থিয়েটার পূজাকে বেঁধে বেঁধে থাকতে শিখিয়েছে

- Advertisement -

বিজয়কুমার দাস

থিয়েটারে নতুন প্রজন্ম : পর্ব ৭


থিয়েটারে নতুন প্রজন্মের এক উজ্জ্বল মুখ পূজা ভট্টাচার্য। কোন শখে নয়, থিয়েটারকে ভালবেসে থিয়েটার করার তাগিদেই থিয়েটারে যুক্ত হয়েছে। শুধু যে যুক্ত হয়েছে তা নয়, নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে নিজেকে গড়েপিটে নেওয়ার আন্তরিক সাধনায় আত্মনিবেদিত পূজা। আর পাঁচজনের মতই ২০০৯ সালে পাড়ার নাটকে অভিনয় করেছিল। সে তো কতজনই করে?.. তাদের সবাই কি পরবর্তী জীবনে থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে থাকার সাহস বা স্পর্ধা দেখায়?…. কিন্তু পূজা সেই স্পর্ধাটা দেখিয়েছিল।

২০০৯ সালে পাড়ার নাটকে অভিনয়ের পর ২০১১’তে পশ্চিমবঙ্গ নাট্যমেলায় অভিনয়ের সুযোগ। আর তখন থেকেই পেশাদারি থিয়েটারে প্রবেশ তার অবশ্য তার এই থিয়েটারপ্রীতির পিছনে আছে তার থিয়েটারপ্রেমী পরিবার। ছোট থেকেই নাটকের একটা পরিমন্ডলে তার বড় হওয়া। আসলে পূজার পরিবারটাই থিয়েটারের পরিবার। অথচ সে যে কখনো থিয়েটারে আসবে, এমন ভাবেনি কখনো। তার থিয়েটারে আসার পিছনে অগ্রণী ভূমিকা তার বাবার। পূজার বাবা স্বপন কুমার ভট্টাচার্য একজন বিশিষ্ট নাট্যকার। মা মৌসুমী ভট্টাচার্য থিয়েটারের ব্যাকস্টেজ সামাল দেন। পূজার পথ ধরে তার বোন সৃজাও থিয়েটারে অনুগত।

পূজার বাবা স্বপনবাবু আর্থিক পরিকাঠামোর নিচে থাকা প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পড়াতে একসময় অনুভব করেন, পুঁথিগত শিক্ষা ওদের প্রকৃত শিক্ষা দানে যথেষ্ট নয়। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে কাজ শুরু করেছিলেন।আবার এটাও বোঝেন যে, এই পিছিয়ে থাকা প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করা যথেষ্ট নয়। তাই তিনি নিজে নাটক লিখতে শুরু করেন। আর সেই নাটকেই পূজার প্রথম হাতেখড়ি। তখন সে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। বাবার এই সংস্কারমূলক কাজকে পূজা তার সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে সাহায্য করতে করতে অনুভব করেছিল, থিয়েটার নামক মাধ্যমটি কত শক্তিশালী! সেই যে জড়িয়ে পড়া, তারপর নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরা থিয়েটারকে।

পাড়ার নাটকে পূজার অভিনয় দেখে বাবার বন্ধু মাধব দত্ত তাকে একটি থিয়েটারের জন্য মনোনীত করেন। মাধববাবু বিভিন্ন নাট্যদলের সাথে যুক্ত ছিলেন।সেই মাধববাবুর মাধ্যমেই পূজা প্রবেশ করে পেশাদারি থিয়েটারের জগতে। শুরুটা হয়েছিল স্কুলে রবীন্দ্রনাথের ” তাসের ঘর” দিয়ে। তখন পূজা ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। তার পরে পূজার অভিনয় তার বাবা স্বপন কুমার ভট্টাচার্যের “গুপীবাঘার বংশধর ” নাটকে। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকা নয়। এরপর একের পর এক নাট্যদলের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে পূজা ভট্টাচার্য এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যে, সে পরিযায়ী পাখি নয়, থিয়েটারে থেকে যেতে এসেছে। চাকদহ হিনাস, হালিশহর সানডে ক্লাব, বীজপুর স্বপনসঙ্গ, মদনপুর যাত্রিক, হালিশহর খেয়া, হালিশহর মাটি, চারুচর্যা , পারমিক ব্যারাকপুর, ডানকুনি থিয়েটার শাইন, কলকাতা ভূমিসুত থিয়েটার, বেলঘরিয়া অভিমুখ ইত্যাদি দলের বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে পূজা তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। বিভিন্ন দলে বিভিন্ন নির্দেশকের নাট্যশিক্ষায় পূজা হয়ে উঠেছে থিয়েটারের নতুন প্রজন্মের উজ্জ্বল মুখ।

অভিনীত প্রিয় চরিত্র কোনটি?.. এই প্রশ্নের উত্তরে পূজা জানিয়েছে, সব চরিত্রই প্রিয়। কারণ চরিত্রকে ভাল না বাসলে তো সেই চরিত্র হয়ে ওঠা যায় না। তাই নিজের শ্রম, সাধনা, মেধা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে সে অভিনীত চরিত্রের মত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। থিয়েটারে থাকতে থাকতে থিয়েটারের জগৎ সম্পর্কে স্পষ্ট একটা ধারণা তৈরি হয়েছে তার। ভাল খারাপ মিশিয়ে একটা জগৎ। সে জানিয়েছে, খারাপ যেমন আছে, ভালও আছে। অমৃত ছেড়ে বিষ পান করব কেন? এটাই তার দৃঢ় প্রত্যয়। সেই প্রত্যয় নিয়েই কাজ করে চলেছে সে। ক্ষমতার অপব্যবহার, স্খলন হয়তো আছে কারো কারো ক্ষেত্রে – তবু এই জগৎ তাকে সে সব এড়িয়ে বাঁচার অন্য মানেও শিখিয়েছে। মাথা উঁচু করে বাঁচা। থিয়েটার নিয়ে বাঁচা। “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ” – কবিতায় পড়া এই প্রায়োগিক মার্গ দর্শন সে শিখেছে থিয়েটারে এসেই। বহু গুণীজনের ভালবাসা, প্রশংসা, প্রজ্ঞা তাকে সমৃদ্ধ করেছে।

থিয়েটার করে কিং সাইজ লাইফ কাটানো সম্ভব না হলেও পূজা বিশ্বাস করে, দু বেলার ডালভাত জোগাড় করা যায়। সরকারী আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা কোনদিনই শিল্পীসহায়ক বলে সে মনে করে না। অদূর ভবিষ্যতেও সহায়ক হয়ে উঠবে কিনা, তা নিয়ে পূজার সংশয় আছে – তবু বাঁচার রাস্তাটা খুঁজছে সে এখানেই। পুজা এ ব্যাপারে জানিয়েছে, থিয়েটারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো পুন:সংস্কার না করলে পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটারে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সক্রিয়তা আশা করা অনুচিৎ। যে পরিবারের সবাই থিয়েটারে নিবেদিত প্রাণ, সেই পরিবারের সদস্যা হিসাবে বাড়ির সবার প্রেরণা তাকে থিয়েটার করে বাঁচার জীবন বেছে নিতে সাহায্য করেছে।নিজেদের তৈরি করা দল “চারুচর্যা” র বিভিন্ন ব্যয় তার বাবাই করে থাকেন। এই সমর্থন তার পাথেয়।

পূজার অভিনীত নাটকের তালিকা দেখলেই বোঝা যায় থিয়েটারে সে কতটা গভীরভাবে জড়িয়েছে! উলটপুরাণ, নহবত, সাজানো বাগান, দর্পণ সাক্ষী, ছুটি, চন্ডালিকা, শ্যামা, তাসের দেশ, মছলী দলের গপ্পো গাথা, ফাঁস, পোস্টমাস্টার, আবাহন, উইনার, জয় বাংলা, অনাম্নী অঙ্গনা, আপনাকে বলছি স্যার ইত্যাদি বহু নাটকে সে অভিনয় করেছে বিভিন্ন দলে, বিভিন্ন পরিচালকের অধীনে। আরো থিয়েটার করতে চায় পূজা। জড়াতে চায় আরো গভীরভাবে। হয়ে উঠতে চায় নানা চরিত্র। এভাবেই চলছে পূজার থিয়েটার পরিক্রমা।

- Advertisement -
সাম্প্রতিক পোস্ট
এধরনের আরও পোস্ট
- Advertisement -