Tuesday, December 17, 2024
Tuesday, December 17, 2024
Homeআলোচনাশিলিগুড়ি ইঙ্গিত প্রযোজিত সওদাগর নাটক দেখে অনুভুত প্রশান্তি

শিলিগুড়ি ইঙ্গিত প্রযোজিত সওদাগর নাটক দেখে অনুভুত প্রশান্তি

দুলাল চক্রবর্ত্তী, ফরাক্কা   

 গত ৯ নভেম্বর ২০২৩, কলকাতার তপন থিয়েটারে শিলিগুড়ি ইঙ্গিত নাট্যদলের ‘সওদাগর’ নাটকটি দেখলাম। ৫৫ মিনিট সময়কালের এই নাটকে সকলের সাবলীল অভিনয়ে মুগ্ধ হলাম। Theatre 4 U (Barisha) আয়োজিত মনমিলন নাট্য উৎসবের অন্যতম আমন্ত্রিত নাট্যদল ছিল শিলিগুড়ি ইঙ্গিত। খবর পেয়ে গিয়েছিলাম নাটক দেখতে। যেহেতু ব্যক্তিগত ভাবে আমিও মফস্বলের নাট্যকর্মী। তাই মফস্বলের নাটকের ঘর গেরস্থালির সাথেই আমার ওঠাবসা বেশি। এই মর্মে সেদিন প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত কলকাতার দর্শকদের ভীড়ে বসে মফস্বল বাংলার এই দলের নিষ্ঠাবান চর্চা দেখে আপ্লুত হয়ে ছিলাম। গর্বিত হয়েছিলাম নাটকের প্রসেসিং এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক অভিনয়-চর্চা নমুনা চাক্ষুষ করে।

নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র সৌমদেব, একজন অর্থনৈতিক মানদণ্ডে নীচে পড়ে থাকা নাট্যকার নির্দেশক। চাকরি সংসার এবং নাটকের কাজে ব্যস্ত তিনি। বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে মার খেয়ে মরে হেজে পচে যাওয়া রিয়েলিটিতে জর্জরিত, তবুও নাটকের কাজের প্রজ্ঞায় উজ্জ্বল তিনি। সর্বক্ষণ নাটকের চালনায় উদ্যোমী তিনি। বলা যায় একজন নাটক পাগল মানুষ। সাথে মানুষের কল্যাণে উদ্বেল সৃষ্টিশীল। কিন্তু নিয়ত জীবন যুদ্ধের সংবাদে উদভ্রান্ত এই সওদাগর। চাঁদ সদাগরের মতই, একটি জ্যন্ত প্রসঙ্গের উপস্থাপনা এসেছে সওদাগর নাটকে। একদিকে সামান্য বেতনের চাকরি, অন্যদিকে ঘরে অসুস্থ একমাত্র ছেলে। মেরুদন্ডের নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির মস্তিষ্কও আক্রান্ত। অর্থাৎ জীবন  বিপন্ন। অতএব, স্ত্রী মাধবী সংসারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আত্মরক্ষার প্রসঙ্গে।

দলের নাট্যকর্মী হরি হালফিলের মেঘা সিরিয়াল নির্মাতা নির্দেশক প্রযোজক ইত্যাদি সকলকে নিয়ে আসে একদিন। তারা, সৌমদেবের লেখা মানসী নাটক কিনে নিতে চায়। এই স্বত্ব বিলোপ করে নাটকের অস্তিত্ব বিক্রি করে দিতে সৌমদেব রাজি হয় নি। চরম বিরোধিতা করে মাধবী। একসময় বাধ্য হয়ে সে রাজি হলেও তার ছেলে এসে শক্তি দিয়ে একাজ না করতেই বলে। নাটকের চলার জয় হয়। যদিও এই তথ্য বাস্তব সত্য হয় না। সেই নিরিখে অসুস্থ কিশোরের এই প্রজ্ঞা জাগরিত হওয়ায় আরোপন আছে। কিন্তু নাটকের সত্য বলেও একটা কথা চালু আছে। যা হুবহু বাস্তব নয়। বাস্তব থেকে সরে এসে যা পথ দেখায়। সেই মর্মে সৌমিত্র চ্যাটার্জী লিখিত একটি সার্থক একাঙ্ক নাটক। ঘটনার বিন্যাস ও সংলাপে মানবিক প্রতিক্রিয়া আছে। আছে তত্ত্ব, সৃষ্টিশীল মানুষ একা, একঘরে, সমাজ সংসার বিচ্যুত বিজন বাসী এক অনির্দেশ্য চৈতন্য। বৃহত্তর স্বার্থে আদর্শ বড় না কর্তব্য? না দায়- দায়িত্ব? 

জীবন ধারণ আর জীবন যাপমে কি পার্থক্য?  সত্যের নির্মম নির্মাণে কান্নাই তো হোম যজ্ঞের আগুন। নাটককার এমনই এক জীবনকে অনেক জীবনের বেপথু চলায় বলতে চেয়েছেন, ” রাস্তা ঠিক হ্যায় তো, এ রাস্তা সহি জগা পর যা রহা হ্যায় বাবুজি? অমৃত কুম্ভের সন্ধানের সেই খোঁজ নিয়েই সাধারণ অসাধারণের বিবাদের কেন্দ্রে আছে জয়ের সংবাদ। নাটককার সৌমিত্র চ্যাটার্জী এদিন দর্শকাসনে ছিলেন, তিনি এই প্রযোজনা দেখেছেন, মঞ্চে এসে অভিনন্দনও জানিয়েছেন, ইঙ্গিত নির্দেশক আনন্দ ভট্টাচার্যসহ দলের সকলকে। আনন্দবাবু কলকাতায় সমাদৃত মানুষ। তাই প্রচুর গুণী দর্শক ছিলেন প্রেক্ষাগৃহে।

নাটকের শ্রেষ্ঠ চরিত্রায়ন মাধবী। জবা ভট্টাচার্য শিলিগুড়ির বড় মাপের অভিনেত্রী।  তিনিই ধরে রেখেছিলেন সমগ্র নাটকের প্রতিটি তরঙ্গকে। তাই জ্যান্ত স্বাভাবিক সাবলীল এই মাধবী চরিত্রে তাঁরই প্রশংসা ছিল অনেকের মুখে। এরপরেই শৈবাল মজুমদারের বিশ্বনাথ অত্যন্ত সুন্দর একটি ভূমিকা। ওনার বাচিক ও শারীরিক ভাষায় চরিত্র ছিল খাপে খাপ। এরপরে একইরকম সাবলীল স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন হরি/ মিঠু সরকার, প্রমোটার মালখাঞ্জি/ তপন ভট্টাচার্য, যগিন্দর সিং/ বিজয় নন্দী, প্রদীপ বাজাজ/ আনন্দ ভট্টাচার্য প্রমুখ শিলিগুড়ি ইঙ্গিতের বিশিষ্ট অভিনেতারা। কিশলয় চরিত্রটি মন্দ নয়, তবে চন্দন সরকারের হাতের ব্যবহার সংযত করতে হবে।

মঞ্চ ভাবনায় শৈবাল মজুমদার যথাযথ। কিন্তু কিছু ওরিয়েন্টেশন দরকার আছে। নাটকের পরিচালকের বাড়ির গুরুত্বে বই শিল্ড ইত্যাদিকে সামনের মঞ্চ ভাগে রাখার দরকার আছে। শিলিগুড়ি থিয়েটার একাডেমি নির্দেশক কুন্তল ঘোষের আবহ চিন্তনে নাটকের অন্তর আবেগ এবং টানা পোড়েন সুন্দর ভাবে সংযুক্ত ছিল। বিমান দাসগুপ্তের আলোক চিন্তাও ঠিকই আছে। এককথায় শিলিগুড়ির এই নাটকের স্বাভাবিক বাচিক অভিনয় ও তালে বাঁধা সুরের ঐক্য নাট্য প্রক্রিয়াকে সুন্দর প্রকাশিত করেছে।

সৌমদেব চরিত্রে সলিল কর যথেষ্ট শ্রম দিয়েছেন। তবে এই নাট্য পরিচালক যেহেতু ঘাত প্রতিঘাতে জর্জরিত ব্যক্তি। আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়েই বলছি, তার হাসি আর কান্না এমন যে বাইরের কেউ-ই তা মাপতে পারে না। আরো ধী শক্তিতে, আনন্দিত কিন্তু জর্জরিত দোটানায় সলিল করকে পেলে এই নাটকের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হবে। প্রি-কনসিভড থিয়েটারের অভিনয় এখন অবসোলিড হয়ে গেছে। অনুভব আর অনুভূতির খেলাই আধুনিক মঞ্চ প্রতিক্রিয়া। কারণ মানুষের বিহেভ প্যাটার্নের বদল এসেছে। আধুনিকতার প্রভাবে। অতি সংক্ষিপ্ত এবং যান্ত্রিকতাবাদ আক্রান্ত হওয়ার কারণে অভিনয়ের বদল সমাজ থেকেই মঞ্চে সরাসরি চলে আসছে। এখানে লক্ষ্য দিতে হতে পারে। তাই বলে উনি তাঁর কাজের মাত্রাকে যথাযথ ধরেই রেখেছিলেন। সারা নাটকের তরঙ্গের উনিও অন্যতম ঢেউ।

ইঙ্গিতের নাটক প্রথম দেখলাম। শুনেছি আগে এই দলের পরশ পাথর এবং আপনজন নাটকের (৪৯ তম মঞ্চায়ন খ্যাত) নানা কথা। তাছাড়া শিলিগুড়িতে আনন্দ ভট্টাচার্য উত্তরবঙ্গের নাটকের বিরাট সমাজকে একত্রিত করেছেন। কোভিড প্রাক্কালের ঘর বন্দী জীবন থেকে তিনিই সারা রাজ্যের নাট্যজদের একান্নবর্তী পরিবারে এনেছিলেন। আমি এভাবেই এসেছিলাম, ওনার সান্নিধ্যে। উনি শ্রদ্ধেয় তাই এবং দলের সকল কুশীলব তাই কলকাতার মঞ্চে দর্শকদের সাধুবাদ পেলেন।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular