মঞ্চে নারীর নিরাপত্তা ও দায়বদ্ধতা, নাটকের একাল এবং সেকাল

- Advertisement -

দেবা রায়

মঞ্চে নারীর নিরাপত্তা ও দায়বদ্ধতা। মঞ্চে নারীদের প্রতিকূলতা রঙ্গমঞ্চে প্রথম লক্ষ্য করা যায় উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ারে। নটী ময়নার মধ্য দিয়ে আমরা বিনোদিনীকে দেখতে পাই। ঐ নাটকেও কপ্তেনবাবু যিনি নাটকের জন্য বিক্রি করেছিল ময়নাকে, ঠিক এমনি ঘটনা বাংলা নাটকের ইতিহাসে কি দেখা যায় নি?

গিরিশ ঘোষের অনুরোধে নিজেকে বিক্রি করেছিল বিনোদিনী, গুর্মুখ রায় মুসাদ্দী নামক এক বড়লোক মাড়োয়াড়ি যুবকের কাছে। প্রলোভন দেখানো হয়েছিল তাঁকে, গুর্মুখের নামে তৈরি থিয়েটারের নাম হবে তারই নামে। গুর্মুখ রায় সেটা চেয়েওছিলেন কিন্তু বারাঙ্গনার নামে থিয়েটারে নাম হলে, ভদ্দরলোক পরিবারের মেয়েরা থিয়েটার দেখতে আসবেন না। সেই স্বপ্নের ‘বি থিয়েটারে’র সেখানেই সমাপতন।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট  

মঞ্চে অভিনেত্রী নিয়ে আসা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সাথে মাইকেলের মত বিরোধ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যে মানুষটা বহুবিবাহ, বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ প্রচলন ও নারী শিক্ষা নিয়ে সোচ্চার, সেই মানুষ বারাঙ্গনাদের মঞ্চে প্রবেসাধিকার সম্পর্কে মোটেই রাজী ছিলেন না। সেই প্রসঙ্গে তিনি ‘বেঙ্গল থিয়েটার’এর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন।

‘বেঙ্গল থিয়েটার’-এ অভিনেত্রী নিয়োগ প্রসঙ্গে তখন তোলপাড় পড়ে যায়। ‘সুলভ সমাচার পত্রিকায় পাওয়া যায় – ‘… মেয়েমানুষ আনিয়া নাটক করিলে অনেক টাকা হইবে, এই লোভে পড়িয়া তাহারা কতকগুলি নটীর অনুসন্ধানে আছ। … মেয়ে নটি আনিতে গেলে মন্দ স্ত্রী লোক আনিতে হইবে সুতরাং তাহা হইলে শ্রেদ্ধ অনেকদূর গড়াইবে। কিন্তু দেশের পক্ষে তাহা নিতান্ত অনিষ্টের হেতু হইবে।’

এইসকল বাবুদের চরিত্র নিয়ে কালের সময় সময়ে ধরে ‘চরিত্তির’ চলে যাবার যে আবহমানের আশঙ্কা তা অবশ্যই আমাদের সামাজিক লজ্জা। গৃহিণীদের অন্তঃপুরে ঠেলে রেখে বারাঙ্গনা নিয়ে ফুর্তির ছাড়পত্র থাকতে পারে, কিন্তু সেই বারাঙ্গনা নটী মঞ্চে প্রবেশাধিকার নৈব নৈব চ।

এমনি সামাজিক টালমাটাল অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মাইকেল নারী শিল্পীদের নেওয়ার স্বপক্ষে শুরু করলেন আন্দোলন। পক্ষে বিপক্ষের মতামতের ঝড় উঠেছিল সেই সময়ের পত্র পত্রিকায়। মনোমোহন বসুর ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় এহেন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু হল। স্বপক্ষে দাঁড়ালো ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’। মধুসূদন লিখলেন ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক। এখানেই অভিনয় করতে আসেন বারাঙ্গনা সমাজের শ্যামা, গোলাপ সুন্দরী, জগত্তারিণী ও এলোকেশী।

নাটক, যাত্রা, সিনেমা ইত্যাদি পারফর্মিং আর্টে চিরকালই মেয়েদের আসাটাকে সমাজের অভিভাবকেরা মেনে নেন নি। এর কারণ ভদ্রলোকের বাড়ির অন্দরমহলের মেয়েরা যারা ‘ভালোমেয়ে’ তকমা পেয়ে থাকে, আর বাইরে কাজ করতে বেরোনো মেয়েরা বরাবরই ‘বাজারের মেয়েছেলে’ বা বারাঙ্গনা বলেই জানে। বা মানে। ভালো মেয়েদের ছিল পুর্ণ অধীনতা অর্থাৎ আনুগত্যের বিনিময়ে তাদের ভালত্বকে কেনা হত। সমাজের প্রোডাকটিভ কাজে তাই তাদের বিযুক্ত থাকতে হতো। অর্থাৎ তাঁদের না ছিল অভিনয় করার অধিকার না ছিল দেখার। সবটাই পরিবারের কর্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

আবার যারা বারাঙ্গনা হয়ে মঞ্চে এলেন নটীর স্বীকৃতি পেয়ে বাংলা নাটকের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে তাঁদেরও কপালে জুটেছিল নানা বঞ্চনা। তাঁদের পেশার কারণে নাচ গান শেখা ছিল বাধ্যতামূলক, তা হলে বাবুদের মনোরঞ্জন করবে কে? আর এই কাজে পারদর্শী কর্মীর থাকতো বাঁধা বাবু। বাবুদের বাগানবাড়িতে পৃথকভাবে তাঁদের স্থান হত। আর এই বারাঙ্গনারা যখন নটী বাংলা রঙ্গ মঞ্চ মাতাচ্ছেন, তখন সেই বাবুরাই তাঁদের সামাজিক উত্থানে প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠছেন।

এই সময়ের গোলাপ সুন্দরী পরে সুকুমারী দত্ত, তিনকড়ি, কুসুমকুমারী এরা সকলেই পতিতা পল্লী থেকেই থিয়েটারে এসেছিলেন। এই থিয়েটার জীবন যেন সেইসময় তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন যন্ত্রণা ও তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যেই এক নিশ্চিন্ত পরিসর হয়ে উঠেছিল। গিরিস-অর্ধেন্দু-অমরেন্দ্র নাথের সময় দেখা গেছে বেশ কিছু বলিষ্ঠ অভিনেত্রীদের, তাঁদের মধ্যে অন্যতম তারাসুন্দরী, নরী সুন্দরী, নিরদা সুন্দরী প্রমূখ।

পরবর্তী পর্বে এলেন প্রভা দেবী, নীহারবালা, বড় রাজলক্ষী, ছোট রাজলক্ষী, চারুশীলা, কৃষ্ণভিমানী, শেফালিকা, সুশীলা সুন্দরী রেবা দেবী, সরযুবালা, মলিনা দেবী প্রমুখ। যদিও এঁরা সমাজের সেই অংশ থেকে আসেননি। 

উত্তর রবীন্দ্রনাথের নটীর স্বাধিকার

ইতিমধ্যে নাট্য জগতে রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ ঘটে গিয়েছে। নাটক লেখা, এবং নিজের অভিনয়ের সাথে সাথে সমাজের সাধারোন ঘর থেকে মেয়েদের নাটকে আসাটা কোথায় যেন সম্মতি বা সম্মান অর্জন করেছে।

যদিও উত্তর রবীন্দ্রনাথ বাংলা রঙ্গমঞ্চের নারীদের অবস্থানকি বদলেছে? একদকে সংসার আর অপর দিকে অভিনয় জীবন দুইই তাকে সমান তালে করে যেতে হয়। না করতে পারলে তার অভিনয় জীবন থেকে অবসর নেওয়া ছাড়া পথ থাকে না। এরই সাথে সাথে নারী আন্দোলনের পথ ধরে নারী পেয়েছে সংরক্ষণের সীমানা। একি স্বাধীনতা? নারীকে আজও আলাদা করে স্বীকৃতি দিতে হয়। যে পুরুষ তাঁর ঋত গৌরব উদ্ধার করে তাঁকে অগ্রাধিকারের শিরোপা পড়াতে এগিয়ে আসে, সেইখানে নারী কি তাকে প্রশ্ন করে, এই অধিকার তাকে পাইয়ে দেওয়ার অধিকার পুরুষের কবে থেকে হল, এই সৃষ্টির সব কিছুতেই তো তাঁদের একটাই অধিকার মনুষ্যত্বের অধিকার। সেটা তো পাওয়া যায় না, অর্জন করে নিতে হয়। 

তাই নারী নাট্যকর্মীদের লড়াই সেই অধিকার অর্জনের প্রতি নজর দেওয়া। কোনওরকম সংরক্ষণের প্রতি সুবিধাভোগী না থেকে মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই বাংলা রঙ্গমঞ্চে নারী অভিনেত্রী, নাট্যকার, নির্দেশক সেই লড়াইয়ের অনেকটাই সদর্থক ইঙ্গিত বহন করে।

নাটকে অভিনেত্রীরা লঘু সম্প্রদায় এবং জন্য দায়ী সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা, এটা আজ কত শতাংশ সত্য তা হিসেবের সময় এসেছে। সমাজে আজ ছেলে মেয়ে বিভেদ অনেকাংশেই কমেছে। তারপরেও থিয়েটারে মেয়েদের সংযুক্তি কি বেরেছে? একজন মেয়ে যদি অভিনয়কে বেছে নেন, তাহলে সবার আগে তাঁদের প্রাথমিক চোখ থাকে সিনেমা বা সিরিয়ালের দিকে। অর্থাৎ গ্ল্যামার সর্বস্বতাকে উপেক্ষা না করে, বরং অত্যন্ত সমাদর করে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেই দিকেই মোহাবিষ্ট হয়ে ছুটে যাওয়াকে সঠিক কাজ মনে করেন। মানে সেই সংখ্যাটাই বেশী। কারণ সমাজ ভোগসর্বস্বতায় নিমজ্জিত। আর সেই সমাজেরই বাই প্রোডাক্ট নারীপুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ।

ভোগ সর্বস্বতায় গা ভাসানো কিছু না-জবাব 

আজ এই ভোগের বাজার দৌড়ে কারা এগিয়ে? কাদের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে নিজেকে সুন্দর করে বাজারে নামতে হয়! লড়াই কিসের? লড়াই কোথায়? মুখে সিগারেট বা হাতে মদই কি নারী প্রগতির সদর্থক দিশা? কোথায় সৃষ্টিশীলতা? পুরুষতন্ত্র নারীকে পণ্য করে রেখেছে আজও, এটা কখনোই মিথ্যা নয়, কিন্তু নারীবাদের নামে কটা লড়াইয়ে সে সামিল করেছে নিজেকে? কটা লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছে? পুরুষতন্ত্রের জিগীর তুলে নিজেকে ভোগের সাম্রাজ্যে নিয়ে যাওয়া কোন স্বাধীনতার লড়াই?   

যে বারাঙ্গনারা নাট্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে রেখেছিল, যে অশ্রুসিক্ত চোখে একটা থিয়েটারের নাম নিজের নামে করতে চেয়েও পারেনি, যে সাহসের সাথে ‘আমার কথা’র মতো আত্মজীবনী লেখার সাহস দেখিয়েছিলেন, সেই উত্তাপ আজ থিয়েটারে কোথায় বা কতটা? সেই তর্ক তুলে দেওয়ার প্রশ্নেই এই প্রাবন্ধিক অবতারণা।     

নাটক গ্ল্যামারাস ফিল্ড নয়। নাটকে কাজ করলে বিনোদনের মডেল হওয়া যায় না। তখনও যেতো না, তবু তাঁরা আসতেন বা আনা হত। তারা হয়ে নয় তারা হয়ে। আজ তাঁদের থিয়েটারে আনতে চাইলে অর্থ উপার্জনের গল্প শোনায়। কিন্তু একটি ছেলে কিন্তু এই গল্প শোনায় না। সে দলকে ভালোবেসে বছরের পর বছর ধরে দল আকড়ে কাজ করে যান। একসময় তাঁদের উত্তরণও ঘটে। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে সে পালিয়ে যায় না।   

হ্যাঁ এখানে একটি কথা অনেকেই বলবেন, একটি মেয়ের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় বা কম সম্ভব। একটা মেয়ের পক্ষে বহুমূল্যের প্রসাধনী কেনা সম্ভব, একটা মেয়ের পক্ষে সিরিয়ালে যুক্ত হওয়া অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ, একটি মেয়ে পক্ষে পণ দেয়া বাপের বিরুদ্ধে কথা না বলা সম্ভব, একটা মেয়ের পক্ষে বিবাহের জন্য বাপের থেকে দানসামগ্রী চেয়ে নেয়া সম্ভব, একটা মেয়ের পক্ষে নিজেকে পণ্য করার প্রবণতায় কোনো ভুল না দেখা সম্ভব, একটা মেয়ের পক্ষে বিনোদনের নামে অশ্লীল বিজ্ঞাপণ বানানো সম্ভব, একটি মেয়ের পক্ষে বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে ধর্মের নামে শিবপূজায় উপবাস করা সম্ভব, একটি মেয়ের পক্ষে সংরক্ষণের সুবিধা নেওয়া সম্ভব, একটি মেয়ে পক্ষে ক্ষমতার অপব্যবহার করা সম্ভব, এহেন বহু সম্ভবের মধ্যে থেকেও আমরা নারী অধিকারের জিগীর তুলে নিজেকে প্রতিবাদে সামিল করে রাখি। আর পুরুষকে সন্দেহের চোখে রেখে দি।   

মনে রাখবেন আজও একটি এম এ পাশ করা মেয়ে লগ্নভ্রষ্টা হয়, এই অসহায়তা কার? পুরুষের না পুরুষতন্ত্রের?    

কিসের নিরাপত্তার অভাব! মহাকাশে যেতে কল্পনাকে কোন নিরাপত্তার অপেক্ষা করতে হয়েছিল। জল স্থল অন্তরীক্ষে বঙ্গ ললনাদের কথা কি তারা ভুলে গেছেন? বহু মেয়ে নাট্যকর্মী সেই ভীড় ট্রেনে চেপে বহু কষ্টের পরে, শহরের নাটকের মহলা কক্ষে উপস্থিত হন। না কোনো মূল্য তাঁরা নেন না। বরং দেন। অর্থ দেন। শ্রম দেন। বুদ্ধি দেন। সময় দেন। তাই না আজও এই এতো এতো নাট্যদলে প্রতিদিন শহর আর গ্রামের মঞ্চে মঞ্চে তারা নাটকে করে যাচ্ছেন, পুরুষ নাট্যকর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। হতে পারে তাঁরা সংখ্যায় কম কিন্তু তাঁরাই আমাদের আজকের বিনোদিনী বা তারাসুন্দরী, কেয়া বা তৃপ্তি, শোভা বা মণিকুন্তলা।    

আজকের মহিলা অভিনেত্রিদের সংখ্যা কমের আরেকটা দায় অনেকেই মনে করাবেন দলের কিছু নির্দেশকের অসভ্য ও অন্যায় আচরণ। তাইবলে বাংলা ঘরে ঘরে প্রতিটি দলের নির্দেশক রেপিষ্ট এটা কবে থেকে কে নির্ধারণ করলো? সমাজেও সেই মেয়েটা বাবা, কাকা, মামা, মাস্টারের কুনজরে থাকে, তাই বলে তাদের উপেক্ষা করে কি সেই মেয়েটাকে তাদের সীমানায় যেতে বারণ করা হয়? নাকি তাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়? যে সিনেমা শিল্পের প্রতি এতো টান বা আগ্রহ সেই সিনেমা শিল্পের ইতিহাস কিন্তু নাটকেরই অশ্লীল ইতিহাসের আঁতুড়ঘর। এটা জেনে রাখুন।      

শেষে সামান্য কিছু কথা

মেয়েরা যেদিন নিজেদের মেয়ে মনে করবেন কম আর মানুষ মনে করবে্ন বেশী সেইদিন তিনি অধিকারের সঠিক পথ খুঁজে পাবেন। নয়তো আজীবন পণ্য হয়েই জীবন সমুদ্রে কাঠের টুকরো হয়ে ভেসে বেড়াতে হবে। এই বোধের জন্ম একমাত্র নাট্য শিল্প থেকেই অর্জন করা সম্ভব।

কারণ এটি সেই অর্থে মানুষ তৈরির কারখানা। ভোগের সাম্রাজ্য নয়। এখন আপনাকেই বেছে নিতে হবে, আপনি ভোগের সাম্রাজ্যে গা ভাসাবেন নাকি কারাখানার শ্রমিক হয়ে উৎপাদনে সামিল হবেন।    

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -