World theatre Day2023: বিশ্বনাট্য দিবস নাকি রামনারায়ন তর্করত্ন  

- Advertisement -

দেবা রায়

পাশ্চাত্যের অনুকরণ আমাদের মজ্জাগত। প্রতিবছর ২৭ শে মার্চ বিশ্বনাট্য দিবস (World theatre Day 2023) ঘটা করে পালন করার জন্য বাংলা তথা দেশের সর্বত্র নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদাযাপন হয়ে থাকে। আমরা যে কোনো বিষয়ে বড় তাড়াতাড়ি মাতামাতি করি। একটা ইভেন্ট চাই। একটা উপলক্ষ্যকে লক্ষ্য করে আমরা এগিয়ে যাই। তাই এবারেও তার অন্যথা হচ্ছে না। ইতিমধ্যে দলগুলি নানা ধরণের অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের নিজ নিজ সোস্যাল সাইটে বিজ্ঞাপণ দিয়ে তাদের নাটচর্চার ইতিউতি জানান দিচ্ছে।

আমরা কি তাহলে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাবার পথে?
এবছর বাংলার প্রথম মৌলিক নাট্যকারের জন্ম দ্বিশতবর্ষ।  নাম রামনারায়ন তর্করত্ন (Ramnarayan Tarkaratna)।


কে এই রামনারায়ন?
প্রথমে একজন বাঙালী নাট্যকার। দক্ষিন ২৪ পরগণা জেলার হরিনাভি গ্রামে ১৮২২ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর জন্মগ্রহন করেন। তিনিই আমাদের প্রথম মৌলিক নাট্যকার। ইনি  ১৮৬২ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গনাট্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
বাংলা নাটকের কথা বলতে গেলে যেমন কালিদাস, ভবভূতি, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বিজন, উৎপল ও বাদলের নাম করতে হয় তেমনি রামনারায়ণ এর নাম না উত্থাপন করলে এই বিশ্ব নাট্য দিবসের উদাযাপন কোথায় অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

ভারতীয়ত্ব নাকি পাশ্চাত্য অনুকরণ?
ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে সবকিছুরই নিজস্বতা আছে, আছে মৌলকত্বের এক গর্বময় ইতিহাস। অথচ আমাদের এই গৌরবময় অধ্যায় বর্তমান দেশবাসীর চর্চা ও চর্যায় প্রায় বিষ্মৃত। আর সেই ভুলে যাওয়া অভ্যাসের ছিদ্র দিয়ে কখন কিভাবে পাশ্চাত্যের অর্থাৎ গ্রীক ঘরানার নাটক ভারতের নাট্যকর্মীরা আপন করে নিয়েছে।

পাশ্চাত্য অনুকরণ আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বে অস্বাভাবিক ঘটনা কিছু নয়। সংস্কৃতির মিশ্রন ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ধরেই। বারে বারে আমাদের সম্পদ লুন্ঠিত হয়েছে, দাসত্ব স্বীকার করতে হয়েছে, আমাদের হৃত গৌরব পুনরুত্থানের চেষ্টা এখনও সেইভাবে লক্ষ্য করা যায় না। বরং পাশ্চাত্যের ছোঁয়া না থাকলে যেন আমরা জাতে উঠি না।

আমাদের ইতিহাসও তো গৌরবের ইতিহাস।  

সংস্কৃত সাহিত্যের শুদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’, কালিদাস রচিত ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’, ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’ সেই নির্দশনই বহন করে চলেছে।


অথচ নাটক বলতেই আমাদের মনে শেকসপীয়র। যেন তাকে না ধরলে আমাদের চর্চা অধরা থেকে যায়। তেমনি মার্কিন সাম্রাজের সংস্কৃতি আজ আমাদের সংস্কৃতিতে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।


১৯৬১ সাল থেকে ২৭ মার্চকেই বিশ্ব থিয়েটার দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউট (ITI) ১৯৬১ সালে বিশ্ব থিয়েটার দিবসের প্রবর্তন করে।


প্ৰথম বিশ্ব থিয়েটার দিবসের আন্তর্জাতিক বাৰ্তা ১৯৬২ সালে ফ্রান্সের জিন কোকটিয়াও লিখেছিলেন। প্ৰথমে হেলসিঙ্কি এবং তারপর ভিয়েনায় ১৯৬১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত আইটিইর নবম আলোচনাসভায় আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইন্সটিটিউটের ফিনিশ কেন্দ্রের পক্ষে অধ্যক্ষ আর্ভি কিভিমায় বিশ্ব থিয়েটার দিবস উদযাপনের প্রস্তাব দেন।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কেন্দ্রসমূহে এটাকে সমৰ্থন দেয়ার পরই দিবসটির বিশ্বব্যাপি প্রচলন শুরু হয়। এর পর থেকে নাট্য দিবস পালনের এক মহাজাগতিক কাজে প্রবৃত্ত হতে থাকলেন আপামর বিশ্ব নাট্য মহল। শুরু হল আজকের এই বিশেষ দিনটির স্বীকৃতি লাভ ও উদাযাপনের ইতিহাস।

এবার দেখা যাক আমাদের দেশের নাটক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
নাটক শব্দটি প্রাচীনতম ভারতীয় সাহিত্যে, বিশেষত ঋগবেদের সংবাদ সূত্রে এমন কিছু কথোপকথোনের উল্ল্যেখ রয়েছে যা ইঙ্গিত দেয় থিয়েটার বা নাটকের। এগুলিই সম্ভবত নাটকের আদিরূপ। এই সময় স্ত্রী ও পুরুষরা নানান ধরনের পোশাক পরে নাচ গান করতেন। যা এই নাটকের পূর্বরূপ বলেই ধরে থাকি। আমাদের দেশ এমন একটি দেশ যেখানে একটি নাট্যশাস্ত্র আছে।

ভরতের নাট্য শাস্ত্র। যা অধ্যয়ন করলে বোঝা যায় সেই নাট্যচর্চার আঙ্গিক বাচিক সব বিষয়েই এক বিজ্ঞান সম্মত বীক্ষা। অথচ  গ্রীসের সংস্পর্শে আসা আমাদের অনিবার্য হয়ে পরে।  সেই থেকেই ভারতীয় নাট্য সাহিত্য গ্রীসের অনুকরন শুরু করে। গ্রীক ঘরানার নাটকগুলিকে আপন করে নিয়েছি।


এদিকে বাংলা নাটকের সূত্রপাত যতটা এই সংস্কৃত নাটক থেকে উদ্বুদ্ধ, ঠিক ততটাই অনুপ্রেরণা নিয়েছ বিদেশি থিয়েটার থেকে।

আধুনিক বাংলা নাটকের সূচনা হয় ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে। সে সময় বিদেশি নাটকের অনুবাদের পাশাপাশি মৌলিক নাটকও রচিত হয়। ১৮২২-এর অনূদিত সংস্কৃত প্রহসন প্রবোধচন্দ্রদয়, শকুন্তলা, রত্নাবলীর মতো। তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ ও জিসি গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ দুটি মৌলিক নাটকের প্রকাশ হয় ১৮৫২ তেই। বিচিত্র বিষয় ভাবনা নিয়ে তৈরি হয় শেকসপিয়রের অনুসরণে হরচন্দ্র ঘোষের, ‘ভানুমতী চিত্ত বিলাস (১৮৫২), কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বাবু নাটক’ (১৮৫৪), উমেশচন্দ্র মিত্রের ‘বিধবাবিবাহ নাটক’ (১৮৫৬) রীতিমতো হইচই ফেলেছিল।

অপর দিকে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে মাথায় রেখে সমসময়ে দাঁড়িয়ে বাংলার অন্যতম নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন লিখলেন মৌলিক নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’। সেখানে যেভাবে সে সময়কার সমাজকে তুলে ধরেছিলেন, তা আগে দেখা কখনও দেখা যায়নি। এরপর একে একে সেই দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে   এগিয়েছেন। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ সে সময়কার নীলচাষীদের সমস্যার কথা তুলে ধরে নজির গড়ে। যদিও এই নাটক কিছুটা সময় অতিক্রান্তের পর।

এই নাটকের মধ্য দিয়েই উঠে আসতে থাকে তদানিন্তন সমাজের সমস্যার কথা। কখনও কৌতূকের ছলে, আবার কখনও কঠিনরূপে। নাটককে ভেঙে নানা রূপ দেওয়া হয়েছে।

খিচুরির সংস্কৃতি

বর্তমানে আবার ফিউশনও তৈরি করা হচ্ছে। যাতে শিল্পে মিশ্র সংস্কৃতির বাতাবরন তৈরী হয়েছে। ধীরে ধীরে আমাদের নিজস্বতাকে ভুলতে বসেছি।

ভারত শুধু নয় গোটা বিশ্বের ইতিহাসে নাটকের একটি আলাদা মর্যাদা রয়েছে। সেখানে সরকার ও দেশের মানুষ সেই শিল্পকে রক্ষার জন্য সদাজাগ্রত।

এদিকে বর্তমানে  বাংলা নাটকের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে। নাট্যশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দায় না আছে সরকারের না আছে দেশের মানুষের। হাজার হাজার নাট্যদল লক্ষ্য লক্ষ্য নাট্যকর্মী এই শিল্পের সাথে যুক্ত।

এই শিল্পের প্রচার ও প্রসারে কোটী কোটী টাকা সরকার ব্যয় করছেন, কিন্তু তবুও এই শিল্পের পুনরুজ্জীবন হচ্ছে না। একদিকে বেকারত্ব অপর দিকে নাট্য গবেষণার নামে সরকারী তহবিলের ব্যবহার।

সরকারের কি করা উচিত?

যে সরকার একটি শিল্পের ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারে তো নাই তার ওপর তাদেরকেই কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রচার ও প্রসারে ব্যস্ত থাকে। অর্থাৎ আমাদের আগামী প্রজন্মের কথা ভেবে কখনোই কোন সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি।

একটা স্থায়ী ব্যাবস্থাপনা দরকার। যেখানে এই শিল্পকে গবেষণা ও চর্চার সুযোগ প্রত্যেক ভারতীয় নাট্যকর্মীর থাকবে। সেখানে আগামীর জন্য থাকবে আলোর দিশা। তবেই এই শিল্পের পুনরুত্থান বা পুনরুজ্জীবন সম্ভব।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে। নাটকের হলগুলিতে টিকিট কেটে নাটক দেখার অভ্যাস করতে হবে। নাটক না দেখলে থিয়েটারের দলগুলি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

অর্থাৎ নাটকের সাথে রুটী রুজির সম্পর্ককে আরো জোড়ালো করতে হবে। দয়া দাক্ষিণ্যের হাত তুলে নিয়ে ‘বাধ্যতামূলক পরিসেবা’ দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে।

 
 কেন নাট্যশিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে?
শিল্প চর্চার শ্রম আর মাটি কাটার শ্রম এই দুই শ্রমের মধ্যে মূলগত পার্থক্য হল,  সৃষ্টিশীলতায়। উদ্ভাবনী শক্তির উন্মেষ ঘটানোয়। যার ফলে দেশে মেধাচর্চার উন্মেষ ঘটবে। একজন ব্যঙ্ক কর্মীকে বাঁচিয়ে রাখার দায় যতটা ঠিক ততটাই একজন নাট্যকর্মীকে বাঁচিয়ে রাখাও তার কর্তব্য।

আজ বিশ্ব থিয়েটার দিবস সব নাট্য শিল্পীদের কাছে বিশেষ আনন্দের এখানে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই আমাদের আনন্দে সামিল হতে হবে। নচেত এই শিল্পের গৌরব টিকিয়ে রাখা যাবে না। সেই গড্ডলিকা প্রবাহে মেতে উঠতে গিয়ে আমরা একে একে হারিয়ে যাবো।

নাট্যকর্মীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে গিয়ে নিজের নিজের আখের গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়বো। সমকালীন সমাজ ও তার প্রতিফলন না ঘটলে নাট্য চর্চা কখনও মাইলস্টোন হয়ে ওঠে না। সেটা কুলীন কুল সর্বস্ব,  নীলদর্পন আর নবান্নই প্রমান করে দিয়ে গেছে।  

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -