Tuesday, November 19, 2024
Tuesday, November 19, 2024
Homeআলোচনাএবার ‘ইয়েস’ বলল গোবরডাঙ্গা নকসা

এবার ‘ইয়েস’ বলল গোবরডাঙ্গা নকসা

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমরা একমনে দেখছিলাম এক নারীর বেদম লড়াই। লড়াই মর্যাদা নিয়ে বাঁচার। লড়াই মানহানি ও অস্বীকারের বিরুদ্ধে। লড়াই টান টান শিরদাঁড়ায় মানুষের মতো বাঁচার।

আমরা দেখছিলাম গোবরডাঙ্গা নকসার ‘ইয়েস’। যেখানে এক মেয়ে যার কিনা কয়েক পুরুষ ওস্তাগর পরিবারে বড় হয়ে ওঠা। যেখানে কাজে কর্মে সর্বত্র পুরুষ-প্রাধান্য-খবরদারি। যেখানে মেয়ে হওয়ার দরুন ছেলেদের মতো তাকে ওস্তাগারের সমস্ত কাজ করতে দেওয়া হয় না। মেয়েটা এই গোঁড়া পরিবারে থাকতে চায় না। সে শহরে চলে আসে, নিজের মতো করে বাঁচতে। শহরে এক মল-এ কাজ নেয়। সেখানেও এক ছেলে তার স্নানের ছবির ভিডিও ভাইরাল করায় তার কাজ যায়। তবে তাতে সে হারে না, সে আশায় বুক বেঁধে স্বপ্ন আগলে এগিয়ে যায়, এই বিশ্বাসে যে অন্য দুয়ার তার জন্য নিশ্চিতভাবে খুলবে। এমনই যে নাটকের কথাবৃত্ত।   

যার নাটক-প্রয়োগ-অভিনয়ে ভূমিসূতা দাস। এখানে তাঁর একেক অভিনয়। দেখছিলাম মঞ্চটা কি বিশ্বস্ত হয়ে ঊঠেছে। এক নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকুরে মেয়ের শহরে একা থাকার ঘর। তার বিবর্ণতা- এলোমেলো ভাবে- রাখা আছে কী বিশদে- তামাম ডিটেল সহ। সেখানে মঞ্চ জুড়ে একটি মেয়ে ভূমিসূতা। অভিনয়ে-অভিনয়ে তাঁর বিপন্নতা-বিষাদ-অসহায়তা-পণ-প্রতিজ্ঞা- দৃঢ়তা- অজেয় ভঙ্গী! আবারো বলি, আমরা একমনে তাঁর কথা শুনি- তাঁকে দেখি। শুনি তাঁর সংলাপ- নৈশব্দ তৈরি- দেখি তাঁর সমুদায় মঞ্চ সামগ্রী ব্যবহার। নানা  প্রসঙ্গে–কথায় মঞ্চের নানা কোনে নিজেকে ভাগ করে নিয়ে যাওয়া, পোশাকের উপযোগী ব্যবহার, অনর্গল অভিব্যক্তি, মঞ্চ জুড়ে তাঁর দরাজ যাওয়া আসা- ওঠা বসা মিলিয়ে আমাদের ভেতরেও, ভূমিসূতা বেদনা-বিহ্বলতা- অসহায়তা ছড়িয়ে দেয়। একি তাঁর অভিনয়, নাকি না-অভিনয়? 

যাই হোক না কেন, আমরা তাঁর কথা শুনতে লজ্জা পাই। শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে ভাবতে থাকি, ও যা বলছে, যা করছে, যা দেখাচ্ছে তা কী ভীষণ সত্যি এই একুশ শতকেও! এই দেশে- এই বাংলায়। তাঁর এমন অভিনয় আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। তাঁর নাটক- প্রয়োগ-বিষয়-বার্তা পৌঁছে গিয়েছে আমাদের কাছে। আমরা ছুঁতে পারছি সময়কে।

যাকে মেলে ধরেছে বরুণ করের আলোক ভাবনা আর অরিত্র পাল এবং জয়দেব দাস ও সঞ্জয় নাথ-এর সহযোগে সঞ্চালনা, ইলিয়াস কাঞ্চনের আবহ ভাবনা, বিশাল মহালের ধ্বনি ভাবনা ও শুভজিত দাসের প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ। আর বলি এই প্রযোজনায় জড়িয়ে থাকেন দুই কৃতি নাট্যজন- উপদেশনায় আশিস দাস এবং সহায়, প্রশ্রয়ে, আলো ছায়ায় দীপান্বিতা বণিক দাস।  

আমরা এখানে যোগ করতে পারি নাটক তাঁর বিষয় নির্বাচনে চারপাশ নিয়ে সচেতনতা তথা বিষয় ও বয়ানে নিবিষ্ট অন্তর্দৃষ্টির কথা। হয়তো সেখানে পাইতে পারি সময়-সমাজ বিশ্বায়নের নানা রসায়নের খানিক অনুষঙ্গ। এমন কথা যোগ হবে কিনা তা একান্তই তাঁর হাতে।  

হিন্দিতে কেন এমন নাটক, তা যদি ওর কাছে জানতে চাই, তা কি ও বঙ্গভাষী- বঙ্গবাসী বলে? না হলে রঙ্গকর্মী বা পদাতিক প্রযোজনা বা বাদল সরকারের ‘জুলুম’ কিংবা ছায়াছবিতে যখন ‘সদগতি’, ‘শত্রঞ্জ কী খিলাড়ি’ দেখি সত্যজিৎ রায়ের বা ‘এক ডাক্তার কি মৌত’ তপন সিংহের  কিংবা তেলেগুতে মৃণাল সেনের ‘ওকা উরি কথা’ বা গৌতম ঘোষের ‘মা ভূমি’, তখন কিন্তু আমরা সেই শিল্পের কাছে সহজেই পৌঁছে যাই। আসলে মনে হচ্ছে নিজ নিজ মাতৃভাষার আবেদন, নির্বিশেষে নাটক-ছায়াছবির দুটি-ই ভাগ, মানুষী নাট্যভাষা ও চিত্রভাষা। যেখানে আমাদের সকলের অবারিত প্রবেশ।   

আসলে এক জীর্ণ-দীর্ণ-ভাঙাচোরা সময়ের আলোড়িত কথা আমাদের শোনাল ভূমিসূতা দাস। ও জোর গলায় তারস্বরে বলল- ‘YES’। হ্যাঁ আমরা আছি- আমরা থাকবো।

প্রযোজনা আমাদের দেখার সুযোগ হল সম্প্রতি মিউনাস আয়োজিত টানা ২৪ ঘন্টা নাট্যোৎসব ২০২৪-এ।

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular