতে হতো তাহলে কি পঞ্চপান্ডব একইভাবে নীরব থাকতো?

প্রশ্ন তোলা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে যেভাবে নারী নির্যাতন চলছে, ধর্ষিতা নারীদের কান্নায় বিবেকবান মানুষের বিবেক জাগ্রত হয় না কেন? প্রশ্ন তোলা হয়েছে সামগ্রিকভাবে দেশ এবং রাজ্যের বিবেক কি ঘুমিয়ে পড়েছে? বিকর্ণ যখন ঘুমোতে পারছে না, বিকর্ণর মধ্য থেকে যখন একজন বিদ্রোহী পুরুষ জেগে উঠছে, ঠিক তখন তিনজন জ্যেষ্ঠ কৌরব এবং ব্রাহ্মণদের অংশটা বিকর্ণকে তারিফ করবার পরেও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে হে বিকর্ণ, আপোষ করো। মধ্যপন্থা গ্রহণ করো। পলায়ন কর। বিদ্রোহ মোটেই ভালো জিনিস নয়। মনে করতে পারছিনা, এইরকম একটি রাজনৈতিক নাটক এর আগে কবে দেখেছি। শুধু রাজনৈতিক নাটক বললে ভুল হবে, শিল্প সমৃদ্ধ থিয়েটার যাকে আমরা টোটাল থিয়েটার বলতে পারি, ২ দশকের মধ্যে কবে দেখলাম?

নাট্যকার প্রবীন মানুষ। শুধুমাত্র প্রবীণ নয়, অত্যন্ত পন্ডিত মানুষ। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে একটার পর একটা অসাধারণ চিরায়াত নাটকের জন্মদিন যাচ্ছেন। আমার এবং আরো অনেকের বিচারে, এইরকম শক্তিশালী নাট্যকার সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটা আমার সিদ্ধান্ত। যারা লিখছেন তারা জলের দাগ কাটছেন। ডুবুরির মত সময়ের সমুদ্র গর্ভে অবগাহন করতে পারেন না। কোন কোন মিডিয়া তাদের তোল্লা দেয়। নিজস্ব লবির  সৌজন্যে টিকে আছেন।

তারা কোনদিন রসিক মারা গেছে, ল্যাংড়া ধাবা, ষষ্ঠ ঋতু, কালকূট, সাইকেল, অন্ধ গলির রাজা, চোখ, নিখোঁজ শুভ্র, নামতে নামতে লিখতে পারবেন না। দৃশ্যকাব্য দলের প্রধান অভিনেতা এবং নির্দেশক সম্রাট সান্যাল কে আমরা নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। এই নাটকে তিনি বিকর্ণের চরিত্রে অবতীর্ণ হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, তার বিকল্প নেই। তিনুবাবু একইভাবে প্রশংসিত হতে পারেন।

একা তিনটে চরিত্র তিনি বহন করেছেন। শক্তিশালী অভিনেত্রী মুনমুন পাঠক অতীতে নন্দিতামি নাটকে যেভাবে জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন, অনেকদিন পর তাকে দেখে আবার মুগ্ধ হলাম। তিনি তো অভিনয় করেন নি। চরিত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন মঞ্চে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে। সাবাস দৃশ্য কাব্য। আপনারা বাঘের বাচ্চা। আপনাদের মেরুদন্ড সোজা আছে। প্রকৃত অর্থে আপনারাই শিল্পী। মানুষের মুখপত্র। লাঞ্ছিত মানুষের কন্ঠস্বর।  

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular