সুব্রত কাঞ্জিলাল
এদেশে সত্যজিৎ, ঋত্বিক বাবুদের নিয়ে যত আদিখ্যেতা হয়, মৃণাল সেনকে নিয়ে আলোচনা করতে তাবড়(২)-র মস্তিষ্কজীবিরা ততটাই নিরব। কর্পোরেট মিডিয়া, বাজার পত্রিকা, বাজারি সংস্কৃতির ব্যাপারীরা বুঝতে পারেন, মৃণালবাবুকে নিয়ে তাদের মতো করে বাণিজ্য হবে না। একই সঙ্গে তাঁরা ভয় পান, মৃণাল বাবুর চলচ্চিত্র দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়লে, বাজার নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থার পতন অনিবার্য। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সত্যজিৎ এবং ঋত্বিক বাবুকে নিয়ে আলোচনার প্রধান সুর ওই দুই শিল্পীর শিল্প চেতনা এবং সমাজ ভাবনার একপেশে দিকগুলো।
আলোচকরা প্রমাণ করতে চান রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যজিৎ এবং ঋত্বিকবাবুরা শ্রেণী সংগ্রামে আস্থাশীল ছিলেন না। পুঁজি নিয়ন্ত্রিত শাসিত সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে ও তাঁরা ভাবিত ছিলেন না। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, দেশভাগ, দাঙ্গা, নকশাল আন্দোলন, ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে তাদের ছবিতে কখনো শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শন সামনে এসে দাঁড়ায় নি। এইখানেই তাদের কাছে মৃণাল সেন মূর্তিমান ত্রাস। সেন মহাশয়ের চলচ্চিত্র যে দেশের তথাকথিত স্বাধীনতার স্বাদকে তাঁর শিল্পকর্মের মধ্যে বিষাদ এবং তিক্ত করে পরিবেশন করেছেন। শুধু তাই নয়, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কোন পথে চালিত হলে প্রকৃত মানব মুক্তির দিশা খুঁজে পাওয়া যাবে, সেই ভাষ্য ও রেখে গেছেন।
নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের মূল সংকট এর চেহারাটা তার সিনেমায় দর্শকের কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসন, ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি ও তিনি শুনিয়ে গেছেন। তাঁর ছবিতে আমরা মিহিন মধ্যবিত্তের অধঃপতন দেখতে পাই। বাঙালি জীবনে বাইশে শ্রাবণ দুঃখের দিন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস। মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন এই দিনটিকে শোকের দিবস হিসেবে পালন করেন।
অথচ মৃণাল সেন এই দিনটাকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এই দিনে তাঁর একটি সিনেমার নায়ক নায়িকার মিলনের দিন হয়ে ওঠে। যারা সেই সময় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বাজারে, মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে এই দম্পতির জীবন ধ্বংসের দিকে পা বাড়ায়। শিল্পীর কাছে ২২শে শ্রাবণের তাৎপর্য এটাই। মৃণাল সেন ছাড়া এই উপমহাদেশে আর অন্য কোন চলচ্চিত্রকার এইভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিল্প সৃজন করেননি।
ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি নাগরিক নিয়ে মস্তিষ্কজীবিরা খুব বেশি কথাবার্তা বলতে চান না। প্রথম ছবি, নানা রকম প্রতিবন্ধকতা ছিল, টেকনিক্যালি খুব দুর্বল এইসব বলে চুপ করে যান। ঘটক মশাই এই ছবিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে যেভাবে তুলধনা করেছেন,
এইটা এড়িয়ে যেতে হয় কেন? এই ছবিতে ঘটক মশাই যেটা বললেন, বুর্জোয়ার জারজ সন্তান মধ্যবিত্ত কূল তোমার বড়লোক হবার যতই আকাঙ্ক্ষা থাকুক, অনিবার্য কারণে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় তোমাকে ডিক্লাস্ হতে হবে।
একইভাবে আকাশ কুসুম ছবিতে মৃণাল সেন নিম্ন মধ্যবিত্ত নায়কের বুর্জোয়া হয়ে ওঠার স্বপ্নের সমাধি দেখিয়েছিলেন। এই ব্যাপারটাও বাজারি পত্রিকা এবং মস্তিষ্কজীবিদের পছন্দ হয়নি। কারণ তাঁরা বলতে চান যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অবাধ প্রতিযোগিতা রয়েছে।
যে কেউ সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পিরামিডের মাথায় উঠে যেতে পারে। কিন্তু বন্ধু, সমাজ সচেতন নাট্যকার শেক্সপিয়ার যে ৪০০ বছর আগে প্রমাণ করে গেলেন, এইরকম সমাজ ব্যবস্থায় সব সময় বড় মাছ ছোট মাছগুলোকে খেয়ে বাঁচে। পিরামিডের মাথায় একজনই উঠতে পারে।
বলা বাহুল্য এই ছবি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে চলচ্চিত্র বিষয়ে পন্ডিত সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় ও এই ছবির অন্তর্নিহিত এই দিকের প্রতি আলোকপাত করলেন না। অবশ্য তিনি কখনোই সামাজিক অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা আলোচনা করেন না সাধারণত। একটা সমাজ ব্যবস্থাকে যে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এইটা বোধহয় তিনি বিশ্বাস করেন না।
সঞ্জয়বাবুর আলোচনায় বিশুদ্ধ নন্দন তাত্ত্বিক দিকগুলো বেশি গুরুত্ব পায়। শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কখনো শিল্প সংস্কৃতির আলোচনায় প্রবেশ করতে চান না। এই কারণেই হয়তো আকাশ কুসুম ছবির শেষ দৃশ্য সত্যজিৎ রায়ের মতো তাঁরও অপছন্দ। ইন্টারভিউ ছবির নায়ক যখন কাপড়ের দোকানের কোট-প্যান্ট পরা পুতুলটাকে ন্যাংটো করে দেয়, আমরা বুঝতে পারি এই দৃশ্যটাও বাজারের বুদ্ধিজীবীদের বিপদে ফেলে দেয়।
নীল আকাশের নিচে ছবিটা সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল। তাদের প্রধান আপত্তি ছিল ওই ছবিতে যেভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষয়টা উঠে এসেছে… আমরা বুঝতে পারি পঞ্চাশের দশকে তখনো ব্রিটিশ প্রভুদের অনুগামী উচ্চবিত্ত শ্রেণী, আমলা শ্রেণী, কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রী, এবং মস্তিষ্ক জীবীদের মানসিকতা কোন খাতে বয়ে চলেছিল। ছবিটা প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জহরলাল নেহেরু দেখেছিলেন। বিপুল প্রশংসা করেছিলেন। এই ছবির আন্তর্জাতিকতাবাদের বিষয়টা তিনি অনুমোদন করেন। পরে ছবিটা জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়।
যদিও সেন মশাই নিজে এই ছবিটা সম্পর্কে কোন কথা বলতেন না। পথের পাঁচালী যদি হয় পঞ্চাশের দশকে মুক্তি প্রাপ্ত ভারতীয় সিনেমার মাইলস্টোন। তাহলে আমরা ৬৭ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত সেন মশাইয়ের ভুবনসমকে বলতে পারি নয়া বাস্তববাদের ভারতীয় সিনেমার মাইলস্টোন। এই ছবিটা হিন্দি সিনেমা জগতকে নাড়িয়ে দিয়ে ছিল। বনফুলের গল্প নিয়ে একজন প্রতাপশালী আমলা শ্রেণীর চরিত্রে উৎপল দত্তের অসামান্য অভিনয় সমৃদ্ধ আখ্যান যেভাবে সিনেমার নতুন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে যা আজও ব্যতিক্রম।
সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও অন্যান্য কোন পরিচালকের কাছ থেকে সিনেমার এই নতুন ভাষা আজ পর্যন্ত দেখা গেল না। পণ্ডিতরা এই ছবির নন্দন তত্ত্ব, বিষয় বৈচিত্র নিয়ে কথা বলেন। এই ছবির রাজনীতি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না।
সত্তরের দশকে এসে মৃণাল সেনকে আমরা যেভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে দেখলাম, সম্ভবত এটাই এই মানুষটির আসল পরিচয়। ইন্টারভিউ, কলকাতা একাত্তর, পদাতিক এবং পরে কোরাস এই চারটি ছবির মধ্যে যেভাবে তিনি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের হাতিয়ার নিয়ে দেশের আর্থসমাজ রাজনীতির পোস্টমর্টেম করেছেন, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই ভূমিকা বিরল। এই কারণেই হয়তো তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র মহলে মার্কসবাদী চলচ্চিত্রকার রূপে পরিচিতি অর্জন করেন। এই কারণেই হয়তো তাকে পদাতিক শিল্পী বলা হয়। তার ছবিতেই আমরা প্রতিবাদী শ্রমিক কৃষক যুবকদের মিছিল দেখতে পাই। তিনি কলকাতা শহরের সীমানা পেরিয়ে চলে যান সাঁওতাল পরগনায়। উড়িষ্যার গ্রাম গ্রামান্তরে। অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রমজীবী মানুষের ভিড়ে।
মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত মৃগয়া ছবির ঘিনুয়া চরিত্রটি ভারতীয় সাহিত্য ও সিনেমাতে একেবারেই ব্যতিক্রমী চিত্রন। এই ছবিতে মৃণাল সেন ভারতের আদিবাসী ভূমি পুত্রদের দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের চেহারাটা বর্ণনা করেছেন।
বলা বাহুল্য এই মৃণাল সেনকে সহ্য করবার মত সৎ সাহসী, জীবননিষ্ঠ মস্তিষ্কজীবিদের আমরা খুঁজে পাইনি আমাদের দেশে। পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ঋত্বিক ঘটক যখন পড়াতেন, তার অনেক প্রিয় ছাত্র জুটে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁরা দু-একজন বাদে কেউই তাদের শিক্ষককে অনুসরণ করেন নি। একইভাবে সত্যজিৎ ভক্তদের মধ্যে থেকে এমন কেউ কি উঠে এসেছিলেন যারা সত্যজিৎকে অনুসরণ করেছেন? সুতরাং স্বাভাবিক কারণে মৃণাল সেন তাঁর কোন সহযাত্রী বন্ধু, ছাত্র খুঁজে পাবেন এটা ভাবা যায় না।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের ১০০ বছরের ইতিহাসে মৃণাল সেনের মত অন্য কোন পরিচালক শ্রেণী সংগ্রামের ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় না। আবার যখন মৃণাল সেন- একদিন প্রতিদিন, খারিজ, একদিন আচানাক, আকালের সন্ধানে, খন্ডহর সিনেমাগুলোতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে শংকর মাছের চাবুক দিয়ে চাপটাতে শুরু করলেন, তখনো বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের বিপন্নতা আরো বেড়ে গিয়েছিল। সেন মশায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াবার জন্য তাদের হাস্যকর কাণ্ডকারখানা নিয়ে একটা সিনেমা তৈরি করা যায়।
শাসক শ্রেণী সত্যজিৎ কে ৬০এর দশক পর্যন্ত সহ্য করতে পারলেও, ৭০এর পরবর্তী সময় থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল, সত্যজিৎ আর সত্যজিতে নেই। একইভাবে মৃণাল সেন ও ছিলেন তাদের কাছে মাথাব্যথার কারণ। ততদিনে মৃণাল সেন আন্তর্জাতিক খ্যাতির শীর্ষ চূড়ায় অবস্থান অর্জন করতে না পারলে হয়তো ছবি করবার টাকা জোগাড় করতে পারতেন না। ঋত্বিক ঘটকের মতো হতাশায় ডুবে মরতেন।
ঋত্বিক ঘটক কতটা মার্কসবাদী ছিলেন আর কতটা ইয়ং বাদি ছিলেন এই নিয়ে পন্ডিতরা ক্রমাগত চর্চা করে যাচ্ছে। আমরা জানি তার প্রতিটি শিল্পকর্মের মধ্যে দেশভাগের যন্ত্রণা ডুকরে কেঁদে উঠেছে। কোথাও তিনি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে চাননি। সত্যজিৎ রায় তার শেষ ছবিতে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন। তথাকথিত সভ্যতার নগ্ন রূপ তার শিল্পকর্মে প্রকাশ পেয়েছে।
অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভন্ডামি, সুবিধাবাদ, অমানবিক এবং পলায়নে তৎপর দিকটা মৃণাল সেনের ছবিতে বারবার আমরা দেখেছি। এখানে তিনি নরম মনোভাব প্রকাশ করেননি। তবে শ্রমিক কৃষক এবং শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সংগ্রামের মিছিলে তিনি আজীবন অবস্থান করে গেছেন।
মৃত্যুর আগেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অধঃপতিত বাঙালি তাকে মনে রাখবে না। তাঁর সৃষ্টিকর্মকে রক্ষা করবে না। এই কারণেই তার সন্তান কুনাল বাবু পিতার আজীবন শিল্প-কর্মের সমস্ত দলিল দস্তা বেজ বিদেশের আর্কাইভে নিয়ে গেছেন।
বাংলায় আজ পর্যন্ত এমন একটা বই প্রকাশিত হলো না যা থেকে মৃণাল সেনের শিল্পকর্মের যথার্থ মূল্যায়ন হতে পারে। আমার বিশ্বাস ইন্টারভিউ, কলকাতায় ৭১, পদাতিক, কোরাস, মৃগয়া ছবিগুলো আমাদের দেশের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি আন্দোলনের দিশা হয়ে উঠতে পারে। স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে এই ছবিগুলোকে হাতিয়ার করতে হবে। জানিনা বামপন্থী দল গুলো এ ব্যাপারে কতটা সচেতন।