দুলাল চক্রবর্ত্তী
সম্প্রতি নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে অনুষ্ঠিত মানিক নাট্যমেলার সপ্তম দর্শনে অভিনীত হয়েছিল, চন্দননগরের সংস্থিতি সংস্থার দুঃশাসনীয় নাটকটি। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লিখিত গল্পটির নামও একই। এই অনন্য গল্পের সাহিত্য রস অক্ষুণ্ণ রেখেই রীতিমতো খুঁজে পেতে মঞ্চ ভাষা পেয়ে এই নাটকটি পরিবেশিত করা হয়েছিল।
আঙ্গিক এবং অভিনয়, সব দিক দিয়েই এটি যেমন একটি অনবদ্য উপস্থাপনা। তেমনি মঞ্চায়নেও ছিল দুঃসাহসিক এক প্রচেষ্টা। সল্প আলোতে অস্পষ্ট ছায়া মূর্তির মতো নগ্ন নারীরা ঘুরছে। তাদের লজ্জাজনক জীবন যাপনের বাস্তবতায়, বিলাপে ভরা এই আখ্যানটি উপস্থিত দর্শকদের ভাবিয়েছিল।
কারণ, বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে অভিশাপ হয়ে নেমে আসা দুর্ভিক্ষের সার্বিক হাহাকার নাটকে দেখানো হয়েছিল। সামন্তবাদের লুটপাটে নিরন্ন বুভুক্ষু গ্রাম বাংলার করুন অবস্থা…খাদ্য দুর স্থান, নিদেন মেয়েদের লজ্জা নিবারনের কাপড় টুকুও নেই। মুনাফা বাজদের লোভী শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে প্রত্যন্ত গ্রামগুলি। গ্রাম্য জীবনে মেয়েরা তাই বিবসনা। তারা স্বামী সন্তানদের মুখোমুখি হতে পারছে না। অন্ধকারেই তারা স্বচ্ছন্দ। আলোতে নগ্ন শরীরে কেউ দেখে ফেলবে, এই ভয়ে গ্রামের সব পরিবারেই মেয়েরা দিনের আলোতে ঘর বন্দী। এদের জীবন জীবনের মতো চলছে না। কাঙ্ক্ষিত দিক গতি জীবনে থাকতেও তারা পঙ্গুত্ব প্রাপ্ত অথর্ব স্থীর জীবন-প্রতীক। ইচ্ছার দ্রুতি বেগ লজ্জার বাধ্যবাধকতায় অনেকটা নিস্তেজ। তাই তারা দেহ গুটিয়ে প্রায় ভুতের মতোই বেঁচে আছে। কাপড় দেবার নাম করে চলছে ছলনা আর বঞ্চনা। বিসম্বাদী গঞ্জনা চলছে ঘরে ঘরে। কল্পনা আছে পোশকে ঢাকা শরীরের আরাম ঘিরে। এখন এভাবেই ধনীদের হাতের পুতুল হয়েছে মানুষ। দারিদ্র কী ভয়ঙ্কর চেহারায় আসতে পারে, তার সত্য স্বরূপ উঠে এসেছে এই দুঃসাশনীয় নাটকে।
চন্দননগরের সংস্থিতি সংস্থা অভাবের অভাবনীয় বাস্তবতাকে এই নাটকে নিখুঁতভাবে গল্পানুসারে তুলে ধরেছে। মরে বেঁচে থাকার নিদারুণ বিবৃতি দিয়েছে সংস্থার শিল্পী কুশীলবেরা নিজেদের অনুভব মিশিয়ে।
অভিনয়শৈলী সহ এই নাটকের মঞ্চ আলো আবহ মিলে সমশ্বর-প্রয়োগ নৈপুণ্য উপস্থিত দর্শকদের চমকে দিয়াছিল। নাট্যরূপ ও নির্দেশনা অনুপম দত্ত। তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা এবং শিল্প জ্ঞানের কারণে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সংস্থিতি প্রযোজিত ওয়ান নাইন টু ফাইভ এবং দুঃসাশনীয় নাটক দুটি দেখে বলতে পারি, তিনি এই সময়ের একজন দক্ষ উদ্ভাবক। রাজনৈতিক দৃষ্টিতে তিনি সময়ের কথা বলতে চান। সংস্থিতি দলের নাটকের বক্তব্যে গতি প্রকৃতিতে এমন ছাপ থাকে। সম্ভবত ২০১৫ সালে সংস্থিতি দলের কাজ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে তা ফুলে ফলে পরিপূর্ণ।
এই নাটকে অনুপম দত্ত নিজে, চমৎকার অভিনয়ে সামন্তবাদের প্রতীক সুরেন ঘোষের চারিত্রিক খুটিনাটি ব্যাঞ্জনা দেখিয়েছেন। ওনার পাশাপাশি আনোয়ার চরিত্রে শ্যামল ঘোষের মার্জিত চরিত্রায়ন নাটকের অন্য প্রাণ ব’লে মনে হয়েছে। বেশ লড়াকু অভিনেত্রী রীনা দত্তের আর্তি পূর্ণ সঞ্চরণে মানদার ভূমিকাটি প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই সারা নাটকের চলায়, সুন্দর ওনার যন্ত্রণা দগ্ধ উপস্থিতি মনকে দোলায়। পাঁচী, বিন্দু ও রাবেয়ার মেয়ের ভুমিকায় ইলা সিংহ সমাদ্দারের তিনটি ভূমিকাই আলাদা এবং উন্নত মঞ্চ কাজ। একঝলক চরিত্রে মালতী / শুক্লা দে, বিপিন সামন্ত / শেখর বন্দোপাধ্যায় দুটি দুরন্ত ভুমিকা। কিন্তু শেখর বন্দোপাধ্যায়ের পুলিশ চরিত্রটি ওয়ান নাইন টু ফাইভ নাটকের সাথে মিলেমিশে নিজস্বতা হারিয়েছে। অনেকটাই দেখানেপনা অভিনয় তার। অন্তর্ভুক্ত কষ্ট উপলব্ধির অভাব রয়ে গেছে কী? মার খেয়ে চলেছে বৈকুন্ঠ চরিত্রের অন্তর বেদনা কাতরতা ও উপায় পথ খুঁজে চলা চারিত্রিক দ্যোতনা। এই চরিত্রটি আরো শক্তিশালী হলে এই প্রযোজনা ভিন্ন মানে যেতে পারে। মানদার ছেলে কানু’র প্রাঞ্জল উপস্থিতিতে অর্ণা দত্তের মাকে ন্যাঙটা দেখে সাবলীল হাসিতে ফেটে পড়া, সারা নাটকে বক্তব্যের মোক্ষম থাপ্পড়। মন্দ নয় রাবেয়া চরিত্রে কলি ঘোষ।
এদিন সপ্তম অভিনয়ে এই নাটকের মঞ্চায়ন হয়েছিল। যখন দর্শকদের পরপর ছটি নাটক দেখে, ক্লান্ত অবস্থায় ঝিমিয়ে পড়ারই কথা ছিল। কিন্তু দুঃসাশনীয় সেখানে এনার্জিপ্যাক নাটকে টেনে ধরেছিল। নেপথ্য কন্ঠে প্রবীর দত্তের গল্প কথা বলা সুপ্রযুক্ত হয়েছে। অর্ঘ পলশাই-এর আলোক এবং অভিজিৎ দত্তের আবহ প্রক্ষেপণ যথাযথ ছিল। এই মানিক উৎসবের অন্যতম বিশিষ্ট উপস্থাপনা দুঃসাশনীয় নাটক।