Tuesday, December 3, 2024
Tuesday, December 3, 2024
Homeনাটকবাংলা নাটক ফিরছে নাটকেই

বাংলা নাটক ফিরছে নাটকেই

স্বপন ঘোষ চৌধুরী 


হৃদয় বলল, জানো মামা, রাখাল আজ গিরীশ ঘোষের থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল। চৈতন্য লীলা। 
রামকৃষ্ণ বললেন – তা যাক না! 
– ওরা খারাপ মেয়ে নিয়ে অভিনয় করে।
– করুক না। সেও অভিনয়, এও অভিনয়। থিয়েটারে লোক শিক্ষা হয়।
প্রায় একশত্রিশ বছর আগে রামকৃষ্ণ বলেছিলেন – “থিয়েটারে লোক শিক্ষা হয়।” এই অমোঘ সত্যটিকে সামনে রেখেই অভিনীত হয় নাটক। নাটকও অভিনয়, যাত্রা পালাও অভিনয়। কিন্তু যাত্রার নাটক আজও নাটকের দলে নাম লেখাতে পারল না, পালা গানই রয়ে গেল। তাই যাত্রার রচয়িতাকে বলা হয় পালাকার। থিয়েটারের রচয়িতাকে বলা হয় নাট্যকার।

লোক শিক্ষাই অভিনয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য। ইংরাজি পালা বা নাটকের অনুকরণে অপেরা এদেশে প্রচলিত হয়েছে অনেক পারে। সেই প্রাচীন যুগ থেকে বাংলার গ্রামে গঞ্জে নিয়মিত অভিনীত হত রাম যাত্রা, কৃষ্ণ যাত্রা, পাঁচালি গান। এতে শুধু মাত্র পৌরানিক বিষয় গুলি প্রাধান্য পায়নি, পেয়েছে লোক শিক্ষার বিষয়টিও। কবিগান, বোলানগান, আলকাপ, ঝুমুর ইত্যাদি শুধু মনোরঞ্জনের জন্য।

আর তাই এই ধরনের গানগুলি শুধু মাত্র আসর মাত করেই বছরের পর বছর কাটিয়ে দিয়েছে। আসলে অবসর বিনোদনের জন্যই ওই সব গানের প্রচলন কমতে কমতে প্রায় মুছে গেল যখন মানুষের কাজের চাপ বাড়ল। মানুষ আর সময় নষ্ট করে ওই সব বিষয়ের প্রতি মন দিতে রাজি নয়। অথচ মানুষ শত কাজের মধ্যেও নাটক দেখতে যান। যান, কারণ এর মধ্যে শেখার কিছু থাকে। দুর্ভাগ্য আমাদের, বাংলার সংস্কৃতি জগতের সেরা সম্পদ যাত্রা পালা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর কিছু দিন পারে হয়তো যাত্রা শব্দটি ভুলে যাবে। জানা কথা, যাত্রায় সব ধরনের অভিনয় হয়, নাটক বা থিয়েটারে অভিনয় হয় অন্য ধরনের।

যত দূর জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে প্রথম থিয়েটার অর্থাৎ তিনদিক ঘেরা মঞ্চে অভিনয় শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। পার্কস্ট্রিট অঞ্চলের কোনো এক স্থানে ছিল মঞ্চ। প্রথম মহিলা অভিনেত্রী হিসেবে নাম শোনা যায় এস্তার লিচের। অভিনয় চলাকালীনই আগুন লেগে যায়। মঞ্চেই আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় এস্তার লিচের। তারপর পশ্চিমবঙ্গের পেশাদারী নাটকের আসর বেশ কয়েক বছর শূন্য হয়ে পড়েছিল। তখন অপেরা দল খোলার সবে তোড়জোর শুরু হয়েছে। ইংল্যান্ডের খোলা মঞ্চে অভিনীত অপেরা দল থেকে বাংলার বিভিন্ন নাট্যদলের নামের শেষে অপেরা শব্দটি যুক্ত হয়েছে। কিন্তু তা পালাগানেই থেমে রইল। বাংলা নাটক যা তিন দিক ঘেরা মঞ্চে অভিনীত হয়, তার শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পার করে। তখন পেশাদার মঞ্চ ছিল না। বাংলা নাটকে প্রথম পেশাদার নাটক অভিনয়ের ক্ষেত্রে যিনি সার্থক হয়ে উঠেছিলেন, তিনি গিরীশ ঘোষ। মূলত তাঁরই হাত ধরে বাংলা নাটক পাকাপাকি ভাবে বাংলার মানুষের মন জয় করার কাজ শুরু করেছিল। দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর আজও বাংলার রঙ্গমঞ্চ সমান ভাবে আমাদের আকর্ষণ করে।

মোটামুটি দু ধরনের বাংলা নাটক অভিনীত হয়। পেশাদারী বা ব্যবসাভিত্তিক নাটক ও পরীক্ষা মূলক বাংলার প্রথম স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ হিসেবে আমরা স্টার থিয়েটারকেই জানি। শ্রীরামকৃষ্ণের পদধূলি ধন্য স্টার থিয়েটারের প্রথম নাটক গিরীশ ঘোষের – “চৈতন্যলীলা”। এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন গিরীশবাবু, বিনোদিনী দাসী, দাশরথী নিয়োগী প্রমুখ। 

এর পরে বাংলার রঙ্গমঞ্চের জগতে নতুন নতুন থিয়েটার হল তৈরী হতে শুরু করলো। মিনার্ভা, রঙমহল, বিশ্বরূপা এদের মধ্যে অন্যতম। বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকেও বাংলা রঙ্গমঞ্চের ছিল রমরমা অবস্থা। এর জন্য দক্ষিন কলকাতায় তৈরী হলো তপন থিয়েটার। মধ্য কলকাতায়ে প্রজ্ঞানানন্দ হল। এরই কাছাকাছি প্রতাপ মঞ্চ। 
উৎপল দত্ত, রাসবিহারী সরকার বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি শম্ভু মিত্র, বিকাশ রায়, কমল মিত্র, অসীম কুমার, তৃপ্তি মিত্র, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া চৌধুরীর মতো চিত্রজগতের শিল্পীরাও মঞ্চে এসেছিলেন। তরুণ কুমার, ভানু বন্দোপাধ্যায়, জহর রায় অন্য স্বাদের অভিনয় করে দেখিয়েছেন বাংলা মঞ্চের দর্শকদের। 
মঞ্চসজ্জায় খালেদ চৌধুরীকে বাংলার নাট্যপ্রেমীরা যেমন বহুদিন মনে রাখবেন তেমনি মনে রাখবেন আলোর জাদুকর তাপস সেনকে। বেশ কিছু নাট্যগোষ্ঠী পরীক্ষা মূলক ও ব্যবসাভিত্তিক নাটক এক সঙ্গে অভিনয় করেছে। এই সব নাটকে অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, তরুণ কুমার, শাঁওলী মিত্র, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, সরোজ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য।

রিভলবিং স্টেজ বা ঘুর্নায়মান মঞ্চ যখন ঠিকে চালু হলো, বাংলার দর্শক দের কাছে বাংলা নাটকের এক নতুন দরজা খুলে গেল। মিনার্ভায় অভিনীত হলো “কল্লোল”, “অঙ্গার”। বিশ্বরূপায় “সেতু”, স্টারে “মল্লিকা”। 
ঘুর্নায়মান মঞ্চ এবং আলোর কারুকার্য ও অসাধারণ অভিনয়ে বাংলা নাটকের তখন স্বর্ণযুগ। “অঙ্গার” নাটকে কয়লা খনির ভেতরের দৃশ্য, “সেতু” নাটকে রেল গাড়ির দৌড় , “মল্লিকা” নাটকে মঞ্চে টাক্সির দৌড় এক অবিস্বরনীয় দৃশ্য সৃষ্টি করে দর্শকদের হতবাক করে দিয়েছিল। গত শতাব্দীর পাঁচের দশকের শেষে মানিক তলায় কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে “আন্টনি কবিয়াল” নাটকটি বেশ কয়েক বছর চলে। এর পর নতুন নাটক মঞ্চস্থ করা হলেও ঠিক মতো দর্শক টানতে পারেনি। 

আমার জীবনের প্রথম নাটক দেখা ব্রজেন দের “লাল পাঞ্জা”। এর পর বোঝবার মতো বয়েসে দেখেছিলাম ডি. এল. রায়ের “সাহাজাহান”। আরও পরে যৌবনে দেখলাম “সেতু” । সে এক অসাধারণ নাটক। যেমন নাটক তেমনই আলোর কাজ । সেতুর ওই ট্রেনের দৃশ্য সারা জীবনে ভুলব না। নায়িকা তৃপ্তি মিত্র আত্মহত্যা করতে গেছেন। খবর পেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে ছুটে গেলেন অসীম কুমার। তৃপ্তি মিত্র রেল লাইনের ধরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। আধো চাঁদ আকাশে, চার পাশে ভৌতিক আঁধার। রেল লাইনের উপর চাঁদের পরে চক চক করছে। লাইনের পাশে ঝোপের আড়ালে দাড়িয়ে আছেন তৃপ্তি মিত্র। এমন সময় দুরে একটা আলোর বিন্দু দেখা গেল। সেই বিন্দু বড় হতে লাগলো। সোনা গেল দূর থেকে ট্রেনের শব্দ। কিছুক্ষনের মধ্যেই আলো ঠিকরে পরে লাইনের উপর। বিশাল কানাডা স্টিম ইঞ্জিন বিকট গর্জনে এগিয়ে আসতেই নায়িকা ঝাঁপ দিতে গেলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পেছন থেকে হাত ধরে তৃপ্তি মিত্রকে বুকের কাছে টেনে নিলেন অসীম কুমার। প্রচন্ড বেগে ইঞ্জিনটা বেরিয়ে গেল। একে একে ট্রেনের কামরা গুলি ঝম ঝম শব্দে হল কাঁপিয়ে দেয়। মঞ্চ একটু বাঁ দিকে ঘুরে গেল। দেখা গেল ট্রেনের শেষ কামরার লাল আলো ক্রমশ দুরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা হতবাক। এই একটি দৃশ্য দেখবার জন্য সাতবার “সেতু” নাটক দেখেছিলুম। 

মল্লিকা” নাটকে মঞ্চে ট্যাক্সি চলছে। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ট্যাক্সির ভেতর দুষ্কৃতিদের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এখানেই ছিল তাপস সেনের আলোর জাদু। “অঙ্গার” নাটকে ছিল কয়লা খনির ভেতরের দৃশ্য। কয়লা কাটা, ডিনামাইট ফাটানোর ঘটনা দেখে মনে হচ্ছিল খনির মধ্যে নেমে গেছি। 

যে দল সরকারে থাকে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে এই দল রেগে যায় । এই ঘটনা আমদের দেশে বিরল নয়। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ মুখার্জিকে কম হেনস্থা হতে হয়নি। সেই সময়ই দীনবন্ধু মিত্রের লেখেন “নীল দর্পণ” নাটক। নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের নির্মম ঘটনা এই নাটকে প্রতিফলিত হয়। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার “নীল দর্পণ” নাটকটির প্রদর্শন বন্ধ করেন। বইটি বাজেয়াপ্ত করেন। 

তারপর প্রায় একশ বছর পারে আমাদের স্বাধীন দেশের সরকার মিনার্ভায় প্রদর্শিত “কল্লোল” নাটকটি বন্ধ করার জন্য আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে অভিযোগ। উৎপল দত্ত পরিচালিত এই নাটকের বিজ্ঞাপন বন্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দুইটি বিখ্যাত সংবাদ পত্রিকা তখন “কল্লোলের” বিজ্ঞাপন প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। 
নাটক লোকশিক্ষা দেয়, নাটক মানুষের বিবেক বোধ জাগিয়ে তোলে। নাটক সমাজের দাবি আমাদের সামনে তুলে ধরে। সচেতন করে। 

মাঝখানে ভালো নাটকের বড় অভাব দেখা দিয়েছিল। সুখের কথা আবার বাংলার নাটক নতুন করে দর্শকদের মাঝে নিজের অস্তিত্ব জানাতে পারছে। আমাদের বড় আশা বাংলা নাটক তার অতীত ঐতিহ্যকে চিরকালীন করে রাখুক, ধরে রাখুক।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular