সত্যজিৎ রায়: বাংলার বুদ্ধিজীবী

- Advertisement -

সুব্রত কাঞ্জি লাল

বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ এবং আর ও কতগুলো শব্দ বাংলা ভাষার অভিধানে আগে খুঁজে পাওয়া যেত না। এগুলো হলো বাজার পত্রিকার আবিষ্কার। আরো একটি মজা হল, বাজার পত্রিকা সব সময় শাসকের এজেন্ট হিসেবে বাংলার সমাজ জীবনে ছড়ি ঘুড়িয়ে এসেছে। ষাটের দশকের পর থেকে এদের আপ্রান প্রচেষ্টা ছিল, বাঙালি সমাজের মধ্যে থেকে সুশীল সমাজ নামে একটা শ্রেণি তৈরি করা। এই শ্রেণীটি শাসিত হবে চালিত হবে বাজার পত্রিকার অনুশাসনে।

ঠিক যেমন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে কেরানি শ্রেণী তৈরি করে ছিল। ব্রিটিশ শাসকদের আসল লক্ষ্য ছিল মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি করে ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত একটি সম্প্রদায় গড়ে তুলতে। যারা কখনো বিদ্রোহ বিপ্লব ইত্যাদি বিষয় আগ্রহী হবে না।

ঐতিহাসিক কারণে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে থেকে একটা অংশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব পোষণ করে এসেছে। কবি সাহিত্যিক শিল্পী দের বড় অংশটা এই শ্রেণী থেকে উঠে আসা। বাজার পত্রিকা খুব কায়দা করে এই শ্রেণীর মগজ দখল করবার নানা কৌশল গ্রহণ করে আসছে। এইসব কবি শিল্পী চলচ্চিত্রকারদের সামনে গাজর ঝুলিয়ে  রাখা হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর কর্পোরেট ম্যাগাজিনে যদি লেখা ছাপতে হয়, অর্থ উপার্জন করতে হয়, নাম যশ প্রতিপত্তি করতে হয়, নানা ধরনের সরকারি বেসরকারি পুরস্কার অর্জন করতে হয়, বিদেশ ভ্রমণ করতে হয়, তাহলে তোমাকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। এই ভাবেই ফার্মা কোম্পানিগুলো তাদের এজেন্ট পুষে রাখে। এবং তাদের দিয়ে ডাক্তারদের মগজ ধোলাই করে।

বলা বাহুল্য এদের কৌশল সব ক্ষেত্রে কার্যকরী ছিল না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সেন, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্তদের মতো অনেকেই তথাকথিত সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে চান নি। সত্যজিৎ রায় জীবনের শুরু থেকে এইসব বুদ্ধিজীবীদের লেখাপড়া পাণ্ডিত্য এবং বুদ্ধির দৌড় বিষয় খুব সচেতন ছিলেন। তিনি ভালো করেই জানতেন এরা হলো বাজার পত্রিকার সেবা দাস।

অর্থাৎ হিজমাস্টার ভয়েস। প্রভুর ছকে দেওয়া নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে এরা নিজস্ব কন্ঠস্বরের অধিকারী হতে পারবে না। হীরক রাজার দেশে এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সত্যজিৎ বাবু হাজির করেছিলেন। এবং রাজার যন্তর মন্তর ঘর দেখিয়েছিলেন।

এই ছবিটা ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছবি। বাজারি পত্রিকাগুলো এই ছবির বিরুদ্ধে খর্গ হস্ত হয়ে উঠেছিল। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই ছবির ফাইনান্সার ছিলেন বামফ্রন্ট সরকার।

পথের পাঁচালী ছবিটা মুক্তি পাবার পর এরাই হইচই করে উঠেছিল, এই ছবিটা তো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প নয়। বাজার পত্রিকা গুলো র হইচই দেখার পর বিভূতিভূষণ বাবুর স্ত্রী রমা দেবী ও বলে দিলেন, এটা আমার স্বামীর গল্প নয়।

দেশের পার্লামেন্টে পর্যন্ত হৈচৈ হয়েছিল। সত্যজিৎ রায় সদ্য স্বাধীন দেশের কুৎসিত দারিদ্র বিদেশের বাজারে বিক্রি করার জন্য এইরকম একটা ছবি তৈরি করেছেন। এই ছবিটা কে সেন্সর করা উচিত।

অন্যদিকে বাংলার বামপন্থী, মুক্তমনা, শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা এই ছবিটা কে যুগান্তকারী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। তারা রীতিমতো সংগঠিতভাবে এই ছবির প্রচার এবং প্রসারের আয়োজন করেছিল। তরুণ সত্যজিৎ রায়কে বিভিন্ন প্রান্তে সংবর্ধিত করেছিল।

এরাই সিনেমা হলে দর্শকদের নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছিল। ছবিটা যখন আন্তর্জাতিক স্তরে রীতিমতো প্রশংসিত হয়, ভারতীয় সিনেমার মুখ উজ্জ্বল করে সেই সময় ও বাজার পত্রিকায় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, এই ছবি ভারতের দর্শক গ্রহণ করবে না। আজও এই প্রচার করা হয় যে, বিদেশের বাজারে পথের পাঁচালী মর্যাদা পেলেও ভারতের বাজারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বাণিজ্য করতে পারেনি। প্রকৃত সত্য একেবারেই বিপরীত।

সত্যজিৎ বাবু এরপর রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্য বাংলা সাহিত্যের যেসব গল্প নিয়ে ছবি করেছেন, প্রত্যেকবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সত্যজিৎ বাবু ওই সব গল্পের প্রতি কোনদিন বিশ্বস্ত ছিলেন না। গল্পগুলোকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। বিকৃত করেছেন।

টালিগঞ্জ স্টুডিওতে একটা বড় গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল যারা মনে করতো, সত্যজিৎ বাবু বাংলা সিনেমার (বাণিজ্যিক) প্রধান শত্রু!!! এই লোকটাকে প্রশ্রয় দিলে বাংলা মূল ধারার সিনেমা ক্ষতিগ্রস্ত হবে!!!

আড়ালে আবডালে হাসাহাসি চলত সত্যজিৎ বাবুর কাজ নিয়ে। বলা হত ওই লোকটা বিদেশের বাজারের জন্য ছবি তৈরি করে। বাংলা ছবি যদি সত্যজিৎ বাবুকে অনুসরণ করে তাহলে সর্বনাশ ঘটে যাবে। সে সময়কার সস্তা চটুল সিনেমা সংক্রান্ত পত্রিকা গুলোতে সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানারকম গসিপ লেখা হতো। দেশদ্রোহী আখ্যা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল।

সত্যজিৎ রায় প্রথম দিকের ছবিগুলোতে সাধারণত অ্যামেচারিষ্ট অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গ্রহণ করেছিলেন। নন এক্টারদের খুঁজে খুঁজে এনে বিভিন্ন চরিত্রের জন্য নির্বাচন করতেন। তারপর উত্তম কুমারকে যখন কাস্ট করলেন, মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতে হৈ হৈ পড়ে গেল। বাজার পত্রিকার সবজান্তা কলমচিদের কলম ঝলসে উঠলো। তারা লিখলেন, এইবার মানিকবাবু স্বধর্ম চ্যুত হয়ে পড়লেন। তিনিও বাংলা সিনেমার মেটিনি আইডল নায়ক কে ছবিতে গ্রহণ করে প্রমাণ করলেন, তিনি বাণিজ্যিক কারণে আদর্শ বদলে ফেললেন।

সত্তরের দশক থেকে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা হয়ে উঠল শ্রেণী সংগ্রামের হাতিয়ার। বেকার যুবকদের সরকার বিরোধী বিক্ষোভ বিদ্রোহ এর সমর্থক হয়ে পড়লেন। পুঁজিবাদী সভ্যতার যাবতীয় গরিমা তার ছবিতে ধ্বসে পড়ল। সীমাবদ্ধ ছবিতে তিনি হয়ে উঠলেন ধন তান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষুরধার সমালোচক। অশনি সংকেত ছবিতে তিনি পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করলেন, যুদ্ধের বাজারে যে মন্বন্তর সৃষ্টি হয়েছিল সেটা ছিল ওপর তলার মানুষের তৈরি মন্বন্তর। জাত পাত বর্ণাশ্র ম প্রথা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি অনেকগুলো ছবিতে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পেরেছেন।

মৌলবাদী সংগঠনগুলো এই কারণেই এই মানুষটাকে তাদের প্রধান শত্রু চিহ্নিত করেছিল। মনে রাখতে হবে মুন্সি প্রেম চাঁদ এর গল্প নিয়ে তিনি দুটো ছবি করেছিলেন।  সতরঞ্জ কি খিলাড়ি ও সদগতি। প্রথম ছবিটা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারত লুটপাটের দলিল। এদেশে ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলো, ব্রিটিশ আমেরিকান পুঁজির তাবেদার মিডিয়া এবং সংগঠনগুলো এই ছবিটির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের অনেক জায়গায় এই ছবির প্রদর্শন বন্ধ করা হয়েছিল। একইভাবে হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলো সদগতি ছবিটা কেও মধ্যপ্রদেশ উত্তরপ্রদেশের প্রদর্শনের উপর বাধা দিয়েছিল। যদিও এই ছবিটি দূরদর্শন কেন্দ্র দ্বারা প্রযোজনা করা হয়েছিল।

একইভাবে ইন্দিরা সরকার সিকিম তথ্যচিত্রটিও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। শিল্পের জন্য শিল্প, এবং বিশুদ্ধ শিল্পের সমর্থকরা সত্যজিৎ রায় কে প্রথম দিকে সহ্য করতে পারলেও, প্রতিদ্বন্দ্বী, জন অরণ্য ছবিগুলো মুক্তি পাওয়ার পর থেকে শেষ ছবি আগন্তুক পর্যন্ত তারা ভীষণ রকম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। নানারকম অপ যুক্তি, কুযুক্তি বিস্তার করে তারা বলা শুরু করেছিল যে, চারুলতার সত্যজিৎ রায় পরবর্তী কালে হারিয়ে গেছে। শাখা-প্রশাখা, গণশত্রু, আগন্তুক ছবিতে সত্যজিৎ রায় মহাবিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় অপরাধ।

সত্যজিৎ রায়ের আরো অনেক অপরাধ ছিল। যেমন গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করা। শ্রমিকদের শ্রেণী সংগ্রামে শামিল হওয়া। কমিউনিস্টদের সঙ্গে মেলামেশা করা। ইত্যাদি। কাকতালীয় হলেও আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই পথের পাঁচালী থেকে শুরু করে শেষ ছবি পর্যন্ত তিনি তার ছবির জন্য শিল্পী নির্বাচন করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন শিল্পীদের বারবার পছন্দ করেছেন। নির্বাচন করেছেন।

বুদ্ধিজীবীদের অপপ্রচার, সিনেমা বিষয় অজ্ঞতা এবং আরো নানারকম দুর্বলতার দিকগুলো নিয়ে এই মানুষটিকে বারবার কলম ধরতে হয়েছে। বিভিন্ন লেখায় তিনি চোখে আঙুল দিয়ে  দেখিয়েছেন যে, এদেশে সিনেমা সমালোচক গোষ্ঠী আজও তৈরি হয়নি। যারা নিজেদের সর্বজ্ঞ মনে করেন আসলে তারা চূড়ান্ত অদক্ষ, অশিক্ষিত।

এই কারণেই তারা সাহিত্য আর সিনেমার মধ্যে তফাৎ বুঝতে পারেন না। সিনেমার নামে এদেশে যা তৈরি হয় এগুলো সেলুলয়েড লিটারেচার। কোনভাবেই চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। তিনি বারবার বলেছেন, দর্শক রুচির কাছে আত্মসমর্পণ করা সত্যনিষ্ঠ শিল্পীর কাজ নয়। আবার এ কথাও বলেছেন যে, এমন বুদ্ধি দীপ্ত, জটিল আঙ্গিকের ছবি তৈরি করা ঠিক নয় যা সাধারণ দর্শকের বোধগম্য হবে না। গল্প বলতে হবে সহজ সরল ভাবে। বাঙালি দর্শকের আবেগপ্রবণতা কেও মাথায় রাখতে হবে। জনৈক বাজার পত্রিকার কলমচি একবার লিখে ফেললেন, মানিকবাবু আসলে শিশু সাহিত্যিক। আমাদের মত বুদ্ধিজীবীদের কথা তিনি ভাবেন না।

এই বুদ্ধিজীবী মহাশয় (!) মানিক বাবুকে শিশু সাহিত্যিক বলে যেমন ছোট করতে চাইলেন, একইভাবে নিজেকেও প্রমাণ করলেন, আসলে তিনি মেধাহীন বাজার পত্রিকার ছাতার নিচে বাস করেন। এই লোকগুলো প্রথম থেকে পথের পাঁচালীর বিশুদ্ধ সৌন্দর্য  আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, পথের পাঁচালী আসলে দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা গ্রামীণ মানুষ ও প্রকৃতির ল্যান্ড স্কেপ।

মারিসিটন -এর মত প্রখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্প সমালোচকরা বলছেন, ভারতীয় গ্রামীণ মানুষের কুৎসিত দারিদ্র্যের ছবি এঁকে সত্যজিৎ রায় প্রমাণ করেছেন যে, এই দারিদ্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। মানুষের সৃষ্টি দারিদ্র। এইখান থেকেই বুঝতে হবে যে, শাসকদের প্রতিনিধিরা বারে বারে কেন সত্যজিৎ বাবুকে আক্রমণ করে বলতেন, আপনি কি দেশের অন্ধকার দিকগুলো দেখতে পান?

সত্যজিৎ বাবু জবাব দিয়ে বলেছিলেন, যা দেখতে পাই, যা সত্য, সেটাই আমার ছবিতে তুলে ধরি। এই সত্য, এই অন্ধকার আমরা তৈরি করি না। আপনারা করেন। এইসব কুৎসিত দারিদ্র, অন্ধকার আপনাদের শাসনের ফলশ্রুতি।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -