Tuesday, July 8, 2025
Tuesday, July 8, 2025
Homeনাট্য সাহিত্যনাটক : এক‌ ফৌজির গল্প

নাটক : এক‌ ফৌজির গল্প

সুব্রত কাঞ্জিলাল

চরিত্র:

নেহাল সিং/ ইকবাল সিং/ রঞ্জিত সিং/ রেশমা/ বিজয়/ দারোগাবাবু/ সেই মেয়েটা (কাশ্মীরি)

পাঞ্জাব প্রদেশের একটা গ্রাম। গ্রামের নাম নানক সাহিব। এখানকার কৃষকদের আর্থিক অবস্থা খুব একটা মন্দ নয়। প্রায় সকলের পাকা বাড়ি, কয়েক বিঘা কৃষি জমি, ইদারা রয়েছে। ট্রাক্টর ভাড়া নিয়ে এরা চাষ করে। প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে একজন দুজন মিলিটারি তে ভর্তি হয়। আমাদের গল্পের নিহাল সিং ও একজন ফৌজি। কাশ্মীর সীমান্তের একটি অঞ্চলে এসে যুদ্ধের সময় মারা গেছে কিংবা নিখোঁজ হয়েছে। তার যুবতী বউ রেশমা বর্তমানে শ্বশুরবাড়িতে বাকি জীবন যাপন করছে। কারণ স্বামীর মৃত্যু সংবাদ এখনো স্পষ্ট নয়।

মঞ্চের পর্দা সরে গেলে দেখা যাবে, রেশমা নানারকম গৃহকর্মের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে।

মঞ্চের পেছনদিকে ওদের বসবাসের বাড়িটা দেখা যাবে। বারান্দায় নানা রকম আসবাব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগোছালো হয়ে রয়েছে।

উঠানে একটা চারপাইয়া দেখা যাচ্ছে। সেখানে নিহাল সিংয়ের ছোট ভাই রঞ্জিত শুয়েছিল। রেশমা তাকে বড় গ্লাসে চা এনে দেবে। চা খেয়ে ছেলেটা বাথরুমে চলে যাবে।

রেশমা শশুরকে ইদারা থেকে জল তুলে মুখ হাত পা ধুতে দেখা যাবে।

রেশমা যখন চা দিতে আসবে রঞ্জিত সিংকে তখন রঞ্জিত ঘুমোচ্ছিল। তাকে ঠেলা মেরে তুলে দিয়ে হাতে চা এর গ্লাস ধরাতে গেলে রঞ্জিত বৌদির একটা হাত চেপে ধরবে। চোখের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাবে।

শ্বশুরের উপস্থিতি বুঝতে পেরে রেশমা সরে যাবে।

ইকবাল।। ট্রাক্টর পাওয়া যাবে আজকে? তুই কি বুক করেছিস? টাকা এডভান্স দেওয়া আছে?

রঞ্জিত।। হা বাবুজি। পাওয়া যাবে। সকাল দশটার মধ্যে চলে আসবে। আপনি কি পঞ্চায়েত অফিসে যাবেন?

ইকবাল।। হ্যাঁ যেতে হবে। সেই জন্য বলছিলাম যে তুই সামাল দিতে পারবি তো? আমার হয়তো ফিরতে দেরি হতে পারে! ওখান থেকে একবার কোতোয়ালিতে যেতে হবে। দারোগা সাহেব খবর পাঠিয়েছে।

রঞ্জিত।। তাহলে ওই সময় মায়ের দাওয়াগুলো খরিদ করে নিয়ে আসবেন। ডাক্তার সাহেব কাল রাতে প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে গেছে।

ইকবাল।। ঠিক আছে আনবো।

রেশমা।। বাবুজি আপনি খানাপিনা না করে কোথাও যাবেন না। আমি ইন্তেজাম করে রেখেছি।

ইকবাল।। টাইম হবেনা বেটি। আমাকে আধা ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে যেতে হবে। বাইরে আমি কিছু খেয়ে নেব। তুমি আমাকে এক গ্লাস দহির শরবত দিতে পারো ব্যাস।

রঞ্জিত।। আম্মা কি খাবে সেটা ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে জেনে আসবেন বাবুজি। ও হ্যাঁ, আমার মোটর বাইক টা নিয়ে যেতে পারেন।

ইকবাল সিং জামা কাপড় পরে বেরিয়ে যাবার সময় হাতের শরবতের গ্লাস নিয়ে ছেলের কাছে আসবে।

ইকবাল।। তুই ঠিক জানিস ট্রাক্টর আসবে?

রঞ্জিত।। জানি তো। কাল রাতেও তো বলল আসবে।

ইকবাল।। কথা দিয়ে দুটো দিন ট্রাক্টর এলো না। তোর কাজকামের খুব ক্ষতি হলো। সেই জন্যই বলছিলাম যে, আজও যদি—–

রঞ্জিত।। আজকে আসবে বাবুজি। কাল রাতেও আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। ইয়ে‌, আপনাকে থানায় ডাকলো কেন বাবুজি? আবারো কি ফলস ইনফরমেশন এসেছে?

ইকবাল।। না গেলে কি করে বুঝবো? কেন ডেকেছে। তোর দাদার টাকা পয়সার ব্যাপারটা ও

তো থাকতে পারে। মানে গ্রাচুইটি, পি‌ এফ, পেনশনের কোন খবর তো এখনো আমরা পাচ্ছি না।

রঞ্জিত।। ঠিক আছে ঘুরে আসুন। আমি এদিকটা সামলে নেব।

ইকবাল সিং বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাবে। রেশমা ইদারা থেকে জল তুলে রান্নাঘরে রেখে আসবার সময় বলল।

রেশমা।। বাবুজিকে ঝুট বললে কেন?

রঞ্জিত।। কি ঝুট বলেছি?

রেশমা।। ট্রাক্টর আজও আসবে না। তোমার অন্য কোন মতলব আছে?

রঞ্জিত।। হ্যাঁ আছে। আজ একটা ফায়সলা করতে হবে।

রেশমা।। কিসের ফায়সলা?

রঞ্জিত।। তোমার সঙ্গে।

রেশমা।। তোমার দাদার অফিস এখনো তার ডেড বডি

কনফার্ম করতে পারে নি। সেই জন্যই গ্রাচুইটি , পি এফ এর টাকা-পয়সা নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না।

রঞ্জিত।। কিন্তু আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

দাদার মতো আমিও কি ফৌজে ভর্তি হয়ে যাব। নাকি

লুধিয়ানা স্কুলের মাস্টারের চাকরিটা নিয়ে নেব।

রেশমা।। তুমি তো বললে যে, ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করবে?

রঞ্জিত।। হ্যাঁ সেটাও করতে পারি। তবে যে দিকেই যাই না কেন, সবার আগে তোমার মতামতটা আমার জানা চাই।

রেশমা।। আমার আবার কিসের মতামত।

রঞ্জিত।। তুমিও তো গ্রাজুয়েট। একটা স্কুলের চাকরি

তুমিও পেতে পারো। তখন আমরা শহরে গিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারি।

রেশ মা।। তোমার বাবা মায়ের কি হবে?

রঞ্জিত।। মাকেও সঙ্গে নিতে পারি। শহরে ভালো ইলাজ হবে। ওখানে বড় বড় হাসপাতাল আছে।

খেতি জমিতে আর কোন ভবিষ্যৎ নেই রেশমা।

রেশমা।। আমার ভবিষ্যৎ এখনও তোমার দাদার ওপর

ঝুলে আছে। কোন ফায়সলা এখনো হয় নি। এটা কেন ভুলে যাচ্ছ?

রঞ্জিত।। কিছুই ভুলতে চাইছি না। তবে দু-একদিনের মধ্যে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

রেশমা।। বেশ তো। তোমাকে তো আমি আগেও বলেছি, হেড অফিস থেকে তোমার দাদার বিষয়ে

কংক্রিট সিদ্ধান্ত এনে দাও। তারপর আমিও নতুন কিছু ভাববার সিদ্ধান্ত নিতে পারব।

রঞ্জিত।। দেখা যাক থানা থেকে ফিরে এসে বাবুজী কি বলেন। তারপর আমি কাল ‌ অমৃতসর গিয়ে তোমাকে কংক্রিট নিউজ এনে দেওয়ার চেষ্টা করব। (ঘরের মধ্যে ঢুকে যাবে। তারপর একটা জামা নিয়ে বেরিয়ে আসবে) তোমাকে বলা হয়নি রেশমা, কয়েকদিন আগে মা আমাকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। তোমাকে খুব ভালবাসেন তো। কথায় কথায় সেদিন বললেন, রেশমাকে এবাড়ি থেকে অন্য কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। আমি বললাম, সেটা কি আমরা পারি? কোন অধিকারে ওই মেয়েটাকে আমরা এখানে আটকে রাখবো? লেখাপড়া জানা আধুনিকা নারী। মা তখন বললেন, নতুন অধিকার তৈরি করে নিতে হবে।

বাড়ির ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠ শোনা যায়——–

মা।। নেহাল, মেরা পুত্তার, তুই কি আমাকে ভুলে গেলি? কেন আসিস না আমার কাছে? নেহাল, নেহাল, তোর জন্য এখনো আমি মরতে পারছি না—-

রেশমা ঠিক এই সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খাবে। বসে পড়বে। কি হলো কি হলো, কিভাবে পড়লে

বলতে বলতে রঞ্জিত ছুটে যাবে। রেশমার পায়ে হাত দেবে।

রঞ্জিত।। খুব লেগেছে? দাঁড়াও বরফ লাগাতে হবে।

বোধ হয় মচকে গেছে।

রেশমা।। ছি ছি তুমি আমার পায়ে হাত দিচ্ছ কেন! কেউ দেখে ফেললে —আমার কিছু হয় নি। (জোর করে উঠতে যাবে। কিন্তু পারবেনা। আবার বসে পড়বে)

রঞ্জিত।। বলছি চুপ করে বসে থাকো। আমি বরফ নিয়ে আসছি-(ছুটে ঘরে গিয়ে বরফ নিয়ে আসবে) একদম নড়বে না! হুটো পটি করার কি আছে? তাছাড়া সব কাজ তোমাকে একা করতে হবে কেন?

রেশমা।। তাহলে কে করবে? বাড়িতে আর কটা দাসিবাদী আছে?

রঞ্জিত।। একটা লোক রাখবার কথা আমি তো অনেকদিন থেকে বলছি। তুমি তো রাজি হচ্ছো না। লুধিয়ানাতে কিন্তু এসব চলবে না। ওখানে ফ্ল্যাট নিতে গেলে কাজের মহিলা রাখতে হবে।

রেশমা।। বাবুজি মা এদের ফেলে রেখে কোথায় যাবে তুমি? আমিও কোথাও যেতে পারবো না।

রঞ্জিত।। ছেলে মানুষের মতো কথা বলো না। আমাদের এই নানক সাহিব  গ্রামের আশপাশের ১০ /২০ টা গ্রাম থেকে অনেক অনেক ছেলে মেয়ে বাইরে চলে গেছে কাজ করতে। আমাদের এখানকার গ্রামগুলোর একটা ঐতিহ্য আছে। প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন করে মিলিটারিতে জয়েন করে। কিংবা লেখাপড়া করবার জন্য বড় শহরে চলে যায়। তারপর বড় চাকরি করে। অনেকে ব্যবসা করে। আজকাল কত মেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য শহরে চলে যাচ্ছে। আমার দাদাও মিলিটারিতে গেছে। বাবুজি বা‌ মা কেউ তো বাধা দেয় নি।

রেশমা।। আমার সঙ্গে তাদের তুলনা করছ কেন? কেন বুঝতে পারছ না যে, এ বাড়ির একজন ছেলে, বাড়ির বড় ছেলে, তিন বছরের বেশি হয়ে গেল চাকরি করতে গিয়ে  সে আর ফিরে এলো না। সে বেঁচে আছে কি নেই সেটাও আমরা সঠিক জানি না। ‌ তোমার মা যে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সে তো তার ছেলের কারণে। তোমার বাবার শরীর ও ভালো না। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু লোকটা ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে আছে। আমাদের বুঝতে দেয় না।(উঠে দাঁড়াবে। খোড়াতে খোড়াতে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করবে। রঞ্জিত বাধা দিয়ে আবার বসিয়ে রাখবে।)

রঞ্জিত।। একটু বসো না বাবা।

রেশমা।। ব্যথা হচ্ছে না—

রঞ্জিত।। এখন হচ্ছে না। রাতের দিকে ঠিক হবে। তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। এক্সরে করানো দরকার। বাবাকে মোটরবাইকটা দিয়ে দিলাম। এলাকার অন্য কারো কাছ থেকে একটা বাইক আনতে হবে।

এই সময় নিহালের একজন সহকর্মী বিজয় আসবে।

বিজয়।। রঞ্জিত বাড়িতে আছো নাকি?

রঞ্জিত।। আরে বিজয়দা যে! কবে এলে তুমি? কেমন আছো?

বিজয়।। গতকাল এসেছি। তোমরা কেমন আছো?

রঞ্জিত।। ওই একরকম। মা তো দাদার খবর ‌ না পাওয়ার পর থেকে বিছানা নিয়েছে। আচ্ছা বিজয়দা, তুমি তো দাদার সঙ্গে একই রেজিমেন্ট এ ছিলে। দাদার ব্যাপারে তুমি কি কিছু বলতে পারো না?

বিজয়।। কিছু তো বলতেই পারি। কিন্তু‌ সেটা হবে আনঅফিশসিয়াল। আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই।

যতটুকু দেখেছি বুঝেছি সেটাও যদি বলি, তোমাদের শুনতে ভালো লাগবে না।

রঞ্জিত।। ভালো লাগবে না কেন বলছ?

বিজয় ইঙ্গিত করবে যে, রেশমার আড়ালে সে কিছু বলতে চায়।

রেশমা।। আপনি আমার সামনে সব কথা খুলে বলতে পারেন। ঠিক কি হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কেন লোকটা বাড়িতে ফিরছে না, আমি সব কথা জানতে চাই। লোকটা যদি মারা গিয়ে থাকে, সেটা জানার অধিকারও আমার আছে। অফিস কেন এখন পর্যন্ত বলতে পারছে না কেন যে, লোকটা বেঁচে নেই?

বিজয়।। আমাদের চাকরিটাই তো এরকম ভাবিজি। একবার ডিউটিতে জয়েন করলে বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত, বাড়ির লোকেরা বিশ্বাস করতে পারে না যে, আমরা ফিরে আসতে পারি। আমরা বেঁচে আছি!

রেশমা।। জানি। আপনার বন্ধুও আমাকে একই কথা বলতো। আপনাদের জীবন সবসময় অনিশ্চিত। পাঞ্জাবের এমন বোধহয় কোন পরিবার নেই যেখানে কোন না কোন ফৌজিদের একজন বিধবাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এসব জানার পরেও মেয়ের বাবারা আপনাদের কাছে আমাদের তুলে দেয়। আর আমরা মন শক্ত করে বাঁচি।

বিজয়।। নিহাল সিংয়ের ঘটনাটা কিন্তু অন্যরকম।

রঞ্জিত।। অন্যরকম মানে?

রেশমা।। সে কি বেআইনী কিছু করেছিল?

বিজয়।। ধরা পড়লে তার কোর্ট মার্শাল হতে পারত।

রেশমা।। কোট মার্শাল!!!

রঞ্জিত।। কি বলছ বিজয়দা? কি এমন অন্যায় করেছিল দাদা?

বিজয়।। দেখো রঞ্জিত, ভাবিজি, সত্যি মিথ্যে আমি কিছুই বলতে পারব না। স্টাফেদের মুখে মুখে যা রটে ছিল সেটুকুই জানি। তার সঙ্গে নাকি শত্রু দেশের গুপ্তচরদের যোগাযোগ ছিল। ঐরকম একজন মহিলা গুপ্তচর নিহালকে ফাঁসিয়েছে।

রঞ্জিত।। তাহলে দাদা এখন কোথায়?

বিজয়।। কেউ কিচ্ছু জানে না। অফিসিয়ালি এমন কোন প্রমাণ নেই যে তার মৃত্যু হয়েছে। এই কারণেই তার টাকা পয়সা সব আটকে গেছে। তবে আমাদের ডিপার্টমেন্টের আই বি সেকশন আজও ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাচ্ছে।

রেশমা।। আপনার কি মনে হয় সেই গুপ্তচর মহিলার সঙ্গে তাদের দেশে চলে যেতে পারে?

বিজয়।। অসম্ভব কিছু না। তবে প্রমাণ কোথায়?

রঞ্জিত।। তুমি কি মনে কর বিজয়দা, দাদার ‌ফিরে আসবার কোন সম্ভাবনা নেই?

বিজয়।। জোর দিয়ে এটাও বলা যাবে না রঞ্জিত। জটিল কেস। আঙ্কেলকে দেখছি না কেন?

রঞ্জিত।। বাবুজিকে থানায় ডেকেছে। একবার পঞ্চায়েত অফিসেও যাবে।

বিজয়।। তাহলে তো এবার মনে হচ্ছে, অফিসিয়ালি কিছু খবর তোমরা পেতে পারো। একদিক থেকে ভালই হবে।

রেশমা।। কি ভাল হবে বলুন তো——মাজীকে কি সুস্থ করে তোলা যাবে? এখন তো তার একমাত্র ওষুধ তার বড় ছেলে। (ঘরের ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে)

বিজয়।। আমাদের মত জওয়ানদের মায়েরা অনেক বেশি ধৈর্য এবং সহ্যশক্তি নিয়ে বেঁচে থাকে। সেই জন্যই তো ইন্ডিয়ান আর্মিতে আমাদের এখান থেকে বেশিরভাগ আর্মি রিক্রুট হয়। আমাকে এখন যেতে হবে। গতকাল এসেছি। দিন 15 ছুটি পেলাম। আমার এক শালির বিয়ে আছে। সেই জন্য বউকে নিয়ে কেনাকাটা রয়েছে। পরে আসবো।

বিজয় চলে যাবে। হতাশ হয়ে রঞ্জিত বসে পড়বে।

রঞ্জিত।। বিজয় দা যা যা বলে গেল, এসব কথা তো আগে কখনো শুনি নি। শত্রু দেশের সঙ্গে আমার দাদার যোগাযোগ থাকবে এটা বিশ্বাস করি না। আর শত্রু দেশের কোন মহিলার সঙ্গে দাদার সম্পর্ক এটাও অসম্ভব ব্যাপার। দাদা কোনদিন কোন মেয়েদের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি। এসব ব্যাপারে দাদা একেবারেই আনপড়।‌ তুমি কি বিশ্বাস করো রেশমা? ইকবাল সিং কে ফিরে আসতে দেখা যায়। সঙ্গে বিজয় আসবে।

রঞ্জিত।। বাবুজি, তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন যে? কাজ হয়ে গেল?

গম্ভীর মুখে খাটিয়াতে বসে পড়বে ইকবাল।

রঞ্জিত।। ওভাবে বসে পড়লে যে? কিছু তো বলো—- কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?

ইকবাল।। নিহাল এর অফিস থেকে টাকাগুলো পেলে রেশমার নামে একটা ট্রাক্টর কিনে ফেলতাম।

রঞ্জিত।। থানা কিছু বলল? দাদা কি——?

ইকবাল।। ওরা সন্দেহ করছে ‌ নিহাল কোথায় আছে সেটা আমরা জানি। সে মাঝে মাঝে এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসে।

রঞ্জিত।। পুলিশ এসব বলছে? ওদের কাছে কোন প্রমাণ আছে?

ইকবাল।। এবার যখন নিহাল ফিরে আসবে তখন পুলিশে খবর দিতে হবে। নইলে ওরা অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে আমাদের সবাইকে।

রেশমা।। এসব কি বলছেন বাবুজি আপনি? আমাদের এরেস্ট করবে কেন? কি করেছি আমরা!!

ইকবাল।। সরকারি চোখে আমার ছেলে একজন দেশদ্রোহী। গাদ্দার!!! আই এস আই এর এজেন্ট।

রেশমা।। না না এসব বিশ্বাস করতে পারছি না। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র আছে–

ইকবাল।। পাঞ্জাবের সন্তান কখনো কোনদিন গাদ্দার ছিল না। দেশের জন্য আমরা খুন দিতে পারি। ইজ্জত দিতে পারি না। বিজয়, তুই আজ যা বলছিস, থানার দারোগা বাবুর মুখ থেকেও প্রায় একই রকম ইঙ্গিত পেলাম। কিন্তু এতদিন এ কথা আমরা জানতে পারলাম না কেন?

রেশমা।। ঠিক বলেছেন বাবুজি। আমারও একই প্রশ্ন। বিজয় ।। অফিসিয়াল সিক্রেসি বলে একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া এই কেসটার মধ্যে মিলিটারি আইন কানুন এটাও তো মাথায় রাখতে হয়। আরো একটা কথা। গত তিন বছরে আমি এবার নিয়ে মাত্র তিনবার বাড়িতে এসেছি। আমরা যারা সীমান্তে ডিউটি করি তাদের ডোমেস্টিক লাইফ বলে কিছু কি আছে? প্রথম দিকে আমরা দুজনে একই সেক্টরে কাজ করতাম। নেহালকে পরে অন্য সেক্টরে ট্রান্সফার করা হয়। ওর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হতো না। কাশ্মীরের এমন সব রিমোট জায়গায় আমাদের ডিউটি পড়তো যেখানে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প গুজব করবার কোন সুযোগ থাকত না। অন্য সেক্টরে কি হচ্ছে না হচ্ছে আমরা কিছুই জানতাম না। সুতরাং আপনাদের এই বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেবার আমার সুযোগ ছিল না। এবার আসবার আগে নিহাল এর ব্যাপারে আমাদের একজন সহৃদয় পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন এর কাছে যা যা শুনেছিলাম, সেটাই আপনাদের বলেছি। ক্যাপ্টেন আমাকে বলেছিল, নেহাল ডিপার্টমেন্টের কাছে ওয়ান্টেড পার্সেন্। তাকে ধরতে পারলে কোর্ট মার্শাল পর্যন্ত হতে পারে। যদিও সেই ক্যাপ্টেন নিহাল এর ব্যাপারে সহানুভূতি শীল ছিলেন। তিনিও বলেছেন, এর মধ্যে কোন রহস্য রয়েছে।

ইকবাল।। তাহলে আমাদের কি কিছুই করবার নেই?

বিজয়।। আপাতত কিছুই করবার নেই। আমাকে এখন যেতে হবে। নেহাল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। আমরা এক গ্রামের মানুষ। ছোটবেলা থেকে আমরা একই সঙ্গে বড় হয়েছি। আমারও মনে হয় এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। জটিল রহস্য।

বিজয় চলে যাবে। ঘরের মধ্যে থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসবে——-

মা।। নেহাল, মেরা পুত্তার, তুই কি এসেছিস? আমার কাছে আসিস না কেন? কি হয়েছে তোর? আমাকে ভুলে গেছিস?

আবহ সংগীত আসবে। আলোর পরিবর্তন ঘটবে।

এখন মাঝরাত। ঘরের ভেতর থেকে রেশমা বেরিয়ে আসবে। তার চোখে ঘুম নেই। রাত জাগা নিশাচর প্রাণীরা চিৎকার করছে। রেশমা বাইরের খাটিয়াতে এসে বসবে। তার ভেতরে ঝড় উঠে গেছে। পাইচারি করে। হঠাৎ সে দেখবে খাটিয়াতে কে যেন বসে আছে।

রেশমা।। কে এ এ এ এ ?

লোকটা মাথা নিচু করে বসে আছে। রেশমা এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়ায়।

রেশমা।। তুমি!!!! কখন এলে? কিভাবে এলে? এতদিন কোথায় ছিলে?

নিহাল।। সে অনেক কথা। দীর্ঘ কাহিনী। অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে এসেছি। এক গ্লাস পানি দেবে?

রেশমা ছুটে গিয়ে জল আনবে।

রেশমা।। এলে যখন এতদিন পরে কেন? তোমার এখন এখানে থাকা যাবে না। পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। ওরা তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।

নিহাল।। জানি। তাইতো দিনের বেলা আসতে সাহস হলো না। মাঝরাতে সকলের চোখের আড়ালে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। আম্মিজান, বাবুজি, রঞ্জিত ওরা কি ঘুমোচ্ছে? তুমি বাইরে কি করছো?

রেশমা।। আমরা কেউ ভালো নেই। সুখে শান্তিতে নেই। তোমার কথা ভেবে ভেবে আম্মিজান বিছানা নিয়েছে।

নিহাল।। আমি জানি এভাবে আমার আসাটা তোমার কাছে ভালো লাগছে না। কিন্তু কি করবো বলো।

রেশমা।। শুনতে তোমার খারাপ লাগবে, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা সবাই তোমাকে ভুলে গেছি। তুমি চলে যাও। তোমার জন্য আমরা নতুন বিপদ টেনে আনতে পারব না।

নিহাল।। জানি তোমাদের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

রেশমা।। দেশের চোখে তুমি এখন গাদ্দার। পাঞ্জাবের কলঙ্ক। তুমি কেন এলে? এখানকার মানুষ তোমাকে দেখতে পেলে পিটিয়ে মারবে।

নিহাল।। তুমিও বিশ্বাস করো যে আমি—–

রেশমা।। আমার কথায় কারো কোন যায় আসে না।

তোমার নামে মিডিয়াতে পর্যন্ত নানা রকম প্রচার চলছে। তুমি একবারও বুঝতে চাও না কেন যে, দেশটা কোন রাজনীতির চোড়া স্রোতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? তোমাকে যারা সমর্থন করবে, তারাও মুখ বুজে আছে।

নিহাল।। অন্য কারোর সামর্থন আমার দরকার নেই। আমি তোমাকে সব কথা খুলে বলতে চাই।

ভেতর থেকে ইকবাল সিং বেরিয়ে আসবে।

ইকবাল।। আমি জানতাম তুমি এখানে আসবে। আর তাই ঘুমের ভান করে জেগে বসেছিলাম।

নেহাল।। বাবুজি আপনি বিশ্বাস করুন আমি এমন কিছু করিনি যে কারণে আপনার বদনাম হতে পারে। আমাদের এই গ্রামের বদনাম হতে পারে।

ইকবাল।। ওসব কথা থাক। সময়টা অনুকূল নয়। তুমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। যদি টাকা পয়সা লাগে আমাকে বলো আমি দিচ্ছি। এখানে আর এক মুহূর্ত থেকো না।

নেহাল।। আমার যা হয় হোক। তবুও আমি আপনাদের

যা সত্যি সে কথা বলে যেতে চাই। এই সুযোগটা আপনি আমাকে দিন।

ইকবাল।। তাতে কি লাভ নিহাল? কেউ কি বিশ্বাস করবে তোর কথা? তুই আমার নিজের ছেলে তবুও আজ তোকে আমার সমর্থন করবার উপায় নেই।

নেহাল।। এই কথাটাই আমি বলতে চাই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে। ঘৃণা করছে। তোমার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে বিরোধ করলে

আমাকে তুমি শত্রু ভেবে নিচ্ছ। ঠিক এটাই তো আমার সঙ্গে ঘটেছে।

রেশমা।। তুমি কি বলতে চাও শত্রু দেশের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ঘটেনি? ওই দেশের কোন মহিলা গুপ্তচরের ফাঁদে তুমি পা দাওনি?

ইকবাল।। সবাই বলছে তুই গাদ্দার—

নেহাল।। আমরা যারা কাশ্মীর সীমান্তে এক হাঁটু ‌ বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ডিউটি করি। তুষার ঝড়ের মধ্যে ও আমাদের শক্ত পাইন গাছের মত সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাইনাস টুয়েন্টি ডিগ্রি টেম্পারেচারে যখন আমাদের শরীরে গরম রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে তখনো আমরা আমাদের কর্তব্য ভুলে যেতে পারি না। কিন্তু  সীমান্ত থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে  ঠান্ডা ঘরে বসে যেসব সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা, আমলারা আমাদের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায় যে আমরা কতটা গাদ্দার , তখন আমাদের মাথাতেও রক্ত উঠে আসে।

ইকবাল।। থিয়েটারি ডাইলগ বন্ধ কর নেহাল। নাটক আমার ভালো লাগছে না।

নেহাল।। বাস্তব জীবনের নাটকের থেকে শহরের স্টেজের নাটক অনেক দূরে আব্বু জান। জীবনের গল্প বানিয়ে বানিয়ে লেখা যায় না। আজ আমি স্বীকার করছি যে শত্রু দেশের একটা মেয়ের জন্য‌ই আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি।

নিহাল।। কি বললি——-

ফ্ল্যাশব্যাক। তুষার ঝড় চলছে! চারিদিকে বরফে আচ্ছন্ন চরাচর। একটি কাশ্মীরি মেয়ে গ্রামের কাঠের ঘরের মধ্যে মানুষের শরীর টানতে টানতে নিয়ে এলো। তারপর আগুন জ্বালাবে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মানুষটাকে আগুনের সেক দেওয়া, গরম দুধ খাওয়ানো আরো নানারকম সেবা সুশ্রূষা করবে। ধীরে ধীরে মানুষটার জ্ঞান ফিরে আসবে। এই মানুষটাই নেহাল সিং।

নেহাল।। আমি কোথায়?

মেয়েটা।। একটা পাহাড়ি গ্রামে—

নেহাল।। সেটা হিন্দুস্তান না পাকিস্তান?

মেয়েটা।। কোনটা হলে তোমার সুবিধা হয়?

নেহাল।। আমি তো হিন্দুস্তানের একজন ফৌজি—

মেয়েটা।। গরম গরম দুধ এনেছি। এটা খেয়ে নাও—-

শরীরে কাগত আসবে—-

নেহাল।। তুষার ঝড় থেমে গেছে?

মেয়েটা।। অনেকক্ষণ।

নেহাল।। তুমি কে?

চলবে–

RELATED ARTICLES
- Advertisment -

Most Popular